অনেকদিন থেকেই নববর্ষ পালন, জন্মদিন পালন, এসব নিয়ে লেখার আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল, কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ তথা গত একমাসের ব্যাবধানে দেশে -বিদেশে একটির পর একটি মর্মর্স্পর্শী দুর্ঘটনা ঘটায় আমি আমার লেখনী শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলতে বসেছি। নিউজিল্যান্ডের মসজিদের সন্ত্রাস ঘটনা, দেশে নুসরাতের মর্মান্তিক মৃত্যু, এবং সম্প্রতি শ্রীলংকা ট্রাজেডি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আপনাদের মতো আমিও অত্যন্ত ব্যাথিত ও মর্মাহত। গত বেশ কয়েকদিন ধরে এই লেখাটি একটু একটু লিখছিলাম । আজ যখন লেখাটি শেষ করবো বলে মন স্থির করেছি, এর মধ্যে বাংলাদেশের খবরে দেখলাম বাংলাদেশ উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণি ঝড় “‘ফণী”। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, এরই মধ্যে সাড়ে ১২ লক্ষ মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা হয়েছে । মহান সৃষ্টি কর্তার কাছে দোয়া করি, আমাদের সবার মঙ্গোল করুন।

যাক, মূল আলোচনায় আসা যাক। প্রবাসী জীবনে উইকেন্ডে ছুটির দিনে জন্মদিন, নববর্ষ ইত্যাদি এটা ওটা বিষয়ে অতিথিয়তা লেগেই থাকে। একেক অনুষ্ঠানে জমিয়ে ওঠা আড্ডায় খোশ গল্পের পাশাপাশি অনেকসময় নানান ধরণের মানুষের অনেক দর্শন, রাজনীতি, খেলাধুলা প্রভৃতি বিষয়ে সিরিয়াস টাইপের আলোচনা হয়। এসব আড্ডায় অনেকসময় ভয়ানক ধরণের তর্কাতর্কি হয়। আমি ড্রয়িং রুমের এক কোনায় বসে এসব আলোচনা মন দিয়ে শুনি এবং উপভোগ করি। বিভিন্ন অনুঠানে এধরণের আলাপ/আলোচনা থেকে আমি বর্ষ পালন, জন্মদিন পালন ইত্যাদি নিয়ে কিছুটা লেখার একধরণের তাড়না অনুভব করছিলাম যা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

জন্মদিন, নববর্ষকে বুঝতে হলে আমাদেরকে সংস্কৃতি এবং ধর্মকে দুটি বলয়ে রাখতে হবে। এদুটিকে একই বলয়ে রাখতে যেয়ে আমরা খেই হারিয়ে ফেলি। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে আমরা যতই চাই না কেন এই ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে এতই ভাব যে এরা মাঝে মাঝেই জড়াজড়ি করে একে অপরকে সাথে নিয়ে চলার চেষ্টা করে এবং কখনো কোনো মুহূর্তে ধর্ম সংস্কৃতিকে বা সংস্কৃতি ধর্মকে ডমিনেট করে আর তাতেই বিপত্তি ঘটে। আজকের নব বর্ষ পালন/জন্মদিন পালন বিষয়ক আমার মূল আলোচনাযু যাওয়ার আগে আমি কয়েকটি ফ্যাক্টরের আলোকে বাংলাদেশের সংস্কৃতির বিস্তারিত কিছু কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরবো: বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে শাসনকর্তার প্রভাব, ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব, মধ্যপ্রাচ্য তথা পাকিস্তানী সংস্কৃতির প্রভাব, পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির প্রভাব এবং তথ্য প্রযুক্তি ও স্যাটেলাইটের প্রভাব। আমরা জানি, বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। এদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম আমি আমার লেখায় বাংলাদেশের সংস্কৃতি বুঝতে মূলত: বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠির সংস্কৃতিকেই বোঝাতে চাচ্ছি। ধর্ম অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান আমার অনেক সীমিত। আমি চেষ্টাকরবো যত কমভাবে ধর্মের বিষয়ে আলাপ করা যায় এবং সেi সাথে সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে নিরপেক্ষভাবে আমার মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করবো ।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে শাসনকর্তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রভাব:

আমাদের অঞ্চলের অনেক প্রাচীন থেকে অদ্যাবধি ইতিহাস ঘেটে পাওয়া যায় অনেকসময় রাষ্ট্র পক্ষ প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে আসছে। আমি এই লেখাটি লিখছি সুদূর কানাডার একটি শহরে বসে। মজার ব্যাপার হচ্ছে কানাডা আমেরিকা যাই বলিনা কেন এদের সভ্যতার ইতিহাস কিন্তু খুব বেশি বছরের না খুব বেশি হলে কয়েকশো বছরের। অথচ দেখুন আমাদের বাংলাদেশের অঞ্চলের সভ্যতার ইতিহাস, সংস্কৃতির ইতিহাস যীশুখৃষ্টের জন্মেরও আগে। মৌর্য বংশের রাজারা যীশুখৃষ্টের জন্মের আগে থেকে ভারতীয় উপমদেশ শাসন করতে থাকে। ওঁদের রাজধানী ছিল আমাদের আজকের বগুড়ার “মহাস্থান গড়”। মৌর্য বংশের রাজাদের মধ্যে একজন জনপ্রিয় রাজা হিসাবে রাজা অশোকের নাম আমরা কম বেশি সবাই শুনেছি যিনি প্রজাদের মঙ্গোল চাইতেন। ইতিহাস ঘেটে পাওয়া যায় এই মহাস্থান নগরী পরবর্তীতে গুপ্ত, পাল, সেন ও আরো পরে অনেক হিন্দু সামন্ত রাজাদের রাজধানী ছিল, যার নিদর্শন আজ সেখানকার যাদু ঘড়ে সংরক্ষিত আছে। পাল বংশ আট শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় চারশত বছর বাংলা ও বিহার অঞ্চল শাসন করেন। পাল রাজারা নিজেরা বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী হলেও তাঁদের রাজত্বে প্রজারা বিভিন্ন ধর্মপালন করার সুযোগ পায়। এসময়ে আমাদের বাংলা ভাষার অনেক সমৃদ্ধি ঘটে। পরে সেন বংশ এ অঞ্চল প্রায় একশ বছর শাসন করেন। সেন বংশের রাজারা একেকজন গোড়া হিন্দু বলে জানা যায়। আর তাই, তাঁদের শাসন আমলে এ অঞ্চলে হিন্দুত্ব সংস্কৃতির বিশেষ বিস্তার লাভ ঘটে। সেন বংশসের পরে ১২০০ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বখতিয়ার খিলজির হাত ধরে এ অঞ্চলে তুর্কি শাসন চালু হয় এবং এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটে । এ সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাদ্রাসা, মসজিদ নির্মাণ হয়। পরবর্তীতে অারব, পারসীয়, অাফগান, মুঘল প্রভৃতি অভিযানকারী জাতি দ্বারা বাংলা শাসিত হয়। এসময় থেকেই মূলত আমাদের দেশে মুসলমান সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে ও ব্যাপকতা লাভ করে। আমরা সবাই সম্রাট আকবরের কথা জানি, উনি আমাদের অঞ্চলে নববর্ষ প্রথা সর্বপ্রথম চালু করেন। আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত যেতে চাচ্ছিনা । পরবর্তীতে, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পরে প্রায় ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনামলে দেশে স্কুল /কলেজ /বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। আমরা ধূতি/পাঞ্জাবি-র পাশাপাশি শার্ট/প্যাণ্ট পড়তে শিখি । ইংরেজি পড়তে উৎসাহিত হয় । ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি খেলা আত্মস্ত করি । ব্রিটিশ আমলে মুসলমানরা হিন্দুদের চেয়ে শিক্ষা/দীক্ষায় কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও রাজনীতিতে হিন্দু মুসলমান সবারই সমান বিচরণ লক্ষো করা যায় । এসময় হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় থেকেই ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন হয় এবং ইতিহাসের পাতায় ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ বসু-র পাশাপাশি আমরা হাজি শরীয়ত -উল্লাহ, বিপ্লবী মহসিন (দুদু মিয়া ) এনাদের তাৎপর্যপূর্ণ অবদানও দেখতে পাই। এ অঞ্চলে এসময় মূলত: নেহেরু-গান্ধী পরিবার দ্বারা পরিচালিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পার্টি-র পাশাপাশি ১৯০৫ সালে ঢাকায় গঠিত হয় নিখিল ভারত মুসলিগ যার নেতৃবৃন্দ ছিলেন: মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলি খান, খাজা নাজিমুদ্দিন, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুক হক প্রমুখ ব্যাক্তিত্ব । কংগ্রেস, মুসলিম লীগ নেতৃত্বের যুগপৎ কার্জকরীতে ব্রিটিশরা চাতুরতার সাথে ধর্মের উপর ভিত্তি করে দুটি পৃথক দেশ সৃষ্টি করেন যা আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ সংস্কৃতিতে হিন্দু-মুসলিমে সংস্কৃতের সংমিশ্রনে অদ্যাবধি এক বিরাট গোলযোগের সৃষ্টি করে। এসময়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল সহ অনেকে এগিয়ে আসেন এবং অসম্প্রদায়িক সংস্কৃতির উম্মেষ ঘটে। বাংলা ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন ও বাংলাদেশের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আমাদের দেশে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা সমন্বিত সংবিধান মাথায় নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত হয় এবং ” বাঙ্গালী” সংস্কৃতির প্রসারলাভ ঘটে।বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা উধাও হয় আবার ফিরেও আসে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হয়। ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান -এর অম্লমধুর সম্পর্কের টানা পোড়ায় বাংলাদেশ একধরণের মিশ্র সংস্কৃতি চর্চার খেত্র পরিণত হয়। প্রবল উৎসাহ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্র/ছাত্রীরা আল্পনা আঁকে রং/বেরঙের মুখোশপরে, মঙ্গোল শোভাযাত্রাকরে নববর্ষ পালন শুরু করেন । নেপথ্যে থেকে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শকুনেরা ছলে/বলে কৌশলে বাংলাদেশিদের মধ্যে “স্বাধীনতার অবদান কার বেশি ইত্যাদি বিতর্কের অবতারণার মধ্যদিয়ে হতভাগ্য বাংলাদেশিদেরকে ‘বাঙ্গালী’ বনাম ‘বাংলাদেশী’ সংস্কৃতের সাথে গোলযোগ বাধিয়ে আমাদেরকে একধরণের ধান্দায় ফেলে দেন । তবে একদিকদিয়ে আমি সকল সরকারকেই ধন্যবাদ দেই সব সরকারের আমলেই বাংলাদেশে মুসলমানদের জন্য দুই ঈদ, আশুরা, ঈদ-ই মিলাদ উন্নবী, হিন্দুদের জন্য জন্মাষ্টমী, দূর্গা পূজা, খ্রিষ্টানদের জন্য বড় দিন, বৌদ্ধদের জন্য বুদ্ধ পূর্ণিমা সরকারি ছুটি বহাল রেখে বাংলাদেশিদের মধ্যে ধর্ম নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন এবং নব বর্ষকে সরকারি ছুটি ঘোষণার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে সম্মান জানিয়েছেন। যাহোক, এবাবেই আমাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে আমরা প্রাচীন কাল থেকেই সরকারের তথা শাসনকর্তাদের একধরণের প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখতে পাই।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব:

এর আগের অংশে আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি আমাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে কিভাবে শত শত বছরের হিন্দু রাজাদের রাজ্য শাসনের ফলে আমাদের অঞ্চলে হিন্দু সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। এখন চলুন আমরা কিছু বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে দেখি আমাদের বাংলাদেশের মুসলিম সংস্কৃতিতে আমরা কিভাবে হিন্দু সংস্কৃতির কিছু অংশ এখনো আঁকড়ে ধরে আছে । আমাদের সামাজিক বিয়ে পর্বে বর / কোণের হলুদ মাখানো অনুষ্ঠান বা মেহেদী অনুষ্ঠান (Mehdi Party ) , প্রেগনেন্ট মহিলাদের সাধ দেওয়া অনুষ্ঠান (baby shower ), মুরুব্বীদেরকে পা ছুঁয়ে দোয়া নেওয়া, ব্যবসা/বাণিজ্যে সন্ধ্যা-বাতি জ্বালানো, হালকাথা, নব-বর্ষ পালন, নবান্ন, চৈত্র সংক্রান্তি, বসন্ত উৎসব ,পিত/মাতাকে বাবা /মা বলে সম্বোধন, ধূতি পাজামা পরিধান করা, মাথায় সিঁদুর দেওয়া, ইত্যাদি সহ আরো কিছু বিশ্বাস যেমন: বৈশাখ মাসে বিয়ে না দেওয়া, শনিবার/বৃহস্পতিবার যাত্রা না করা ইত্যাদি । এই যে উদাহরণগুলো দিলাম এগুলি আমাদের বাংলাদেশের মুসলিম পরিবারে প্রাকটিস হলেও একেক পরিবারের পারিবারিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, পরিবারের স্বকীয় ধর্মভীরুতা, পারিবারিক আয়/উপার্জন তথা স্বচ্ছলতা ইত্যাদি অনেক ফ্যাক্টার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় । আগের মতো এখনো গ্রাম বাংলায় ধুমধাম করে পয়লা বৈশাখ উজ্জাপিত হয়, পহেলা বৈশাখে মেলা বসে । সেখানে গুড়ের জিলাপি বিক্রি হয়, বাচ্চারা মাটি-র তৈরী খেলনাপাতি, বেলুন, ঘূর্ণি কিনে থাকে, নাগর দোলা উঠার বায়না ধরে,কখনো কখনো মেলায় পুতুল নাচ হয় । গ্রাম বাংলার এই নব বর্ষ পালন উৎসব শহরে এসে কালচক্রে আরো ফুলে ফেঁপে নতুন মাত্রা পেয়েছে. নারী /পুরুষেরা বিশেষ পোশাকে এই সরকারি ছুটির দিনে রমনার বটমূলে একত্রিত হয়, ছেলেমেয়ে পরিবার সহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করে. এসব কিছু প্রমান করে আমাদের সংস্কৃতিতে এখনো ভারতীয় সংস্কৃর প্রভাব বিদ্যমান ।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মধ্যপ্রাচ্য তথা পাকিস্তানী সংস্কৃতির প্রভাব:

এর আগে আমরা আলোচনা করেছি বাংলাদেশে অনেক বছর মুসলিম শাসন ছিল, তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান থেকে এসে অনেকে এ অঞ্চল শাসন করেছেন। এছাড়াও এসব এলাকা থেকে অনেক ধর্মপ্রাণ ব্যাক্তি ধর্ম প্রচার করতে এদেশে এসেছেন এবং এভাবে এ অঞ্চলে একটি মুসলিম প্রধান জনগোষ্ঠী গড়ে উঠে। স্বাধীনতার পরেও অনেক পাকিস্তানি নাগরিক এদেশে থেকে গেছে যাদেরকে আমরা সাধরণত: আটকে পরা পাকিস্তানি বা বিহারি বলে থাকি। চুলুন দেখা যাক আমাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মধ্যে প্রাচ্য ও পাকিস্তানী তথা বিহারি সংস্কৃতির প্রভাব কতটুকু আছে তা দেখার । আমরা ছোট বড় কারো সাথে দেখা হলে বা ফোনে কথা বলতে শুরুকরলে সালাম দিয়ে কথা বলি ( যদিও আমরা আসালামু আলাইকুম সঠিকভাবে না বলে আমাদেরকায়দায় উচ্চারণ করে থাকি), মুসলমানি/খাৎনা অনুষ্ঠান, আকিকা অনুষ্ঠান, পিতা /মাতাকে আব্বা/আম্মা (কালক্রমে যা আব্বু, আম্মু, হয়েছে), উচ্চস্বরে দরূদশরীফ পড়ে মিলাদ মাহফিল, শবেবরাত পালন, মারা যাওয়ার ৪০ দিন পরে চালশে বা চল্লিশা, মৃত্যুবার্ষিকীতে কবর জিয়ারত করা, আত্মীয়ও স্বজন, ফকির/মিসকিন খাওয়ানো রোজার সময় হরেকরকমের ভাজাপোড়া দিয়ে ইফতারি, মহিলাদের, মাথায় কাপড় দেওয়া, বোরকা পরা, হিজাবা পরা, নেকাব পরা, মহিলাদের হাতে মেহেদী দেওয়া, ছেলেদের কাবুলি ড্রেস , গিরা পর্যন্ত লম্বা জুব্বা পরিধান , জন্মের সময় ছেলে হলে আজান দেওয়া ইত্যাদি। এগুলিও একেক পরিবারের পারিবারিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, পরিবারের স্বকীয় ধর্মভীরুতা, পারিবারিক আয়/উপার্জন তথা স্বচ্ছলতা ইত্যাদি অনেক ফ্যাক্টার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির প্রভাব:

আমাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মধ্যে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির যথেষ্ট প্রভাব লক্ষো করা যায় । যেমন ধরুন, জন্মদিন পালন , বিবাহ বার্ষিকী পালন, পাশ্চাত্য ঢঙে পোশাক (ছেলেদের হাফ প্যান্ট পড়া , মেয়েদের ফুলপ্যান্ট পরা, স্কার্ট পরা , ম্যাক্সি পরা মহিলাদের পুরুষদের মতো করে মাথার চুল ছাটা, মানুষের সাথে দেখা হলে হ্যান্ডশেক করা, ব্যান্ড সংগীত, পপ /রক/ রাপ সংগীত, বাংলা বলার সময় প্রচুর ইংরেজি শব্দের ব্যাবহার, পিত/মাতাকে ড্যাড / ড্যাডি-ম্যাম/ম্যাম্মি বলে সম্বোধন করা, ছোটো/ বড় সবার সাথে মুখের উপর কাটা কাটা কথা বলা (Direct approach), ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা ভালোবাসা দিবস উজ্জাপন, নারী শিক্ষা, কর্ম ক্ষেত্রে মহিলাদের বিচরণ, আমাদের খাদ্য অভ্যাস, খাবারের তালিকায় পাস্তা, বারবিকিউ ইত্যাদি সংযোজন, অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে না দেয়া, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্বোধোনে আপনে /তুমি থেকে শুধুমাত্র ‘তুমিতে’ রূপান্তরিত হওয়া, স্বামীকে নাম ধরে ডাকা ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। পশ্চিমাদের প্রভাবে আমাদের সংস্কৃতিতে দেখতে পাই সংসারে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যেমন উন্নয়ন ঘটেছে আবার পশ্চিমাদের মতো আমাদের সমাজেও বিবাহ বিচ্ছেদের প্রবণতাo বৃদ্ধি পেয়েছে , একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবারের সৃষ্টি হয়েছে, এতেকরে একদিক দিয়ে যেমন বৌমা/শাশুড়ির বৈমাতৃসুলভ আচরণ কমেছে কিন্তু অপরদিকে , বাচ্চারা নানা/নানী, দাদা/দাদির শ্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়াছে। বাবা/বায়ের সাথে ছেলে/মেয়ের সম্পকের পরিবর্তন হয়েছে। সমাজে বৃদ্ধাশ্রম বা (old home care ) সৃষ্টি, হয়েছে পরিবারে তথা সমাজে নারী/পুরুষের সমঅধিকার নিয়ে কথা বলা শুরু হয়েছে। এই উদাহরণ গুলি অধিকাংশ সমাজের মধ্য বিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত শ্রেনি-র মধ্যে পরিলক্ষহীত হয়। তবে কিছুটা নিম্ন বিত্তের মানুষের মাঝেও লক্ষো করা যায়। আমি বাংলাদেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চেলেও দেখেছি মহিলারা ম্যাক্সি ব্যাবহার করছেন, গ্রাম অঞ্চলের মহিলারা শহরের কাজের মানুষের চাকুরীর দিকে না ছুটে, নগকর্মীদের কল্যাণে স্বাবলম্বী হতে শিখছে, শহরে যেয়ে গার্মেন্টসে চাকুরী । আমাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে পারেন্টিং-এরও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে । আমরা ট্রাডিশনাল Authoritarian Parenting থেকে বের হয়ে পশ্চিমাদের মতো কিছুটা Authoratative Parenting এর দিকে ঝুকে পরতে শুরু করেছি যা ছেলে/মেয়েদের সাথে কিছুটা বন্ধুভাব বজায় রেখে ওদের চাহিদার কোথাও মাথায় রাখা শেখায়। এসব উন্নতির পাশাপাশি আমাদের স্বীকার করতে হবে এই যে নূসরাতদের যে পৈশাচিক ভাবে হত্যা করা হয়েছে, এই যে আমাদের বাংলাদেশে সার্বিকভাবে বলবোধের অবক্ষয় হচ্ছে, মানুষের মাঝে মৌলবাদী মতবাদ তৈরী হচ্ছে বা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে তা আমাদের সবার একটি সুস্থ সুন্দর অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি থেকে সরে এসে প্রযুক্তি নির্ভর পশ্চিমা সংস্কৃতির দিকে ঝুকে পরারই এক ধরণের পরিনাম।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে প্রযুক্তি ও স্যাটেলাইটের প্রভাব:

বিগত ৫-১০ বছরে সারা বিশ্বে তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এতেকরে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে পজিটিভ-নেগেটিভ দুই ধরণেরই প্রভাব উপলদ্ধি করা যায়। । বিগত কয়েক বছরে হলো আমরা দেখতে পাই আজ, বাংলাদেশের ঘড়ে ঘড়ে face book একাউন্ট। ইন্টেরনেটের ব্যাবহার আগের চেয়ে বেড়েছে বহুগুন। মানুষ ম্যাসেন্জারএর মাধ্যমে সারা বিশ্বে অনায়াসে কথা বলছে। মোবাইল ফোনের ব্যাবহার বেড়েছে । দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে ইন্টেরনেটের মাধ্যমে সারা বিশ্বের সাথে যোগাযোগের কল্যাণে পশ্চিমা দুনিয়ার মতো বাংলাদেশেও বাবা দিবস /মা দিবস সহ আরো কতো দিবস পালিত হচ্ছে যা সংস্কৃতিকে আরো সমৃদ্ধি করেছে । মোবাইল ফোনের ব্যাবহার বেড়েছে । on -line ভিত্তিক সেবা দান বৃদ্ধি পেয়েছে । আবার, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে গ্রামে গঞ্জে মানুষ ভারতীয় সিরিয়েল দেখছে, সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা দর্শকের সংখ্যা তলানিতে এসেঠেকেছে । গ্রাম পর্যায়ে দল বেঁধে বড় পর্দায় ক্রিকেট খেলা/ফুটবল খেলা দেখছে । চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে , কৃষি ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তির বাৰহেৰে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ।দেশের জিডিপি বৃদ্ধে পেয়েছে।
মানুষের আয় /উপার্জন বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের মধ্যে নব বর্ষ, বইমেলা , বসন্ত উৎসব ইত্যাদি অনুষ্ঠানে নারী/পুরুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে । প্রযুক্তির অপব্যাবহারে যুব সমাজ থেকে শুরুকরে বয়স্করাও অতিরিক্ত ভাবে face book এ আসক্ত হয়ে পরেছে । বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ‘সেলফি’-র রাম-রাজত্ব চলছে। নারী/পুরুষের অনেক সম্পর্ক গড়ছে আবার ভাঙ্গছে। এভাবেই বিগত কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে প্রযুক্তি ও স্যাটেলাইটের ভালো/খারাপ যাই বলিনা কেন, একটি ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে ।

লেখকের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা ও মতামত:

বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক উপরের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে উপরোক্ততো ফ্যাক্টরগুলির আলোকে আমরা এক কোথায় বলতে পারি ‘Rome was not built in a Day’.আমাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতি একদিনে গড়ে উঠেনি। অতি প্রাচীনকাল থেকে তিল তিল করে পাললিক শিলার মতো স্তরে স্তরে গঠিত আমাদের সংস্কৃতিকে দাঁড় করিয়েছে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা যা আমরা অতি প্রাচীনকালে আর্যগোষ্ঠী থেকে পেয়েছি। এই ভাষার সাথে ধর্মের গ্রাফটিং করেছে এই উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলিম রাজাদের শাসন। পরে এই সংস্কৃতিকে আধুনিকতার রূপ দিয়েছে ইষ্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানি-র ২০০ বছর শাসন। পরবর্তীতে প্রযুক্তির বদৌলতে এবং সমাজের বিত্তবানদের ছত্রছায়ায় বানের জলের মতো পশ্চিমা সংস্কৃতি ঢুকে পড়েছে আমাদের বাংলা সংস্কৃতিতে। এতে লাভবান হয়েছে বিত্তশীলরা। এরা বাংলাদেশের খেয়ে, পোড়ে, বাংলাদেশ থেকে সম্পদের পাহাড় বানিয়ে অবকাশ কাটাতে বেড়াতে আসে ইউরোপ/আমেরিকায়, চোস্ত-ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলে বড় বড় শপিং মলে কেনা/কাটা করে অবলীলায় ওদের সংস্কৃতির সাথে হ্যান্ডশেক করে ফুর ফুঁরে মেজাজে ঘুরে বেড়ায়, আবার এদেরকেই দেখা যায় রং/বেরঙ্গের কাপড় পোড়ে রমনার বটমূলে সবার আগের শাড়িতে বসে মঞ্চ থেকে ভেসে আসা ” এস হে বৈশাখ ” গানে তালে তালে গুন্ গুন্ করে মাথা নেড়ে নেড়ে গাইছে, মাটির পাত্রে পান্তা/ইলিশ গোগ্রাসে গিলছে, আহা, কত ভালোবাসা এদের হৃদয়ে , যেন বাংলা সংস্কৃতির প্রেমে পোড়ে একেবারে হাবু-ডুবু খাচ্ছে। দেশের পত্রিকা, ফেস-বুক -এর সকল পাতাজুড়ে এদের বর্ষ-বরণের রংবেরঙের কত ছবি !! এসব ছবির আড়ালে বৈশাখী তাপদাহ দুপুরে কৃষকের, শ্রমিকের শরীরের ঘাম বাংলার সোনালী রোদ্দুরে চিক চিক করতে থাকে । পুষ্টিহীন বাংলা সংস্কৃতি ক্ষনিকের জন্য রং মেখে সং সেজে সার্কাসের ক্লাউনের মতকরে বৈশাখী মেলায়, বসন্ত উৎসবে নেচে গেয়ে বাংলার মানুষকে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করে, এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে মৌলবাদীরা।
প্লিজ, আমাকে ভুল বুঝবেননা। আমি কোনো রাজনীতি বা ধর্মনীতি-র সমালোচনা করছিনা। আমি বিত্তশীলও না আবার , মৌলবাদীও না। আমি বহু বছর দেশ ছেড়ে প্রবাসে প্রবাসী হয়েও এখনো সমাজের মানদন্ডে আমি বাংলাদেশের নিরীহ মধ্যবিত্ত শ্রেণীকেই প্রতিনিধিত্ব করি। দেশেও যেমন বিত্তশীলদের আশেপাশে ঘেঁষতে পারিনি, একই ভাবে ভিনদেশে এসেও সাদা চামড়াদের সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরতে পারিনি। কাউকে দেখলেই কাঁধ ঝুকে ‘hey whats up ‘ বলতে শিখিনি। আমাদের বাচ্চারা এখানে আশেপাশে দেখে শেখে। স্কুলে সহপাঠীদের কাছথেকে আত্মস্থ করে ভিনদেশি ইংরেজি সংস্কৃতি। হ্যালোয়িন রাতে ভুত/পেত্নী-র মুখোশ পোড়ে ফর্সা ছেলে/মেয়েরা ব্যাগ হাতে হৈহুল্লুড় করে ঘড়ে ঘড়ে চকলেট সংগ্রহ করতে থাকে। আমাদের বাচ্চারা দুই সংস্কৃতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমরা মধ্যবিত্তরা দেশে বা প্রবাসে কখনো কোনোকালেই ময়ূর বা পাতিকাক কোনো দলেও ঢুকতে পারিনি। আমাদের এই মধ্যবিত্তদের অবস্থান দাঁড়িয়েছে শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। একটু ঝেড়ে কাশি, তাহলেই আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন ধরুন : ছোটবেলা থেকেই আমরা জেনে এসেছি আমাদের দুটি নাম। একটি ভালো নাম যে নামে স্কুল /কলেজে বা চাকুরী ক্ষেত্রে ডাকা হয় । বাবা-মা শিখিয়েছেন বাহিরের কেও নাম জিজ্ঞাসা করলে ভালোনাম (পুরা নাম) বলতে হয় । অথচ প্রাক্টিক্যালি এর প্রয়োগ অত্যন্ত সীমিত । আমরা সবাই ডাকনাম ধরেই সম্বোধন করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি, কারণ এটি আমাদের সংস্কৃতি । একটি বেশে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে আমাদের বাবা /মা আকিকা করে আমাদের নাম স্থির করেন, এটাও এক ধরণের সংস্কৃতি। আমি যখন আমার ছেলের নাম ‘নিলয়’ রাখার চেষ্টা করেছিলাম তখন আমার পরিবার থেকে বলা হলো এসব নিলয়/মলয় নামরাখা যাবেনা। আমাকে বলাহল ছেলের নাম “রেজোয়ান’ রাখতে হবে যার অর্থ ‘বেহেস্তের চাবি । আমি সুকৌশলে ‘বাঙ্গালী’ ও ইসলাম ধর্মীয় সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটিয়ে আকিকা দিয়ে ছেলের নাম ঠিক করলাম ” রেজোয়ান মোয়ীন অর্ণব। অর্ণব মানে সমুদ্র । সমুদ্রের মতো বিশাল হবে আমার ছেলের হৃদয় । কিন্তু এখানেও কথা । কানাডাতে একবার আমাদের ফ্যামিলি ডাক্তার যিনি মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছেন, উনি বললেন “তোমার ছেলেটি নাম জানো ?” আমি মানে বলে দিলাম । উনি বললেন আরবিতে অর্ণব মানে খরগোশ । দেখুন কি অবস্থা। আবার বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ফ্যামিলি নাম খুব একটা শোনা যায় না । কেউ কেউ নামের শেষে বংশ পদবি সরকার/ চৌধুরী/ আকন্দ/ফকির ইত্যাদি ব্যাবহার করেন । আমরা ১০ ভাই/বোন. একমাত্র আমার নামের সাথে বাবার নামের মিল রেখে উদ্দিন রাখা হলো । সেই সূত্রে আমিও আমার ছেলের নামের শেষে উদ্দিন পদবি ব্যাবহারের সঙ্কল্প করলাম । বিপত্তি ঘটলো ওই যে শহুরে সংস্কৃতি । যাহোক, ধরা খেলাম অন্য যায়গায় । কানাডাতে এসে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করতে এসে ছেলের নাম চাওয়া হলো । আমি বীর দর্পে বললাম রেজোয়ান মোয়ীন অর্ণব । আমার নাম জিজ্ঞাসা করা হলো আমি ঝটপট বলে দিলাম জাকারিয়া মুহাম্মদ মোয়ীন উদ্দিন । ব্যাস, আর যাই কোথায় । আমাকে বলা হলো তুমি কি ওর Stepfather? আমি উত্তেজনায় ঠান্ডার দেশে ঘামতে শুরু করলাম । আমার অবস্থা দেখে ওরা বললো, “Sorry, never mind Mr. Arnob”. আমি বাকি বছরগুলিতে ছেলেরে স্কুলে ছেলের পিতৃত্ব দাবি রেখে আমার নাম জাকারিয়া মুহাম্মদ মোয়ীন উদ্দিন ভুলে Mr. Arnob হিসাবেই থাকাকেই শ্রেয় বলে মনে করলাম।

চলুন এবার জন্মদিন পালন নিয়ে কিছু আলোচনা করি। আমার আগের আলোচনা থেকে আমরা বুঝে নিয়েছি HAPPY BIRTHDAY সংস্কৃতি ঠিক আমাদের বাংলাদেশের বিশেষকরে গ্রাম/বাংলার সংস্কৃতির সাথে মোটেই খাপ খায়না। ঐযে বললাম, বাচ্চা বলে কথা। এরা দেখে শেখে। এদের আল্লাদ পূরণ করতে অনেকসময় কেক কেটে, ভালো খাবারের ব্যাবস্থা করে একটু হৈচৈ করে ওদের মনকে আঁনন্দে ভরিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। ওরা অন্তত জানুক, ভাবতে শিখুক, আজকের দিনে ওদের এই সুন্দর পৃথিবীতে আগমন ঘটেছে শুধু এই পৃথিবীর তাবৎ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্যও নয়। ওদেরকে এই দিনে মনেকরে দিতে হবে শুধু পাওয়া নয়, এ সমাজকে, এ পৃথিবীকে দেয়ার মতোকরে ওদেরকে উপযুক্ত হতে হবে, মানুষ হতে হবে। মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। তাই জন্মদিন জাতীয় অনুষ্ঠানর মাধ্যমে বাচ্চাদের কাছাকাছি আসার এ এক সুবর্ণ সুযোগ বলে আমি মনে করি । কেক কেটেই যে জন্মদিন পালন করতে হবে , এমন কথা নেই, বাচ্চাকে সাথে নিয়ে কিছু সমাজ সেবামূলক কাজ করুন,বেশী করে গাছ লাগান, বাচ্চাকে নিয়ে স্থানীয় এতিম খানায় যেয়ে এতিম বাচ্চাদের নিয়ে দিনার করুন। আসুন, এমন একটি সংস্কৃতির কথা ভাবি যেখানে প্রতিটি জন্মদিনে ওরা বাবা/মায়েদের কাছ থেকে উপহার পাওয়ার পাশাপাশি ওরাও আমাদের উপহার দিতে শিখুক কিভাবে গুরুজনদের সম্মান করতে হয়, কিভাবে শুদ্ধ ভাবে ধর্মীয় চর্চা করতে হয় । তাহলেই দেখবেন ওরা একদিন একেকজনখাঁটি খাঁটি সোনা হয়ে পরিবারের, সমাজের তথা সারা বিশ্বের মুখ উজ্জ্বল করবে । আমি ব্যাক্তিগতভাবে জন্মদিন পালন করা নিয়ে আমাদের মুসলিম সমাজের বিতর্ক অনেকটা এড়িয়ে চলি । কারো ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করা আমার সংস্কৃতির মধ্যে পোড়ে না। তবে এতটুকু বলতে চাই, আমরা আমাদের হালাল উপার্জনের দিকে , আমাদের নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাতের কথা যেমনখেয়াল রাখবো, একইসঙ্গে আত্মীয়/স্বজন প্রতিবেশীদের হক আদায়ের কথা যেমন খেয়াল রাখবো পাশাপাশি বাচ্চাদের মন ভালো রাখার বিষয়গুলির দিকেও যেন খেয়ালরাখতে হবে । মনে রাখবেন, আমাদের বাচ্চারা আমাদের সম্পদ। ওদের ভাবলাগুলিকে, ভালোলাগাগুলিকে যেন প্রাধান্য দেয়া হয়। আবার এও ঠিক বেশী প্রাধান্য দিতে যেয়ে যেন সীমা অতিক্রম না করি সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

উপসংহার:

আমাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের বহু বছরের বহু মানুষের অনেক ধর্মীয় বিশ্বাস, অনেক রীতি নীতি ও মূল্যবোধ। আমরা আমাদের বিবেক দিয়ে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক/ অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আলোকে সকল অপসংস্কৃতিকে পরিহার করে, নববর্ষ বলি বা জন্মদিন বলি এ জাতীয় যেকোনো অনুষ্ঠান পালনা করলেও সকল ধরণের বাড়াবাড়িকে পরিহার করে বাংলাদেশের সুস্থ সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করি। হে সৃষ্টি কর্তা আমাদেরকে তৌফিক দিন আমরা যেন আমাদের নিজেদের রাজনীতির /ধর্মের/বর্ণের /বিত্তের / বিভেদ ভুলে আমাদের চলা ফেরায় বাংলাদেশের সঠিক সুস্থ সংস্কৃতির প্রয়াগ করতে পারি। হে সৃষ্টি কর্তা আমাদেরকে তথা এই বিশ্বভ্রমান্ডকে রক্ষা করুন। আমিন.

পূর্ববর্তী নিবন্ধআপনার সোশ্যাল মিডিয়ার উপস্থিতিকে পরিপাটি এবং পরিচ্ছন্ন রাখুন।
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাসী বাংলাদেশী ছেলেমেয়ে
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন