১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ বাঙালির মুক্তির যে সংগ্রাম শুরু হয়ে ছিল ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ তার শেষ হয় এক ঐতিহাসিক বিজয়ের মধ্যে দিয়ে। জন্ম নেয় একটা নতুন রাষ্ট্রের – বাংলাদেশ। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন ৩০ লাখ মানুষ , ধর্ষিতা হন ২ লাখ নারী , মতো ভেদে এই বীরাঙ্গনার সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। যার মধ্যে ১২/১৩ বছরের মেয়েও ছিল। আর এই যৌন নির্যাতনের ফলে জন্ম হয়েছিল কয়েক হাজার যুদ্ধশিশুর। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বেশ কয়েক হাজার বই প্রকাশিত হয়েছে – যাতে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনী। লেখা হয়েছে কাহিনী ৭জন বীর শ্রেষ্টের জীবনী নিয়ে। ৩০ লাখ শহীদের বীরত্বের কাহিনী আমাদের সবার জানা। আস্তে আস্তে উঠে এসেছে বীরঙ্গনাদের কাহিনীও। কিন্তু আজও অবহেলিত আর অন্ধকারেই রয়ে গেছে ৭১এর সেই সব যুদ্ধশিশুদের কথা।

করা এই যুদ্ধশিশু ? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিপেক্ষিতে অধিকৃত বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বরে মধ্যে পাক সেনাদের কতৃক বাংলাদেশী নারীদের ধর্ষণের ফলশ্রুতিতে যে শিশু জন্ম নিয়েছিল , তারাই ” যুদ্ধশিশু ” । কখনো কখনো তাদেরকে ডাকা হয়েছে “শত্রু সন্তান” , “বেআইনি শিশু” , “পরিত্যাক্ত শিশু” , – “জারজ” বলে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এদেরকে “জারজ” গালি দেয়া হতো। আর জন্মদাত্রী মাকে “ধর্ষনের শিকার ” বলে সমাজে গ্রহণ করা হতো না। শুধুমাত্র ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল ২ এর বিজ্ঞ বিচারক ধর্ষণের শিকার এই সব নারী ও যুদ্ধ শিশুদের জাতির “শ্রেষ্ট সন্তান” বলে আখ্যায়িত করেন এবং সরকারকে তাদের পুনর্বাসনের জন্য অনুরোধ করেন। অত্যান্ত দুঃখজনক হলেও হলেও এটাই সত্য যে আমরা জানিনা , সেই সব যুদ্ধশিশুরা কে কোথায় আছে? কি ভাবে বেড়ে উঠছিলো তাদের জীবন? আর জীবনের জন্য তারাই বা কতটুকু দায়ী ?

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের কথা শুনে মর্মাহত হয়েছিল অনেক বিদেশী পরিবার। তাদের হাত ধরেই সেই সব যুদ্ধশিশুদের অনেকেই পাড়ি জমিয়েছিল বিদেশের মাটিতে। এমনি ভাবে ১৯৭২ সালের ১৫ই জুন ১৫জন যুদ্ধশিশু কানাডার টরন্টো আর মন্ট্রিয়াল শহরে এসে পৌঁছায় তাদের দত্তক গ্রহণকারী পিতামাতার কাছে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেই হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়টা তুলে এনেছেন জনাব মুস্তফা চৌধুরী তার গবেষেণা মূলক রচনা “৭১এর যুদ্ধশিশু” গ্রন্থে। তার এক সুদীর্ঘ সাধনার সফল বাস্তবায়ন তার এই গ্রন্থ। যার মাঝে উঠে এসেছে ইতিহাসের একটা হারিয়ে যাওয়া অধ্যায় – যা কিনা আমাদের ইতিহাসের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধদের ইতিহাসকে পূর্ণতা দিতে হলে এই অধ্যায়কে অস্বীকার করা যাবে না। আমার মতে ৭১ এর যুদ্ধশিশুদের নিয়ে এটা একটা মূল্যবান গবেষণামূলক গ্রন্থ, একটি অবিদিত ইতিহাস।

একটি সময় উপযোগী গবেষণামূলক বই উপহার দেবার জন্য জনাব মুস্তফা চৌধুরীকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম। সেই সাথে সবাইকে বইটা পড়ার জন্য অনুরোধ করবো।

১ মন্তব্য

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন