ফেলে আসা শৈশব কৈশোরের সব স্মৃতি মানুষ মনে রাখে না, মনে রাখতে পারেও না। আবার কিছু স্মৃতি মানুষের নিজের অজান্তেই শক্ত এক ভিত তৈরী করে ফেলে, ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে তার নিজের জীবনকেই। এরকম কিছু স্মৃতি আমারও আছে।  অনেক ছোটবেলায় বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আব্বা একগাদা গল্পের বই কিনে নিয়ে আসতেন আমাদের পড়ার জন্য। মহা উৎসাহ নিয়ে সেই সব বই পড়তাম। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, সবে তখন এস এস সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে, আগামী তিন মাস তেমন কিছু করার নেই। আব্বা যথারীতি ব্যাগভর্তি বই নিয়ে আসলেন, উৎসাহ দিলেন world classic বা বিশ্ব সাহিত্যের সেরা বইগুলো পড়ার জন্য। সব বইয়ের নাম মনে নেই। কিন্তু একটি বই ছিল যা বিশ্ব সাহিত্য পড়ার জন্য আমার মধ্যে বিপুল আগ্রহ জাগিয়ে তুলে। বইটি ছিল রবার্ট লুই স্টিভেনশন এর লেখা ‘Treasure Island’। এই বই আমার জন্য উন্মোচন করে নতুন এক দিগন্ত। শুরু হয় বইয়ের জগতে এক নুতন অভিযাত্রার।  একে একে পড়ি জুলভার্নের সবগুলো বই, এইচ জি ওয়েলস, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, জ্যাক লন্ডন সহ আরো অনেকের বই। বলা বাহুল্য বই পড়ার নেশা জাগিয়ে তুলতে আব্বার মিশন  সফল হয়েছিল। অনেক বছরের নিরলস চেষ্টায় নিজে যেমন বইয়ের বিশাল এক ভান্ডার গড়ে তুলেছিলেন, তেমনি উৎসাহিত করেছেন আমাদেরকে এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে। আমাদের মেয়ে লামিয়ার বইয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরী হয় দুই বছর বয়সে, ২০০৩ সালে, যখন পড়তে আসি লন্ডনে। Royal Borough  of  Greenwich এক ছোট শহর Woolwich । প্রতিদিন লামিয়াকে স্ট্রলারে বসিয়ে প্রায় বিশ মিনিট হেটে উলিচ পাবলিক লাইব্রেরিতে আসতাম। কিডস সেকশনে বসে টমাস আর ফ্র্যাংকলিনের বই নাড়াচাড়া করতে করতেই তার পড়াশুনার হাতেখড়ি।  এখন লামিয়া  বাথরুমের ক্লোজেট বই দিয়ে ভরে ফেলার কারণে যখন তার মায়ের বকুনি শুনে, আমি তখন হাসি। ভাবি, শুধু বকুনি দিয়ে এই জেনেটিক রোগ সারা যাবে না। শুধু বই পড়াই নয়, ভালো মানুষ হয়ে গড়ে উঠার নৈতিক শিক্ষা, মানুষের  প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন এবং জীবনের সব কিছুতে পরিমিতি বোধ (sense of moderation) কে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা ও আব্বা আম্মা করে গেছেন নিরলসভাবে। এখনো করে যাচ্ছেন।  কতটুকু সফল হয়েছেন জানিনা, কিন্তু এটুকু জানি যে এসব বিষয়ে আমাদের মধ্যে যথেষ্ট শক্তিশালী নৈতিক বোধের এক আস্তরণ তৈরী করে দিতে পেরেছেন। খুব সাধারণ পরিবেশে বেড়ে উঠে, সাদামাটা জীবন যাপন করেও একান্ত নিজের চেষ্টায় আলহামদুলিল্লাহ, আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের একটি অবস্থান তৈরী করতে পেরেছি। হয়তো উনাদের সফলতা এখানেই। শুধু অর্থের মাপকাঠিতে এই সাফল্যের পরিমাপ করা সম্ভব নয়।

মাঝে মাঝে ভাবি, আমাদের বাবা মা সৎ, নির্মোহ, নৈতিক জীবন যাপনের যে শিক্ষায় আমাদেরকে উদ্ভুদ্ধ করেছেন তার কতটুকু আমরা পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে সঞ্চারিত করতে পারবো। আধুনিক parenting এর ধারণার সাথে সনাতনী মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার সংমিশ্রনের সুযোগ কতটুকু আছে ?  যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে নিজের ঐতিহ্য, শিকড় ভুলে না যাওয়ার উপায় কি ? দেশ ছেড়ে এসেছি বলে কি নিজের স্বকীয়তা ভুলে পানির মতো যে পাত্রে রাখা হবে সেই পাত্রের আকার ধারণ করতে হবে ? প্রবাসে এই বিষয়গুলো অনেক ভাবনার জন্ম দেয়। একথা সত্য যে নিজেরা প্রতিকূল পরিবেশ ও সীমাবদ্দতার মাঝে বড় হয়েছি বলে ছেলেমেয়েরাও একই পরিস্তিতির সম্মুখীন হউক, তা আমরা কেউই চাইনা। কিন্তু চাইলেই যে সবকিছু পাওয়া যায়না, সবকিছুতেই যে সীমাবদ্দতা আছে, জীবন মানে যে সবসময় ফ্যান্টাসির জগতে বিচরণ নয়, সেই ধারণা ছেলেমেয়েদেরকে সঠিকভাবে না দিতে পারলে বাস্তব জীবনে কার্যত তারা আরো বেশি প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়। আমরা নিজেরা জীবনে যা অর্জন করতে পারিনি, নিজের সন্তানের মধ্যে সেই অর্জন ও তার ধারাবাহিকতা প্রত্যাশা করি। হয়তো এই প্রত্যাশা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু সেই অর্জনের জন্য মূল্যবোধ, সুশিক্ষা, পরিমিতিবোধ ও নৈতিক ভিত্তি তৈরী করে না দিতে পারলে শুধুই বিত্ত বৈভব অর্জনের শিক্ষা শেষ পর্যন্ত কারো কোনো কাজে আসে না। অতৃপ্তির জীবন তখন তাড়িয়ে বেড়ায় পরম্পরায় – এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে।

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন