আমার ছোট কন্যা তুতুলকে দিয়েই শুরু করি।

আমার ছোট কন্যা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে ছোট বেলায় সে কি কি করতো? আমি কিভাবে তিনটা বাচ্চাকে বড় করলাম!! আরোও অনেক প্রশ্ন তার। সব শোনার পরে বলে ও বাচ্চা বড় করতে পারবে না, কারন তার ভাষায় “Kids are so annoying”. কারন সে নিজেও ট্রাবল মেকারদের এজকন ছিল যখন সে ছোট ছিল????

আবার মাঝে মাঝেই বলে তুমি আমাকে নিয়ে লিখো না কেন? আমি বলি লিখে কি হবে তুমি তো বাংলা পড়তে পারো না! Ma That’s your fault, আমিও তাই মনে করি। খুব দুঃখ লাগে ওর কাছে তামিল লেখা যা আর বাংলা ও তাই। প্রতি সামারেই আমরা বাংলা শুরু করি কিন্তু শেষ হয় না!! এবার নাকি সে পড়তে শিখবেই।
বড় দুই কন্যা সোমা আর তৃণার সমস্যা নাই,এখানে আসার আগে একজন ক্লাশ ফাইভে পড়ত,আরেকজন টুতে। বাংলা লিখতে পড়তে কোন অসুবিধা হয় না।

তুতুল সব কিছুই নিজের মতো করে, করতে হয় সেই ছোট বেলা থেকেই। আমি বিরক্ত হই আবার ধৈর্য্য ধরি,কারন দেশী ফর্মুলা খাটাতে পারছি না। 
তার যত ঝামেলা আছে সে সকাল থেকে শুরু করত, যখন স্কুলে ভর্তি করেছি । প্রথমে এই জামা পড়বনা সেই জামা, না এটাও না আরেকটা। তারপর আমার চুল দুইটা পনি টেল করে দাও, দিলাম। কিন্তু আয়না দেখে এসেই কান্না জুড়ে দিল, চুল কেন খাড়া হয়ে আছে!! কেন দেখা যায়? আরোও অনেক ঝামেলা। তখন আমি বেবী সিটিং করি,সেই বাচ্চাদেরও স্কুলে দিতে দেরী হয়ে যায়। আমি দেখি একে হ্যান্ডেল করতে হলে বাংলাদেশী ফর্মূলা একটু ইউজ করতে হতে পারে। এসব দেখে তার বাবা বলে আমার মেয়ের চুল আমি বাধব। ঠিক আছে সে ঘাড়ের কাছে রাবার ব্যান্ড লাগিয়ে দেয়। আয়না দিয়ে দেখা যায় না, তাতেও সমস্যা। কিন্তু তাতে কিছুটা খুশী।

সোমা, তৃনাকে আমি কোন দিন কোন কিন্ডারগার্টেন এ দেই নি । নিজেই পড়িয়ে অগ্রনীতে ভর্তি করিয়েছি। এক দিন প্রাইভেট ও পড়াইনি। আমি নিজে পড়াতাম, দু’জনের রোল প্রথম চার জনের মধ্যে ছিল । যাহোক ভাবলাম বড় দুই মেয়ের মতো ওকে আমি শিখাব। যখন লেখা শিখাতে গেলাম, প্রথমেই কান্না আমি কেন ওর খাতায় লিখলাম। যা লিখি সেটাই মুছে ফেলে। আর তখন সে কিছু ইংলিশ বুলি শিখে গেছে “I know everything ” I can do everything by myself,????

লেখা শুরু করল বাম হাত দিয়ে, তার বাবা চেষ্টা করে ডান হাতে লিখাতে, কিন্তু না কাজ হয় না। আমি যদিও কিছুটা জানতাম এই বয়সে কোন কোন বাচ্চাদের পার্সোনালিটি খুব স্ট্রং থাকে। কিন্তু’এটা জানতাম না আর যারা লেফট হ্যান্ডেট হয় তাদের ব্রেনের দুই সাইডই খুব জোড়ালো থাকে। তারা লিটারেচার আর রাইটিং এ খুব ভালো হয়। এটা তার টিচার বলার পরে ওর বাবা গিভ আপ করছে, আমার ও স্বস্তি হলো।

স্কুলে না যাবার জন্য অনেক ঝামেলা করত। কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখলাম তাকে আমার কোন কিছুই বলতে হয় না একে বারে জুনিয়র কিন্ডারগার্টেন থেকেই। হোম ওয়ার্ক,ব্যাগ গোছানো সব নিজে করে। আর ভুলে ও তার কোন পেপার রিসাইকেল বা গার্বেজ করলে সেটা আবার সেফ জায়গায় রাখে। সব কাজ শেষ করে টিভি দেখে । যেটা নিয়ে সে কোনদিন ঝামেলা করে নাই সেটা হলো খেলনা বা খাবার শেয়ার করা নিয়ে। কারণ বন্ধু ছাড়া সে থাকতে পারে না,আর খেলা ছাড়া কি আছে জীবনে!! সেন্টক্যাথারাইন্সে যে এপার্টমেন্ট বিল্ডিং আমরা থাকতাম সেখানে ২৩ /২৪টা বাংগালী ফ্যামিলি ছিল। মিনি বাংলাদেশ সেটা। আর খেলার আড্ডা বেশীর ভাগ সময় আমার বাসায়। আমার বলা ছিল খেলার পরে খেলনা জায়গা মত মানে একটা বড় প্লাস্টিকের বাকেটে রাখবে। নালিশ করা যাবেনা। নিজেদের প্রব্লেম সলভ করতে হবে। একটা চেয়ার রাখতাম পাশে নাম ছিল, থিংকিং চেয়ার। যে প্রব্লেম মেকার সে সরি বলত।

আমরা এক সময় সেই বিল্ডিং থেকে হাউজে গেলাম। আশে পাশের ববাচ্চারা বাসার সামনে ছোট পার্কে খেলে। আমি সাথে যাই বা জানালা দিয়ে দেখি। একদিন সে খুব মন খারাপ করে বলে আম্মু তুমি আমাকে কোনদিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট হতে দাও না। আমার বন্ধুরা হাসে, তুমি কেন দেখো আমি খেলতে গেলে! স্কুলে যাবার সময় দেখো। স্কুলটা আমার বাসা থেকে ৫ মিনিটের পথ। বাসা থেকে দেখা যায়। শুধু ছোট রাস্তাটা ক্রস করতে হয়। ভাবলাম তাকে দেই স্বাধীনতা। পাশের বাসার, বিল,ক্যাটরিনা, রেইচেল,ব্রিটনি সবার সাথে তার ভাব। এক ই স্কুলে যায়। ওদের খেলতে দিয়ে ভিতরে সব্জি বাগানে কাজ করছি, কিছুক্ষন পরে এসে দেখি তারা সেখানে নেই। আমার বুকের ভিতর কেপে উঠল, আশে পাশে কোথাও দেখিনা। জুলাই মাসের দুপুরবেলা, ছোট্ট শহরে আমরা যেখানে থাকি শূনশান নিরবতা। আমাদের বাসা থেকে কিছুটা দুরেই একটা বড় কবরস্থান। আমি সেদিকে হাটছি, কোন শব্দ পাই না। ছোট ছোট কাশবনের ভিতর দিয়ে ছোট্ট খালের মত আছে সেটা এই সেমিট্রির ভিতর দিয়েই গিয়েছে। সেখান থেকে কথা ভেসে আসছে। আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম। দেখি তারা সেই পানি থেকে ব্যাং, আর পোকা ধরে ব্যাগে জমা করছে। আমাকে দেখে সেতো খুব ভয় পেয়েছে। কিছু বলিনি তখন, বাসায় এসে বললাম “Freedom always comes with responsibilities ” তুমি সেটা রেসপেক্ট করো নাই। এখন নিজেই বলো আমার কি করা উচিত? বললো খেলতে গেলে তুমি বা বড় বোনেরা দেখুক কিন্তু স্কুলে আমি একা যাব। ঠিক আছে সেই স্বাধীনতা তাকে দেয়া হলো। দেখা গেল ৫ মিনিটের পথ আসতে ৩৫/৪০ মিনিট। বানরের তৈলাক্ত বাসে উঠানামার মত। তারা যতটুকু আসে আবার ততোটুকু ফেরত যায়, দাড়িয়ে থাকে +৩৫ বা মাইনাস ৩০ টেম্পারেচারে। এটা নিয়ে কিছু বলিনা।

আমার সেই কন্যা গ্রেড সিক্স এ ওঠার পর থেকে পড়াশুনায় খুব সিরিয়াস হয়ে গেল। প্রচুর গল্পের বই পড়ে। ইরাক,ইরান যুদ্ধ, সেখানে মানুষের জীবন, ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে সব ধরনের বই পড়ে। প্রতি সপ্তাহে লাইব্রেরী থেকে ৮/১০ বই আনে, আমার যত কাজই থাকুক তার যেটা লাগবে সেটা সেটা করতে হবে। কোন এসাইনমেন্ট জমা দেবার ডেটএর কমপক্ষে ৩ দিন আগে সেটা ফাইনালাইজ করে ফেলে। অনেক সময় খুব টায়ার্ড লাগতো, কিন্তু কিছু করার নাই। যখন যা বলে সাথে সাথে এনে দেই। এভাবে সে ক্লাশ এইটে টপ স্টুডেন্ট হয়ে গ্রেড নাইনে উঠল। এখানে নাইন থেকে হাইস্কুল, আর তখনই আমরা সেই ছোট্ট শহর থেকে মিসিসাগাতে মুভ করলাম। তার সব বন্ধুদের ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হবে সেজন্য সে আবদার করলো তার একটা বিড়াল লাগবে। তার বাবা রাজী না, আমি মেয়ের কান্না দেখে বিড়াল নিয়েই অন্য শহরে চলে আসলাম।

গ্রেড নাইনে বা টেনে ওদের রোমিও জুলিয়েট পড়তে হয়। সেখানে তার এনালিটিক্যাল Essay writing দেখে ইংলিশ ডিপার্ট্মেন্টের হেড আমাকে মিটিংয়ে ডাকলেন।প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম। উনি বললেন রোমিও এন্ড জুলিয়েটের ইম্যাচিওর প্রেম, ব্রেন দিয়ে চিন্তা না করে ইমোশনাল ছিল বেশী। যাহোক ইত্যাদি সে দেখিয়েছে তার ক্রিটিকাল রিভিউয়ের মাধ্যমে। তখন উনি বললেন সায়েন্স বা ম্যাথে অনেকেই ভালো করে কিন্তু ইংলিশ লিটারেচারে তার যে দক্ষতা সেটা অনেকের নাই। আমি বুঝতে পারলাম ছোট বেলা থেকে ওর বই পড়ার প্রতি আগ্রহ এতো সুন্দর লেখার যোগ্যতা সে অর্জন করেছে।

গ্রেড টেন এ ওঠার পর তার ভিতরে কিছু চেঞ্জ দেখতে পাই। প্রতিদিন বাসায় এসেই খুব মেজাজ, আর কোনকিছুতে পার্মিশন না দিলেই কেন দিলাম না সেটা নিয়ে ঝামেলা!! আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে তোর? সে বলে আমার এখন হরমোনাল চেঞ্জ এর জন্য এরকম এটিচিয়ূড হবে। সে স্কুল থেকে শিখে এসেছে। বললাম বুঝতে যখন পারছো কন্ট্রোল কর নিজেকে। আর তোমার মায়ের ও কিন্তু হরমোনাল চেঞ্জ এর মধ্য দিয়ে যেতে হইছে। আর পার্মিশনের ব্যাপারে আমাকে সে জোড় করতে পারবে না, ডিসিশন নিয়েই যদি পার্মিশন চায় তার উত্তর হবে “না”। আমরা কম্প্রোমাইজে আসলাম। সে হাই স্কুল শেষ করলো অন্টারিও স্কলার হয়ে ( সব সাব্জেক্টে ৯০ উপরে যাদের)। ভর্তি হলো কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে ডিন লিস্টে থেকে এপ্লাইড ইকোনমিকস এ অনার্স-মাস্টার্স করে এখন কানাডা ফেডারেল গভঃ এ একটা গুরুত্বপূর্ণ ডিপার্টমেন্টে রিসার্চে আছে। এবছর গভঃ জব রিভিউতে সে প্রথম চার জনের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। মাস্টার্সে টিচার এসিটেন্ট হিসেবে কাজ করত। এবং ফুল স্কলারশিপ পেয়েছে।

পড়াশুনা, পার্টাইম কাজ, বাজার করা, রান্না করা, সব নিজে করত। যখন সে ইউনিভার্সিটিতে পড়ত, কয়েকবার বাসা চেঞ্জ করার সময় গিয়েছি।এখানে শুধু প্রথম বর্ষের ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য হোস্টেল দেয়া হয়। বাকী ৩/৪ বছর বাসা ভাড়া করে থাকতে হয় বন্ধুদের সাথে, ইউনিভার্সিটির আশে পাশেই। আমাকে কিছুই ধরতে দেয় না,ভাবে ওর মায়ের বেশী শক্তি নাই। অনেক রেস্পন্সিবল মেয়ে আমার। আমাকে আর তার বাবাকে বলে তোমরা রাগ হতে পারো না!! কারন তুমি মা ????

আমাদের মাদার ডটার টিভি টাইম,মুভি টাইম আমরা বের করি, গল্প করি। যখন সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে ” I Love you Ammu????আমি জিজ্ঞেস করি কি দরকার । বলে পার্মিশন ????আমার সেই ছোট্ট ধীর স্থির, খুব সচেতন, সহজ সরল সুন্দর মনের মেয়েটার জন্য অনেক দোয়া করি।

আগে আমার সাথে রাগ হলেই বলত ” তুমি একটা ভালো মা হও নাই ???? ওভার প্রোটেক্টিভ মা। ওর বাচ্চা কিছু করতে চাইলে না করবে না,ইত্যাদি।

” চিত্ত যেথা ভয় শূন্য উচ্চ সেথা শির” আমাদের অনেক গল্প আছে আবার ও বলব।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন