কানাডাতে স্থায়ী ভাবে থাকার জন্য উদ্বাস্তু বা শ্মরনার্থী দাবী (Making a Refugee Claim)

টরেন্টো থেকে:-

আমার জানা মতে যারা এখানে রেফিউজী দাবীর মাধ্যমে স্থায়ী হয়েছেন এবং পরবর্তীতে নাগরিকত্ব পেয়েছেন তাদের মধ্যে শতকরা ৯৫-৯৮ জনই সত্যিকারের রেফিউজী না, তবে তারা তাদের ইন্টারভিউ এবং প্রমানাদির দ্বারা হেয়ারিং বোর্ড এর বিচারককে সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন যে তাদের দেশে ফিরে গেলে অমানবিক অত্যাচার, নির্যাতন এমনকি জীবননাশের সম্ভাবনা আছে। তাদের কেউ ট্যুরিষ্ট ভিসা নিয়ে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন, আবার কেউ পড়াশোনা করার নাম নিয়ে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন অথবা কোনো সেমিনার বা ওয়ার্কশপ এ আসার নাম করে ভিসা নিয়ে এখানে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। এছাড়াও আরো অনেকভাবে ভিসা যোগাড় করে এসে রেফিউজী ক্লেইম করা যায়।

আমি এই লেখার মাধ্যমে খুব সংক্ষেপে এবং সাধারন ভাষায় রেফিউজী ক্লেইম থেকে শুরু করে স্থায়ী হবার আবেদন পর্যন্ত কিছু তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো যাতে করে কেউ যদি এখানে রেফিউজী ক্লেইম করতে চান তাহলে তাকে কানাডিয়ান সরকারী ওয়েবসাইটের অসংখ্য তথ্যের মধ্যে হারিয়ে যাবার বদলে যেন সহজেই কিছু প্রাথমিক ধারনা পান।

আপনি এয়ারপোর্টে, কানাডিয়ান বর্ডারে বা কানাডার মধ্যে থেকেও রেফিউজী ক্লেইম করতে পারেন। তবে কানাডা/আমেরিকান বর্ডার থেকে রেফরউজী ক্লেইম করা যাবে না। যেমন ধরুন, আপনি যদি আমেরিকা এসে নায়াগ্রা ফলসের ওপারে বাফেলো থেকে আবেদন করেন সেটা গ্রহনযোগ্য হবে না, সেক্ষেত্রে আপনাকে আমেরিকাতেই রেফিউজী ক্লেইম করতে হবে। আপনি এদেশে রেফিউজী প্রটেকশন চাইলে আপনাকে অবশ্যই Convention Refuge বা Person in Need of Protection এর সংগার মধ্যে পড়তে হবে। এ দুইটি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত বর্ননা নীচে দেওয়া হলো।

Convention Refuge

Convention Refugee হতে হলে আপনার একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ভয় থাকতে হবে যে নিম্ন লিখিত কারণগুলির জন্য আপনি দেশে থাকলে আপনাকে নির্যাতন বা অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হবে, এমনকি আপনার জীবন নাশের হুমকিও থাকতে পারে।

কারণগুলি হলোঃ

জাতি

ধর্ম

জাতীয়তা

রাজনৈতিক মত অথবা

কোনো একটি বিশেষ দল বা গোষ্ঠির সদস্য

আপনার উপর অত্যাচার বা নির্যাতন সরকারের দিক থেকেও হতে পারে আবার অন্যদের দিক থেকেও হতে পারে। অন্যদের দিক থেকে হলে আপনাকে দেখাতে হবে যে সরকার আপনাকে এই নির্যাতন বা অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে ব্যার্থ হচ্ছে বা আপনাকে কোন নিরাপত্তা দিতে পারছে না।

Person in Need of Protection

Person in Need of Protection হতে হলে আপনি দেশে ফিরে গেলে আপনাকে অমানবিক অত্যাচার এবং নির্যাতনের শিকার হতে হবে এবং আপনার সরকার আপনার এই নির্যাতন বা অত্যাচার থেকে আপনাকে রক্ষা করতে পারছে না, অর্থাৎ আপনাকে নিরাপত্তা দিতে ব্যার্থ। এবং নিরাপত্তাজনিত এই ঝুঁকিগুলি দ্বারা শুধুমাত্র আপনিই ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্ত, অন্য কেউ নয়।এখন যদি আপনি দেশে কোন অপরাধ করে থাকেন এবং সেজন্য সাজা হয় অথবা দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় বা আপনি যথাযোগ্য চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না, এসব থেকে পরিত্রাণের জন্য রিফুজি ক্লেম করতে পারবেন না।

রিফুজি ক্লেমেরে প্রক্রিয়া

কানাডাতে আপনি রিফুজি প্রটেকশন চাইলে আপনাকে রিফুজি ক্লেম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আগাতে হবে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে Immigration and Refugee Board এর Refugee Protection Division সিদ্ধান্ত নিবে যে আপনি একজন প্রটেকটেড পারসন কিনা। সেটা হতে পারে Convention Refugee বা Person in Need of Protection. মনে রাখতে হবে IRB কিন্তু CIC অথবা CBSA-র কোন অংশ নয়।

আপনাকে নিজে বা উকিলের সাহায্য নিয়ে IRB কে সন্তুষ্ট করতে হবে যে আপনি একজন Conversion Refugee বা Person in Need of Protection. এটা আপনাকে করতে হবে আপনার কেসটিকে সুন্দর করে সাজানো এবং সে বিষয়ে যথাযোগ্য প্রমাণাদি এবং আপনার হেয়ারিং বোর্ডে মৌখিক ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে। আপনি ইংরেজি না জানলে IRB আপনার জন্য বাংলা ভাষাভাষি ইন্টারপ্রেটার এর ব্যবস্থা করবেন।

আপনার গল্পটি (কেস) যে সত্য সে বিষয়ে যত বেশি তথ্য প্রমানাদি জোগাড় করতে পারবেন তত ভাল। এসমস্ত ক্ষেত্রে একজন ভাল উকিলের সাহায্য নেওয়া বাঞ্ছনীয়। আপনার কাছে যথেষ্ট অর্থ না থাকলে আপনি এখানকার লিগাল এইড এর জন্য আবেদন করতে পারেন, তারা আপনার উকিল খরচের ব্যবস্থা করবে।

যদিও কানাডার ভিতরে এসে তারপর রিফুজি ক্লেম করা যায় তথাপি বর্ডারে বা এয়ারপোর্টে এসেই আবেদন করা অনেক ভাল। আর আপনি কানাডা আসার পর যত বেশি দেরী করে রিফুজি ক্লেম করবেন, আপনার দেশে ফিরে গেলে যে সমস্যা আছে সেটা প্রমাণ করতে তত বেশি কঠিন হবে। তাই রিফুজি ক্লেমের উদ্দেশ্য থাকলে যত দ্রুত সম্ভব ষেটা করে ফেলুন। যেমন ধরুন আপনি যদি কানাডার ইমিগ্রেশন আইন ভঙ্গ করেন, কোন কাগজপত্র ছাড়া এখানে থাকেন বা কোন ক্রিমিনাল কাজ করেন এবং ধরা পড়েন তাহলে আপনাকে Removal অর্ডার দিবে আর একবার এটা দিলে আপনার জন্য রিফুজি ক্লেম করা খুব কঠিন হবে তাই এসব কিছু ঘটার আগে দ্রুত ক্লেম করে ফেলুন। আগে বলেছি আপনি আমেরিকা থেকে কানাডা ঢুকে রিফুজি ক্লেম করতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে আপনি “Safe Third Country” আইনে পড়ে যাবেন।

বর্ডারে বা এয়ারপোর্টে এসে যদি আপনার কোন সঠিক পরিচয়পত্র না থাকে তাহলে আপনাকে হয়তো CBSA-র Detention Center বা জেলে যেতে হতে পারে। আপনার যদি পাসপোর্ট না থাকে তাহলে আপনার অন্য কোন পরিচয়পত্র দেখাতে পারেন, যেমন ড্রাইভিং লাইসেন্স, জন্ম সনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র। আপনার যদি কোনই পরিচয় পত্র না থাকে তাহলে আপনার কোন আত্মীয় বা বন্ধু কানাডাতে থাকলে তারা আপনার পরিচয় প্রমাণ করতে পারবেন। কোন পরিচয়পত্র না থাকায় আপনাকে যদি জেলে বা Detention Centre-এ রাখে তাহলে আপনি ওদের মাধ্যমে Legal Aid-এর সাথে যোগাযোগ করুন তারা আপনাকে উকিল দিবে আপনাকে মুক্ত করা এবং আপনার রিফুজি ক্লেমে সহযোগিতা করার জন্য।

এখন আপনার কেসটি IRB তে শুনানির জন্য উপযুক্ত হলে কি ঘটবে?

আপনার ক্লেমটি যদি IRB তে শুনানির উপযুক্ত হয় তাহলে IRB তে পাঠানো হবে। সংগে সংগে একটি Conditional Removal Order-ও তৈরী হবে। যদি IRB আপনার কেস গ্রহণ করে তাহলে এই Removal Order কার্যকারি হবে না। আপনার কেস IRB তে পাঠানোর পর শুনানির জন্য আপনাকে কমপক্ষে ৮-১০ মাস অপেক্ষা করতে হবে। এ সময়ে আপনাকে কাজের অনুমতি দিবে তাই আপনি কাজ করে অর্থ যোগাড় করতে পারেন, এবং আপনার শুনানির জন্য উকিলের সাহায্য নিয়ে প্রস্তুতি নিতে পারেন। আবার আপনি কোন কারনে কাজ করতে সক্ষম না হলে Social Assistance এর জন্য আবেদন করতে পারেন। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার আপনাকে থাকা এবং খাওয়া বাবদ আপনাকে নুন্যতম অর্থ প্রদান করবেন এবং আপনি এখানকার বিনামূল্যে চিকিৎসা ও গ্রহণ করতে পারেন।

আপনার IRB শুনানির দিনে আপনি এবং আপনার উকিল যদি সরকারি পক্ষের উকিলের যুক্তি খন্ডন করে বিচারককে সন্তুষ্ট করতে পারেন যে আপনার কেসটি সত্য তাহলে বিচারক আপনাকে একজন Protected Person হিসাবে বিবেচনা করতে পারেন। বিচারক তার এই সিদ্ধান্ত সংগে সংগেই জানাতে পারেন অথবা চিঠির মাধ্যমে পরে জানাতে পারেন। বিচারক যদি আপনার কেসটি বাতিল করেন অর্থাৎ আপনাকে যদি Protected Person হিসাবে বিবেচনা না করেন তাহলে আপনি তার এই সিদ্ধান্তের উপর আপিল করতে পারেন এবং অনেক সময় আপিলের মাধ্যমেও অনেকের কেস Accept হয়ে থাকে। এবং এই আপিল প্রক্রিয়াতে অনেক সময় লাগে। যদি আপিল এর পরও কেসটি Accept না হয় তাহলে Humanitarian এবং Compassionate Ground-এ আবেদন করতে পারেন। এতেও কিছু না হলে আপনাকে দেশে ফিরেযেতে হবে। তবে এ পর্যন্ত পৌছাতে আপনাকে বেশ সময় লাগবে। আপনার দেশের অবস্থা, কাগজপত্র, প্রমানাদি এবং আপনার কথাবর্তা ঠিক থাকলে আবেদন নাকচ হওয়ার কোন কারণ নেই।

IRB শুনানিতে বিচারক যদি আপনার কেসকে Convention বা Person in Need of Protection হিসাবে গ্রহণ করেন তাহলে এ সিদ্ধান্ত পাওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যেই আপনাকে স্থায়ী হওয়ার জন্য CIC-র কাছে আবেদন করতে হবে। এই আবেদনে আপনি আপনার স্বামী/স্ত্রী বা ছেলেমেয়ে থাকলে তাদের নাম যুক্ত করবেন। এরপর CIC আপনাকে PR কার্ড বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি দিবেন। সংগে সংগে আপনার স্বামী/স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরাও স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পাবেন। স্থায়ী হওয়ার পর আপনি দেশে যাওয়া আশা করতে পারবেন। আপনার কেস্, আপিল এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর নির্ভর করে এই সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কত সময় লাগবে। সেটা ২/৪ বৎসর থেকে শুরু করে ১০/১২ বৎসরও হতে পারে। আর প্রক্রিয়া চলা কালে অর্থাৎ স্থায়ী হওয়ার আগে আপনি দেশে যেতে পারবেন না। স্থায়ী হওয়ার ৩ বৎসর পর আপনি নাগরিকত্বর আবেদন করতে পারেন। আপনার স্থায়ী হওয়ার আগের প্রক্রিয়ায় যদি সময় অনেক ব্যয় হয় তাহলে আপনার পুরাপুরি ৩ বৎসর অপেক্ষা করতে হবে না তার আগেই নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন স্থায়ী হওয়ার পর যে কদিন দেশে কাটাবেন সে কদিন মোট হিসাব থেকে বিয়োগ হবে।

রিফুজি ক্লেম গ্রহণের হার আগে খুবই বেশী ছিল এবং সময়ও কম লাগতো, কিন্তু ৯/১১-এর পরে এবং বিশেষ করে সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে এখন অবস্থা আগের থেকে ভিন্ন। যাহোক এর পরও দেখছি লোকজন আসছে, আবেদন করছে এবং গ্রহণও হচ্ছে।

আশাকরি আপনাদের কিছুটা ধারণা দিতে পেরেছি। আগে বিস্তারিত জানতে হলে কানাডিয়ান সরকারী ওয়েবসাইট, CLEO (Community Legal Education Ontario) বা এবিষয়ের সরকারী আইন কানুন পড়ে দেখুন। আমি এলেখার জন্য উপরোক্ত রিসোর্সের সাহায্য ছাড়াও কিছু রিফুজি ক্লেমেন্টদের সাথে আলোচনা এবং ২/১ উকিলের সাথেও কথা বলেছি। এর বাইরে কারো কাছে এ বিষয়ের কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকলে এবং আমি সেগুলি বাদ দিয়ে থাকলে অনুগ্রহপূর্বক এই ব্লগের Comment -এ গিয়ে যুক্ত করুন অথবা সে বিষয়ে একটি লেখাও লিখতে পারেন। এর আগের পর্বে আমি লিখেছি ছাত্র/ছাত্রী হিসাবে এসে কিভাবে স্থায়ী হবেন।

আগামী পর্বে থাকবে কিভাবে দক্ষ ক্যাটাগোরিতে আসা যায় এবং স্থায়ীভাবে থাকা যায়।

মোটকথা আমার উদ্দেশ্য হলো যাদের দেশে ভাল চাকরি বাকরি, ব্যবসা বা বাবার যথেষ্ট সম্পদ এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেই এবং এখানে আসতে চান তাদরকে দেরি না করে, যে কোন একটি পদ্ধতি অবলম্বন করে দ্রুত চলে আসুন। আর এখানকার জীবন, সংগ্রাম এবং ব্যবস্থা সম্পর্কে অনেক আগেই লিখেছি তাই ভেবে চিন্তে যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তাহলে চলে আসুন। কানাডাতে আপনাকে স্বাগতম। কোন প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে এই লেখার Comment-এ গিয়ে লিখুন আমরা উত্তরের চেষ্টা করবো।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন