বাসায় আমি, আমার স্ত্রী শিউলী ও সদ্যপ্রসূত ছোট মেয়ে রিজা।মাত্র তিন দিন হলো রিজা দুনিয়ার আলো দেখেছে।  বড় মেয়ে নুহা দুই রাত্রির জন্য টরন্টোর বাইরে গিয়েছে।স্কুলের বাৎসরিক ক্যাম্পে কার্নিতে গিয়েছে সে।হঠাৎ শিউলীর ডাকে আমার ঘুম ভাঙ্গলো।  তখন ভোর ৪টা বাজে।  আমি হুড়মুড় করে ঘুম থেকে উঠে জিঙ্গাসা করলাম, কী হয়েছে? খারাপ লাগছে? শিউলী বললো, আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে, শ্বাস নিতে পারছি না, ঘুমাতে পারছি না।আমি বললাম, তোমাকে কি হাসপাতালে নিয়ে যাব?  ৯১১ এ কল দিব?শিউলী বলল, ৯১১ এ কল করতে হবে না।একটা ট্যাক্সি কল করো, আমি হাসপাতালে যাব।

টরন্টো ইস্ট জেনারেল (বর্তমান নাম মাইকেল গ্যারণ) হাসপাতালের জরুরী বিভাগে যখন পৌঁছালাম তখন হয়ত পৌণে পাঁচটা বাজে।কাউন্টারের কর্তব্যরত ব্যক্তি শিউলীর হেলথ্ কার্ড দিতে বললেন।শিউলীর ব্যাগে তাঁর কার্ড নাই।  অনেক খোঁজাখুঁজি করে সে বলল, তুমি না গতকাল আমার ঔষুধ কেনার জন্য কার্ডটা নিয়েছিলে?  কার্ডটা তোমার কাছে। এবার আমি খোঁজা শুরু করলাম: ওয়ালেট বের করে সব কার্ড পেলাম কিন্তু তাঁর হেলথ্ কার্ড পেলাম না।  হেলথ্ কার্ড ছাড়া কি শিউলীকে জরুরী বিভাগে ভর্তি করা যাবে?  আমাকে কি আবার বাসায় ফিরে যেতে হবে? বাসায় গিয়ে কি কার্ডটা খোঁজে পাব? শিউলীতো অসুস্থ্য সে কিভাবে এখন রিজাকে রাখবে?  কোথায় যে কার্ডটা রেখেছি কোনভাবেই মনে করতে পারছি না।  বলাবাহুল্য, কানাডার সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের জন্য হেলথ্ কার্ড থাকা আবশ্যক। কাউন্টারের নারী কর্মীটি আবারও হেলথ্ কার্ড দিতে বললেন।আমি আবার খোঁজা শুরু করলাম: ওয়ালেট, প্যান্টের দুই পকেট দেখলাম।শার্টের পকেটে হাত দিতেই কার্ডটা পেয়ে গেলাম।  আলহামদুলিল্লাহ!তাড়াহুড়া করে যে শার্টটি পরে এসেছি, সেই শার্টটিই গতকাল ঔষুধ কিনতে যাওয়ার সময় পরেছিলাম।ভাগ্য ভালো যে আজও একই শার্ট পরে হাসপাতালে এসেছি।

কাউন্টারের আনুষ্ঠানিকতা শেষে শিউলীকে জরুরী বিভাগে ভর্তি করা হলো। কোলে নিয়ে, হাসপাতালে পায়েচারি করতে করতে কখন যে দুপুর ১ টা বেজে গিয়েছিল বুঝতেই পারি নি।  এর মধ্যে শিউলীকে স্যালাইন দেয়া হলো, ঔষুধ খাওয়ানো হলো, ইসিজি, এক্সরে কত কিছু করা হলো।তাঁর মাথা ব্যথা কমছে না, শ্বাস কষ্ট আগের মতই, কোনভাবেই ঘুমাতে পারছে না সে।যাঁর রক্তচাপ ১৯৪ (সিস্টোলিক)/ ৯৬ (ডায়াস্টলিক), সে কিভাবে ঘুমায়? ডাক্তার চেষ্টা করেও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না।তাঁকে জরুরী বিভাগ থেকে কেবিনে পাঠানো হলো। তাঁর নিরবিচ্ছিন্ন বিশ্রাম প্রয়োজন।  কোয়াইট জোনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সম্বলিত কেবিন। বিশাল জানালার পর্দা সরালে বরফাচ্ছন্ন টরন্টো শহর।বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন পেছনের কথা মনে হয়ে গেল।

রিজার জন্মের সময় এই হাসপাতালেই শিউলী দুইদিন ছিল।সিজার হয়েছিল।  তারপরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দুইদিন পর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল।আমাদের প্রথম মেয়ে নুহাও সিজারে হয়েছিল।বাংলাদেশের হাসপাতালে তাঁকে চারদিন থাকতে হয়েছিল। হওয়ার দুইদিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে শিউলী খুশিই হয়েছিল। নুহা কার্ণিতে যাওয়ার আগে ছোট বোনকে দেখে যেতে পারবে। বাসায় এসেই আস্তে আস্তে চলাফেরা, সংসারের কাজ কর্ম শুরু করে দিয়েছিল শিউলী। হাসপাতালে যাওয়ার আগে রান্না-বান্না করে রেখে গিয়েছিল।তার উপর আবার আমার প্রাক্তণ সহকর্মী মশিউল হাসান ভাইয়ের বাসা থেকে দু’বার খাবার পাঠিয়েছিল। মশিউল হাসান ভাই ও ভাবী আমাদের এ বিশেষ সময়টাতে অনেক সহযোগিতা করেছেন। প্রবাসজীবনে তাঁরাই অনেক আপনজন। ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনতো কেউ এখানে নেই। আশেপাশের বাংলাদেশি কয়েকটি পরিবারও খাবার পাঠিয়েছে, অনেক খোঁজ খবর নিয়েছে। সকলে সহযোগিতা করে আপন-জনের অভাব ভুলাতে চেয়েছেন।আমি ও আমার পরিবার এদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ।

কেবিনে ডাক্তারের আগমনে আমার মনোযোগ ফিরে এলো।  তিনি শিউলীকে দেখলেন।আজ রাতটা পর্যবেক্ষণে রাখার কথা বললেন।বড় মেয়ে আজ কার্ণি থেকে ফিরবে।তাকে স্কুল থেকে বিকাল ৪টার দিকে বাসায় নিয়ে আসার কথা। নার্স এসে বললেন, তোমার ছোট মেয়েকে বাসায় রাখার কেউ নেই? আমি বললাম ‘না’; আমার এই তিন দিন বয়সের মেয়েকে বাসায় দেখার মত কেউ নেই। সে আমাদের সাথে হাসপাতালেই থাকবে। নার্স আমাকে সাফ জানিয়ে দিলেন সে যদি এখানে থাকে তবে তাঁর সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব তোমার।কোন নার্স এ বিষয়ে তোমাকে কোন সহযোগিতা করতে পারবে না।মনে রেখ, তোমার স্ত্রী’র বিশ্রাম দরকার। তোমার মেয়েকে তোমাকেই রাখতে হবে, ফর্মূলা  খাওয়াতে হবে, সবকিছু করতে হবে। তোমার মেয়েকে যে তুমি নিজ দায়িত্বে এখানে রাখছ এ বিষয়ে তোমাকে একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে হবে। আমি জানতে চাইলাম কেন আমাকে এ সম্পর্কিত কাগজে স্বাক্ষর করতে হবে? সে আমাকে বুঝিয়ে বলল।সারমর্ম হলো, হাসপাতালে অনেক রোগি আসেন।তাঁদের রোগ- জীবানু দ্বারা সুস্থ্য মানুষও আক্রান্ত হতে পারেন। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেহেতু কম সেজন্য তাঁদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আরো বেশি।পরবর্তীতে যাতে কেউ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা না করতে পারে সেজন্য কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে রাখা।নিজ দায়িত্বে আমার ছোট মেয়েকে আমাদের সাথে হাসপাতালে রাখলাম।মনে মনে ভাবলাম ফর্মূলা খাওয়ানোর পর রিজাকে ঢেঁকুর তুলব কিভাবে?ডায়াপার কিভাবে পরাব?নিশ্চয়ই এসব শিখে নিতে পারব।কিন্তু বড় মেয়েকে কোথায় রাখব?

আমাদের পাশের এপার্টমেন্টের সোহানী আপার সাথে কথা বললাম। তাঁর ছেলে প্রত্যয়ও কার্নিতে গিয়েছে।তিনি নুহাকে স্কুল থেকে নিয়ে এসে তাঁর বাসায় রাখার কথা বললেন।আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় আসব বলে জানালাম।রিজা হওয়ার সময় আমরা যখন হাসপালে ছিলাম তখন সে পাশের বিল্ডিংয়ের কন্কা আপার বাসায় ছিল। এবার কোথায় থাকবে?  নুহাকে জিজ্ঞাসা করলাম সে এবার কোথায় থাকতে চায়?নুহা বাসায় থাকার কথা জানালো।সে কিভাবে বাসায় একা থাকবে? চিন্তায় পড়ে গেলাম।স্ত্রী’র সাথে পরামর্শ করে ঠিক করলাম যে সোহানী আপাকে অনুরোধ করব তিনি যেন নুহার সাথে আমাদের বাসায় এসে রাতে থাকেন।বাসায় এসে আপাকে সেভাবেই অনুরোধ করলাম। তিনি এ নিয়ে কোন রকম চিন্তা করতে না করলেন।মশিউল হাসান ভাই ও ভাবীও নুহাকে তাঁদের বাসায় রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নুহাতো নিজ বাসায়ই থাকতে চায়। সেজন্য আর হাসান ভাইয়ের বাসায় দেওয়া হয় নি।নুহার বিষয়ে একটা সুরাহা হলো। আবার হাসপাতালে ছুটলাম।রাতে রিজাকে নিয়ে পায়েচারি করি আর কিছুক্ষণ পরপর নার্সদের সাথে স্ত্রী’র রক্তচাপের উঠা-নামা পর্যবেক্ষণ করি।দু’জন নার্স নিয়োজিত ছিলেন পর্যবেক্ষণের জন্য। রিজা একটু কান্না-কাটি করলেই কেবিন থেকে বের হয়ে যাই।করিডোরে হাটা-হাটি করি।ফর্মুলা খাওয়াতে চেষ্টা করি।ডাক্তার নার্স যতই বলুক ফর্মুলা দিয়ে মেয়েকে শান্ত রাখতে কিন্তু কোনভাবেই আমি তা পারিনি। শিউলী ঘুম থেকে জেগে যায়।মেয়েকে কাছে টেনে নেয়।তাঁর আর বিশ্রাম হয় না।

সকাল বেলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এসে শিউলীকে দেখেন। বলেন, এখনোতো রক্ষচাপ স্বাভাবিক হয় নি।আমরা আজও রোগিকে হাসপাতালে রাখব। হয়তবা কাল আপনারা বাসায় চলে যেতে পারবেন।আরো একদিন হাসপাতালে থাকতে হবে! তবুও ভালো যে আর মাত্র একদিন। বড় মেয়ে নুহাকে ফোন করে বিষয়টি জানালাম।সন্ধ্যার দিকে বাসায় গিয়ে নুহাকে একবার দেখেও আসলাম।হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে তাঁকে বললাম, মা আর মাত্র একদিন।কালই বাসায় চলে আসব।এমনি করে প্রতিদিন ভাবি আজই আমরা বাসায় চলে যেতে পারব। কিন্তু বাসায় আর যেতে পারি না।  ডাক্তার বলেন, তাঁর কাছেও নাকি ব্যাপারটি ব্যতিক্রম লাগছে। বুঝতে পারছেন না কেন রক্ষচাপ স্বাভাবিক হচ্ছে না।এত সময় লাগার নাকি কথা না! কোনভাবেই তিনি এ অবস্থায় রোগিকে বাসায় চলে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারেন না।এভাবে আমাদের পাঁচটি দিন হাসপাতালে থাকতে হলো।

পাঁচদিন পর যখন হাসপাতাল ছাড়ার অনুমতি পেয়েছিলাম তখন আমাদের দু’জনের কী যে আনন্দ! এই পাঁচদিনকে জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় মনে হয়েছে।দুর্বিসহ লেগেছে প্রতিটি মুহুর্ত।দুশ্চিন্তায় কেটেছে প্রতিটি ক্ষণ। সময় থেমে থাকে না।সময় চলে যায়।তবে স্মৃতি হয়ে থাকে জীবন থেকে চলে যাওয়া সময়গুলো।

টরন্টো

২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন