মানসিক স্বাস্থ্য একজন মানুষের সার্বিক স্বাস্থ্য কাঠামোর একটি অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য অংশ। সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও  ভালো থাকার কোনো বিকল্প নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, “Health is a state of complete physical, mental and social well-being and not merely the absence of disease or infirmity”। একইভাবে মানসিক স্বাস্থ্য মানে শুধুমাত্র মানসিক রোগের বা মানসিক প্রতিবন্ধিতার অনুপস্থিতি নয়। মানসিক স্বাস্থ্য হচ্ছে ভালো থাকার এমন একটি অবস্থা বা পর্যায় যেখানে একজন মানুষ তার নিজের সামর্থ্যকে কাজ লাগাতে পারে, সব রকমের চাপ সহজভাবে মোকাবেলা করার মানসিকতা বজায় রাখে, ফলপ্রসূভাবে কাজ করতে পারে এবং একই সাথে  নিজের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনেও অবদান রাখতে পারে। আপাত সাধারণ বিষয় মনে হলেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজের সুবাদে এই বিষয়ে কিছু ভিন্ন ধারণা এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ হয়েছে। যেমন কিছু কিছু মানুষকে দেখি যারা শারীরিক সুস্থতার বিষয়ে সজাগ থাকলেও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে আমলে নিতে চান না। সচেতনতার অভাব,  ব্যক্তিগত ধারণা, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হবার ভয়, ঔষধের উপর নির্ভরশীল হবার আশংখায় মানসিক অসুস্থতার অস্তিত্বকেই তারা অনেকে অস্বীকার করে থাকেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর পরিণতি হয় ভয়াবহ। শুরুর দিকে গুরুত্ব না দেয়া বা অস্বীকার করার কারণে সমস্যা প্রকট হতে থাকে। অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসা শুরু হয়। আবার দেরিতে চিকিৎসা শুরু করার কারণে অসুস্থ মানুষটিকে সুস্থ, স্বাভাবিক করার কাজটিও হয়ে পড়ে সময় সাপেক্ষ। অথচ শারীরিক অসুস্থতা হলে এর Diagnosis এবং Treatment কোনোটার জন্যই কেউ বসে থাকেন না। এই বিষয়ে চমৎকার মন্তব্য করেছেন  ‘Deal or No Deal’ টিভি শো  খ্যাত বিখ্যাত উপস্থাপক ও কানাডিয়ান কমেডিয়ান Howard Michael Mandel। নিজেও ‘Depression’ ও ‘Obsessive Compulsive Disorder ‘ কাটিয়ে আসা Mandel এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “There isn’t anybody out there who doesn’t have a mental health issue, whether it’s depression, anxiety, or how to cope with relationships. Having OCD is not an embarrassment anymore – for me. Just know that there is help and your life could be better if you go out and seek the help”।

মানসিক স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ এবং আসক্তি আক্রান্ত মানুষদের জন্য টরোন্টোতে বিভিন্ন রকম সেবা কার্যক্রম চালু আছে। এর বেশিরভাগই বিনামূল্যের সেবা। একটি উদাহরণ দিলে হয়তো বিষয়টি পরিষ্কার বুঝা যাবে। ধরা যাক দবির সাহেবের  (কল্পিত নাম) জন্ম ও বেড়ে উঠা টরোন্টোতে। যেকোনো কারণেই হউক বিষন্নতা তীব্রভাবে জেঁকে বসেছে তার জীবনে। তার ফ্যামিলি ডাক্তারের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলাতে ডাক্তার তাকে একজন Psychiatrist এর জন্য রেফার করলেন কোনো এক হাসপাতালে। একজন Psychiatrist পেতে দবির সাহেবকে হয়তো দুই থেকে ছয়মাস অপেক্ষা করতে হতে পারে। এই সময় পর্যন্ত উনি কি বসে বসে Psychiatrist এর জন্য দিন গুনবেন ? উত্তর হচ্ছে, না । এই সময়টাতে দবির সাহেবকে সহায়তা করার জন্য কিছু সংগঠন আছে যেখানে একজন Psychiatrist সপ্তাহে একদিন বসেন দবির সাহেবের মতো অবস্থার মানুষকে সহায়তার জন্য। Sound Times এরকম একটি সংগঠন  যেখানে প্রত্যেক বুধবারে একজন Psychiatrist বা মনস্তত্ত্ববিদ বসেন বিনামূল্যে মনস্তাত্ত্বিক সেবা দেবার জন্য। হয়তো সেই মনস্তত্ত্ববিদ তাকে ঔষধের পাশাপাশি counselling নিতে বললেন। প্রতি সেশনে ৯০-১৫০ ডলার খরচ করে কাউন্সেলিং নেয়ার আগ্রহ, সময় এবং সামর্থ্য কোনোটাই হয়তো দবির সাহেবের নেই। তার জন্য রয়েছে Woodgreen Community Service বা Yonge Street Mission এর মতো সংগঠন যেখানে প্রতি মঙ্গল, বুধ এবং বৃহস্পতিবারের “ফ্রি ওয়াক ইন কাউন্সেলিং” কর্মসূচিতে কোনো এপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই যেকেউ কাউন্সেলিং সেবা পেতে পারেন। এসব মানুষদের কর্মসংস্থানে সহায়তার জন্য রয়েছে বিশেষ কিছু সংগঠন, যেমন Canadian Council on Rehabilitation and Work। মদ এবং মাদকাসক্তি নিয়ে যারা সমস্যায় আছেন তাদের সহায়তার জন্য রয়েছে Rapid Access Addiction Medicine বা RAAM নামের কিছু ড্রপ ইন ক্লিনিক।  টরোন্টোতে নয়টি হাসপাতাল এবং একটি কমিউনিটি এজেন্সিতে এই ড্রপ ইন ক্লিনিকগুলো রয়েছে যেখানে আসক্তি সংক্রান্ত এসেসমেন্ট, ফার্মাকোথেরাপি, কাউন্সেলিং এবং রেফারেলের সহায়তা প্রদান করা হয় । কোনো রেফারেল বা এপয়েন্টমেন্ট এর প্রয়োজন নেই, শুধু ক্লিনিকের নির্ধারিত দিন এবং সময়ে উপস্থিত থাকতে হবে। ৯১১ ছাড়াও Crisis Services এর জন্য রয়েছে  “Distress Centres of Greater Toronto 416-408-4357”,  Gerstein Crisis Centre 416 929 5200 যেখানে ২৪ ঘন্টা জরুরি  মানসিক  স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হয়।  যারা ফোনের পরিবর্তে অনলাইন এবং টেক্সটে যোগাযোগ করতে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তাদের জন্য আছে ONTX – Ontario Online and Text Crisis Services।  প্রয়োজন হলে 258258  নম্বরে টেক্সট করে অথবা  www.dcontario.org এ ঢুকে  সংকটকালীন  সেবা পেতে পারেন। মোটকথা  মানসিক  স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ এবং আসক্তি আক্রান্ত মানুষদের জন্য রয়েছে এই রকম অসংখ্য কার্যক্রম যার বিস্তারিত আলোচনা হয়তো এই সীমিত পরিসরে সম্ভব নয়।

আমাদের বাঙালি সমাজে মানসিক অসুস্থতা এখনো ‘কেউ জেনে ফেলবে’ ভেবে চুপিসারে, ফিসফিসিয়ে বলার মতো একটি বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই ধারণা বদলাতে না পারলে ক্ষতিগ্রস্থ হবো আমরাই। যেকোনো সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ হচ্ছে সমস্যাকে সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা, মেনে নেয়া এবং দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে তা সমাধানের চেষ্টা করা । আমরা খুব সৌভাগ্যবান এজন্য যে আমরা এমন এক শহরে বসবাস করি যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক চ্যালেঞ্জ এর ডায়াগনসিস এবং ট্রিটমেন্ট দুটোই বিনা পয়সায় করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত এসব মানুষকে সহায়তার জন্য রয়েছে অসংখ্য কর্মসূচি ও সংগঠন। এতো কিছু থাকার পরেও যদি  বিনামূল্যের এসব সেবা আমরা নিতে না পারি, সেটা একান্তই আমাদের ব্যর্থতা। আবারো স্মরণ করি Howard Mandel কে,  “Just know that there is help and your life could be better if you go out and seek the help” । আসুন সবাই ভালো থাকি, ভালো রাখার চেষ্টা করি আশেপাশের সবাইকে।


সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন