(এক)

যাচ্ছিলাম শর্টকাট রাস্তা ধরে ট্রেন ধরবো বলে। যাবার পথে বিরাট একটা ঝিল পেরিয়ে যেতে হয়। তখন ছিল গ্রীস্মকাল। প্রচন্ড গরম। প্রতিদিন বিকেলে স্থানীয় কিশোর-কিশোরীরা হৈ-হুল্লোড় করতে করতে সাঁতার রেস দিতে নেমে পড়ে ঐ ঝিলে। এককালে এটি ‘কলাবতী’ নামে একটি প্রসিদ্ধ নদী ছিল। শুনেছি, ঐ নদীতে ভাসমানরত সুবর্ণ পুস্পরেনুর সুসজ্জিত এবং সুদর্শণ কারুকার্যময় বিশাল ময়ূরপঙ্খী নৌকায় তৎকালীন রাজা-বাদশাদের শৌখিন-বিলাসীতার মহরৎ চলতো। চলতো দেব-দাসীদের আনা গোনা। প্রেমলীলা, অভিসার। চলতো গ্রামোফোন রেকর্ডে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের অপূর্ব মূর্ছণা। সেই সঙ্গে চলতো, লাস্যময়ী উর্বশী রমণীদের মনোমুগ্ধকর নৃত্যগীতের আসর। পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসনের আমলে অবস্থার বিবর্তনে ক্রমাণ্বয়ে অপব্যবহারে শহরের নোংরা আবর্জনা জমতে জমতে চড় পড়ে গিয়ে একটি ঝিলের আকার ধারণ করে। বর্তমানে সেটি নালা নর্দমায় পরিণত হয়ে গঙ্গানদীর সাথে মিশে গেছে।

হঠাৎ দূর থেকে দেখি, ঐ ঝিলের চারপাশে লোকে লোকারণ্য। অগণিত মানুষের ভীঁড়। ভাবলাম, সাঁতার রেস হচ্ছে বোধহয়। কেউ কেউ তখনও ছুটে যাচ্ছে দেখতে। আর কেউ সমবেদনা প্রকাশ করে বলছে, -‘আহা রে, বেচারা!’

তখন কত আর বয়স আমার। স্বভাবসুলভ কারণে প্রচন্ড উৎসুক্য নিয়ে দ্রুত হাঁটতে থাকি। কাছাকাছি পৌঁছোতেই লক্ষ্য করলাম, চোখেমুখে কারো আবেগ নেই। উদ্বেগ নেই। কাউকে উৎসাহীতও মনে হচ্ছেনা। সবাই বিমূঢ় ম্লান, নির্বিকারে তামাশা দেখছে। ইতিমধ্যে হাওয়ায় ভেসে আসে এক প্রৌঢ়া মহিলার কণ্ঠস্বর। তিনি উৎকন্ঠিত হয়ে বলছেন,-‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমরা সব তামাশা দেখছ! একটু মায়া হচ্ছে না তোমাদের! আশ্চর্য্য, দেখছ কি হাঁ করে! ছেলেটা দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে যে। শীগ্গির যাও, তোমরা কেউ টেনে তুলে নিয়ে আসো ওকে!’

তখন বুঝলাম, কেউ পড়ে গিয়েছে ঝিলে। দিলাম উর্দ্ধঃশ্বাসে এক দৌড়। দৌড়ে গিয়ে দেখি, সে এক অবাক কান্ড। রীতিমতো হাস্যকরও বটে। সাত-আট বছরের একটি নাবালক ঘন্টার পর ঘন্টা ডুবে আছে জলে। কখনো তিমি মাছের মতো ভেসে উঠে পলকেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে জলের গভীরে। সাংঘাতিক দুঃসাহসী ছেলে সে। একেবারে বাঘের কলিজা ওর। কিন্তু তা লোক দেখানোর জন্য নয়। মায়ের অবাধ্যতা এবং বেপরোয়ার কারণেই ওর ঐ নিমর্ম পরিণতি।

দেখলাম, কাঁচাবাঁশের সরু একটি কি হাতে নিয়ে ঝিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে, মুখের পেশিগুলোকে শক্ত করে ফুলিয়ে, চোখমুখ রাঙ্গিয়ে রাগে গজগজ করছেন ওর মাতারানী অন্নপূর্ণা দেবী। ওনার গুণধর পুত্রুর জল থেকে ডাঙ্গায় উঠে এলেই আর রক্ষা নেই, পড়বে ওর পিঠের উপর দমাদম বেতের বারি। কিন্তু কতক্ষণ! অন্নপূর্ণা দেবী অদৃশ্য হয়ে যেতেই ছেলেটি চুপিচুপি জল থেকে ডাঙ্গায় উঠে আসে। ভিজে বিড়ালের মতো র্থথর করে কাঁপতে কাঁপতে প্রাণপণে দেয় দৌড়।

ছেলেটির নাম গঙ্গারাম। তো তো স্বরে কথা বলে আর খুব তোতলায়। তাই সবাই ওকে তোতারাম বলে ডাকে। ওরা তিন-ভাইবোন। দুইদিদির একমাত্র ছোটভাই। কত আদরের, ওদের চোখেরমণী। আর মায়ের তো কলিজার টুকরো। আদর করে ওকে ‘গোঙ্গু’ বলে ডাকে। কিন্তু যেমন চন্চল, অস্থির চিত্তের, তেমনি লেখাপড়ায় অষ্টরম্ভ, অমনোযোগী। এক একটা ক্লাসে দু’বছর না পড়লে পরিক্ষায় উর্ত্তীণ হতে পারে না। ওদিকে বেলেল্লাপণাতেও একেবারে পারদর্শী। দিদিদের তো গ্রাহ্যই করেনা, আর মাতারানী চোখের আড়াল হলেই পবনপুত্র হনুমানের মতো ওর লেজ গজায়। রাত পোহালেই শুরু হয় ওর নিত্যনৈমিত্তিক তুলকালাম কান্ডের পুনরাবৃত্তি। ওকে যে কোণ্ ধাতূ দিয়ে বিধাতা গড়ে ছিলেন, ডর-ভয়, লজ্জা-শরমের বিন্দুমাত্র বালাই নেই। পশু-পাখীর চেয়েও অধম। পশু-পক্ষীরাও নিজের আরাম বোঝে। শান্তিপূর্ণ নিড়িবিলি জায়গা ওরাও খোঁজে। র্সূয্য অস্তাচলে ঢলে পড়লে ওরাও যথাসময়ে ফিরে যায় আপন ঠিকানায়। ব্যতিক্রম শুধুমাত্র গোঙ্গুর বেলায়। নামমাত্র ওর লেখাপড়া। ছুটির ঘন্টা বেজে উঠলেই ব্যস, গোঙ্গু চোখের নিমেষে উধাও। পাত্তাই পাওয়া যায়না ওর। স্কুলের ব্যাগটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখে শিকারী হায়নার মতো আম-জামরুলের সন্ধানে চোখদু’টো ওর চড়কির মতো ঘোরে চারিদিকে। কোনদিন ঘু ঘু ডাকা নির্জন দূপুরে তরতর করে লোকের আমগাছে উঠে পাখীর মতো খুঁটে খুঁটে পাকা আমগুলিই বেছে বেছে খায়। আর খেয়ে খেয়ে আমের আঁটিগুলি ছুঁড়ে ফ্যালে পার্শ্বস্থ ঘর-গৃহস্থের চালের উপর। কখনো পাথর ছুঁড়ে লোকের টালি ভেঙ্গে দেয়। ওদিকে ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে যান মাতা অন্নপূর্ণা দেবী। চিন্তা ভাবনায় অস্থির হয়ে উঠেন। গোঙ্গু বাড়ি ফিরে না আসা পর্যন্ত মন্ত্রের মতো শুধু জপতে থাকেন, ‘এই বুঝি পাড়ার লোক সব স্বদলবলে নালিশ নিয়ে এলো বোধহয়। ওর মায়ের পিন্ডি চটকাবে। মায়ের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করবে। ভগবান, মরণও কেন হয়না আমার!’

ইতিপূর্বে গোঙ্গুর উৎপাত, উপদ্রপ, অত্যাচারে পাড়ার বিক্ষিপ্ত মহিলারা কোমড় বেঁধে বিহিত করতে এসে হাজির। ওর মায়ের সঙ্গেই তুমুল কোন্দল বিবাদ বাকযুদ্ধ শুরু করে দেয়। গালিগালাজ করে। থানা পুলিশের হুমকি দেয়। কেউ কেউ তীব্র উপহাস করে বলো,-‘বান্দর একখান্ তো পুইষ্যা রাখছ, হ্যাড়ে ছাইর‌্যা দিছ ক্যান! মাইনষের যে অনিষ্ট কড়তাছে, খবর রাখো কিছু! নিশ্চিন্তে থাকো ক্যান? বেআক্কল, বেশরম!’

এইভাবে দিনের পর দিন লোকের কাছে অপদস্থ হতে হতে ক্ষোভে, দুঃখে অপমানে অন্নপূর্ণা দেবী একেবারে অতিষ্ট হয়ে গিয়েছেন। ইচ্ছে হয়, গোঙ্গুর গলাটাই টিপে দিতে। আর দিদিরা তিক্ত-বিরক্ত হয়ে ওর নামই উচ্চারণ করেনা কেউ। কাছে এলে অশৌচীর মতো চোখমুখ বিকৃতি করে ওকে দূর দূর করে তাড়ায়। কিন্তু মায়েরই হয়েছে যত জ্বালা। না ফেলতে পারেন, না সইতে পারেন।

অবশেষে একদিন অধৈর্য্য হয়ে শহর থেকে প্রায় তিন’শ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি বোডিং-স্কুলে এমন চুক্তিবদ্ধভাবে দাখিল করে দিলেন, যাতে কোনদিন মা-বোনের দর্শণ না পায়। ছুটিতেও বাড়ি আসা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। অথচ নির্বোধ নাবালক গোঙ্গু, ওর মা-বোনের বিচ্ছেদে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখা গেল না ওর চোখেমুখে। কোনো ভাবান্তরও হলো না। এতটুকু কষ্ট হলো না। মুহূর্ত্যরে জন্যও মনকে মলিন ম্রিয়মান করলো না। উল্টে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠে। মনে মনে বলে,-‘কি মজা! কেউ শাসন করবে না। কেউ বাঁধা দেবেনা। মনের সাধ মিটিয়ে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারবে।

কিন্তু অজ্ঞাত অনভিজ্ঞ গোঙ্গুর ধারণা ছিলনা যে, বোডিং-স্কুলের নিয়মকানুন, শাসন-শৃঙ্খলা, শিক্ষা ব্যবস্থা কত কঠোর। কত জটিল। সেখানে ফাঁকি দেওয়া তো দূর, কোন নিয়ম ভঙ্গ করলেও বোডিং-স্কুলের রুল অনুযায়ী শুধু দন্ডনীয়ই নয়, একবার ধরা পড়লে আর ক্ষমা নেই। বহিঃস্কার অবধারিত। অথচ কারাবাসের মতো একরকম ঘড়ি ধরে রুটিনমাফিক বন্দি জীবন। একত্রে দলবদ্ধ হয়ে আড্ডা দেওয়া নিষিদ্ধ। যেখানে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নেই, আন্তরিকতা নেই। ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালোবাসারও কোনো কদর নেই। সবই নিমিত্তমাত্র। সেখানে টিকে থাকা গোঙ্গুর জন্য খুবই মুশকিল।

(দুই)

মানুষ পরিবর্তনশীল। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শুধুমাত্র শারীরিক আর মন-মানসিকতার পরিবর্তনই নয়, জীবনের রূপই বদলে যায় মানুষের। তদ্রুপ জ্ঞান-বুদ্ধির বিকাশে খানিকটা বোধগম্য হতেই একাকী নিঃসঙ্গতায় দেহ-মনে ক্লান্তি আর অবসাদে গোঙ্গুকে গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে ফ্যালে। যেদিন ওর অতীতের হাসি-কাঁন্না আর কোলাহলের আনন্দ মুখরিত দিনের অম্লান স্মৃতিগুলিকে কল্পনায় ফিরিয়ে এনে মরমে মরমে উপলদ্ধি করে, এ যেন এক অভিশপ্ত জীবন যাপন করছে। এক ধরণের নির্বাসিত জীবন। এদের হৃদয় এতো কঠোর। এতটুকু মায়া-দয়াও নেই। এর চেয়ে নিজের মায়ের হাজারটা বেতের বারিই বরং অনেক ভালো ছিল। আঘাত পেলেও স্নেহমিশ্রিত মায়ের কোমল পরশ, পিঠের ওপর মৃদু হস্ত সঞ্চালন, শরীরের ব্যাথা-বেদনা নিমেষে উধাও হয়ে যেতো। তার পর মুহূর্তে বুকে জড়িয়ে ধরে মা আমায় কত আদর করতো। কপালে গালে চুম্বন করতো।

ভাবতে ভাবতে অস্ফূট আর্তনাদ করে ওঠে গোঙ্গু,-‘মা, মাগো। তুমি কোথায় মা! কেন এতবড় শাস্তি আমায় দিলে মা! আমার জন্য একটুও কি তোমার প্রাণ কাঁদে না মা! এখানে আমার বড় কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে তোমায়! কবে আসবে মা আমায় নিতে!’

গোঙ্গু অনুভব করে, জীবন যেন থেমে গিয়েছে ওর। ক্লান্ত পথিকের মতো শরীরটাও যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। কোনো কাজেই মন লাগছে না ওর। সময় মতো নাওয়া-খাওয়া করেনা। কারো সাথে কথাবার্তাও বলতে ইচ্ছা করেনা। ভারাক্রান্ত মনে ক্লাসে চুপচাপ উদাস হয়ে বসে থাকে। হাসতেও যেন ভুলে গিয়েছে। সূর্য্য ডুবে গেলে চন্দ্রালোকিত মধ্যরাত্রির মতো গাঢ় নিস্তদ্ধতায় ছেয়ে যায় চারদিক। ক্রমশ ঘনিয়ে আসে অন্ধকার। হোষ্টেলের অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রিদের কারো সাড়া শব্দ পাওয়া যায়না। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত থাকে। ততক্ষণে বিশ্বব্রম্ভান্ড ঘুরতে ঘুরতে আবার সকাল হয়, দূপুর আসে। দূপুর গড়িয়ে সন্ধ্যার মধ্য দিয়ে রাত ফিরে যায় ভোরে। অথচ একইস্থানে অবস্থানরত গোঙ্গু, মা-বোনের শূন্যতায়, অভাববোধে সারাদিন বিষন্ন হয়ে থাকে ওর মন-মানসিকতা। হাহাকার করে ওঠে বুক। মা-বোনের জন্য ওর মন কাঁদে। প্রাণ কাঁদে। ঘুম হয়না রাতে। অগত্যা, স্মৃতিকাতর গোঙ্গু মনবেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে হাত-পা কুঁকড়ে সারারাত পড়ে থাকে বিছানায়।

কিন্তু মনে মনে বড্ড রাগ হয়, অভিমান হয় গোঙ্গুর। মনস্থির করে, মা-বোন কেউ দেখতে না এলে কোনদিন আর বাড়ি যাবে না। গোঙ্গু এমন কি অপরাধ করেছিল যে, ওর মুখদর্শণই করতে চায় না কেউ! আজ ও’ পরিত্যাক্ত, নিগৃহীত। শৈশবে প্রত্যেকেই কম বেশী অন্যায় অপরাধ করে থকে।
গোঙ্গুর মনে পড়ে, শৈশবের খেলার সাথী ঝন্টুও অত্যন্ত দুরন্ত ছিল। মা-বাবার অবাধ্য ছিল। ঘরের জিনিসপত্র অনিষ্ট করতো। ভাঙ্গ চূড় করতো। ছোটবোন পিঙ্কির সাথে সবসময় মারামারি করতো। ওর চুল ধরে টান দিয়ে দৌড়ে পালাতো। আর ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে নাকে কাঁদতো পিঙ্কি। কই নিষ্ঠুর নির্দয়ের মতো ঝন্টুর মা-বাবা ওকে তো চোখের আড়াল করে রাখেনি! বোডিং-স্কুলে ফেলে রাখেনি! ঘর থেকে দূর করে দেয়নি। হতভাগ্য গোঙ্গু তো ওর বাবাকে কোনদিন চোখেই দ্যাখেনি। মায়ের কাছে শুনেছে, ওর জন্মের বহু আগেই ইহলোক ছেড়ে পরলোকের বাসিন্দা হয়েছেন তিনি। তখন গোঙ্গু কি জানতো, ইহকাল পরকালের অর্থ কি! শুধু বুঝেছিল, পিতৃস্নেহ ভালোবাসা যার কপালেই জোটেনি, পিতৃত্বের উষ্ণ পরশ এবং তার মধুর সান্নিধ্য যে কোনদিনও পায়নি, তার জীবনের কিইবা মূল্য আছে! তাকে কেউ ভালোবাসে না। কিন্তু মায়ের জন্য গোঙ্গুর যে প্রাণ কাঁদে! দেখতে ইচ্ছে করে! দিদিদের মতো মাও কি ভুলে গিয়েছে গোঙ্গুকে?

কিন্তু সে খবর গোঙ্গু জানবে কেমন করে! বাড়ি থেকে বহিঃস্কার হওয়ার পর পাড়ায় উৎপাত উপদ্রপ হৈ-হুল্লোড় সব বন্ধ হয়ে গেলেও আকস্মিক পুত্র বিচ্ছেদে অন্নপূর্ণা দেবী রীতিমতো রোগগ্রস্থ হয়ে পড়েন। গোঙ্গুর নিত্যদিনের ব্যবহার্য জামা-কাপড়, স্কুলের ব্যাগ, ইউনিফর্ম, গোলাকৃতি পাথরের মারবেল, (যার জন্য প্রতিদিন ঝন্টুর সাথে ওর মারামারি হতো) ঘরে বাইরে চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা গোঙ্গুর স্মৃতিগুলি তাকে নিরন্তর কষ্ট দিতে থাকে। বিবেকে দংর্শন করতে থাকে। ফলে ক্রমে ক্রমে তিনি কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। অথচ প্রাত্যহিক জীবনে হৈচৈ চিৎকার চেঁচামিচি, কোন্দল অশান্তি থেকে মুক্তি পেতেই মাতৃস্নেহ বি ত হতভাগ্য গোঙ্গুকে তিনি চোখের আড়াল করে দূরে ফেলে রেখেছেন। কিন্তু তার অন্তারাত্মা একদিনও শান্তি পায়নি। নানা দুঃশ্চিন্তা দৃর্ভাবনায় অক্টোপাসের মতো তাকে আষ্টে-পাষ্টে ফিরে ধরে। তবু গোঙ্গুর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বুকের মাঝে পাথর চাপা দিয়ে সহে আছেন, ওর অন্ধকার জীবনে আলোর রস্মি ফুটে উঠবে বলে। সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে পৃথিবীর রূপ-রং যেমন বদলে যায়, তেমনি গোঙ্গুর জীবনেও একদিন পরিবর্তন আসবে! গোঙ্গু লেখাপড়া শিখে বড় হবে। মানুষ হবে। ওর জ্ঞান-বুদ্ধি বিকশিত হবে। সুমতি হবে। পাঁচটা ছেলের মতো ভালো-মন্দ বুঝতে শিখবে। নিজের পায়ে নিজস্ব মাটিতে দাঁড়াতে শিখবে। মায়ের ব্যথাটা গহীন অনুভূতি দিয়ে উপলদ্ধি করতে শিখবে।

কিন্তু পুত্রবিরহে কাতর, মুহ্যমান অন্নপূর্ণা দেবী তার একমাত্র পুত্র গোঙ্গুর চরম সফলতার কামনায় উচ্চাকাক্সিক্ষত স্বপ্ন দেখতে দেখতেই তিনি বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়বেন, তা কে জানতো!

একদিন হঠাৎ হৃদক্রিয়া বিকল হয়ে মহাপ্রয়াণ ঘটে অন্নপূর্ণা দেবীর। চলে গেলেন তিনি মায়ার সংসার ছেড়ে। যেদিন তার পাশে কেউ ছিলনা। সংসার আর ভাইয়ের খরচ চালাতে দুই দিদিই তখন হিমশিম খাচ্ছিল। চাকুরী নিয়ে দুজনেই ব্যস্ত। কিন্তু মাতারানী অন্নপূর্ণা দেবী অস্তগামী সূর্য্যরে মতো জীবনের অন্তিম সময়ের অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন, তা কেউ টের পায়নি। স্বপ্নেও ভাবেনি কেউ। অথচ সেদিন ভোর রাত্রিরেই অমঙ্গলের একটা সংকেত গোঙ্গু টের পাচ্ছিল মনে মনে। অহেতুক বুকের ভিতরটা ওর বারবার কেঁপে উঠছিল। একদন্ডও স্বস্তি পাচ্ছিল না।

সাধারণতঃ ছুটির দিনে একটু দেরীতেই ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস গোঙ্গুর। কিন্তু ঊষার প্রথম প্রহরে ঘুমটা কেন যে হঠাৎ ওর ভেঙ্গে গেল, ভেবেই পায়না। জানালা দিয়ে চেয়ে দ্যাখে, গুমোট মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। একটু বাতাস নেই। পশু-পক্ষীর কলোরব নেই। চারদিক নীরব, গাঢ় নিস্তব্ধ। যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীটা। মনে হচ্ছে, এক্ষুণিই প্রলয়ঙ্করী বেগে ছুটে আসবে প্রকান্ড ঝড়-তুফান। ছড়িয়ে পড়বে দ্বিগবিদিকে।

মুহূর্তে বিষাদে ছেয়ে যায় গোঙ্গুর শরীর আর মন। তবু ছুটির দিন, রবিবার, কলেজ যাবার তাড়া নেই। তাই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ার কোনো তাগিদবোধ করছে না। কিন্তু জানালার কার্ণিশে বসে থাকা পাতিকাকটা যেন কোনো দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে এসেছে। কানে তালা লাগিয়ে একটানা শ্রুতিকটূ কাঁ কাঁ শব্দে গোঙ্গু বিচলিত হয়ে ওঠে। মায়ের জন্য মনটা ওর কেমন করছে। থেকে থেকে মোচড় দিয়ে উঠছে। খাঁচার বন্দী পাখীর মতো গোঙ্গু ছটফট করতে থাকে। ইচ্ছে হচ্ছে দৌড়ে মায়ের কাছে চলে যেতে।

গোঙ্গুর নিরবিচ্ছিন্ন মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। কিছুতেই স্বস্তি পায়না। অবশেষে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বোডিং-স্কুলের সকল রীতি-নীতি লঙ্ঘন করে উষার প্রথম সূর্য্য ওঠার পূর্বেই হষ্টেলের বিশাল প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে আসে বাইরে। পিছন ফিরেও তাকায় না। সরাসরি গাড়িতে চেপে মরিয়া হয়ে ছুটে আসে মায়ের কাছে। কিন্তু কোথায় মা? নজরে পড়ছে না তো কোথাও! যার গলার আওয়াজ সারাপাড়া রমরম করতো। আজ তারই কোনো সারাশব্দ নেই!

আশংক্ষায় বুকটা ধড়াস করে ওঠে গোঙ্গুর। ধুক্ ধুক্ করছে। গোঙ্গু থমকে দাঁড়ায়। দূর থেকে দ্যাখে, ওদের বাড়ির প্রাঙ্গনে অগণিত মানুষের ভীঁড়। তার ভিতর থেকেই হাওয়ায় ভেসে আসছে, মরা কাঁন্নার শব্দ। সবাই বিমূঢ় ম্লান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখে জল। ততক্ষণে বুঝতে কিছু আর বাকী থাকেনা।

গোঙ্গু দূর থেকেই ‘মা’ বলে আর্তচিৎকার করতে করতে ছুটে আসে। দুইহাতে বুক চাপড়াতে থাকে। মৃত মায়ের পা-দু’খানি বুকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে ওঠে, ‘মা, মাগো! আমার ওপর অভিমান করে তুমি চলে গেলে মা! ক্ষমা চাইবার সুযোগ পর্যন্ত দিলে না! চোখ খোলো মা, দ্যাখো, তোমার গোঙ্গু ফিরে এসেছে। তোমার গোঙ্গু এখন বড় হয়ে গিয়েছে মা। আর কক্ষনো তোমার অবাধ্য হবে না। তোমায় কষ্ট দেবেনা। তুমি কেন একটিবার আমায় জানালে না মা, মাগো! শেষবারের মতো তোমার কোলে মাথা রেখে কেন আমায় কথা বলার সুযোগ দিলে না মা, মাগো!’
বলে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের প্রাণহীন নিথর দেহের উপর আঁছড়ে পড়ে গোঙ্গু।

মায়ের মৃতদেহের উপর কতক্ষণ আছড়ে পড়েছিল, কোনো হুঁশ-জ্ঞান ছিলনা গোঙ্গুর। একসময় হঠাৎ চমকে ওঠে। লোমহর্ষক হয়। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। জেগে স্বপ্ন দেখছে না কি ও’!
গোঙ্গুর মনে হোল, মাতারানী অন্নপূর্ণা দেবী ওর কানে কানে ফিস্ ফিস্ করে কি যেন বলছে।

মুহূর্তে কাঁন্না থেমে যায় গোঙ্গুর। যমের দুয়ারে কাঁটা পড়েছে ভেবে ভিতরে ভিতরে একরাশ আনন্দ আর সংকটের সংমিশ্রণে মুহূর্তের জন্য স্বম্ভিত হয়ে যায়। রুদ্ধ হয়ে যায় ওর কণ্ঠস্বর। ইতিমধ্যে পলকমাত্র দৃষ্টিপাতে স্থির হয়ে যায় ওর চোখের দৃষ্টি। শোনে কান পেতে। স্ববিস্ময়ে বড় বড় চোখ পাকিয়ে মায়ের মুখপানে চেয়ে থাকে।

হ্যাঁ, গোঙ্গু ঠিকই শুনেছে। ক্ষণপূর্বে যাকে মৃত বলে ঘোষনা করা হয়েছিল, তিনিই পাড়া-প্রতিবেশী সকলকে অবাক করে দিয়ে কাঁন্নাজড়িত কণ্ঠে ক্ষীণ মৃদু শব্দে বলছেন,-‘তুই এসেছিস বাবা। আমার বুকে আয়। এই অভাগিনী মায়ের বুকখানা কতকাল শূন্য হয়ে আছে বাবা। আমার বুকে আয়। তরে দুচোখ ভইর‌্যা দেখি।’
বলে গোঙ্গুর কপালে গালে অবিরত চুম্বন করতে থাকে অন্নপূর্ণা দেবী।

ক্ষণিকের প্রত্যাশীত আনন্দে গোঙ্গু উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। নিজের কানদুটোকে কিছুতেই যেন বিশ্বাস হয় না। এমন কলিকালে মৃতব্যক্তি প্রাণ ফিরে পায় কখনো? এ কেমন করে সম্ভব হোল! একেবারে মিরাকলের মতো। স্বয়ং যমরাজ বোধহয় গোঙ্গুর বিলাপ শুনে বিগলিত হয়ে অন্নপূর্ণা দেবীর প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছেন।

নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় গোঙ্গুর। অসীম আনন্দে মায়ের পা-দুটো বুকে জুড়িয়ে ধরে। মনের মধ্যে পূঞ্জীভূত সমস্ত গ্লানি, মায়ের প্রতি অভিমান, অভিযোগ যা ছিল, সব নিমিষে দূরীভূত হয়ে যায়। এ যেন শাপে বর! মাত্র কয়েক মুহূর্তের ব্যবধান। মেঘলা আকাশের বুক চিরে যেমন সূর্য্য উদয় হয়, ঠিক তেমনই রায়চৌধুরী পরিবারে আচমকা দুঃখের কালো ছায়া সরে গিয়ে উজ্জ্বল আলোয় ভরে ওঠে।

এই তো মানুষের জীবন। দু’দিনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কাঁন্না, আনন্দ-বেদনার জীবন। শুধু মায়ার খেলা। কিন্তু একজন গর্ভধারিনী মায়ের বুক উজার করা আদর-স্নেহ মমতা-ভালোবাসা? সেও কি মায়ার খেলা? না, মোটেই নয়। সেটা হলো মাতৃত্বের একাত্ম বন্ধন। আপন গর্ভে লালিত সন্তান আর মায়ের নারীর চিরন্তন বন্ধন। সে এক অবিচ্ছেদ্য গভীর টান। যা কখনো ছিন্ন হয়না। আর হয়না বলেই মায়ের নামকরণে গোঙ্গু নির্মান করে কারুকার্যময় বিশাল মন্দির। মন্দিরের চূড়ায় শ্বেতপাথরে খোদাই করা বিরাট অক্ষরে লেখা, ‘মাতৃ মন্দির অন্নপূর্ণা।’

যেখানে সকাল সন্ধ্যে প্রতিদিন দুইবেলা ফুল-বেলপাতা চড়িয়ে, ধূপ-ধূনো জ্বালিয়ে, কাঁসা-ঘন্টা বাজিয়ে, কায় মন বাক্যে মায়ের দীর্ঘায়ূ কামনা করে গোঙ্গু।

সমাপ্ত

যুথিকা বড়য়া : কানাডার টরন্টো প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন