এক

রোদে পুড়ে আজ তার গায়ের রং বদলে গেছে। চোখের নিচে বেশ কালিও পড়েছে। কিন্তু একদিন-তার রূপের খ্যাতি ছিল। বাবা মায়ের দেয়া সুন্দর একটা নামও ছিল, ‘রানু’। আজকাল দিনের বেলা আসাদ গেট, কল্যানপুরের ফিলিং স্টেশনে তাকে দেখতে পাওয়া যায়। গাড়ি আসে তেল নিতে। সে এগিয়ে যায় গাড়িতে বসে থাকা ভদ্র, শিক্ষিত মানুষের কাছে। সালাম দিয়ে ভিক্ষা চায়। বুকের কাপড়টা সরে  গেলে অনাবৃত স্তন চোখে পড়ে। সভ্য সমাজের কাছে তার পরিচয়-সে আজ ভাসমান পতিতা। রাতে তার ঠিকানা-ফার্মগেটের আনোয়ারা পার্ক, সংসদ ভবনের ফুটপাত, কিংবা চন্দ্রিমা উদ্যানের আশেপাশের এলাকা। তবে, জীবিকার প্রয়োজনে রাতের অন্ধকারে, এখন আর খদ্দেরের খোঁজ করে না সে। রাত গভীর হতে না হতেই-চোখে ঘুম আসে; গভীর ঘুম। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ার আগেই চোখে ভাসে-বন্দুক হাতে এগিয়ে আসা খাকি পোশাক পরা সেনাদল, আগুনের লেলিহান শিখা; রক্তাক্ত লাশ। কানে আসে দপ দপ করা বুটের শব্দ ; গুলির আওয়াজ; বুক ফাটা আর্তনাদ। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে খান সেনাদের অট্টহাসি যেন বাতাসে বাতাসে প্রতিফলিত হয়ে বারং বার তার কাছেই ফিরে আসতে থাকে।

দুই

                ১৯৬৬ সাল দেশ জুড়ে চলছে বিক্ষোভ, ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঢাকায় বৈঠক, ইয়াহিয়ার নির্বাচন। ১৯৭০সালের সেই নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইন সভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এরই মাঝে হাতে মেহেদী দিয়ে, লাল বেনারসী পরে শফিকের ঘরে আসে রানু। সূর্যের আলো এসে পড়ে গাছের পাতায়, ঘাসের ডগায়। উত্তরের হাত্তয়া বয়ে যায়। গাছের শুকনো হলুদ পাতা ঝরে পড়ে মাটিতে। গড়াই নদীর পাড় ধরে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন চলে যায় গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে। শফিক শুধু স্কুলে শিক্ষকতাই করে না, রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করে, দেশের কথা ভাবে। রানুকে বলে,

“দেখ, দেশের এই অবস্থা বেশিদিন থাকবে না। একদিন আমরা স্বাধীন হব। আর আমাদের সন্তান সেই স্বাধীন দেশে জন্ম নেবে।”

গভীর রাতে পূর্ণিমার আলোতে উঠোন ভরে যায়। জানালার ফাঁক দিয়ে সেই আলো ঘরে এসে পড়ে। গাছের পাতা চুঁইয়ে চুঁইয়ে- টপ-টপ শব্দ করে বৃষ্টির মত কুয়াশা পড়ে টিনের চালে। শফিকের বুকে মাথা রেখে, রানু স্বপ্ন দেখে তার ছোট ছেলেকে বুকে নিয়ে সে দুধ দিচ্ছে। চুক চুক শব্দ করে ছেলেটা তার স্তন চুষে দুধ খাচ্ছে। ছেলে হলে রানু নাম দেবে রনি, আর মেয়ে হলে শফিক নাম দেবে শমী।

গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়। হলুদ হয়ে যাওয়া সর্ষে ক্ষেতে প্রজাপতি উড়ে। মৌমাছি মধু খায়। আসে ৭ই মার্চ। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন

“এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।”

স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত সব বন্ধ হয়ে যায়। তবে, শফিকের কাছে অনেকেই আসে। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে ওরা সবাই আলোচনা করে। সেদিন শুক্রবার। মাগরিবের নামাজের পর এক প্রতিবেশি আসে শফিকের কাছে। মাথায় টুপি। হাতে তজবী। টুপিতে এক ফলি সবুজ চাঁদ। তীক্ষè গলায় হারুন বলে, “শুনতাছি, তুমি নাকি দ্যাশ স্বাধীন করবার চাও। আরে দ্যাশত একটাই, তার দুইটা ভাগ। ওরা হইতাছে গিয়া আমাগো বড় ভাই। ভাই এর লগে ভাই এর আবার যুদ্ধ কিসের? শালার বাচ্চা! স্বাধীনতার কথা বইলা দ্যাশটারে ভাঙতাছে ভারত। এই মালাউন গুলোইত আমাগো শক্র।”

মাথায় রক্ত ওঠে যায় শফিকের। চিৎকার করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলে তাকে। হারুন মন্ডল তবুও উঠে না। বলে-

“ভাবীর এত সুরত। একবার দ্যাখলেও পরানটা জুড়ায়। তবে, তার হাতে এক গ্লাস শরবত না খাইয়া উঠি ক্যামনে?”

ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং মুজিবসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ও জনসাধারণের অসন্তোষ দমনে শুরু করে ২৫ শে মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট। পাকিস্তানি সেনারা সেই রাতের কালো অন্ধকারে হত্যা করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরু হলে মজিবুর রহমান ২৬ শে মার্চ ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়ি থেকে ওয়ারলেসের মাধ্যম্যে স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। ২৫ তারিখেই গভীর রাতে পাকিস্তানি সেনা প্রবেশ করে কুষ্টিয়া শহরে। ২৬ তারিখ থেকে শুরু হয় ৩০ ঘন্টার কারফিউ। হুড খোলা জীপে করে তারা টহল দিতে শুরু করে। পুলিশ লাইন, টেলিফোন এক্সচেন্স ভবন দখলে নেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। শহরের জেলা স্কুল, চাঁদ সুলতানা, দিনমনি স্কুলসহ বিভিন্ন স্কুল ও জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করে ওরা। আর তাদের প্রধান থাকে-মেজর শোয়েব, ক্যাপ্টেন শাকিল ও সামাদ। ৩০ তারিখে ভোর চারটায় মোহিনী মিল ও ওয়ারলেস স্টেশনের উপর আক্রমণ চালায় শফিক। ওর সাথে থাকে তরুণ, রাজ্জাক, সোবাহান ও কমল। ঐ অপারেশনের পর কুষ্টিয়া ছেড়ে যাবার আগে রানুর সাথে দেখা করতে অনেক রাতে বাড়িতে আসে শফিক। চলে যাবার সময় রানুকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলে,

“তোমার রনি আর শমীর জন্য আমি ঠিকই ফিরে আসব একদিন।” পরদিন ভোরবেলা শৈলকূপার কাছে পুলের গোড়ায় গর্ত করে তারপেলিন দিয়ে সেই গর্ত ঢেকে শফিকরা হত্যা করে শোয়েবকে।

                শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকেও শত শত লোক আসছে এখানে। এরপর তালবাড়িয়া ঘাট হয়ে চলে যাচ্ছে সীমান্তের ওপারে। লাখ লাখ মানুষ গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে ও দেশের শরণার্থী শিবিরে। ভারত সরকার খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসা, অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে এদেশের মানুষকে। একদিন, দুই দিন করে মাস পার হয়ে যায়। শফিকের কোন খবর আসে না বাড়িতে। দিন দশেক আগে গভীর রাতে, আলমডাঙ্গা থানার অপারেশন শেষে মুক্তি বাহিনীর চার জন ছেলে এসেছিল বাড়িতে। রানু আর ওর শ্বাশুড়ি ওঠে ভেতরের ঘরে বসে গরম ভাত রান্না করে খাইয়ে ছিল ওদের। ওদের কাছেও শফিকের কোন খবর পাওয়া যায়নি। ছেলেগুলো চলে যাওয়ার সময় ওদের সাথে মুড়ি, খই, চিড়া দিয়ে দিয়েছিল রানু। ওর ভাসুর রফিক, সে যুদ্ধে যায়নি। বড় বাজারে কাপড়ের দোকান আছে তার। দুই মেয়ে আর বৌ’কে বহু আগেই শ্বশুর বাড়িতে রেখে এসেছে সে।

                একটানা বৃষ্টি চলে কয়েকদিন। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ নতুন সুর তোলে। একই ঘরে পাশের খাটে শ্বশুর ঘুমায়। রানুর পাশে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে থাকে প্রৌঢ়া শ্বাশুড়ি। রাত গভীর হয়। রানুর চোখে ঘুম আসে না। শফিকের মুখটা মনে পড়ে। কত দিন হয়ে গেল শফিককে দেখে না সে। রানু ঠিক করে রনি আর শমী নয়, ওর ছেলে হলে নাম দেবে-স্বাধীন, আর মেয়ে হলে নাম দেবে মুক্তি। লেখাপড়া  শিখে স্বাধীন আর মুক্তি একদিন অনেক বড় হবে। শফিক স্কুলে পড়ায়, ওরা কলেজে পড়বে। দেশ স্বাধীন হবার কথা শুনলেই সে উঠোনের উপর পতাকা উড়াবে। স্বাধীন দেশের মাটিতে সেই পতাকা উড়বে। যুদ্ধ শেষে শফিক বাড়ি ফিরবে। দৌড়ে গিয়ে তার বুকের মাঝে শফিককে জড়িয়ে ধরবে সে। আর কোন দিন সে শফিককে কাছ ছাড়া করবে না,—————–কোন দিন না।

তিন

টগবগ করে বড় হাঁড়িতে ভাত ফুটছে। ঘরের মোরগটা জবাই করা হয়েছে। ক্ষেত থেকে পুঁই এর ডগা কেটে নিয়ে এসেছে রানু। জ্বাল কমে এসেছিল, মসলা বাটতে বাটতে ব্যস্ত হয়ে খড়ি দিয়ে উনুনের জ্বাল বাড়িয়ে দেয় সে। নদীর ঐ পাড়ে হরিপুর গ্রামে বাড়ি রানুদের। সেই সাত বছর বয়সে মা মারা গিয়েছে। বাবা, বড় ভাই রায়হান আর ভাবীকে নিয়ে সংসার। শফিক যুদ্ধে গেছে, খবর পেয়ে রায়হান এসেছে রানুকে নিয়ে যেতে। মসজিদে গিয়ে জুম্মার নামাজ আদায়ের জন্য তৈরি হচ্ছিল ওরা। রানুর শ্বশুরের সাথে রায়হানও পুকুর পাড়ে গেছে ওজু করতে। অনেক দিন পর ভাসুরও আজ দোকানে গেছে এমন সময় শুরু হয় চিৎকার ছোটাছুটি। বড় রাস্তার মোড়ের উপর পাকিস্তানি সেনা বোঝাই দু’টো জিপ এসে থামে। জিপ থেকে নেমেই সৈন্যরা ছড়িয়ে পড়ে। গর্জে ওঠে তাদের হাতের রাইফেল আর মেশিন গান। পাখির মত গুলি করে মারতে থাকে সবাইকে। গায়ের স্বর্ণলঙ্কার, টাকা-পয়সা  ছিনিয়ে নেয়। তারপর আগুন লাগিয়ে দেয়। দাউ দাউ করে পুড়তে থাকে সবকিছু। দু/তিন জন সেনাকে নিয়ে, হারুন এসে দাঁড়ায় রানুদের উঠোনে। একজন লাথি মেরে উল্টিয়ে দেয় ভাতের হাঁড়ি। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে শুধু ভাত আর ভাত। খোঁটা থেকে দুধের গাই দুটোকে ছাড়িয়ে নিয়ে, হারুন ওর ভাইকে গরুগুলো বাড়ি নিয়ে যেতে বলে। এক জন রানুর শ্বশুর-শ্বাশুড়ীকে লাথি মারতে মারতে ঘরের ভেতরে নিয়ে যায়। তারপর তোষক দিয়ে পেঁচিয়ে উঠোনের জলন্ত উনুন থেকে আগুন নিয়ে, আগুন ধরিয়ে দেয় ওদের – গায়ে। হারুন এগিয়ে আসে রানুর দিকে, এরপর রানুর মুখটা তুলে ধরে বলে,

“দ্যাখেন হুজুর, কেমন মাল যোগাড় করেছি আপনাগো লাইগ্যা।” রায়হানের সাথে পাড়ার রাজ্জাক, নিতাই, বিশু, জব্বার, হারান সহ আরো অনেককে ধরে নিয়ে আসে নদীর পাড়ে। তারপর দড়ি দিয়ে বেঁধে অল্প করে গলা কেটে ছেড়ে দেয় ওদের। ঘোড়ার ঘাট থেকে শ্বশান ঘাট পর্যন্ত প্রতিদিন শত শত মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে ওরা। কখনো সারি বেঁধে সবাইকে দাঁড় করিয়ে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচাতে থাকে, ছুরি দিয়ে একে একে সবার নখ আর চোখ তুলে নেয়। জল খেতে চাইলে সামনে প্রসাব এনে জোর করে খাইয়ে দেয়। মুখের উপর ইট ছুড়ে মারে। নদীর জলে শুধুই রক্ত ভাসে। তারপর সেই জল বয়ে যায় সাগরে। বাতাসে রক্তের  গন্ধ। গড়াই এর চরে শুধুই লাশ আর লাশ। সন্ধ্যা নামলে শেয়াল কুকুরে সেই লাশ নিয়ে টানাটানি করে।

চার

               একইভাবে আরো কয়েকটা মাস কেটে যায়। আসে ১৬ই ডিসেম্বর। সোহরাওয়ার্দী  উদ্যানে নিয়াজী আত্মসমর্পণ করে জেনারেল আরোরার কাছে। স্বাধীন হয় মাতৃভূমি। চারিদিকে পতাকা উড়ে। সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত সেই বৃত্তে হলুদ রং এর বাংলাদেশের মানচিত্র। স্বাধীনতা, মুক্তির  আনন্দ বয়ে আনে ঠিকই, কিন্তু ঘরে ঘরে সন্তান হারা মায়ের আর্তনাদ আর স্বামী হারানো স্ত্রীর কান্নায় যেন বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। লাঞ্ছনা, অসম্মান আর অপমান নিয়ে দিন কাটতে শুরু করে ধর্ষিতা মেয়েদের। সেদিন মিলপাড়া থেকে রানুর সাথে লক্ষীদি, রত্না, কাকলিদি, সীমা ভাবী আর ঝর্ণাকেও তুলে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। ঘরে দেড় বছরের ছেলে রেখে গিয়েছিল সীমা ভাবী। ফিরে এলে স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি মিলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল সীমা ভাবীকে। কুষ্টিয়া কলেজ আই, এ পড়ত লক্ষীদি। বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ছেলে বিয়ে করবে না শোনার পর আত্মহত্যা করল। দুই মাসের অন্তঃসত্ত¡া র্ঝণা, ময়নার মাকে দিয়ে গর্ভপাত ঘটানোর সময় মারা গেল। কে নাকি বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল ঔষধের সাথে। বাড়ি বাড়ি ছাত্র পড়িয়ে সংসার চালাত কাকলিদি। এখনো বাড়ি ফেরেনি সে। ছেলেকে হারিয়ে ঘরে বসে অপেক্ষা করছে তার বিধবা মা। হয়ত কোন একদিন ঘরে ফিরে আসবে তার মেয়ে। আট মাসের অন্তঃসত্তা রতœা চলে গেছে নারী পূর্নবাসন কেন্দ্রে। যশোরের সেনানিবাস হাসপাতাল থেকে অনেকেই চলে যাচ্ছিল পূর্নবাসন কেন্দ্রে। তাদের  সাথে রানুও চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু শফিক তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে বাড়িতে। শহীদ, বীরাঙ্গনা তারা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের একজন তাই আজ কত উৎসাহ রফিকের। অথচ যুদ্ধের সময় পাক সেনারা মিলপাড়া আক্রমন করেছে জেনেও সেদিন সে বাড়িতে আসেনি। কোথায় পালিয়ে ছিল, তারপর রাতের অন্ধকারে চলে গিয়েছিল শ্বশুর বাড়িতে। সেই রফিক আজ ঢাকা থেকে  অনেক টাকা অনুদান নিয়ে আসে। আগে দোচালা ঘর ছিল, এখন ইটের গাঁথুনি দিয়ে চৌচালা ঘর তোলে। বাড়িতে টিউবওয়েল বসায়। তার কাপড়ের দোকানটিও এখন অনেক বড়। রাতের অন্ধকারে তার লোক বর্ডারে গিয়ে কাপড় নিয়ে আসে। বাতাসে কাঁচা টাকা ওড়ে।

                সময় গড়াতে থাকে। শুকনো গাছ আবার হলুদ হয়। গাছে গাছে আমের বোল আসে। সেই গন্ধ ছড়িয়ে থাকে চার পাশে। রাত গভীর হয়। বিছানায় শুয়ে র্নিঘুম রাত কাটে রানু আর শফিকের। ঘরের চালে ডাহূক ডাকে। বাঁশ ঝাড়ে বাতাসের দোলা লাগে। পাতায় পাতায় খস্ খস্ শব্দ হয়। সেই সব দিনের স্মৃতি সর্ম্পূণ রূপে ভুলে যেতে চায় রানু। কিন্তু পারে না। সেদিন আর সব মেয়েদের সাথে রানুও ওঠল মিলিটারি জিপে। জিপে ওঠার সময় পাকসেনারা ওদের প্রত্যেকের পেটে সজোরে লাথি মারছিল। সেই থেকে শুরু। জিপ এসে থামল থানায়। আরো কত মেয়ে এখানে, সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানেই কাটল। তারপর রাত নামলেই মেয়েদের হাত, মুখ, চোখ বেঁধে আবার জিপে তোলা হল। কাউকে নিয়ে যাচ্ছে বাঙ্কারে, কাউকে ব্যারাকে আবার কাউকে সেনানিবাসে। অনেক রাতে তারা পৌঁছাল যশোর সেনানিবাসে। এরপর মেয়েগুলোকে পৌঁছে দেওয়া হল এক এক রুমে। হেড কোয়াটারের বারান্দা দিয়ে হাঁটার সময় দু’পাশের ঘর থেকে শুধু মেয়েদের চিৎকার শোনা যায়, ঘরে ঢুকিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হল রানুর। তারপর লাথি মেরে মাটিতে শুইয়ে শুরু হল পাশবিক অত্যাচার। একজন শেষে আরেক জন আসে। সারারাত চলে। সকাল হয়। বেলা বাড়লে প্রস্্রাব করার জন্য ঘরের বাইরে এলে স্তম্ভিত হয়ে যায় সে। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারে না রানু। একি দেখছে সে! একটু দূরের বারান্দায় সারি সারি বিবস্ত্র মেয়ে শূন্যে ঝুলছে। মোটা লোহার তারে চুলের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে তাদের। কাউকে গরুর মত লাথি মারা হচ্ছে, কাউকে পশুর মত পেটানো হচ্ছে, কাউকে দিয়ে উত্তমভাবে আঘাত করা হচ্ছে। কেউ হাসতে হাসতে ধারালো ছুরি দিয়ে কোন কোন মেয়ের স্তন কেটে দিচ্ছে, আর কেউবা মেয়েদের যোনি পথে ছুরি বা লোহার দÐ ঢুকিয়ে আনন্দ উপভোগ করছে, আবার অনেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে। রক্ত! শুধু রক্ত ঝরছে মেয়েদের শরীর দিয়ে। ভয়ে চিৎকার করে ওঠে রানু। কয়েকজন এসে বারান্দার ওপর আছড়ে ফেলল তাকে। তারপর আবার সেখানেই শুরু হল পাশবিক অত্যাচার। রানুর বুকে পিঠে, গলায়, গালে কামড়ের দাগগুলোতে হাত বুলিয়ে দেয় শফিক। বলে, “আমরা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি ঠিকই, কিন্তু তোমরা আমাদের চাইতেও বড় মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের সন্তান একদিন তোমাকে সেই মর্যাদা দেবে, দেখে নিও।” রানুর চোখে জল আসে। শফিককে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে।

পাঁচ

                সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিক হতে শুরু করে সবকিছু। কিন্তু কেন যেন রানুর বুকের ভেতরটা শুধুই হা হা কার করে। সংসারের বাঁধনটা কেমন যেন আলগা আলগা লাগে তার কাছে। মনে হয়, স্বাধীন কিংবা মুক্তি এলেই তার বুকটা ভরে যাবে। মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে থাকে শফিক আর রানু। কত জায়গায় মানত করে। কিন্তু কোন আনন্দের খবর আসে না ওদের ঘরে। রানুকে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় শফিক। অল্প কিছু পরীক্ষা করেই ডাক্তার জানিয়ে দেয় সেন্যদের সীমাহীন নির্যাতনের কারণে, শুধু রানু নয়, রানুর মত আর অনেকেই আর কোন দিন মা হতে পারবে না। মুহূর্তের মধ্যেই রানুর আকাশটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। ঘরে ফিরে শফিক বলে,

“আমার জন্য তুমি আর তোমার জন্য আমি আছি। দু’জন দু’জনকে নিয়ে বাকিটা জীবন আমরা কাটাতে পারব না রানু?”

পদ্মার জল গড়াই এ এসে পড়ে। বড় বড় ঢেউগুলো পাড়ে এসে আঘাত করে। পাড় ভাঙে। দু’কূল উপচে জল আসে। এক সময় জল নামে। রেখে যায় পলি মাটি। ফসলের পর ফসল জন্মে। একটা কথা আসে রানুর কানে।

“বংশ যখন রক্ষা হইব না তখন, শেয়াল কুকুরে খাওয়া একটা মেয়ে ছেলেরে নিয়া সংসার কইরা কি লাভ? তালাক দিয়া আরেকটা বিয়া করলেই ত হয়।”

ভাসুরের কথার পিঠে কথার কোন উত্তর দেয় না রানু।

বেঁচে থাকার সব আনন্দই একে একে হারিয়ে যায় তার জীবন থেকে । দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে ছাত্র পড়ায় শফিক। পড়া শেষে শেখ মুজিবের কথা বলে। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের কথা তুলে ধরে ওদের সামনে। তার ছাত্র রাসেল, মানিক, শুভ, অপু’র মাঝে খুঁজে পেতে চায় তার স্বাধীন আর মুক্তিকে। যে চেতনা নিয়ে শফিক যুদ্ধে গিয়েছিল, সেই চেতনা সে ফিরে পেতে চায় ওদের চিন্তায়, ওদের মননে। ওরা একদিন বড় হয়ে য্দ্ধুপরাধীদের বিচার করবে; বীরাঙ্গনাদের শ্রদ্ধা জানাবে।

ছয়

১৫ই আগষ্ট, ২৫ শে মার্চের ভয়াল কালো রাতের মতই অন্ধকারাছন্ন আরো একটি রাত। ক্ষমতালোভী সেনা অফিসার, পাকিস্তানি দোসর ফারুক; রশিদ, ডালিম, মোস্তাকসহ আরো অনেকে মিলে শুধু শেখ মুজিবই নয়, নিষ্পাপ শিশু রাসেল সহ পরিবারের ২২ জন সদস্যকে নির্মম, নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে। সিড়ি ঘরে লুটিয়ে পড়েন শেখ মুজিব। স্তব্ধ হয় তার কণ্ঠস্বর । পতন ঘটে নক্ষত্রের। রক্ত আর রক্ত। সেই রক্তে লাল হয়ে ওঠে ধানমন্ডি ৩২ নং বাড়ি। শুধু বিদেশে থাকায় প্রাণ বেঁচে যান শেখ মুজিবের দুই কন্যা- হাসিনা, রেহানা। এর কিছু দিন পর ৩রা নভেম্বর জেলখানায় ঢুকে হত্যা করা হয় আরো চার নেতা- তাজউদ্দিন, ক্যাপ্টেন মনসুর, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও কামরুজ্জামানকে। খুব তাড়াতাড়িই বদলে যেতে শুরু করে সব কিছু। ক্ষমতায় আসে নতুন সরকার। ক্রিকেট খেলার সময় পাকিস্তান প্রেমীরা ঘরে ঘরে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ায়, উল্লাস করতে-বাজি পোড়ায়, মিষ্টি খায়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাকিস্তানের দোসররা সংসদ সদস্য হয়। আলিশান বাড়ি, গাড়ি করে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তাদের বীর বিক্রম, বীর উত্তম, বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। অথচ বীরাঙ্গনাদের ত্যাগের মহিমা কেউই অনুভব করতে পারে না। সবাই ভ–লে যেতে চায় ওদের কথা। যেন-৭১’এ পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা এদেশের একটি নারীও ধর্ষিত হয়নি।

               কয়েক মাস পরের ঘটনা। সকাল থেকেই আকাশে মেঘ। তবে বৃষ্টি নেই। গুমোট ধরে আছে। বেলা গড়ার সাথে সাথে আর মেঘ জমতে থাকে আকাশে। সূর্য ডোবার আগেই সন্ধ্যা নামে। রানুকে নিয়ে হরিপুর থেকে ফিরছিল শফিক। রায়হানের মৃত্যু আর রানুর ঘটনা শুনে স্ট্রোকে প্যারালাইসিস হয়ে আজ পাঁচ বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছেন রানুর বাবা। ঘোড়াঘাট পার হওয়ার আগেই টিপ টিপ করে বৃষ্টি নামে। ৭১’এর সেই হারুন আজ শফিকের স্কুলের সেক্রেটারি। মোটা অঙ্কের টাকা সে দান করেছে স্কুলের ফান্ডে । এক সপ্তাহ আগে সে শফিককে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল তার কক্ষে।

“শোন মাস্টার, ক্লাসের পড়া বাদ দিয়ে তুমি নাকি ছাত্রদের যুদ্ধের গল্প শোনাও। পাকিস্তানি সেনা ও আমাগোর নামে গিবত গাও। এক সপ্তাহের মধ্যে হয় তুমি স্কুলের চাকরি ছাড়; না হইলে সকালের অ্যাসেমব্লিতে সকল ছাত্রের সামনে তুমি হাত জোড় কইরা কইবা তুমি যা বলছ, তার সবই মিথ্যা।”

হারুনকে কিছু না বলেই ঘর থেকে বের হয়ে আসে শফিক। এ যেন আরেক যুদ্ধ বলে মনে হয় তার কাছে। নিজের বিবেক, নিজের সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে-এত বড় অন্যায়, সে কখনো, কোন দিন করতে পারবে না। ঘাট পার হয়ে আসে ওরা, অন্ধকার আর বৃষ্টি এক সাথে। জনশূন্য রাস্তা। বাতাসে বৃষ্টির জল মুখে এসে পড়ে। বড় রাস্তায় ওঠে এসে রিক্সার জন্য সামনে এগিয়ে যায় ওরা। হঠাৎ সামনে থেকে মোটর সাইকেল এসে থামে ওদের সামনে। তিনজন লোক নামে। কিছু বুঝে ওঠবার আগেই দু’জন শফিককে জড়িয়ে ধরে ওর মাথায় পিস্তল ঠেকায়। অন্যজন পিছন থেকে রানুুর মুখ চেপে ধরে। পর পর দুটো গুলির শব্দ কানে আসে রানুর তারপর———————————- তারপর, সব কিছুই শুধু কালো অন্ধকার।

সাত

                গোয়ালন্দ ঘাট। সব ট্রেন এসে থামে। তারপর, আবার ফিরে যায়। নিস্তব্ধ স্টেশনটা যেন হা-হা কার করে। গোয়ালন্দ ঘাটের পাশেই নিষিদ্ধ পল্লী। আর সেই নিষিদ্ধ পল্লীর বাসিন্দা আজ রানু। টিনের চালের সারি সারি ঘর। পার্টিশন দিয়ে ঘরগুলো আর ছোট করা। সরু গলি পথ দিয়ে সেই ঘরে ঢোকার রাস্তা। যেখানে নানা বয়সী মেয়েরা বসে বসে কেউ আড্ডা দেয়, কেউ কাঁদে, কেউ হাসে, কেউ আগের রাতের কথা বলে, আবার কেউ মদ খেয়ে মাতলামি করে। এই ছয় মাসে রানুর বেশ নাম ডাক হয়েছে। রাতের  মানুষগুলো এখানে এসে অনেকেই রানুর খোঁজ করে। কোন কোন দিন বিকেল হলে নিজের খুপড়ি ঘর ছেড়ে বাইরে আসে রানু। বাঁশের সাঁকো পার হয়ে সোজা হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে এসে বসে সে। সামনে পদ্মা, প্রমত্ত পদ্মা। নদীর ওপারের সীমানা চোখে পড়ে না। যত দূরে চোখ যায় শুধুই জল, আর জল। বাতাসে শাড়ির আঁচল ওড়ে। চুলগুলো মুখের ওপর এসে পড়ে। ছোট ছোট ঢেউগুলো মাটি ছুঁয়ে আবার ফিরে যায়। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চায় রানু, কিন্তু পারে না। অসহ্য এক কষ্ট! চোখ উপচে জল আসে। স্বাধীন আর মুক্তি ত কবেই তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছে। শফিক যে দুই হাত দিয়ে তার বুকের মধ্যে রানুকে আগলে রেখেছিল, সেও আজ নেই। মরতে ত সেও গিয়েছিল, কিন্তু পারল না কেন? কিসের টানে এই ক্লেদাক্ত, এই অন্ধকারময় জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা? জীবনের প্রতি এই মায়া কার জন্য? উত্তর খোঁজে রানু, কিন্তু কোন উত্তরই পায় না সে।

               সেদিন কিছুটা অবচেতন আর কিছুটা চেতনার মধ্যে রানুর মনে হয়েছিল, কেউ যেন প্রচন্ড শক্তি বলে তাকে পিষে ফেলতে চাইছে। তার মুখে, স্তনে কেউ যেন কামড় দিচ্ছে। তবে কি যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি? ঐ পাকিস্তানি শিবিরে কি, সে এখনও বন্দী! এর পর আর কত জন আসবে ? এক, —-দশ;——আট—–সাত, দুই—-ঘোরের মধ্যেই রানুর কানে একটা কথা এল,

“শালা! মাগীর অহনও জ্ঞান ফেরে নায়।”

আবার ঘুমের মধ্যে হারিয়ে গেল সে। গভীর সেই ঘুম। কতক্ষণ এভাবে কেটে গেল বুঝতে পারে না রানু। হয়ত ২/৩ ঘন্টা; তার বেশি অথবা কম। হঠাৎ তার মনে হল, কেউ যেন তার চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে। চোখ মেলে তাকাল সে। অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। খুব জোরে শব্দ হচ্ছে। যেন আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। বøাউজটা ছেঁড়া, অবিন্যস্ত শাড়ি। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় সে বুঝতে পারল একটা ঝড়ো বাড়িতে সে শুয়ে আছে। এটা ত সেই সেনানিবাস নয়। যুদ্ধ’ত কবেই শেষ হয়েছে। যুদ্ধ শেষে শফিকও ত ফিরে এসেছে স্বাধীন দেশে। একে একে তার মনে পড়তে লাগল সবকিছু। মুহূর্তের মধ্যেই বুকটা যেন শূন্য হয়ে গেল রানুর। অবশ হয়ে এল তার শরীর।———————- তারপর, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে উচ্চারণ করল শ—ফি–ক। বাইরে তখনও বৃষ্টি আর উত্তাল বাতাসের মাতামাতি। বৃষ্টির মধ্যে রানুর যেই কণ্ঠস্বর, বাতাসে ভাসতে ভাসতে দূরে হারিয়ে না গিয়ে, ঘরের মধ্যেই বার বার পাক খেতে লাগল। চিরদিনের মত শফিক তার জীবন থেকে হারিয়ে গেল; তার কোল খালি, বাকিটা জীবন সে এখন কাকে নিয়ে বেঁচে থাকবে? এত বড় সর্বনাশ তার কে করল? এমন কেন হল! কিছুক্ষন আগে মেঘ চমকানোর আলোয় একটা ব্যাঙ দেখেছিল ঘরের কোণে। সেই ব্যাঙটাই বোধ হয় পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল। তবুও স্থির মত বসে রইল রানু। শফিক, তার প্রেম, তার ভালোবাসা। বিয়ের পর ৩/৪ মাসই শফিককে, সে যা কাছে পেয়েছিল তাই। তারপর যুদ্ধ শেষে দু’জনেই বাড়ি ফিরে এল ঠিকই, কিন্তু পেল ভাঙা সংসার। আর সেই ভাঙা সংসারটাও আজ সম্পূর্ণ ভেঙে গেল। অনেক দূর থেকে ফযরের আযানের সুর ভেসে এল। হয়ত ৪টা বাজে। রাত শেষ হতে চলছে তাহলে। ওঠে দাঁড়াবার সময় নিজের শরীরে কষ্ট পেল রানু। এই প্রথম তার অনুভূতিতে এল যে-গত রাতে সে আবার ধর্ষিত হয়েছে। আবার রক্ত ঝরছে তার শরীর থেকে। এই বৃষ্টির মধ্যে শফিকের লাশটা কি ’ওখানেই পড়ে আছে, কেউ বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে, না শেয়াল কুকুরে খাচ্ছে? শরিফের মৃত্যুর খবর এতক্ষণে নিশ্চয় বাড়ির মানুষ জেনে গিয়েছে, আর না জানলে তাকে বাড়ি গিয়ে জানাতে হবে। বড় বাড়ির বড় ঘর থেকে বাইরে এল রানু। জায়গাটাকে চেনার চেষ্টা করল সে। তারপর গলি ধরে হাঁটা শুরু করল। বৃষ্টি থেমে গেছে। বাতাসে বাতাসে মেঘ ভেসে চলছে। মেঘ এসে চাঁদ ঢেকে দিচ্ছে, আবার মেঘ সরে যেতেই চাঁদ দেখা যাচ্ছে। গলি ছেড়ে বড় রাস্তায় এল রানু। তার পরিচিত রাস্তা। এই রাস্তা ধরে মাইল খানেক হাঁটলেই সে বাড়ি পৌঁছে যাবে। মাঝে মাঝে বাতাসের দোলা লেগে পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির জল ঝরে পড়ছে। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগল রানু হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, যুদ্ধের সময় এদেশের লাখ লাখ মেয়ের উপর যারা নির্যাতন চালিয়েছিল, তাদের একটা পরিচয় ছিল তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। কিন্তু আজ যারা তাদের নির্যাতন করছে, তাদের পরিচয় কি? তারা’ত এদেশেরই সন্তান। যুদ্ধ শেষে যখন সে ঘরে ফিরে এসেছিল, তখন মাঝে মাঝেই পুরুষ, ঝি, সবাই উঠোনে এসে দাঁড়াত। তারা সে সময়ে পাকিস্তানি বন্দী শিবির থেকে ফেরত আসা একজন অত্যাচারিত নারীকে দেখতে আসত। আর আজ, সকাল হলেই সবাই আবার আঙ্গুল তুলে একজন ধর্ষিতাকে সমাজের বাকী সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দেবে। সতীত্ব কি শুধুই গায়ের চামড়ায় থাকে? পুরুষেরা তাদের পাশবিক শক্তি দিয়ে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন নারীকে ভোগ করলেই সেই সতীত্ব হারিয়ে যায়। এতই সস্তা! মিলের পিছন দিয়ে বাঁয়ের দুটো গলি পার হয়ে ডানের গলিতে উঠতেই, দূর থেকে বাড়ি দেখতে পেল রানু।্ মরা বাড়ি! অথচ শোকের মাতম নেই, বুক চাপড়ানো হা-হা কারো নেই। উঠোনে শফিকের লাশও নেই। রাতের অন্ধকার কেবল মাত্র কাটতে শুরু করেছে সেই আবছা আলোতে টুপি মাথায় দেয়া দু’জন কে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে দেখল রানু। ভোরের আলোয় কিচিরমিচির শব্দ করতে করতে এক ঝাঁক পাখি আকাশে উড়ে গেল। বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটতে থাকলে এরকম বহু জনের সম্মুখে পড়তে হবে, তাই পিছনের আম আর বাঁশ বাগানের ভেতর দিয়ে ঘরের পাশে দাঁড়াল সে। বৃষ্টিতে জল কাঁদায় মাখামাখি। ঘরের কাছে আসতেই জায়ের গলা শোনা গেল

রানু ত অহন ফিইরা আইল না। বেলা বাড়লে থানায় গিয়া একবার খোঁজ কর।”

“আল্লাহর কাছে শোকর জানাও। ছোট যেন আর ফিইরা না আসে। শফিক মারা গেছে। ছোট সারারাত বাড়ি ফেরে নায়, ঐ নষ্ট বিধবা মেয়ে ছেলেরে আশ্রয় দিলে সমাজে আমার মুখ দেখাতে পারবো? না মেয়েদের কোন দিন বিয়া হইব? আমার সাফ কথা ছোট যদি কোন দিন ফিইরা আসে, এবাড়িতে ওর জায়গা নায়। সে যেন তার বাপের কাছে চইলা যায়।”

কথাটা শোনার পরও বাঁশ ঝাড়ে দাঁড়িয়ে রইল রানু। মিল থেকে সকালের প্রথম সাইরেন ভেসে এল। অর্থাৎ সাড়ে পাঁচটা বাজে। একটা কাক উড়ে গেল। রানুর গায়ের উপর পায়খানা এসে পড়ল। তবুও নির্বাক সে। নতুন কয়েকজন ঘরে এল। গলার স্বর শুনে মানুষ চেনার চেষ্টা করল রানু। কয়েকজন পথচারী মিলে শফিককে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই সে মারা যায়। হাসপাতাল থেকে শফিকের লাশ এখনও ছাড়েনি। ডাক্তার এসে পোস্টমার্টেম করার পর লাশ বাড়িতে আসবে,। বাড়িতেই কবর দেওয়া হবে শফিককে। মিল থেকে ছটার সাইরেন ভেসে এল। বেলা  বাড়ার সাথে সাথে এই পিছন দিক দিয়েও লোক ভেঙ্গে পড়বে মরা বাড়িতে। আবার হাঁটতে শুরু করল রানু। কোথায় যাবে সে এখন? কে আশ্রয় দেবে তাকে?  ছেঁউড়িয়ার দিকে হাঁটতে লাগল সে । রাস্তার দুধার জলে ডুবে আছে। বৃষ্টির জলে গাছের পাতায় জমে থাকা ধুলো ধুয়ে গিয়েছে। কি সবুজ দেখাচ্ছে সেগুলো। গাছের পাতায়, সাদা মেঘে মেঘে দিনের প্রথম সূর্যের আলো। গাঢ় নীল আকাশ। কি সুন্দর! কি পবিত্র সব কিছু! যেন গত রাতের বৃষ্টি পৃথিবীর সব পাপ ধুয়ে নিয়ে গেছে। আরো কিছুদূর হাঁটার পর, অসমাপ্ত একটা বাড়ি দেখতে পেল রানু। ছাদ ঢালাই এর পর ইটের গাঁথুনি দিয়ে ঘরগুলো আলাদা করা হয়েছে মাত্র। রানুর কি মনে হল, সেই বাড়িতে ঢুকল সে। সামনে ধানের ক্ষেত। ক্ষেতের ওপার দিয়ে রেল লাইন। একটা লম্বা মালগাড়ি চলে গেল। অনেকক্ষণ ধরে মালগাড়িটা যাওয়া দেখল সে। তারপর, কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে মেঝেতে শুয়ে থাকল রানু। বেলা বাড়ার সাথে সাথে শহরে গুঞ্জন শোনা গেল শফিক মাস্টার খুন হইছে, আর অর বৌ এর যার লগে পিরিত ছিল, তার লগে পালায়ছে। সারাদিন – পাখির কিচিরমিচির ডাক আর ট্রেনের হুইসেলের শব্দ কানে এল রানুর। তারপর, মাগরিবের আযান শেষে, যখন রাতের অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে আকাশের তারা উঠতে শুরু করল, তখন ক্ষেতের আল ধরে হাঁটতে লাগল সে। ভিজা মাটিতে বার বার পা পিছলে যেতে লাগল তার। ভিজা মাটি আর লাঙ্গল দেওয়া ক্ষেতের গন্ধ; রানুর মনে হল যেন কত বছর পর সে এই মাটির গন্ধ পাচ্ছে। রেল লাইনের ধারে এসে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না রানুকে। দূর থেকে আসা ট্রেনের হেড লাইটের আলোর সাথে সাথে শব্দ ও খুব তাড়াতাড়ি কাছে আসতে লাগল। রেল লাইনের পাশ দিয়ে সমান্তরালভাবে চলে যাওয়া তারটা পার হয়ে লাইনের আরো কাছে এসে দাঁড়াল সে। মরবে সে। মরতে তাকে হবেই। প্রতিক্ষনে রানুর মনে হতে লাগল এই মুহূর্তে সে রেল লাইনের ওপর গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু পারল না। এক অদৃশ্য শক্তিতে তার পা দু’টো যেন আটকে রইল।। তারপর বাতাস উড়িয়ে, প্রচন্ড শব্দ করে রানুকে পাশ কাটিয়ে ট্রেনটা চলে গেল। হত বিহব্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রানু। কেন এমন করল সে! কোথায়; কার কাছে ফিরে যাবে সে এখন? রেল লাইনের উপর দিয়ে একটা শেয়াল আরেকটা শেয়ালকে তাড়া করে দৌড়ে গেল। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক কানে বাজতে লাগল। ট্রেনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে ছিল রান্।ু হঠাৎ ট্রেনটা থেমে গেল। সিগনাল পায়নি। কয়েকজন লোক ওঠা নামা শুরু করল। রেল লাইনের ভেতরে পাতা শ্লিপার এর ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগল সে। এরপর সিঁড়ি দিয়ে ট্রেনের এক কামরায় ওঠে দরজার কাছে বসে পড়ল।

               হ্ইুস্ল দিয়ে ট্রেন ছাড়ল। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যত। তার নিজের সাজানো ছোট্ট ঘর, সংসার, শফিক, বাবা সবাইকে ছেড়ে কোন এক অজানা গন্তব্যে চলল সে! ব্রীজের ওপর ট্রেন ওঠল। গড়াই নদীটা দেখার চেষ্টা করল রানু। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। হু হু করে বাতাস আসতে লাগল, বাইরে নিকোষ কালো অন্ধকার। মাঝে মাঝে দূর লোকালয়ের মিট মিট করা আলো চোখে পড়ে। হাঁটুতে মাথা রেখে বসে থাকল রানু। একে একে চড়াইখোল, কুমারখালী, খোকসা, মাছপাড়া, পাংশা পার হয়ে ট্রেন চলতে লাগল। রাতও বাড়তে লাগল ধীরে ধীরে। গতকাল রাত থেকে নিদ্রা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা কোন কিছুর চাহিদাই রানুর অনুভূতিতে আসেনি। অবশ্য এ অভিজ্ঞতা তার নতুন নয়। যশোরের সেনানিবাসে যখন সে ছিল, তখনও একটানা তিন দিন না খেয়ে ছিল সে। তখন মনে হত না খেয়ে মরে যাবে। কিন্তু মরেনি, আজও মরতে পারল না সে, মৃত্যু কি এতই কঠিন! রাজবাড়ি স্টেশনে এসে ট্রেন অনেক ফাঁকা হয়ে গেল। অনেকক্ষণ  ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকল এখানে। দরজার কাছ থেকে ওঠে গিয়ে রানু সিটে এসে বসল। এক ছেলে পানির জগ আর গ্লাস নিয়ে যাচ্ছিল, তার কাছ থেকে একে একে পাঁচ গ্লাস পানি খেল সে। ট্রেন চলতে শুরু করলে জানালার কাছে বসা লোকটি এগিয়ে রানুর মুখোমুখি এসে বসল। নাম বলল সুরত আলী। বয়স ৩০/৩২। স্বাস্থ্যবান। ইচ্ছে করে কথা বলতে শুরু করল রানুর সাথে, রানু কোথায় যাবে? কোথায় বাড়ি? আকাশে আবার মেঘ চমকানো দেখে বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠল রানুর। আবারও বৃষ্টি। আর দুটো স্টেশন পরেই দৌলতদিয়া ঘাট। ট্রেনের যাত্রা শেষ। ট্রেন থামবে। তারপর আজ ভোর রাতে যাত্রী নিয়ে ট্রেন ফিরে যাবে তার গন্তব্য। কিন্তু তার গন্তব্যে কোথায়? স্টেশনে বসেই বাকী রাতটা কাটাবে সে। রাত শেষে পদ্মায় গিয়ে ডুবে মরতে চাইলে সে পারবে কি? সে ত সাঁতার জানে। পাঁচুরিয়া স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই বৃষ্টি নামল। রানুর কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে সুরত আলী এবার বলল ,

“বইন, তোর কষ্ট দেইখা আমার চোখে পানি আসতেছে। তা না হইলে এত রাতে কোন মাইয়া একা একা পথে বাহির হয়।” এবারও কিছুই বলল না রানু, তবে একটা সহানুভূতির কথা শোনায়, তার চোখ দুটো জলে ভরে ওঠল। বৃষ্টির ছাঁট আসছিল, সুরত আলী ওঠে পাশাপশি জানালা দুটো বন্ধ করে দিল। তারপর রানুর মাথায় হাত রেখে বলল

“কাঁদিস না বইন। আল্লা যে কার কপালে কি লিখেছে!”

শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে রানু এবার হু হু করে কাঁদতে শুরু করল। গোয়ালন্দ বাজার স্টেশনে ট্রেন যখন পৌঁছাল, তখন বৃষ্টি নেই। সুরত আলীর সাথে রানুও নামল ট্রেন থেকে। বাড়িতে তার বৌ অসুস্থ। ঘরে দেড় বছরের ছেলে। ছেলেকে দেখার কেউ নেই। ছেলেকে রাখার জন্যই রানুকে নিয়ে যাচ্ছে তার বাড়িতে। মানুষ নয়, সুরত আলীকে ফেরেস্তা বলে মনে হচ্ছিল রানুর।

 ছোট্ট স্টেশন। হাতে হ্যাজাক বাতি নিয়ে স্টেশন মাস্টার ঘোরাঘুরি করছে। স্টেশন থেকে বের হতেই হ্যাজাকের আলো মিলিয়ে গেল। মাথার ওপরে চাঁদ। অনেক রাত বলে মনে হল রানুর। দুটো রিক্সা দাঁড়িয়ে ছিল। কোন কিছু না বলেই সুরত আলী তার একটাতে ওঠে বসে রানুর জন্য জায়গা করে দিল। হারিকেনের আলোয় রিক্সা চলতে লাগল মাটির পথ ধরে। ক্রমশঃ যেন গাঢ় হয়ে ওঠতে লাগল অন্ধকার। চরিদিকে ব্যাঙ ডাকার শব্দ। সম্মুখের কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিল রানু। হঠাৎ সুরত আলীর হাত এসে পড়ল তার বুকের ওপর,। সিগারেটের গন্ধ ভর্তি মুখটাও এগিয়ে এল রানুর মুখের কাছে। কিছুক্ষন পর, রানু বুঝতে পারল  তার ঠোঁট দিয়ে রক্ত ঝরছে। তারপর থেকে প্রায় প্রতি রাতেই সুরত আলী আসে রানুর ঘরে। শুধু রানু নয়, কাজল, ফাতেমা, রেখা, ছবি ওদের সবাইকে এই পতিতালয়ে এনে তুলেছে সুরত আলী। মেয়ে বিক্রি করাই তার কাজ।

আট

                ১৯৮৪ সাল। কয়েকদিন হল, বাতাসে একটা কথা ভাসতে থাকে। পতিতালয় উচ্ছেদ হবে। পতিতালয়ের ঐ অপবিত্র, পাপী মেয়েগুলো সমাজকে কলুষিত করে। তাই এই সমাজকে পবিত্র করতে হাতে লাঠি নিয়ে অনেকই জমায়েত হয় এখানে। এরপর এক সময় লাঠি উঁচিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপর। ঘরের বিছানা লেপ, বাসন সব ছুঁড়ে ফেলে দেয় বাইরে। ঘরের চাল আর বেড়ার ওপর বৃষ্টির মত লাঠি এসে পড়ে। এরপর ঘরে আগুন লাগিয়ে চলে যায় ওরা। ৭১’এর কথা মনে পড়ে রানুর। যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি সেনারা এই দেশ ছেড়ে চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু তাদের দোসরা ত এদেশে রয়েছে আর চিরকাল থাকবে। তাদের হাত থেকে এদেশকে বাঁচাবে কারা? সেই দিন শেষে খোলা আকাশের নিচে বসে রইল তারা সবাই। মাঘের কনকনে শীতে দুধের শিশুগুলো সারারাত কাঁদতে থাকল। কি দীর্ঘ সে রাত। মায়ের বুকের উষ্ণতা সে রাতে সন্তানকে উত্তপ্ত করতে পারেনি। তাইত, পরদিন সকালে নীলিমার দ’ুমাসের ছেলেটা তার বুকের মধ্যে মারা যায়।

 গোয়ালন্দ থেকে কিছুটা দূরে দৌলতদিয়া ঘাটে গিয়ে রানুরা আবার বসতি গড়ে। রাতের অন্ধকারে যারা রানুদের কাছে আসে, দিনের আলোতে তারাই উচ্ছেদের কথা বলে; রানু, সুফিয়া, শাবানাদের গালি দেয় বেশ্যা মাগী বলে। রাতের  অতিথিরা সমাজের মানী, গুণী মানুষ, আর রতœরা অচ্ছুত, অস্পৃশ্য। জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্নতা এখানে রাতের অন্ধকারাচ্ছন্নতার চাইতেও কালো। সন্ধ্যা শেষে রাত নামলেই মেয়েরা সাজতে  শুরু করে। কপালে টিপ পরে, গালে রং মাখে ঠোঁটে লিপিষ্টিক দেয়। তারপর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। খদ্দেরদের কেউ কেউ মদ নিয়ে ঘরে ঢোকে। ঘরের দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। অবুঝ সন্তানগুলো দরজার বাইরে বসে কাঁদতে থাকে। এর নামই কি জীবন! বাবার কোন পরিচয় থাকে না। তবুও সন্তানের সকল দায়িত্ব নিয়ে এখানে মেয়েরা সন্তান গর্ভে ধারণ করে। সন্তানের জন্ম দেয়। মাতৃত্বের কি আকাঙ্খা! শফিকের কথা মনে পড়ে রানুর। বীরাঙ্গনা বলে, কোনদিন সামান্যতম সম্মানটুকুও পায়নি সে। আর আজ! আজ তার স্বাধীনের বয়সী ছেলে আসে তার কাছে। রানু বুঝতে পারে না ঐ ১৬/১৭ বছরের ছেলেরা এসে কি তাদের শারিরিক চাহিদা পূরণ করে, না বিকৃত লালসা মেটায় কোনটা? সময়ের সাথে সাথে পতিতালয়েও মেয়েদের ভিড় বাড়তে থাকে। কারো স্বামী এসে বিক্রি করে যায়, কেউ ধর্ষিত হয়ে আসে। আবার কেউ কেউ বৃদ্ধ বাবা-মা কিংবা সন্তানের দু’টো ভাত দিতে স্বেচ্ছায় এই পথে আসে।

নয়

                আজকাল রানুর শরীরটা ভালো লাগে না। দিনের বেলা ঘুমের সময়েও তার চোখে ঘুম আসে না। প্রায় সময়ই মাথা ব্যথা হয়। ভারী হয়ে থাকে মাথাটা। হাতুড়ি পেটানোর মত দপ্ দপ্ করতে থাকে। কেমন ঘোলা ঘোলা লাগে চার পাশটা। একাই নদীর পাড়ে এসে বসে সে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামে। কৃষ্ণ পক্ষের আধা খাওয়া চাঁদ ওঠে আকাশে। জলে চাঁদের ছায়া ভাসতে থাকে। অনেক দূরে পদ্মার বুকে জেলে নৌকার কুপির আলো মিট মিট করে জ্বলতে থাকে। অনেক রাতে ফেরে রানু। কিন্তু ফিরে এসেও আর কাউকে ঘরে  ঢুকতে দেয় না সে। কিছু দিন কেটে যায় এভাবে। একদিন রাতে সুরত আলী আসে ঘরে। অন্য সবার মত সেও দেরী করে না। ঘরে ঢুকেই দরজা আটকিয়ে দেয় সে। অথচ কোন পরিবর্তনই ঘটে না রানুর। খাটে হেলান দিয়ে বসেছিল, তেমনিই বসে রইল সে! কিছুক্ষন পর সুরত আলী আরও এগিয়ে এলে, তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষিপ্ত কুকুরের মত,  তাকে কামড়াতে লাগল রানু। এরপর, রানুর ঘরে আসতে আর কেউ সাহস করেনি। ১০/১৫ দিন এভাবেই কাটার পর দিপালী নামের একজন তার ঘরের দখল নিল।

                দৌলতদিয়া ল   ঘাটের হোটেলে এসে কাজ নেয় রানু। বাসন ধুয়ে দেয়, মসলা বাটে, বিনিময়ে দু’বেলা খেতে পায় সে। রাতে ল   ঘাটের এক কোনে শুয়ে থাকে। কখনো কোনদিন হয়ত চোখে ঘুম নামে আবার কখনো হয়ত সারারাত নির্ঘুম কাটায় সে। সকাল হয়। সারি সারি ল  বাধা থাকে ঘাটে। সকাল আটটার সময় রাজশাহী থেকে ট্রেন আসার পর ট্রেনের যাত্রীরা লে  এসে উঠতে লাগল। রানুর মনে হল সেও যাত্রীদের সাথে লে র ডেকে এসে উঠল। ঘন্টা বাজার পর ল  ছাড়ল। ঘাট ছেড়ে ল  সরে এল। সবুজ হয়ে থাকা ছোট ছোট চারা ধানের ক্ষেত ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে লাগল। নীল আকাশের সাদা মেঘ; বাতাসে নদীর জলের গন্ধ। সোনালী রোদ। দূর আকাশে ডানা মেলে ভাসতে থাকা এক ঝাঁক বক; সাদা ফেনাওয়ালা জলের ঢেউ রানু মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগল সব কিছু। ভেপু বাজিয়ে ভট্ ভট্ শব্দ করে ল  চলতে লাগল তার গন্তব্যে। ওপারে আরিচা ঘাট।

দশ

                সাড়ে চার বছর পরের ঘটনা। ১৯৯৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। কুয়াশা ভেজা সকাল। এক বার, দুই বার, তিন বার করে ৩১ বার তোপধ্বনি বাতাসে শব্দ তোলে। দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে বিজয়ের ২৫ বছর পূর্তি। চারিদিকে লাল সবুজের পতাকা। মাইকে মাইকে বেজে চলেছে “সালাম সালাম হাজার সালাম” অথবা “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি” আবার কখনো কখনো শেখ মুজিবের কণ্ঠস্বর “এবারের সংগ্রাম  আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।”—————————————–আর যদি একটা গুলি চলে—–” খবরের কাগজের পাতায় পাতায় যুদ্ধের গল্প কবিতা, প্রবন্ধ। ঞ.ঠ. তে মুক্তিযুদ্ধের নাটক, স্মৃতিচারণ আলোচনা। ২৬শে মার্চ কিংবা ১৬ই ডিসেম্বর মানে অন্য রকম ছুটি। দুপুরে খাবার টেবিলে ভালো খাবার; বিকালে স্বাধীনতা বিরোধী ছেলেকে সাথে নিয়ে স্মৃতি সৌধে গিয়ে ফুল দিয়ে আসা; রাতে আদম ব্যবসায়ী আর ফেনসিডিল পাচারকারী কবির ও সোহেলের সাথে বসে জম্পেস আড্ডা, সাথে মদ, ভি.সি.আর এ শিল্পাশেঠীর উদ্দাম নাচ। আরও পরে কোন কাজল কিংবা পারুলের ঘরে গিয়ে রাত কাটানো।

এই ত ¯া^াধীনতার মূল্য! হায়রে দেশ! ৩০লক্ষ শহীদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য তৈরি হয়েছে স্মৃতিসৌধ। অথচ দেশের কোনো প্রান্তে কোথাও বীরাঙ্গনা শব্দটি উচ্চারিত পর্যন্ত হয়নি! এতই ঘৃণিত, অস্পৃশ্য তারা; ৭১এর লাখ, লাখ ধর্ষিত, অত্যাচারিত নারীরা আজ কোথায়? এদেশের মাটিতে, এদেশের পতাকায়, এদেশের জাতীয় সঙ্গীতে, যাদের সবচেয়ে অগ্রাধিকার এদেশ তাদের বানিয়েছে বহু ভোগ্যা, বেশ্যা পতিতা।

                শীতের সকালে, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট উলঙ্গ, অভুক্ত শিশুরা শীতে, ক্ষুধায় কান্না করে। স্বাধীনতা এদের জীবনে ক্ষুধা মেটাতে পারে না। সন্তানের ক্ষুধার অন্ন যোগাড় করতে ক্লান্ত মায়েরা জানে না কেন এই বিজয় দিবস? জীবনের সব অধিকার থেকে বি ত হয়ে ছোট ছোট ছেলেরা রাস্তায় পতাকা বিক্রি করে চলে। সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা বাসের কন্ট্রাকটারগুলো চিৎকার করে বলতে থাকে— এই —- নবীনগর——— নবীনগর। স্মৃতিসৌধ,—————- স্মৃতিসৌধ। হাতে ফুল নিয়ে বহু মানুষ স্মৃতিসৌধে যায় শহীদের বিন¤্র শ্রদ্ধা জানাতে। মাথাটা ব্যথায় টন টন করতে থাকে রানুর। দিনের এত আলোর মাঝেও চারপাশটা কেমন অন্ধকার লাগে তার কাছে। এই নিয়েই ছেঁড়া কাপড়ে শরীর ঢেকে বাসের যাত্রীদের কাছে গিয়ে ভিক্ষার হাত বাড়ায় সে। বাতাসে বাতাসে ভাাসতে থাকে “তোমদের এই ঋণ কোন দিন শোধ হবে না। না——————–না,——————না শোধ হবে না।”

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন