কালের প্রবাহে নয় মাস সময় ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র, অতি তুচ্ছ, নগন্য। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় কালের সাক্ষী হয়ে আছে এই নয় মাস। এই নয় মাসে বাঙালী জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হয়েছে। একথা অজানা নয় যে, নয় মাস সময়ে পাকিস্থান ত্রিশ লক্ষ নিরীহ মানুষ হত্যা; চার লক্ষ নারী ধর্ষন (সরকারী হিসাব মতে দুই লক্ষ); হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে মুসলিম ধর্মে রুপান্তর, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ সহ নানাবিধ মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত। এই নারী নির্যাতন এবং গণহত্যা সবই ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ডায়েরীতে লিখেছিল, “ Paint the green of East Pakistan Red.” এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলছেেি, “ Kill three million of them and the rest will eat out our hands”.

জুলফিকার আলী ভূট্টো এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মধ্যে ২৫ লক্ষ হত্যা করলে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন ক্ষতি নয় এবং এতে সকল সমস্যার সমাধান সহ পাকিস্তান অখন্ড থাকবে। এবং তাদের এই পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই তারা ১৯৭১ এ ত্রিশ লক্ষ মানুষ হত্যা করে।

ইয়াহিয়া খান ফেব্রুয়ারী মাসের তৃতীয় সপ্তাহে জুলফিকার আলী ভূট্টোর সাথে পরামশর্ করে সেনা প্রধান হামিদ খানকে পূর্ব পাকিস্তানে সেনা অভিযানের জন্য প্রস্তুত হতে বলে। এই সেনা অভিযানের নাম ছিল অপারেশন সার্চ লাইট। হামিদ খান ও টীক্কা খান বিশ শে মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের অনুমোদন দেয়। ২৫ শে সন্ধ্যা ৭:৩০ এ গোপনে ঢাকা ত্যাগ করার আগে ইয়াহিয়া গণ হত্যার নির্দেশ দিয়ে যায়। পাকিস্তান গর্ভনরের উপদেষ্ঠা জেনারেল রাও ফরমান আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং হিন্দু অধ্যুাষিত পুরানো ঢাকায় সেনা অভিযান চালানোর আদেশ নামা দেয়। রাত ১২টার আগে ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনারা জীপ আর ট্রাকে করে শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তারা ঝাপিয়ে পড়ে নিরীহ জনগণের উপর। কামানের গোলায় আগুন জ্বলতে থাকে চারিদিকে। মাটারের শেল, মেশিন গান আর মূমুর্মুহ গোলাগুলির শব্দে ভারী হয়ে উঠে বাতাস। পাকিস্তানী সেনারা প্রথমে ব্রিটিশ কাউন্সিলে পাহাড়রত ই.পি.আর গাডর্দের হত্যা করে এরপর তারা তৎকালীন ইকবাল হলে ঢুকে অবিরাম বুলেট, কামান ও গ্রেনেড ছুড়ে ২০০ জন নিরপরাধ ছাত্রকে হত্যা করে এবং উক্ত হলের কর্মচারীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লাউঞ্জে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। ইকবাল হলের পর উত্তর ও দক্ষিনের গেট দিয়ে পাক সেনারা প্রবেশ করে জগন্নাথ হলে। হিন্দু ছাত্রাবাস হওয়াতে জগন্নাথ হলের উপর তাদের আক্রোশ ছিল আরো বেশী। হলের ছয় থেকে সাত শত আবাসিক ছাত্রকে হত্যা করে তারা। রাত শেষে ভোরের আলোয় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী হলের বাকী আরো ছাত্র, কর্মকর্তা, কর্মচারী সহ অন্যান্যদের দিয়ে হলের সামনের মাঠে গর্ত করায়। আশে পাশের লাশ নিয়ে এসে গর্তে ফেলানোর পর সারিবদ্ধ ভাবে দাড়ঁ করিয়ে সবাইকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। রাতের প্রথম প্রহরেই পাকিস্তানী সেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক আনোয়ার পাশা, হলের প্রধ্যোক্ষ ড: গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক ফজলুর রহমান, শরাফত আলী, জ্যোতিময় গুহ ঠাকুরতা, ভূতত্ব বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মুকতাদির গণিতের অধ্যাপক এম আর খাদিম, হলের আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য সহ নয়জন শিক্ষক ও তাদের আত্মীয় স্বজনকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। ২৫শে মার্চের সেই রাতে রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও রক্ষা পায়নি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাত থেকে। হলে আগুন ধরিয়ে দিলে ছাত্রীরা হল থেকে দৌড়েঁ বের হবার সময় মেশিন গান দিয়ে অবিরাম তাদের উপর গুলি বর্ষন করা হয়। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় অনেককে। আত্ম সম্মান বাঁচাতে অনেক ছাত্রী ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্ম হত্যা করেছিলেন। তারপরও শেষ রক্ষা হয় নি। সেই রাতে অনেক ছাত্রী পাক সেনাদের অত্যাচারের স্বীকার হয়েছিলেন। নরপিচাশেরা ফ্যানের সিলিং এ ধর্ষিত নগ্ন মেয়েদের মৃতদেহ ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছিল। পাক সেনারা হল চত্ত্বরে হলের কর্মকর্তাদের নির্মম ভাবে হত্যা করে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ক্যাম্পাস নয়, ক্যাম্পাসের আশেপাশের কলাভবন সংলগ্ন গুরু দুয়ারা নানক শাহী মন্দির, রমনা কালি মন্দির, শহীদ মিনার সংলগ্ন রমনা শির মন্দির এলাকা আক্রমন করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানীরা। রমনা কালি বাড়ি মানুষের রক্তের স্রোতে লাল হয়ে উঠে। গভীর রাতে রমনাকালী মন্দির ও আশ্রম ঘেরাও করে পাক সেনারা। এরপর সার্চ লাইটের আলোয় বন্দুকের মুখে খুঁজে বের করে সবাইকে মন্দিরের সামনে এসে দাঁড় করিয়ে প্রায় ৮৫ থেকে ১০০ জনকে গুলি করে হত্যা করে। মন্দিরের পুরোহিতের পরিচয় পেয়ে তাকে জোর করে কলেমা পড়ানো হয়। পড়ে বেয়নেট দিয়ে পেট চিরে ফেলে গুলি করে হত্যা করে। সবশেষে ভোর চারটার পাক সেনারা মন্দির ত্যাগের সময় বেশ কয়েকজন তরুনীকে ধরে যায়। পরবর্তীতে যাদের আর ফিরে পাওয়া যায় নি। পুরানো ঢাকার শাখারী বাজার, তাঁতী বাজার, নয়া বাজার সহ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা গুলোতে বিভৎষ হত্যা কান্ড চলে। এলাকাবাসীকে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে পাক সেনারা। এরপর ট্যাংক চালিয়ে রিকয়েলস রাইফেলের গুলিতে পেট্রোল ঢেলে কিংবা পাউডার ছিটিয়ে বাড়ি ঘর ধ্বংস করা হয়। রেললাইন আর রাস্তার পাশের বস্তির মানুষেরা আগুনে পুড়ে ছাই হয়। ২৫ শে মার্চের সেই রাতে কেবলমাত্র বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক কিংবা সাধারণ মানুষ নয়, বাঙ্গালি নিরাপত্তাকর্মী সেনাবাহিনী, ই.পি.আর, পুলিশ হত্যা করাও ছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য। তাই তারা একই সাথে ঢাকার পিলখানায়, রাজার বাগ পুলিশ লাইনে, চট্টগ্রামের ইবিআরসি সহ সারা দেশের সামরিক আধাসামরিক সেনাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এক রাতেই ঢাকা ও তার আশের এলাকাতে প্রায় এক লক্ষ নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটে। অপারেশন সার্চ লাইটের বাঙ্গালী নিধনের এই হত্যা যজ্ঞ ঢাকা শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ে রাজশাহী, যশোর, খুলনা, রংপুর, সৈয়দপুর, কুমিল্লা, সিলেট ও চট্টগ্রামে। দেশের এমন কোন স্থান নেই, যেখানে গণ হত্যা ঘটেনি। শহর ও গ্রাম অ লের হিন্দু প্রধান এলাকা ছিল পাকিস্তানী সেনাদের আক্রমনের লক্ষ্য বস্তু। ১৯৭১ এর ২০ শে মে খুলনার চুকনগরে ১০ হাজার নিরীহ মানুষ হত্যা করে পাক সেনারা।

এদেশের মাটিতে পাকিস্তানী সেনা বাহিনী নির্যাতন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে পোল্যান্ড নাজি বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার চাইতেও ভয়ঙ্কর ছিল । ৭১ সনে কিশোরগঞ্জের বরইতলা গ্রামে এবং সকালে সাত/ আটশ মানুষের একজনের বাহু অন্যজনের সাথে বেঁধে রেললাইনের উপর বসিয়ে দেয় এবং ত্রিশ কেজি ওজনের বিশেষ ধরনের শাবলের আঘাত প্রত্যেকের মাথা চুর্ণ বিচূর্ন করে ফেলা হয়। তারপর তাদের উপর ব্রাশ ফায়ার করা হয়। এরপর ও যারা সামান্য বেঁচে ছিলেন তাদের বেয়নেট চার্জে হত্যা করা হয়।
১৩ই জুন সৈয়দপুর শহরের কাছে গোলাহাটে পাক সেনারা ১৫০ জন লোককে তাদের পরিবার সহ ভারতে পৌছে দেবার নাম করে স্থানীয় রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে আসে। ট্রেনের ৪টি বগির পেছনের দুটিতে নারী ও শিশু এবং সামনের দুটি বগিতে পুরুষদের তোলা হয়। দুই কিলোমিটার যাবার পর রেলওয়ে কালর্ভাটে এসে ট্রেন থামিয়ে দেওয়া হয়। এক এক জন পুরুষদের নামানো হয় এবং খোলা তলোয়ারের কোপে তাদের দেহ দুখন্ড করে ফেলা হয়। জানালা ভেঙ্গে যারা পালানোর চেষ্টা করেছিলেন তাদেরকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়। উপর্যুপরি ধর্ষন শেষে নারীও শিশু সহ ৪১৩ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানী সেনারা।

মৌলভী বাজারের কাছাকাছি এক ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর সংগ্রহের জন্য এবং মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে ১৫/২০ বছরের শিক্ষিত এক তরুনকে সকালে ধরে নিয়ে আসে পাক সেনারা। তাদের জিজ্ঞাসা বাদে ছেলেটি সবকিছু অস্বীকার করাতে প্রথমে মিলিটারীরা তার হাত ও পায়ের প্রত্যেকটি নখে গরম সূই ঢুকিয়ে দেয়। এরপর বিকাল পর্যন্ত ছেলেটির সমস্ত শরীরে জলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়। মিলিটারীরা যখনই কেউ ঘরে ঢোকে কিংবা ঘর থেকে বের হয় তখন প্রত্যেকই তাকে লাথি মারে ও থুতু দেয়। রাতে ছেলেটিকে উলঙ্গ করিয়ে তার পুরুষ অঙ্গ নিয়ে মিলিটারীরা হাসি ঠাট্টা মেতে উঠে। রাত শেষে ছেলেটিকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। ছেলেটি তখনও কিছু বলতে অস্বীকার করলে তখন চার জন মিলে তাকে শুইয়ে দেয়। প্রথমে তার ডান পা কেটে ফেলে, তারপর তার পুরুষ অঙ্গ কেটে তাকে ছেড়ে দেয়।

ঝালকাঠির কাছে এক ক্যাম্পে ধরে নিয়ে আসা এক তরুনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পাক সেনারা। কিন্তু উত্তর মিলিটারীদের মন মত না হওয়াতে তার শরীর কেটে কেটে চাক চাক করে। তারপর বাটা মরিচ আর লবন সারা শরীরে মাখিয়ে মাথা নীচু করে পা উপরের দিকে বেধে বন্দুকের বাট দিয়ে মারতে থাকে। নাক মুখ দিয়ে ছেলেটিকে রক্ত পড়তে থাকে। ঝুলন্ত অবস্থায় হত্যা করা হয় ছেলেটিকে।

রাঙ্গামাটির কাছে এক ক্যাম্পে একদিন এক পুরুষ লোককে ধরে আনে পাকিস্তানী সৈন্যরা। ধরে নিয়ে আসার পর শুরু হয় তার উপর মার। তারপর হতভাগ্য লোকটিকে বস্তার ভিতরে ঢুকিয়ে, বস্তার মুখ ভালো ভাবে বেধে বস্তার উপর দিয়ে গরম পানি ঢালতে থাকে। এই ভাবে গরম পানি ঢেলে তাকে হত্যা করে পাক সেনারা।

ঝালকাঠিতেই ধরে নিয়ে আসা আরো এক যুবকের কাছে মুক্তিযোদ্ধাও মেয়েদের খোজ জানতে চায় পাক সেনারা। তখন সে ভূল তথ্য দেয়। মিলিটারিরা সেখানে গিয়ে কাউকে না পাওয়ায় ছেলেটির সারা শরীর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্ত বের করে। এরপর একজন তার গলার উপর উঠে দাঁড়ায় আর দুইজন তার বুকের উপর দাঁড়ায়, আরো দুই জন তার পুরুষ অঙ্গটিপে তাকে হত্যা করে। নির্মমভাবে হত্যা করার সময় কত জন পানি পানি চিৎকার করত। পাকিস্তানী সেনারা তখন প্যান্টের চেইন খুলে মুখের ভিতর প্রসাব করে দিত।

১৯৭১ সালে গণ হত্যার মত নারী নির্যাতনও ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনা ছিল তাদের সেনাবাহিনী দ্বারা ব্যাপক হারে গণ ধর্ষন করে বাঙ্গালী নারীর গর্ভে পাক বাঙ্গালী শঙ্কর শিশুর বীজ বপন করা। যার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের আদলে পূর্ব পাকিস্তানে একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠে এবং বাঙ্গালী জাতি স্বত্ত্বা বিলীন হয়। পাকিস্তানী জেনারেল টীক্কা খান সমন দেওয়ার ফলে ঐ দেশের সরকার যুদ্ধ চলাকালে সৈনিকদের বাঙ্গালী নারী ধর্ষনের বেধতা দিয়ে ছিল। ফল স্বরুপ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এত ব্যাপক হারে নারী নির্যাতন করেছিল। দীর্ঘ নয় মাস পূর্ব বাংলার ৪৮০টি থানা ২৭০ দিন পাক সেনাদের দখলে ছিল। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্ট, পুলিশ ব্যারাক স্থায়ী সেনা বাঙ্কার বিভিন্ন স্কুল কলেজ ছিল ধর্ষন কেন্দ্র। ৮/৯ বছরের শিশু থেকে ৭৫ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত কেউই বাদ যায় নি পাকিস্তানী সেনাদের নির্যাতনের হাত থেকে। শহরও গ্রামের নারীদের এরা বন্দী করে নিয়ে গিয়েছে তাদের ক্যাম্পে, বাঙ্কারে নয় মাস আটক রেখে তাদের উপর অকথ্য অবর্ণনীয় নির্যাতন করেছে। তাদের ইচ্ছা মত বন্দী নারীদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে গিয়েছে। ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরিয়েছে। ক্যাম্পের পরিবর্তন হলে তাদের নিয়ে গিয়েছে পরবর্তী অন্য জায়গায়। আবার তাদের ঘাটি ও ক্যাম্পে থাকাকালীন সময়ে অনেক নারীকে বাধ্য করেছে দিনের পর দিন তাদের কাছে উপস্থিত হতে। পরিবারের স্বামী, পিতা, ভাই কে হত্যা করে নারীদের আটক করে, পাহারার ব্যবস্থা করে যেত; কেউ যেন পালিয়ে যেতে না পারে। আর তাদের ইচ্ছা মত এসে ঐসব নারীদের উপর নির্যাতন করে যেত। কোন কোন নারীকে পাকসেনারা এক রাতে ৮০ বার ধর্ষন করেছে আর এক একটি বার গণ ধর্ষনে ৮/১০ জন থেকে শুরু করে ১০০ জন পর্যন্ত অংশ নিয়েছে। লক্ষ লক্ষ নারীদের উপর পাক সেনারা যে নিষ্ঠুর নির্যাতন করে গেছে তা চিন্তাতীত। সেই ঘটনা বিশ্লেষন করলে বিবেক স্তব্ধ হয়ে যায়। কলমের গতি থেকে যায়। বরগুনার কাছের এক ক্যাম্পে আলো নামের ১৫/১৬ বছরের এক সন্তান সম্ভবা কিশোরীকে ধরে নিয়ে আসে পাক সেনারা। অসম্ভব সুন্দরী হওয়ার কারনে দিনে রাতে ১/২ ঘন্টাও সে পাকসেনাদের নির্যাতনের হাত থেকে রেহায় পেতনা। অতিরিক্ত অত্যাচারের ফলে এক সকালে বাচ্চা প্রসব হয়। হতভাগ্য মা পড়ে থাকে অচেতন অবস্থায় আর শিশুটি রক্তের ভিতরে থেকে কান্না করতে করতে কিছু সময় পর মারা যায়। মেয়েটির অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ হতে থাকে। এই অবস্থায়ও সন্ধ্যার সময় পাক সেনারা এসে তাকে নির্যাতন শুরু করে। আর আলো অনেক কষ্টে শুধু পানি চাইতে থাকে। একের পর এক পাক সেনাদের নির্যাতনের ফলে মেয়েটির শরীর থেকে কাটা গরুর মত রক্ত ছুটতে থাকে। এক সময় তার শরীর থেকে দড়ির মত নাড়ী বের হয়ে আসতে থাকে। এক সেনা তার জুতা দিয়ে নাড়ী চেপে ধরে, অন্য জন সেটা ছিড়ে ফেলে। উলঙ্গ অবস্থায় মেয়েটিকে ঘর থেকে বের করে বারান্দায় রাখে। চারিদিকে শুধু রক্ত। ঘন্টা দুয়েক পর জীবিত অবস্থাতেই আলোকে এক গর্তে ফেলে দিয়ে আসে।

মৌলভী বাজারের কাছে এক ক্যাম্পে শিক্ষিত এক মেয়েকে ধরে নিয়ে এসেছিল পাক সেনারা। মেয়েটির শরীরে এত কামড়ের ক্ষত ছিল যে, সেই ক্ষতগুলো দিয়ে সব সময় রক্ত ঝড়ত। শকুন যেমন মরা প্রাণী ছিড়ে ছিড়ে খায় তেমনি তার স্তন দুটো টেনে ছিড়ে দিয়ে ছিল পাকসেনারা। অতিরিক্ত নির্যাতনের ফলে রক্ত ক্ষরণ হতে শুরু করলে ভোরের দিকে মেয়েটিকে বারান্দায় নিয়ে এসে ফেলে রাখে তারা। এক পাক সেনা এসে রাইফেলের পিছন দিক দিয়ে তাকে মারতে থাকে এবং কিছু জানতে চায়। কিন্তু জ্ঞান না থাকায় মেয়েটি কোন কিছুর উত্তর দিতে পারেনি। তখন পাকসৈন্যটি তার যৌনাঙ্গে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে গুলি করে। ক্রমাগত রক্ত ক্ষরনের দুদিন পর মেয়েটি মারা যায়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ক্যাম্পে, বাঙ্কারে বন্দী থাকা লক্ষ লক্ষ নারীদের উপর এমন অমানবিক, নিষ্ঠুর, নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে পাকিস্তানী সেনারা। যুদ্ধকালীন সময়েও যুদ্ধ শেষে যৌন দাসী বানানোর উদ্দেশ্যে সাত/আটশত নারীকে পাক সেনারা সাথে করে নিয়ে গিয়েছে।

পরাজয় যখন নিশ্চিত, বাঙ্গালীর বিজয় যখন দ্বার প্রান্তে, তখন পাক জেনারেলরা আরো একবার তাদের হীন, বর্বর মানসিকতার পরিচয় দিল। আর এ কাজে সহায়তা করেছিল তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল বদর, আলশাম্সরা। বুদ্ধিজীবি হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল রাও ফরমান আলী। জামায়েতের আব্বাস আলী খান ও গোলাম আজম হত্যার খসরা করে তা অনুমোদনের জন্য দিয়েছিল রাও ফরমান আলীর নিকট। তার ডায়েরীতে সারা দেশের বুদ্ধিজীবিদরে নামের তালিকা পাওয়া যায়। বাংলাদেশকে মেধা শূন্য করে পঙ্গু করে দিতে সেই তালিকা অনুযায়ী ১১ই ডিসেম্বর রাত থেকে শুরু হয় বুদ্ধিজীবি আটক। দেশের শেষ্ঠ্র সন্তান-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক সবাই ছিলেন তাদের তালিকায়। মোহাম্মাদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজ আল বদর বাহিনীর সদর দপ্তরই শুধু ছিল না, ছিল টর্চার সেল। রাতের অন্ধকারে বুদ্ধিজীবিদের নিজ বাসা থেকে হাতও চোখ বেধে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যাওয়া হত কখনও টর্চার সেলে আবার কখনো অজ্ঞাত স্থানে। আটকে রেখে অকথ্য নির্যাতন করার পর মিরপুরও রায়ের বাজার বদ্ধভূমিতে নিয়ে গিয়ে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হত তাদের। আলবদর কমান্ডার আশফাকুজ্জামান ঢাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত জন শিক্ষককে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে ছিল। কবি মেহেরুনেচ্ছাকে বিহারী অধ্যষিত মিরপুরের বাসায় গলা কেটে হত্যা করে তারই চুল দিয়ে পাখার সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। রায়ের বাজার বদ্ধভূমিতে ইট খোলার মধ্যে অনেকের লাশ পাওয়া যায় যাদের কারো চোখ, কারো হৃদপিন্ড তুলে নিয়েছিল নরপশুরা। নির্যাতনের মাত্রা এত বেশী ছিল যে, অনেক ক্ষত বিক্ষত বিকৃত বিভৎস লাশ গুলো সনাক্ত করা সম্ভব হয় নি। আবার অনেকের লাশ খুজে পাওয়া যায় নি। শুধু ঢাকা শহর নয়, সারা দেশের সহস্রাধিক বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হয়েছিল। রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ের সাতজন শিক্ষককে নির্মমভাবে হত্যা করে জল্লাদরা। ঠাকুরগাঁয়ের কয়েকজন বুদ্ধিজীবিকে জীবন্ত অবস্থায় বাঘের খাচায় ফেলে হত্যা করা হয়েছিল। মাগুরার শিক্ষিকা লুৎফুন্নাহার হেলেনকে জীপের পিছনে বেধে শহরের রাস্তায় ঘুরিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মীর আব্দুল কাইয়ুমকে পদ্মার তীরে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল। যশোরের আইনজীবি মশিউর রহমানের চেহারা অত্যাচারের ফলে বিভৎস হয়ে গিয়েছিল। সৈয়দপুরের ডাক্তার শামশাদ আলীকে ট্রেনের জ্বলন্ত কয়লার ইঞ্জিনে ছড়ে ফেলে হত্যা করা হয়েছিল। সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, পাকশী, ইশ্বরদী , পাহাড়তলীতে ট্রেনের ইঞ্জিন সব সময় জ্বালিয়ে রাখা হত বুদ্ধিজীবি সহ অন্যান্য দের পোড়াবার জন্য।

জাতি হিসাবে আমরা আজও কলঙ্কিত এই কারনে যে, বীরঙ্গনা নারীদের আমরা কোন প্রকার সম্মান দেই নি। বিচার করিনি সেই সব রাজাকার দের যারা এদেশের মা বোনকে শুধু পাক সেনাদের হাতে তুলেই দেয়নি, ওদের সাথে তারাও মেতে উঠেছিল ধর্ষন যজ্ঞে। এদেশের মাটিতে এত নির্মম, নিষ্ঠুর অত্যাচার, ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যা, ৪ লক্ষ নারী নির্যাতন এত মানবতা বিরোধী অপরাধ করে গিয়েছে পাকিস্তানী সেনারা অথচ ৫০ বছরেও তার কোন বিচার করিনি আমরা। কিন্তু ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যার বিচার অসম্ভব নয়। কারণ গণ হত্যার কথা আন্তর্জাতিক ভাবে বহু জায়গায় উল্লেখ আছে।

গিনেজ বুক অব ওয়াল্ড রেকর্ডস- এ বাংলাদেশের হত্যা ঘটনাকে বিশ ¦ শতকের পাঁচটি ভয়ঙ্কর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

যুক্ত রাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের “নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভের” অবমুক্তকরণ দলিলে ৭১ এর নৃশংস হত্যাযঙ্গকে Selective Genocid হিসাবে বলা হয়েছে।

এন সাইক্লোপেডিয়া আমেরিকান, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতেও ৭১’এ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দ্বারা ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যার কথা উল্লেখ আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় টাইম ম্যাগাজিনে বলা হয়েছিল, “ It is most incredible, calculated thing since the days of the Nazis in Poland ”

১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে জাতি সংঘের এক প্রতিবেদনে লেখা আছে, “Among the genocide of human history, the highest number of people killed in lower span of time is in Bangladesh in 1971. An average of 6,000 to 12000 people were killed daily average in the history of genocide

ইতিহাসে পাকিস্তানের কোন ক্ষমা নেই। ১৯৭১ এর এই নির্বিচারে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবি হত্যা, নারকীয় নারী নির্যাতনের প্রেক্ষিতে পাকিস্থান যুদ্ধপরাধী এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমসের আইন অনুযায়ী যুদ্ধপরাধী পাকিস্থানের বিচার হতেই হবে।

শম্পা সাহাঃ মানবাধিকার কর্মী, শহীদ পরিবারের সন্তান ও লেখিকা।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন