প্যারেন্টিং -এর ভালো বাংলা খুঁজে পেলাম না ৷ ভাবার্থ ঠিক রাখার  জন্য  তাই হুবহু ইংরেজি শব্দটি বাংলা করে লিখতে হলো৷সম্পর্ক নিয়ে আমার ধারাবাহিক লেখায় আজ লিখছি এমন একটি জরুরি বিষয় নিয়ে যা দিয়ে শুরু হয় আমাদের পারিবারিক সম্পর্কের একেবারে ভিত্তি৷ একসময় আমরা যারা মধ্যবিত্ত পরিবারে মানুষ হয়েছি, আমরা কখনো এটাকে আমল দেয়নি কারণ আমরা বেড়ে উঠেছি একান্নবর্তী পরিবারে ৷ বাবা, মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি, নানা-নানী-র মমতাময় ভালবাসায় সিক্ত হয়ে  প্যারেন্টিং -এর ঘাটতি অংশ গুলো ব্যালান্সড হয়ে  থাকতো৷এখন যুগের পালা বদলে, জীবিকা-র সন্ধানে মানুষকে বের হতে হয়েছে নিজ জেলা শহর থেকে৷ সভ্যতার মোড়কে আমরা  সঙ্কুচিত করে ফেলেছি পরিবারের সংজ্ঞাকে৷ ব্যাস্ততাময় যান্ত্রিক জীবন আমাদের অগোচরে  প্যারেন্টিং-এ সৃষ্টি হয়েছে  হাজার হাজার ফাটল ৷ আমরা যখন সেটা টের পাই, ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ আর তাই, পত্রিকার পাতায় নিজ ছেলে/মেয়ের কুকর্মের খবরে আঁতকে উঠি৷ আমার ছেলে/মেয়ে কখনো এ কাজ করতে পারে না বলে কেঁদে উঠে মা জননী ৷ মায়ের সেই ক্রন্দন ওদের নাড়া দেয় না৷ দেশের ক্ষমতার রাজনীতি, ধর্ম নীতি,  ওদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখে৷ ওদের লোভ. লালসা, কামনা-এর চোখ স্থির হয়ে থাকে মহাশূন্যের দিকে৷ অথচ, আমাদের সঠিক প্যারেন্টিং সঠিক সময়ে ওদেরকে বাঁচিয়ে তুলতে পারতো৷

বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী Diana Baumrind (1971, 1991)   মোট চার ধরণের প্যারেন্টিং শনাক্ত করেছেন:

স্বৈরাচারী(Authoritarian), প্রামাণিক (Authoritative), অনুমতিসূচক(Permissive),উপেক্ষাপূর্ণ(Neglectful)৷ ইন্টারনেট ঘেটে বাংলা অর্থ কিছু পেয়েছি,যা আমার তেমন মনে ধরেনি ৷ আপনাদের যদি ভালো সমার্থক বাংলা জানা থাকে, দয়াকরে জানাবেন৷ আজ আমি যা আলোচনা করতে যাচ্ছি আমরা হয়তো অনেকেই এসব জানি, তবুও চলুন, নিজের জানাটাকে একটু ঝালাই করে নেই৷

প্রথমটি অর্থ্যাৎ স্বৈরাচারী(Authoritarian)প্যারেন্টিং নামের সাথে অত্যন্ত সঙ্গতি পূর্ণ৷ এধরণের বাবা-মা  অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির৷ এঁরা চায় ছেলেমেয়েরা সবসময় তাঁদের কথামতো চলবে৷ একটু পান থেকে চুন খোশলেই এঁরা ছেলেমেয়েদেরকে শাস্তি দিতে কার্পণ্য করেনা৷ তাই, এই বাচ্চারা বড়  হয়ে মারমূখী স্বভাবের (Aggressive)হয়ে থাকে৷ এ ক্ষেত্রে, ছেলেমেয়েদের কাছে মাবাবাদের অনেক high expectation থাকে৷ মেরে পিটে ছেলেমেয়েদের ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চায়৷ এ ধরণের প্যারেন্টিং-এ সাময়িক সফলতা পাওয়া যায় তবে বাচ্চাদের self-esteem, social skills, problem solving skill অনেক কম হয়ে থাকে৷ মা-বাবা সবসময় ক্ষমতার প্রয়গ (power exercise) করতে চায়৷ যেমন: “আমি বলছি, তোমাকে এটা করতে হবে”৷ অথবা “যেহেতু, আমি তোমার বাবা, আমি এটা  পছন্দ করি, সুতরাং তোমাকেও এটা পছন্দ করতে হবে”৷ আজকালকার Teen aged ছেলেমেয়েরা  দেশে হোক বা প্রবাসে হোক, এধরণের প্যারেন্টিং-এ প্রচন্ড রিএক্ট করে৷

এবার চলুন, প্রামাণিক(Authoritative) সম্পর্কে জানা যাক৷ নামকরণের সাথে এধরণের প্যারেন্টিং-এর তেমন মিল নেই৷ এধরণের প্যারেন্টিং-এ মা-বাবারা বাচ্চাদের  কাছ থেকে অতি উচ্চাবিলাসী expectation রাখেনা, তারপরেও বাচ্চারা মা-বাবাদের নিয়ন্ত্রনে থাকে৷ তবে এধরণের নিয়ন্ত্রন এর মাঝে অনেকটা Mutual relationship থাকে৷ মা-বাবারা কখনো কোনো কিছু চাপায় দেয়না৷ ছেলেমেয়ে এবং মা-বাবা প্রত্যেকে প্রত্যেকের কথা শুনে৷ মা-বাবারা প্রতি বিষয়ের, সুবিধা, অসুবিধা, অপসন ইত্যাদি নিয়ে ছেলেমেয়েদের সাথে আলোচনা করেন৷ একটি উদাহরণ দিলে কিছুটা পরিষ্কার হয় যেতে পারে৷ ধরুন, আপনার বাচ্চাকে প্রতিদিন স্কুল-ব্যাগে, টিফিন, সাজিয়ে দিচ্ছেন, কিন্তু, বাচ্চাটি কিছুতেই খাচ্ছেনা৷ Authoritarian ধরণের প্যারেন্টিং হলে, মোটামুটি উত্তম/মধ্যম, বকাঝকা করে যাচ্ছেন৷ কিছুতেই কাজ হচ্ছেনা৷ একসময় হয়তো বাচ্চাটি আপনাকে ভয় পেয়ে পুরো খাবার  ডাস্টবিনে ফেলে আপনাকে খুশি করার জন্য বললো “আমি টিফিন খেয়েছি”৷ এ ক্ষেত্রে, বাচ্চাটি টিফিনতো খেলোয়ই না, উপরোন্ত আরো  চাপে পরে মিথ্যা কথা বলা শিখলো৷ অথচ,  Authoritative-এর ক্ষেত্রে, মাবাবা অনেক সময় নিয়ে ছেলে মেয়েদের স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে আলোচনা করেন, প্রয়োজনে অপুষ্টি জনিত বিভিন্ন ভিডিও দেখে বাচ্চাটির মনে একধরণের প্রতিক্রিয়া তৈরির চেষ্টা করেন৷একসময়, বাচ্চাটি নিজথেকে শুধরিয়ে, হয়তো দেখা গেলো সত্যিকারভাবে টিফিন খাওয়া শুরু করেছে৷এভাবে দেখুন বাবামায়ের সহায়তায় বাচ্চাটি আত্ম উপলদ্ধি থেকে নিজেকে সংশোধন করছে কি চমৎকারভাবে৷ তাহলে, দেখাগেলো, Authoritarian ধরণের প্যারেন্টিং-এ মা-বাবারা বাচ্চাদেরকে তথ্য (Resource) সরবরাহ করে থাকেন এবং আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিয়ে থাকেন৷

Permissive হচ্ছে আরেক ধরণের প্যারেন্টিং৷ অনেকসময় এধরণের মা-বাবাকে   Indulgent parent বলা হয়ে থাকে. অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে, মা-বাবারা ছোটবেলায়  ছেলে মেয়েদের  অতিমাত্রায় আদর দিয়ে মাথায় তুলে রাখেন পরে আর নামাতে  পারেননা৷ মা-বাবারা ছেলেমেয়েদের এত অন্ধ ভাবে ভালোবাসেন যে, ওদের কোনো দোষ -ই তাঁদের  চোখে পড়েনা৷ বাসায় বাচ্চারা কোনো নিয়ম  শৃঙ্খলার মাধ্যমে বেড়ে উঠেনা৷ মা বাবাদের প্রশ্রয়ে বাচ্চারা আল্লাদে আল্লাদে  উশৃঙ্খল ভাবে বেড়ে উঠে যা পরবর্তীতে সীমা আরো ছেড়ে যায়৷ মা-বাবারা অনেকসময় bribery-এর আশ্রয় নিয়ে থাকে একটু উদাহরণ দেওয়া যাক৷ ধরুন, আপনার বাচ্চাকে নিয়ে শপিং করছেন৷একটু খেলনা দেখে বাচ্চাটি কান্না শুরু করলো. “আমাকে এটা কিনে দিতে হবে”৷ অমনি, আপনি কিনে দিলেন৷ আরো কিছু বছর পরে, বাচ্চাটি জেদ ধরলো, আমাকে  Play station কিনে দাও, নাহলে কাল থেকে স্কুল যাবোনা৷ আপনি, কোলে করে বাচ্ছাকে দোকানে নিয়ে কিনে দিলেন৷ ধীরে ধীরে চাহিদার মাত্রা মাবাবার প্রশ্রয়ে কেবল  বাড়তেই থাকলো৷ বাচ্চাটি শিখতে থাকলো, “চাইলেই পাওয়া যায়”৷ শুধু তাইনা, মাবাবার  আদরে, অনেকসময় ছেলেমেয়েরা মৌলিক(basic) আদব/ কায়দাও  শিখে উঠেনা৷ বাসায় হয়তো কোনো বেয়াদবি জাতীয় কিছু করলো, আপনার আদরের চোখে তা ধরা পড়লনা ৷ এমনকি, বাহিরে হয়তো কোথায় বেড়াতে গেছেন, আপনার বাচ্চাটি আরেকটি বাচ্চাকে অন্যায়ভাবে আঘাত করলো৷ আপনি হয়তো আপনার বাচ্চাটির হয়ে সাফাই গাইলেন, “আসলে ও ছোট মানুষতো তাই এটা করেছে”৷ আপনার প্রশ্রয়ে, এই ছোট মানুষই হয়তো একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেললো৷ আপনি বিস্ময়ে হতবাগ হয়ে ভাবছেন, কি করে আপনার আদরের সেই ছেলেটির পক্ষে এমন কাজ করা সম্ভব৷

সর্বশেষে, আলাপ করবো আরেক ধরণের প্যারেন্টিং উপেক্ষাপূর্ণ(Neglectful)৷ নাম থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে এক্ষেত্রে, মা-বাবারা বাচ্চাদের ব্যাপারে একেবারে উদাসীন থাকেন৷ বাচ্চার হোম ওয়ার্ক, ক্লাস অ্যাটেনডেন্স, খেলাধুলা, বাচ্চার নানান চাহিদা, এমনকি বাচ্চারা কাদের সঙ্গে মেলামেশা করছে মা-বাবারা সেদিকে খেয়াল করেননা এটা হতে পারে তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা নিজেদের নিয়ে অতিরিক্ত ব্যাস্ততার জন্য৷বাচ্চাদের ব্যাপারে তাঁদের কোনো প্রতিক্রিয়াই খুঁজে পায় যায়না ৷ বাচ্চাদের দিকে কোনো স্নেহ/ভালোবাসার চোখে তাকানের সময় পাননা৷ আপনার বাচ্চাটি হয়তো পরীক্ষায় ভালো মার্ক পেয়ে খুশিতে আপনাকে জানাতে চাচ্ছে৷ কিন্তু আপনি ফিরেও তাকালেন না  ফেসবুক নিয়ে ব্যাস্ত থাকলেন৷ তাই মা-বাবাদের স্নেহ বঞ্চিত এসব বাচ্চারা বেড়ে উঠে আপনমনে ৷বড় হয়ে এরা  মাদকাসক্ত হওয়ার সম্ভাবনার দিকে ঝুকে পরে ৷

তাই, সময় হয়ে এসেছে আসুন নিজেদের দিকে  তাকাই. এ প্রসঙ্গে, আরেকটি কথা বলা যেতে পারে, আমাদের দেশীয় কায়দায়, মায়েরা সচারচর বাচ্চাদের পিছনে পিছনে ঘুরে ঘুরে ইনিয়ে বিনিয়ে মুখে তুলে খাওয়ানো-র চেষ্টা করেন৷ অথচ, একবারও কি ভেবে দেখেছেন, এই কাজটি বাচ্চাদের জন্য poison এর মতো কত ক্ষতি করছে? এর মাধ্যমে আমরা হাতে ধরে ওদেরকে পরনির্ভরশীলতা শিখাচ্ছি, একেবারে ছোট বেলা থেকেই৷ বাচ্চাদের তুলে খাওয়ানো বন্ধ করতে হবে একেবারে গোড়া থেকেই. যতটুকু োর নিজ থেকেই খেলো ওটাতেই খুশি থাকতে হবে ৷ ভালোবাসতে হবে ছেলেমেয়েদেরকে৷ তবে সেই ভালোবাসার মধ্যে যেন অন্ধত্ব না থাকে৷ বাচ্চাদের সাথে মিশতে হবে বন্ধুর মতো ওদের সুখ/দুঃখ যেন আপনার সাথে বন্ধুর মতো শেয়ার করতে পারে৷ কোনো সিদ্ধাত ওদের মাঝে না চাপিয়ে, ওদের সাথে আলোচনা করতে হবে৷ ওদের চাওয়া/পাওয়াকে সম্মান করতে হবে৷ তবেই ওরা আপনাকে সম্মান করবে৷ প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে সমঝোতার মাধ্যমে ওদের সাথে আলাপ করতে হবে, বিশেষ করে টিন এজেড বাচ্চাদের ক্ষেত্রে৷ আমরা প্রানপনে চেষ্টা করবো আমাদের প্যারেন্টিং যেন Authoritative ধরণের হয় নতুন বছর এই হোক আমাদের Ney year regulation

সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে ভালো রাখুক, সুসম্পর্ক বজায় থাকুক সবার মধ্যে, ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে আমরা  যেন সুখে থাকি, আনন্দে থাকি, সুন্দর থাকি৷ আমিন৷

পূর্ববর্তী নিবন্ধ"কাউন্টিং ব্লেসিংস"
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশী ডাক্তারদের কানাডাতে চাকুরির ব্যাপারে কিছু তথ্য
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন