বাঘের গর্জন …

বিশ্ব কাপ ক্রিকেট নিয়ে লেখা তৃতীয় পর্বে একটি প্রবাসী ব্লগে দুদিন আগে আমি আজকের খেলা নিয়ে ভবিষদ্বাণী করেছিলাম। আজ আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তাবৎ পৃথিবী আজ শুনতে পেয়েছে বিশ্ব মানচিত্রের একটি ছোট্টদেশ “বাংলাদেশ”-এর একদল বাঘের তীব্র গর্জন। আর সে গর্জনে খান খান হয়ে ভেঙে পড়েছে এক সময়ের পরাক্রমশীল ভিভ রিচার্ড’ ক্লাইভ লয়েড, ব্রায়ান লারাদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ , আর সে সংঙ্গে জিয়ে থাকলো এই ক্রিকেট পাগল দেশের বিশ্ব কাপের্ দ্বিতীয় পর্বে উঠার রঙিন স্বপ্ন ।

বাঘের গর্জনের কথা বলতে যেয়ে কেন যেন আমার ভালুকের গল্পের কথা মনে হচ্ছে। আপনারা হয়তো ভাবছেন, বাঘের সাথে আবার ভালুক এলো কিভাবে। হ্যাঁ. প্রাসঙ্গিক ভাবেই আমি ভালুকের গল্প টেনে এনেছি। এই কারণে যে, আজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস শেষে যখন স্কোর দাঁড়ালো ৩২১ তখন দেখলাম ফেস বুকে অনেকেই মাশরাফিকে গালাগালি করছে কেন টসে জিতে ব্যাট করলাম না , ইত্যাদি। চুলুন পিছনে ফেরা যাক। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে ২০১১ সালে ইন্ডিয়া, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশ একসাথে আয়োজন করেছিল বিশ্বকাপ ক্রিকেট। মার্চ মাসের ৪ তারিখে ২০১১ সালের বিশ্বকাপে গ্রূপ পর্যায়ের খেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাংলাদেশকে অল আউট করে দিলো মাত্র ৫৮ রানে। ৯ উইকেট ও ২ ২৬ বল হাতে রেখে হেসে খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টপকে গেলো সে রান। ঢাকার দর্শকেরা হতবিহব্বল হয়ে দেখলো নবাব সিরাজি-উদ-দৌলার আরেক পতনের দৃশ্য। সেবারের স্কোরবোর্ডে জমা রইলো তামিমের ০, ইমরুল কায়েছের ৫, জুনায়েদ সিদ্দিকীর ২৫, মুশফিকের ০, আজকের সাকিবের ০, আশরাফুলের ১১ রান। কিছু অতিউৎসাহী দর্শক পাথর ছুড়ে মারলো সাকিবের বাসায়। এ কারণেই, কেন যেন আজ আমার ভালুক ও দুই বন্ধুর সেই বিখ্যাত রূপক গল্পের কথা ঘুরে ফিরে বার বার মনে হচ্ছে। আজ খেলা শেষে সেই সাকিবকে মাথায় করে নিয়ে আমরা বিজয় উৎসব করছি। আমরা বাঙ্গালী কত রঙ্গ জানি। রাজনীতি বলি, খেলাধুলা বলি সর্বত্রই কাউকে সহজেই মাথায় তুলে রাখি আবার খারাপ করলেই পাথর ছুড়ে মারি। এমনকি নির্বংশ করে ছাড়ি। তাই আমার গত লেখায় লিখে ছিলাম, জিতলেও আছি বাংলাদেশের সাথে, হারলেও আছি বাংলাদেশের সাথে। আমি সেই অতিচালাক বন্ধুটি-র মতো ভালুক দেখে বন্ধুকে ফেলে গাছে চড়ে বসে থাকিনা।

যাক ওসব কথা। আমরা বাপ্-ব্যাটা স্থানীয় সময় প্রায় ভোর প্রায় সাড়ে পাঁচটা থেকে টিভি খুলে বসে আছি। আমার বিকাল থেকে কাজ। তাই ফুরফুরে মেজাজে খেলা দেখছি। অর্ণবের ইউনিভার্সিটিতে রিডিং উইক চলছে। কোনো ক্লাস নেই। আজকের খেলা দেখার আয়োজন বলতে, দুই প্যাকেট পপ-কর্ন, মাঝারি সাইজের এক বয়াম ভর্তি শ্রীলংকান দোকান থেকে কেনা ঝাল চানাচুর এবং গতকালকের বাবা দিবস উপলক্ষে বারবিকিউ করা বেঁচে যাওয়া কয়েক পিস চিকেন আর ফ্রয়েড রাইস। তাড়াহুড়া করে সকালের নাস্তা সেরে নিয়েছি এক বাটি দুধ সাথে সিরিয়াল আর টপিং হচ্ছে পিস পিস করা পাকা কলা। গোগ্রাসে খেয়ে খেলা দেখছি। বিপত্তি ঘটলো সকাল সোয়া আটটার সময়। মিতার কাজ শুরু সাড়ে আটটায় , অধরার স্কুল ৮:৪০ । আমার দায়িত্ব হচ্ছে এই দুই যাত্রীকে ট্যাক্সি ড্রাইভারের মতো সময়ত ওদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া। গাড়ি চালাতে হবে অতি সাবধানে কারণ ২০১২ সালের আগস্ট মাসে ও ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পর পর দুইবার একসিডেন্ট করে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে অনেক টাকার ইন্সুরেন্স দিয়ে। তাই স্বাভাবিক ভাবে আজ যখন সকালে গাড়ি চালাচ্ছিলাম মন থেকে প্রানপনে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছি ওয়েস্ট ইনিজের মারমূখী ইনিংস। বাসায় ফিরেই চিৎকার করে অনবের কাছে জানতে চাইলাম ওদের স্কোর কত হলো। অর্ণব নিরুত্তর। আমি একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। অর্ণব চুপ-চাপ মানে নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে। আমি আমি যখন আজ সকালে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছি ওয়েস্ট ইন্ডিজের রানের সংখ্যা ছিল ২৪.৩ ওভারে দুই উইকেটে ১২২। আর এখন স্কোর হয়েছে ৪৬ ওভারে ২৯৭। ভাগ্য ভালো উইকেট পড়েছে সাতটি। মূল হার্ড হিটার সবাই আউট। মুস্তাফিজের করা ইনিংসের মহা কাব্যিক ৪০ তম ওভারটির কথা ছেলের কাছে শুনলাম ওই ওভারে মাত্র তিন রান দিয়ে হেটমেয়ার আর এন্ড্রো রাসেলের আউট হওয়ার গল্প। মনে একটু ভরসা পেলাম। কিন্তু তাইবলে ৩২২ লক্ষমাত্রা ? এ ও কি সম্ভব? এত রান তারা করে ওয়ার্ল্ড কাপে কোনো দেশের জেতার কাহিনী শুধু একবারই ঘটেছে। তাই কিছুটা আশা/নিরাশার মাঝে বাংলাদেশের ব্যাটিং দেখার জন্য আবারো টিভির সামনে বসলাম। ৫২ রানের মাথায় সৌম্যের আউট হওয়ায় মন খারাপ হয়ে গেলো। ১৭.৩ ওভারে তামিমের ট্রাজিক রান আউট দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। খানিকটা পরে ১৮ ওভারে মুশফিকের ১ রানে আউট হওয়া দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিলোনা। আমি কি ঠিক দেখছি? অর্ণব গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে গলা বসে ফেলেছে। আমি নিজেকে সংবরণ করার জন্য সেল ফোনে ফেস বুক নিয়ে কিছুক্ষন পরে থাকলাম। কে জানে বিধাতা তখনও কত বড় বিস্ময় আমার জন্য রেখে দিয়েছে। সাকিব বাবাজি চোখের সামনে মহা কেলেঙ্কারি করে ফেললো। ইতিহাসে হাতে গোনা কয়েকজনের পাশে নিজের নাম লেখালো একদিনের খেলায় ছয় হাজার রান পূর্ণ আর আড়াইশো উইকেট প্রাপ্তি। বিশ্বকাপে দলের প্রথম চার ইনিংসেই পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলা মাত্র চতুর্থ ক্রিকেটার হয়ে গেছেন সাকিব। এর আগে ১৯৮৭ বিশ্বকাপে নভজ্যোৎ সিং সিধু, ১৯৯৬ বিশ্বকাপে শচীন টেন্ডুলকার ও ২০০৭ বিশ্বকাপে গ্রায়েম স্মিথ প্রথম চার ম্যাচেই পঞ্চাশের বেশি রান করেছিলেন।গ্যালারি ভর্তি দর্শক সাকিবকে তালি মেরে অভিবাদন জানাচ্ছে। ডাবল পূর্ণ করতে সাকিবের লেগেছে মাত্র ২০২ ম্যাচ। এর আগে রেকর্ডটির মালিক ছিলেন শহীদ আফ্রিদি, লেগেছিল ২৯৪ ইনিংস। জ্যাক ক্যালিসের লেগেছিল ২৯৬ ইনিংস, আর সনাথ জয়াসুরিয়ার লেগেছিল ৩০৪ ইনিংস।নিজেকে বেশ গর্বিত মনে হচ্ছে এই সাকিব নামের যে ছেলেটি যে দেশে জন্মেছে আমিও একই দেশে জন্মেছি। আহা! কি আন্নন্দ। সৃষ্টিকর্তা তখনও আঁনন্দের আরো কিছু ঘটনা আমার জন্য রেখে দিয়েছে তখনও জানতাম না । শাকিব-লিটন মিলে বেধড়ক পেটাচ্ছে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘদেহী ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্রুত গতিতে বল করা সব বোলারদের। একেকটি ৮ /৬ মারছে বাংলাদেশ-বাংলাদেশ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হচ্ছে সমগ্র এস্টেডিয়াম। বাঘের মুখোশ আর লাল-সুজের পতাকায় দুলে দুলে উঠছে গ্যালারি। আমি বিস্ময় হয়ে লক্ষ্য করলাম সাকিবের যখন উপর্যুপরি দ্বিশতক পূর্ণহলো গ্যালারিতে অনেক অবাঙালি সাদামুখো দর্শকও নেচে নেচে হাত তালি দিচ্ছে। এর মধ্যে লিটন আবার মহা কান্ড করে বসলো। ৩৮তম ওভারটি করতে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ার দশা শ্যানন গ্যাব্রিয়েলের। ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করছেন। আর লিটন দাস কিনা তাঁকে যেখানে ইচ্ছা সেখানে আছড়ে ফেলছেন! প্রথম তিন বলেই তিন ছক্কা হাঁকালেন লিটন দাস! বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ছক্কার প্রথম হ্যাটট্রিক। আঁনন্দে চোখে পানি আসার মতো অবস্থা। গলা ভেঙে যাওয়ায় অর্ণবের গলা থেকে যা বের হলো তা হলো “বাবা আমরা বুঝি জিতেই যাচ্ছি”। হ্যাঁ সমগ্র বিশ্বকে তাকে লাগিয়ে ৩২২ রান তাড়া করে বাংলাদেশ ৭ উইকেটে ৫১ বল হাতে রেখে হেসে খেলে জয়লাভ করলো। ১৬ বছরের প্রবাস জীবনে এরকম আঁনন্দের ঘটনা আমার জীবনে খুব কমই ঘটেছে।

দুদিন পরেই বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের পরের খেলা শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে। না ভুল বললাম । অস্ট্রেলিয়ার খেলা শক্তিশালী বাংলাদেশের সঙ্গে। বুদ্ধি করে আমি আগেই ছুটি নিয়ে রেখেছি । অধীর আগ্রহ নিয়ে আরেকটি কাব্যিক জয়ের নাটক লেখার অপেক্ষায় থাকলাম। সঙ্গেই থাকুন। জয় হোক বাংলাদেশ ক্রিকেটের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাবা
পরবর্তী নিবন্ধভালোবাসার ঋণ কখনো পরিশোধ হয়না…
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

১ মন্তব্য

  1. ভাই
    সুন্দর একটা লেখার অনেক জন্য ধন্যবাদ। পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় রইলাম।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন