সকালের সোনাঝরা রৌদ্রে ঘুম ভাঙ্গে নিপার। চোখ বন্ধ করেই সে চিন্তা করে স্কুলে যাওয়ার আগে তার কি কি কাজ বাকি আছে। আলসেমিতে তার উঠতে ইচ্ছে করে না। তা সত্ত্বেও তাকে উঠতেই হয় বিছানা ছেড়ে। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে চোখ পড়তেই দেখে তার বহু কাঙ্খিত সাদা গোলাপটি। খুশিতে তার গাইতে ইচ্ছে করে ‘বলিও আমার গোলাপ বালা বলিও আমার গোলাপ বালা।’ 

নিপা খুব একটা খারাপ গায় না। যদিও কখনো তার গান শেখা হয়নি। গোলাপটি হাত দিয়ে স্পর্শ করতে সে দৌড়ে নীচে নেমে আসে। পরম মমতায় ছুঁয়ে দেখে ফুলটি। ফুলের সঙ্গে কথা বলে। বিগত জীবনের কথা। অনাগত ভবিষ্যতের কথা। ঘুম ভেঙেই ফুলের স্পর্শ তার মনকে ফুরফুরে করে দেয়। নিপা চায়, সারাটা দিন এভাবেই কাটুক। মনটাও হয়ে উঠুক গোলাপ ফুল। সুগন্ধ ছড়াক সবার মাঝে। পবিত্রতার স্পর্শ বিলিয়ে দিক চারদিকে। 

নিপাকে স্কুলে যেতেই হবে। তাই ফুলের স্পর্শ নিয়ে ছোটে রান্না ঘরে। তার হাত চলে মেশিনের মতো। তার চিন্তা পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য। সে সকালটায় নিজের জন্য পাঁচ মিনিট সময়কেও অনেক বিশেষ কিছু মনে করে। সমস্ত কাজ গুছিয়ে স্বামী সন্তানদের যার যার গন্তব্যে পাঠিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নিজেকে মুহূর্তকালের মধ্যে গুছিয়ে নিয়ে  গাড়িতে উঠে বসে ড্রাইভিং সিটে। স্টার্ট দেয়। সকালে রাস্তাটা ফাঁকা থাকে। এ জন্য গন্তব্যে পৌঁছতে বেশি সময় নষ্ট করতে হয় না তার। পথে যেতে যেতে চারদিকে গাছপালার সবুজের বিস্তার। পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। বড় কোনো যানজট নেই কোথাও। সাঁই সাঁই গাড়ি চালায় নিপা। সকালে গোলাপের স্পর্শ আর পথে প্রকৃতির সবুজ তার মনকে পুলকিত করে তোলে। 

নিপা গাড়ি চালায় আর গান গায়- ‘ফুলে ফুলে ঢোলে ঢোলে বহে কিবা মৃদু বায়…’। চারদিক তার কাছে কেমন যেন বর্ণিল মনে হয়। প্রকৃতি মানুষের মনকে এত বদলে দিতে পারে!-  ভাবে নিপা।  

গান শেষ করে একা একাই বলে- প্রকৃতি পারে মানুষকে পাল্টে দিতে। কিন্তু প্রকৃতির কাছ থেকে মানুষের নেয়ার সেই মানসিকতা থাকতে হয়। এ জন্যই কেউ কবি, কেউ গল্পকার।  

নিপা কাজ করে একটি  কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। যখন সে স্কুলে পৌঁছে তখন বাচ্চারা প্লেগ্রাউন্ডে। নিপাকে দেখামাত্রই বাচ্চাগুলি দৌড়ে আসে। জড়িয়ে ধরে তাকে। তাদের মুখে প্রাকৃতিক, নিষ্পাপ হাসি। ওই গোলাপ ফুলের মতো। সে হাসিতে ভালবাসা আছে। আকুতি আছে। নিপার চারপাশে এতগুলি কচিমুখ দেখে তার পুরোটা দিনই যেন আনন্দে ভরে উঠে। সারাদিন এই বাচ্চাগুলোর আবেগ উচ্ছ্বাস, ঝগড়া, কান্না, নালিশ আর বিচার-আচার করে করে সময় কাটে তার। এর মধ্যে অন্য রকম এক আনন্দ উপভোগ করে নিপা। তার মনে হয়, অ্যানজেলদের সঙ্গে সময় কাটছে তার। 

খেলার মাঠে অলিভিয়া দৌড়ে এসে বলে- মিস নিপা ‘দিলান’ আমাকে ধাক্কা দিয়েছে। অথবা আমার খেলনা নিয়ে গেছে। 

 দিলানকে কাছে ডাকেন নিপা। বলেন  ‘তুমি ওকে ধাক্কা দিয়েছো? খেলনা নিয়েছো?’

দিলান হ্যাঁসূচক  মাথা নাড়ে।

তিনি বলেন ‘আমরা কি একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিতে পারি?’

দিলান বলে ‘না’। 

নিপা তাকে বলেন, ‘হাত শুধু সাহায্যের জন্য। বন্ধুর সাথে খেলার জন্য। তুমি কি আর ধাক্কা দিবে?’

দিলান যেন কাঁচা সোনা। বুঝে ফেলে সে অন্যায় করেছে। সেটা বুঝতে পেরে সে বলে- ‘না’। সে অলিভিয়ার হাত ধরে খেলতে চলে যায়। এমন বিচার করতে হয় সারাদিন। নিপা যেন ওদের এক বিশাল আশ্রয়স্থল। এই যে দিলান, ওদের জীবনকে সাজিয়ে দিতে, জীবনের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতে নিপার স্বর্গীয় সুখ হয়। সে মনে করতে থাকে, এতগুলো কচি বাচ্চাকে সে সঠিক পথের নির্দেশনা দিচ্ছে। তাই এই চাকরিকে তার কাছে চাকরি মনে হয় না। মনে হয়, মানবতার সেবা করছে। তাই এতটা সজীব থাকে নিপা।

এ জন্যই কোন বাচ্চা স্কুলে না এলে নিপার খুব চিন্তা হয়। অথবা কোন বাচ্চা ছুটিতে দূরে কোথাও গেলে নিপা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে তার ফিরে আসার জন্য । আজ স্কুলে জনি আসেনি। নিপা ভাবলো হয়ত সে অসুস্থ। কিছুক্ষণ পর ডাইরেক্টর তাকে রুমে নিয়ে জানালেন কয়েকদিন জনি আসতে পারবে না। কারণ, তার বাবা-মা সেপারেশনে যাচ্ছে। এজন্য বাচ্চাটার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। তার বাবা মায়ের কথা নোট রাখতে হবে-  তারা কি চায়! 

কয়েকদিন পর জনি যখন স্কুলে ফিরে এলো তখন অফিস থেকে দিন নির্ধারণ করে দেয়া হলো-  জনিকে স্কুলে বাবা ও মা কে কয়দিন স্কুলে দিয়ে যাবে বা নিতে আসবে। তাদের বাইরে আর কেউ স্কুলে আসবে কিনা। নিপার খুব খারাপ লাগছিল বাচ্চাটার জন্য। সে সব সময়ই জনির বাবা-মাকে খুব হ্যাপী  কাপল ভাবতো। জনি কিছু বুঝতে পারে না, কি ঘটতে যাচ্ছে। প্রথম একদিন দুইদিন সে স্বাভাবিকই ছিল। এরপর দেখা যায় জনি মাঝে মাঝেই অকারনে কান্না করে। চুপচাপ থাকে। অন্য বাচ্চাদেরকে মারতে যায়। খেলনা আছড়াতে থাকে। বন্ধুদের কে কোন জিনিষ বা খেলনা শেয়ার করে না। বাচ্চাটার মধ্যে অনেক রকম জটিলতার সৃষ্টি হতে থাকে। 

  জিয়ানা আর জেরিমি ( জনির বাবা বা মা ) তাকে পিকআপ করার সময় টিচারের কাছে জানতে চান, সে কেমন ছিল! কি করে সারাদিন? শরীরে কোন দাগ আছে কিনা? স্কুলে টিচার কোন অব্জারভেশন রিপোর্ট রাখছে কিনা?

নিপা জানে তারা কেন এত সব তথ্য সংগ্রহ করে।   জনিকে শুধু তাদের একজনের কাছে রাখতে পারার অধিকার আদায় করতে। 

স্কুলে টিচারদেরও জনির যে কোন বিষয়ে ভীষণ সচেতন থাকতে হয়। বাবা মা যেই  তাকে ড্রপ করুক তার শরীরে কোন মার্ক বা দাগ আছে কিনা দেখে তদের সাথে কথা বলে রিপোর্ট রাখতে হয়। জেরিমি আর জিয়ানার প্রশ্নে নিপা মিথ্যা বলতে পারে না। সে কোন এক সময়ে আসেপাশের পরিবেশ দেখে তাদের দুজন কে আলাদা আলাদা ভাবেই বলে, “ তোমাদের পারিবারিক সমস্যা কি তা আমি জানি না। আমার তোমাদের কোন বিষয়ে কথা বলাটাও শোভন না। কিন্তু তোমাদের ফুটফুটে বাচ্চাটার কিন্তু বিভিন্ন রকম মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ও তোমাদের দুজনকেই খুব মিস করে। তোমরা যদি ম্যারেজ কাউন্সিলরের সাথে কথা বল আমার মনে হয়  তিনি তোমাদের সমস্যা গুলো কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারেন।” নিপা মনে থেকে চায় বাচ্চাটার অবস্থা বিবেচনা করে যদি তারা সিদ্ধান্ত পাল্টান!  

এভাবেই দিন যেতে থাকে। জনি যখন কান্না করে নিপা তাকে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। গল্প শোনায়। জনিকে খেলনা শেয়ার করতে শেখায়। জনি তার টিচারকে একজন বন্ধু মনে করে। এমনই একদিন বিকেলে বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল নিপা। হঠাৎ দেখে জনির বাবা-মা একসাথে ক্লাশে প্রবেশ করছেন। নিপা অবাক হয়ে জানতে চাইলো-  আজ তো জিয়ানার  জনিকে নেয়ার কথা। মি. জেরিমি তুমি কি ভুল করে এসেছো ওকে নিতে? 

জনির বাবা উত্তর দেয়ার আগেই জিয়ানা উত্তর দিলেন। বললেন, আজ জনি আমাদের দুজনের সঙ্গেই বাসায় যাবে। কারণ আমরা আর আলাদা থাকছি না। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মিস। আমাদের ভুলটা ভাঙ্গিয়ে দেয়ার জন্য। আমাদের কারণে জনি অনেক কষ্ট পাচ্ছিলো। শুধু ওর কথা চিন্তা করে আমরা আমাদের মত পাল্টেছি।

জনি ওর বাবা-মায়ের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। আকাশের সূর্যটা হেলে পড়েছে। নিপা দূর থেকে দেখছে ওদের চলে যাওয়া। ওর মনে হয় এমন সুন্দর দৃশ্য অনেকদিন দেখা হয় না।পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর আর কোন দৃশ্য যেন হতে পারে না। সে যেন ধরনীর বুকেই এক স্বর্গ দেখতে পাচ্ছে । দেখতে দেখতে আনন্দে চোখ ভিজে ওঠে  তার।

(ছবি: সৌজন্যে Medium)

১ মন্তব্য

  1. আপা
    আবারো একটি চমৎকার কাহিনীর জন্য অনেক ধন্যবাদ।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন