মানসিক প্রশান্তি খুঁজে ফেরেন না, জগতে এমন মানুষের সংখ্যা বিরল। যে যেখানে, যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, দিনের শেষে সবাই খুঁজি স্বস্তি এবং শান্তিময় জীবন। এই প্রশান্তি অন্নেষণের তরিকা এক এক জনের এক এক রকম। কেউ জাগতিক বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্যে নিজেকে জড়িত রেখে প্রশান্তি খোজেঁন, আবার কেউ এর সন্ধান করেন ঐশী প্রেরণার উৎসের মধ্যে। মানসিক স্বাস্থ্যের অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে মানসিক প্রশান্তি। মানসিক প্রশান্তি আবার জড়িয়ে আছে ‘Spirituality’ এর সাথে। মনস্তত্ববিদরা  “Medical model of Psychiatry” তে  ‘spirituality’ বা ‘আধ্যাত্বিকতাকে’ পাত্তা দিতে না চাইলেও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে অথবা মানসিক স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এর গুরুত্ব এখন বিশেষভাবে অনুভুত হচ্ছে। “Spirituality & Psychiatry” এর টানাপোড়েনের  বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে ইংলেন্ডের ‘Royal College of Psychiatrists’ এর  “Spirituality and Mental Health” শীর্ষক একটি নিবন্ধে। নিবন্ধের শুরুতেই বলা হয়েছে, “সাধারণ অর্থে মনস্তত্বের সাথে আধ্যাত্বিকতার খুব একটা মিল নেই। কিন্তু আধ্যাত্বিকতার কিছু বিষয় যে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থেই অবদান রাখতে পারে, সেই সম্পর্কে আমরা দ্রুত সচেতন হয়ে উঠছি”। এই সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে এখন তাত্ত্বিক আলোচনা এবং ব্যবহারিক প্রয়োগ – দুই ক্ষেত্রেই। মনস্তত্বের বাইবেল খ্যাত Diagnostic & Statistical  Manual এর চতুর্থ সংস্করণে “Spiritual & Religious Problem” নামে  (V-Code 68.89)  নুতন ডায়াগনস্টিক ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্তি এই ক্রমবর্ধমান সচেতনতারই বহিঃপ্রকাশ। অন্যদিকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক চ্যালেঞ্জ আক্রান্ত মানুষের মধ্যে এখন “Mindfulness Meditation”,  Mindfulness based Cognitive Behavioral Therapy, Dialectical  Behavioral Therapy ব্যাপক আগ্রহের সঞ্চার করছে। মদ্যপানের আসক্তি কমানোর জন্য ১২ স্তরের (12 steps Alcoholics Anonymous program) যে কর্মসূচি চালু আছে, তারও আটটি স্তরই হচ্ছে মন নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক। একজন মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আত্মিক অবস্থান এবং পারিপার্শিকতাকে আমলে না নিয়ে  শুধু দৈহিক লক্ষণ এবং অবস্থাকে প্রাধান্য দিয়ে  “Medical model” নির্ভর  যে চিকিৎসা এখন প্রচলিত, তাতে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী ফল লাভের  সম্ভাবনা খুব সীমিত বলেই ‘Wholistic Approach’ এ বিশ্বাসীরা মনে করেন। সব মনস্তত্ববিদরাই যে শুধু মেডিকেল মডেল অনুসরণ করে চিকিৎসা করেন তা নয়, অনেকেই এখন এগিয়ে আসছেন সমন্বিত এপ্রোচ ব্যবহারের দিকে। এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কর্মসূত্রে আমার পরিচিত টরন্টোর সেন্ট মাইকেল হসপিটালের Staff Psychiatrist, Dr Arash Nakhost বলেন, “Spirituality is a belief. We all believe in something be it God or not. People take medication because they believe that it will work. Simultaneously, if you believe your prayers will be answered by a divine force, please do so by all means”। বলা বাহুল্য যে  ‘Simultaneously‘ শব্দটি ব্যবহার করে তিনি সমন্বিত চিকিৎসার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।

মনস্তত্বের একাডেমিক ও পেশাগত বিশ্লেষণের সীমানা ছাড়িয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সুস্থ মানসিক জীবন যাপনের ক্ষেত্রে আত্মিক প্রশান্তি অর্জন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। পবিত্র কোরআনের অনেক জায়গাতেই হতাশা, কষ্ট, নিরাশ হওয়া, ইত্যাদি বিষয়ে অনেক নির্দেশনা এসেছে। যেমন অনেক সময় মনে প্রাণে কোনো কিছু চেয়েও না পেলে আমরা হতাশ হয়ে যাই। এ বিষয়ে সূরা বাকারায়  (আয়াত ২১৬) বলা হয়েছে, “ আসলে তোমরা যা অপছন্দ করছো, তাই তোমাদের জন্য ভালো হতে পারে আর যা পছন্দ করছো, তা হতে পারে তোমাদের জন্য খারাপ। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা জানেন তোমরা তা জানো না”। হতাশায়, গ্লানিতে ডুবে যাওয়া মানুষের জন্য সূরা ইউসুফে (আয়াত ৮৭) আশ্বাস দেয়া হয়েছে, “ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। কারণ সত্য অস্বীকারকারী ছাড়া আল্লাহর রহমত থেকে কেউ নিরাশ হয়না“। সূরা তাওবা ( আয়াত ৪০) তে  বলা হয়েছে, “ভয় করোনা, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন”। বিভিন্ন অশান্তিতে মানুষ যখন একেবারেই দিশেহারা হয়ে যায়, কোনো উপায় খুঁজে পায়না, সেই সময়ে আল্লাহপাক আশ্বাস দিচ্ছেন সূরা তালাক এর ১ নম্বর আয়াতে, “তুমি জানো না, আল্লাহ হয়তো নুতন কোনো উপায় বের করবেন”। তার সীমাহীন রহমত নিয়ে আল্লাহ্পাক নিজেই বলছেন, “এবং আমার করুণা সব কিছুকে ঘিরে আছে” (সূরা আরাফ: আয়াত ১৫৬)।  প্রার্থনায় কোনো কাজ হয়না ভেবে যারা হাল ছেড়ে দেন, তাদের জন্য সূরা বাকারায় ( আয়াত ১৮৬)  ঘোষণা হয়েছে, “ আমি তো  তাদের খুব কাছেই আছি। প্রার্থনায় যে আমাকে ডাকে, আমি তার ডাক শুনি, তার ডাকে সাড়া দেই”।  এরকম আরো অসংখ্য আয়াতে অসহায়, হতাশাগ্রস্ত, বিপন্ন, নিরুপায় মানুষের জন্য আশা ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। সমস্যা হলো কোরআনকে পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করার ক্ষমতা আমাদের নেই। বিশিষ্ট বুজুর্গ এবং মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমীর (রঃ) শিক্ষক শামস তাবরিজ (রঃ) যথার্থই বলেন, “প্রত্যেক পাঠকের জন্য পবিত্র কোরআনকে বুঝার ক্ষমতা আলাদা আলাদা, যা নির্ভর করে তার নিজস্ব বুদ্বিমত্তার উপর। এই বুদ্ধিমত্তার চারটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায় হলো বাইরের অর্থ। বেশির ভাগ মানুষ এই অর্থটুকু বুঝেই সন্তুষ্ট থাকে। পরবর্তী পর্যায়ের নাম বাতম- বা ভিতরের অর্থ। তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে ভিতরের মধ্যকার ভিতরের অর্থ। আর চতুর্থ পর্যায়টি এতই গভীর যে তাকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, ফলে তা চিরকালই বর্ণনার বাইরে থেকে যায়”। ফলে কোরআনের গভীরে ডুব না দিলে দূর থেকে দেখা বহমান নদীর মতোই এর স্রোতের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। 

পবিত্র কোরআনের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ অথচ সংক্ষিপ্ত অনেক আয়াতের মধ্যে সূরা হাদীদের তিন নম্বর আয়াতটি অন্যতম। এই আয়াতে  বলা হচ্ছে, “হুওয়াল আউয়ালু ওয়াল আখিরু, ওয়াজ্জাহিরু ওয়াল বাতিনু। ওয়া হুয়া বিকুল্লী শাইয়িন আলিম”।  অর্থাৎ “তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ। তিনিই প্রকাশ্য, তিনিই গোপন। তিনি সব বিষয়ে সম্যক অবহিত”। সর্বত্র বিরাজিত সর্বশক্তিমান এই সত্তার অপার করুনায় আস্থা না রেখে অন্যত্র শান্তি খোজাঁর চেষ্টা কতটা কার্যকর হয়, তা আমার জানা নেই।  স্রষ্টায় নিখাদ বিশ্বাসী মানুষের মধ্যে এমনিতেই জন্ম নেয় আশ্চর্য্য এক প্রশান্তি ও নিরাপত্তাবোধ। এটাকে বাদ দিয়ে সুখ, শান্তি ও সার্থকতা আসে না জীবনে। 

সৈয়দ মসিউল হাসান 
টরন্টো থেকে। 

(ছবি সৌজন্যে Contemplative studies)


আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন