আজ সকালে উইকএন্ডের পরে প্রথম অফিস গিয়েছি। প্রোগ্রাম ডিরেক্টর আমাকে ডেকে উনার রুমে নিয়ে গেলেন , আমার সাথে কিছুক্ষন কথা বলে সসম্মানে আমাকে বাড়ি যেতে বললেন ১৪ দিন সোশ্যাল আইসোলেশন থাকার জন্যে। আমিও সুর সুর করে বাড়ি চলে এলাম । পাঠকগণ, ভয় পাবেন না আমার এখনও অফিসিয়ালি COVID-19 ধরা পরেনি। আমার জন্যে যেটা করা হলো সেটা হচ্ছে একটি উন্নত দেশের আগাম সাবধানতা অবলম্বনের পদক্ষেপ। হায়রে বাংলাদেশ, প্রবাসে বসে দেশের করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতার কথা ভাবতে ভাবতে ঘন্টাখানিক গাড়ি চালিয়ে একটু আগে বাড়িতে ফিরলাম। এসব উন্নত দেশে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করতে কত রকমের পদক্ষেপ নিয়েও হিমশিম খাচ্ছে, আর ওদিকে আমাদের দেশে … ভাবতেও ভয়ে গা ছম ছম করে উঠছে । বাড়িতে আসতে না আসতেই, অফিসের এইচ আর থেকে লম্বা ফোন। আমাকে কিছু ফ্রম ফিলাপ করে পাঠাতে হবে। চলুন, বিস্তারিত শোনা যাক।

ঘটনা ঘটেছিলো গত বুধবারের দিন। তারও আগে অর্থাৎ আগের শুক্রবার থেকে ছুটি কাটাচ্ছিলাম। আমাদের অফিসে ফিসকাল এয়ার এপ্রিল টু মার্চ । তাই মার্চের মধ্যেই বাধ্যতামূলক ভাবে বাকি ছুটিগুলি শেষ করতে হবে। গত শুক্রবার অর্থাৎ মার্চের ২০ তারিখে সেই হিসাবে ছুটি শেষে আমার কাজে যোগদানের কথা। আমি মহা উৎসাহে ছুটি কাটাচ্ছি আর করোনা ভাইরাস বিষয়ে জ্ঞান বিতরণ করে চলেছি। সহধর্মিনী বেচারা প্রবল বেগে চাকুরী করে যাচ্ছে আর আমার দিকে কিছুটা ঠোঁট বেঁকে আরো চোখে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কাজে বেরিয়ে যাচ্ছে যার অর্থ হতে পারে এরকম ” আল্লাহ তোমাদের সুখ দিয়েছে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও আর আমি কাজ করে করে মরি ।

তো হয়েছে কি, সেদিন মানে ওই বুধ বারের সকালে উনি কাজে যাবার আগে বলে গেলেন , “বাসায়ই তো আছো, গাড়িটাও তো একটু ক্লিন করতে পারো “। এদিকে মার্চ ব্রেক, বাচ্চারাও বাড়িতে। তাই, বুধ বারের সকালে চকচকে রোদ দেখে বাবা-মেয়ে মিলে মহা উৎসাহে গ্যারাজের সামনে বাড়ির ড্রাইভ ওইয়েতে গাড়ি ক্নিন করতে লাগলাম । এরই মধ্যে আবহাওয়া যে এতো বিশ্বাসাঘাতকতা করবে মোটেই ভাবিনি। কাজের মধ্যে ছিলাম বলে টের পাইনি , ভালোই ঠান্ডা লাগছিলো। যা হবার তাই হলো হালকা জ্বর বেঁধে ফেললাম। খুব ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি, একটু ঠান্ডা লাগলেই আমার প্রথমে গলা খুশ খুশ করে, তাঁর পরে যদি সাবধানতা অবলম্বন করি অর্থ্যাৎ গলায় কাপড় পেঁচে, লবন পানি দিয়ে গার্গেল করি হয় ভালো হয়ে যায় অথবা তিন ধরণের ঘটনা ঘটে : এক , টন্সিল আক্রান্ত হয়ে প্রবল কাশি হতে থাকে, দুই, সর্দি হয়ে নাক/চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে ; তিন নম্বর হলো জ্বর হয়ে শরীরের তাপমাত্রা সাকিবুল হাসানের বেটিং এর মতো বলের সাথে পাল্লা দিয়ে উর্ধমুখী হতে থাকে। খুব ছোটবেলায় আমরা যখন রংপুর শহরের আলম নগর এলাকায় থাকতাম এরকম জ্বর হলে সাত্তার ডাক্তার অথবা তালুকদার ডাক্তার ছাড়া আমার জ্বর ভালো হতোনা। পরে যখন ১৯৭৩/৭৪ সালের দিকে বগুড়ায় আসলাম, তখন ইয়াসিন ডাক্তার সাহেব ছিলেন আমাদের পারিবারিক ডাক্তার । আমার জ্বর হলেই, উনার ডাক পড়তো, উনি আবার আমার বাবার ছাত্র ছিলেন এবং দূরসম্পর্কের আত্মীয় ও ছিলেন বিধায়, ডাক পড়লেই বাসায় আসতেন। আমার জ্বর হলেই ইয়াসিন ডাক্তার সাহেব আমার জ্বর কে টাইফয়েড ক্যাটাগরিতে ফেলে লাল সিরাপের বোতল হাতে ধরে দিতেন যা খেলে ৫/৬ দিন অন্তত পড়াশুনা করতে হতোনা , গ্লুকোজবিস্কুট , বার্লি ইত্যাদি খেয়ে সপ্তাহখানিক ভোগার পরে জ্বর সেরে যেত। কিন্তু , এবারের কাহিনী আলাদা । এবার জ্বর বেঁধে ফেলেছি করোনা ভাইরাস মৌসুমে ।

বৃহস্পতিবারে সারাদিন নিয়ম করে ৪ ঘন্টা পর পর টাইলেনল খেয়োও যখন জ্বর সাড়ছে না , কপালে আমার ও মিতার (স্ত্রী ) অসংখ ভাঁজ পড়া শুরু করলো । শুক্রবার সকালে সুপারভাইজারকে জ্বরের দুঃসংবাদ জানিয়ে টেক্সট করে দিলাম। একেবারে মৌচাকে ঢিল পড়লে যা হয় তাই হলো । সারা অফিস রোটে গেলো জাকারিয়ার জ্বর হয়েছে । আমাকে সুপারভাইজার জানালো , বাসায় বসে থাকো । সুস্থ হলে অফিসে আসবে। এদিকে , মিতা নিজ ভয়েই হোক আর ভালোবেসেই হোক প্রানপনে চেষ্টা করে যাচ্ছে আমার জ্বর কমানের। ওষুধের পাশাপাশি আদা, লং, লেবুর রস দিয়ে চা খেতে খেতে আলজিব্বা পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তারচেয়েও ভয়াবহ ঘটনা হলো , মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা শুরু হলো । বিছানায় লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে করুন ভাবে চারিপাশে তাকিয়ে ভাবি এই যে এত বড় টেলিভিশনে কি চমৎকার বাংলা সিরিয়াল, ফ্রিজ ভর্তি খাবার দাবার (ফ্রিজে হাঁসের মাংস রান্না করা ছিল ), কয়েকমাস আগের কেনা এত প্রকান্ড বাড়ি এগুলি ফেলে রেখে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যদি সত্যিই মরে যায় তাহলে কি হবে!! ভাবতে ভাবতে দিনের বেলায় লম্বা একটি ঘুম দিলাম । ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছি গরম গরম পাতলা খিচুড়ি,  সাথে ঝাল আলুর বার্তা আর টপিং হিসাবে বেশি করে রসুন দিয়ে ভাজা ভাজা হাঁসের মাংস দিয়ে গোগ্রাসে গিলছি। মিতার গলার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো । মিতা আমার সামনে একটি প্লেট বাড়িয়ে দিয়ে মিটিমিটি হাসছে, “খাবারটি খেয়ে টাইলেনল খেয়ে নাও।” ভুত দেখার মতো চমকে যেয়ে দেখি প্লেটে একেবারে গরম পাতলা মোটা চালের খিচুড়ি। একেবারে প্লেট থেকে গরম ভাব উঠছে । সেই হাঁসের মাংস , তবে স্বপ্নের সাথে একটু হালকা কারেকশন আছে। আলু ভর্তার জায়গায় কুচি কুচি করে আলু ভাজি র সেই সাথে বাসায় বানানো ঘি। মুখে দিয়ে মনে হলো যেন অমৃত খাচ্ছি। মিতাকে মনে মনে প্রাণ ভোরে দোয়া দিতে দিতে ভাবছি, এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে করোনা ভাইরাসের খপ্পরে পরে যদি সত্যি সত্যিই চলে যেতেই হয় তবে কি হবে!!!

আজ হোক কাল হোক আমাকে চলে যেতেই হবে কি আর করা, তাই মন টন খারাপ করে কিছু পরিচিত বন্ধু /বান্ধবকে ফোন দিলাম । ওমা এ কি অবস্থা!!, যেই না জ্বরের কথা বলছি বন্ধুরা তাড়াতাড়ি ফোন রাখতে উদ্দিশ পায় না । ভাবখানা, যেন জ্বরের কথা শুনলেই করোনা ভাইরাস বুঝি ফোন পথে ওদের কাছে চলে যাবে। হায়রে পৃথিবী!! কি আর করা , গুন্ গুন্ করে একা এক ‘তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়’ গান গেয়ে, ফেস বুকে বিচরণ করতে থাকলাম। রবিবারের দুপুরের মধ্যেই মিতার অসম্ভব ধরণের সেবা শুশ্রুষার ফলে ঘাম দিয়ে জ্বর নেমে গেলো । হাফ ছেড়ে বাচলাম, তবে কি এযাত্রায় বেঁচে যাচ্ছি !! যাহোক, আজ অর্থাৎ সোমবারের সকালে অফিসে যেতেই যে দুই একজন ছিল চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকাচ্ছে যেনো অফিসে এসে বিরাট অপরাধ করে ফেলেছি। পরে, ডিরেক্টর হিউমান রিসোর্স এ ফোন করে আমাকে জানালো আমাকে ১৪ দিনের হোম করেন্টাইনের হিসাবে ফেলা হয়েছে, আমি যেন এখুনি বাড়ি যাই। এমনিতেই, আমাদের অফিসে গত সপ্তাহ থেকে নিয়ম ছিল, আমরা বাসায় বসে অফিস করতে পারবো, একেক স্টাফ ছোট ছোট ৫ জনের গ্রূপ করে সপ্তাহে শুধু একদিন অফিসে আসতে হবে। সেই হিসাবে, আমার সোমবার করে শুধু অফিসে আসার কথা ছিল, যা হোক এখন থেকে তাও হবে না । এদিকে, মেয়ে আমার বাসায় ১৪ দিন থাকার কথা শুনে মুখ লম্বা করে বসে আছে। বাবা বাসায় থাকলে আই ফোনে খেলা যাবে না ।

সারাদিন অনলাইনে প্রথম আলো, বাংলাদেশের টিভির খবর ও এখানকার খবর দেখতে দেখতে আজকের দিন কেটে গেলো । দেরিতে হলেও এবার বুঝি সরকারের টনক নড়েছে। দেশে লম্বা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে, অতি সত্তর মিলিটারি নামছে, প্রধান মন্ত্রী আগামীকাল জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন ইত্যাদি । দেশ ও দশের কথা ভাবতে ভাবতে এই ভাবেই অতিবাহিত হতে চলেছে আমার ১৪ দিনের প্রথম দিন।আজ আমাদের জাস্টিন ট্রুডো বেশ করা মেজাজে সোশ্যাল ডিসটেন্স মেইনটেইন করার ব্যাপারে টিভিতে ভাষণ দিলেন । ডুয়েল সিটিজেনশিপের এই এক জ্বালা। একই সঙ্গে দুইটি দেশ নিয়েই ভাবতে হয় ।

আমার এই দুই দেশের কথা ভাবতে ভাবতে এই ভাবেই অতিবাহিত হতে চলেছে আমার ১৪ দিনের প্রথম দিন।

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধমেঘের আড়ালেই সূর্য্য হাসে।
পরবর্তী নিবন্ধ“Beacon of Hope”
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন