Young couple walking along the street in Istanbul. Urban life style. Routine. Life in Turkey.

মাঝে মাঝে খুবই ফিল করি ওদের জন্য বুঝলা মারি । বৌকে সে এই নামেই ডাকে – মারিজুয়ানা থেকে মারি । প্রথম দিন দেখার পর থেকেই নাকি মোবারকের যে নেশা ধরেছে সেটা আজ এতো বছর পরেও একই রকম আছে । দিনভর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির এক রবিবার বিকালে দুলাভাইর কলিগের কলাবাগানের বাসায় “কেউ জানে না কিন্তু সবাই জানে ‘ এরকম একটা ইনফর্মাল মেয়ে দেখার অনুষ্ঠানে কিছুটা বাধ্য হয়েই যেতে হয়। বিয়ে করবে না বলে গো ধরে থাকা মোবারককে বড় বোন যখন বললো, “যদি যাস তাহলে আমাদের নতুন গাড়ি চালাতে দেব। তোকে ওই বাড়ির কেউ কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবে না, শুধু যাবি, দূর থেকে মেয়েটাকে দেখবি তারপর নাস্তা খেয়ে চলে আসবি”। ব্যাস, সেই যাওয়া। মোবারকের শঙ্কা ১০০ ভাগ সত্যি করে এক সময় দেখা যায় বসবার ঘরে তারা দুইজন ছাড়া আর কেউ নেই । নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডের উপর বসে থাকার মতো টেনশনময় ১৫ মিনিট কাটলো ভয়াবহ অস্বস্তিতে।  ছাদ, ফ্লোরের টাইলস আর ডান দিকের একটা বন্ধ জানালা ছাড়া যে বাকি দুই দিক থাকে তার এক দিকে সেই মেয়ে বসা আরেক দিকে টিভিতে বাংলা ছবিতে বাসর রাতের দৃশ্য। হাতের কাছে রিমোট ও নাই যে চ্যানেল বদলাবে। একেবারে না তাকালে নিতান্তই ছোটলোকামি হয়ে যায় বলে অনেক কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে আড়ষ্ট ভাবে একবার মেয়েটার দিকে তাকায়। কোন রকম মেকাপ নাই, মেঘলা আকাশ এবং জানালার মোটা পর্দার কারণে নাই কনে দেখা রোদের ছিটে ফোটাও, তবুও স্কুল ইউনিফর্মের মতো একটা ড্রেস পরে আসা মেয়েটাকে দেখে কি জানি কিসের নেশায় আজীবনের জন্য ধরা খেয়ে যায় মোবারক। এই ইতিহাস তার পরিচিত মন্ডলের প্রায় সবাই জানে। হিংসুটে কাউকে কাউকে আড়ালে বলতেও শোনা গেছে যে মোবারককে নাকি জাদু করা হয়েছে। একথা কানে আসলে মোবারক আহ্লাদিত হয়ে বলেছে, “সত্যি হলে এরকম জাদু বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেয়া উচিৎ।”

ছুটির দিনে বৌ যখন সকালের নাস্তা বানায় তখন কিচেনের কাউন্টার টপের উপর বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে গল্প করা মোবারকের অনেক দিনের প্রিয় অভ্যাস। গত পরশু দিন, শনিবারেও সেরকম একটা মুহূর্তে মোবারক তার গল্প শুরু করে। বৌ মাঝে মাঝে হু হা করছিলো ঠিকই কিন্তু তার মাথা তখন কালী জিরা আর চিনি গুঁড়া চালের এক ধাঁধা নিয়ে পাগল হওয়ার অবস্থায় ঘুরছে। মির্জা ভাবি বার বার করে বলে দিয়েছে কোনটা দিয়ে পোলাও আর কোনটা দিয়ে তেহারি ভাল হয় কিন্তু এখন সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না। 

মোবারক বলে যায়; “ছোট বেলায় এক সময় কত আনন্দই না করছি। কি কলেজে কি মহল্লায় কি মিনা বাজারে কি মারামারিতে, কি ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল খেলা দেখতে – সব কিছুতেই এক সাথে বুঝলা। এখন কেমন জানি হয়ে গেছে সবাই!”

মানুষটা এতো আগ্রহ নিয়ে গল্প করছে বলে ফোন করে ভাবীকে জিজ্ঞেস করাও যাচ্ছে না। ঠিক এই সময় একেবারে আশীর্বাদের মতোই মির্জা ভাবীর ফোন আসলো।

মোবারক হোসেন খুব একটা বিচলিত হয় না, গল্প সে বলেই ছাড়বে। কাল বাদে পরশু দেশে যাওয়া হচ্ছে; ম্যারাথন লম্বা ফ্লাইটে বসে অনেক গল্প করা যাবে। বৌ সামনের দরোজার কাছাকাছি উপরে যাওয়ার সিঁড়িতে বসে ফোনে কথা বলছে, এখান থেকে কথা শোনা যায় না তবে কিচেনের টাইলসে প্রবল বেগে হাত পা নড়ার ছায়া দেখে বোঝা যাচ্ছে যে আলাপ ভালোই জমেছে। 

গল্প তার ঠিক করাই আছে। বেশির ভাগই ছোটবেলার বন্ধুদের নিয়ে।

রিফাতটা ছোট বেলা থেকেই একটু পাগলাটে টাইপের। পিরামিডের উপর কি একটা লেখায় পড়েছে যে পিরামিডের স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের কারণেই তার মধ্যে থাকা মমি গুলি অলমোস্ট অবিকৃত অবস্থায় হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে। ব্যাস, রিফাত নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে মহা উৎসাহে লেগে গেলো কার্ড বোর্ড দিয়ে পিরামিড বানাতে এবং কিছুদিনের মধ্যে ওদের বাসায় আসন গাড়া এক বেকার চাচার সহায়তায় একটা প্রায় চার ফুট বাই চার ফুট পিরামিড দাঁড় করিয়েও ফেলল। সে কিছুদিন আগে মোহাম্মদপুর পিসি কালচারের ঝিলের পাশ দিয়ে যাচ্ছে ইফতি ভাইর(ওর দুলাভাই) সাথে গাড়িতে। চলতি পথে রিফাত হঠাৎ গাড়ি থামাতে বলে। তারপর গাড়ি থেকে নেমে  শার্ট খুলে খালি গায়ে কচুরি পানার মধ্যে নেমে যায় কারণ এই পথে সরাসরি হেটে গেলেই নাকি ওকে নিতে আশা স্পেস শিপের কাছে শর্ট কাটে পৌঁছানো যাবে।

মহসিনের কথা তো মোটামুটি জানই । আমাদের মধ্যে সবচে ইন্টেলিজেন্ট ছিল। ব্যাটাকে তিন বছর ধরে রিকোয়েস্ট করেও একটা রোজা রাখাইতে পারি নাই, হঠাৎ কিছুদিন আগে দেখি তার ট্রেড মার্ক গোঁফ একদম নাই করে দিয়ে সুন্নাতী দাঁড়ি টাড়ি  রেখে এক পীরের মুরিদ হয়ে গেছে।

আমাদের মধ্যে সবচে এ্যাকটিভ ছিল রাতুল। সবার জন্ম দিন মনে রাখা তো কোনো ব্যাপারই না, সে এমনকি আমাদের প্যারেন্টসদের এনিভার্সারিও মনে রেখে কার্ড দিয়ে যেত। যে কারণে ওনাদের কাছে রাতুল ছিল ভালো এবং আদর্শ ছেলের উদাহরণ।  সেই রাতুল এখন কলকাতার একটা রিহ্যাবে কাটায় বছরের বেশিরভাগ সময়।

কয়েক মিনিট আগে টার্কিশ এয়ার লাইন্সের ক্যাপ্টেন ঘোষণা দিয়েছে আর আধা ঘন্টার মধ্যে প্লেন ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবে, গ্রাউন্ড টেম্পারেচার যা বললো সেটা ক্যানাডায় ২০ বছর ধরে থাকা কারুর জন্য রীতিমতো ভয়াবহ। সিট বেল্ট বাধার ইন্সট্রাকশন আসার আগেই বৌ গেছে নোজ পাফ করতে রেস্ট রুমে। মোবারক ড্রিম লাইনারের জানালা দিয়ে ইস্তাম্বুল শহরের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যায় অনেক অনেক আগের স্মৃতিতে।

কোনও এক অজ্ঞাত কারণে রাতুলের ছোট বোন নিপুন, মোবারককে অনেক আগে থেকেই ইস্তাম্বুল ভাই বলে ডাকত। মোবারক অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে, “এই তুই আমাকে ইস্তাম্বুল ডাকিস ক্যান রে”? নিপুন সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মুখ টিপে হাসত; শুধু একদিন কেমন জানি খ্যাপাটে গলায় বলেছিল, ” আমার যা ইচ্ছা আমি তাই ডাকব, বেশি কথা বললে মগ বাজার বা মালি বাগ ভাই ডাকা শুরু করব, ঠিক আছে”? মোবারক হা করে তাকিয়ে ছিল। বেশ কম বয়সে একটু অদ্ভুত ভাবেই নিপুনের বিয়ে হয়ে গেল আমেরিকা প্রবাসী এক লোকের সাথে। নিপুনের প্রায় দ্বিগুন বয়সী ভদ্রলোকের প্রথম বিবি আমেরিকা নেমেই এক মাসের মাথায় আগের প্রেমিকের সাথে ভাগুরা হয়ে যায়। তারপর রাগে, দুঃখে, লজ্জায় তিনি সিদ্ধান্ত নেন, জীবনে আর বিয়ে টিয়ে করবেন না। দেশ থেকে মা কে নিয়ে এসে নিজের কাছে রেখেছেন। মা’র সময় কাটাবার জন্য এক জোড়া বিড়াল আনা হয়; গত পাঁচ বছরে তাদের অনিয়ন্ত্রিত বংশ বিস্তারের ফলে ঘরের মধ্যে এখন প্রায় সারাক্ষন দেড় ডজন বিড়ালের সদম্ভ এবং যাচ্ছেতাই ক্যাট ওয়াক দেখা যায়। একদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পর মায়ের থমথমে মুখ দেখে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করাতে মা শীতল কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন যে ছেলে যদি  আগামী দুই মাসের মধ্যে বিয়ে না করে তাহলে এই বিড়াল বাহিনীকে রেখে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবেন। লং স্টোরি শর্ট, অতঃপর ছেলের প্রয়াতঃ বাবার এক সময়কার ব্যাংকের এমডি বন্ধুর মেয়ের সাথে টেলিফোনে বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলো।  

ঢাকা এয়ারপোর্টে ভিড়ের মধ্যে একটু আড়াল পেয়ে জীবনে প্রথম এবং সম্ভবত শেষ বারের মতো মোবারক নিপুনের মুখে নিজের নাম শুনে চমকে ওঠে, “মোবারক ভাই, খুব শখ ছিল ইস্তাম্বুলের রাস্তায় রাস্তায় আপনার হাত ধরে হাঁটার; সেটা আর হলো না। আপনাকে ইস্তাম্বুল ভাই ডাকতাম কারণ এমন একটা নামে ডাকতে চেয়েছিলাম যে নামে কেউ কোনোদিন আপনাকে ডাকবে না। নামটা আমি নিয়ে যাচ্ছি সাথে করে, আপনি ভাল থাকবেন।”

“কি ব্যাপার, চেহারা তিতা করে বসে আছ কেন, ভাবছ তুমি একা একা গল্প করেছ আর আমি ঘুমিয়েছি ? সব কথাই শুনেছি চোখ বন্ধ করে।  রিফাত ভাই, মহসিন ভাইর গল্প করছিলে। তারপর রাতুল ভাইর গল্প করতে গিয়ে তো ঘুমিয়েই গেলে মনে হলো!”

জানালা দিয়ে তাকিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা মোবারকের সম্বিৎ ফিরে আসে বৌয়ের কথায়। দীর্ঘশাস ঠেকানো ছোট্ট একটা ঢোক গিলে মধুর হাসি নিয়ে সে ফিরে তাকায়। ঠোঁটে একটু লিপস্টিকও দেয় নি বোধহয় । চুল আঁচড়েছে। চোখে মুখে দেয়া পানির ছিটা পুরোপুরি মোছা হয়নি – তাতেই কেমন নেশা ধরানো স্বর্গীয় স্নিগ্ধতায় ভরা অপ্সরীর মতো লাগছে মারিকে! মনের মধ্যে উথলে ওঠা আবেগে সৃষ্টি কর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ক্ষনিকের জন্য বিস্মৃত হওয়া প্রিয় নেশায় আবার বুদ্ হয়ে যায় মোবারক।

3 মন্তব্য

  1. অত‍্যন্ত সাবলীল বর্ণনা, ভালো লেগেছে। চালিয়ে যাও – মাঝেমধ্যে মেসেজ‌ও চাই।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন