আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ছি যে যার কাজে । এরই মাঝে অনেক নতুন বাঙ্গালীদের সাথে পরিচয় হলো , এদের মধ্যে কেউ কেউ খুব হতাশ আবার অনেকে জীবন কে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছে । কোথাও কারো একটা চাকুরী হলে সেটা নিউজের হেড লাইন হয়ে যায় তখন মনে আবার আশা জাগে হয়ত সবারই হবে একদিন!এভাবে টরোন্টোতে আমাদের দুই বছর চলে যায় । ভালোই লাগে , কাজ করি , বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরি , ফ্রি বই এনে পড়ি লাইব্রেরী থেকে , অনেক বন্ধু হয়ে গেল । দাওয়াত যেমন খাই আবার দেই । মনেই হয় না আমাদের কোন অভাব আছে বা ভালো চাকুরী নেই । মেয়েরাও স্কুল এঞ্জয় করে ,ভাষাগত সমস্যা নাই ।

ভালোই চলছিল , কিন্তু এরই আমার হাজব্যান্ড ও অন্যান্য বাংগালী ভাইয়েরা খবর পেল এখানে আবার কম্পিউটার সায়েন্সে পড়লেই চাকুরী নিশ্চিত । এর মধ্যে বেশীর ভাগই ইঞ্জিনিয়ার । আমার হাজব্যান্ড ও বাসায় এসে তার সিদ্ধান্ত জানালো সে পড়তে যাবে। আমাদের যাবার ইচ্ছা নাই কারন আমি এখানে কাজ করছি , আর মেয়েরাও এডজাস্ট করে নিয়েছে । তার কিছু বন্ধুরাও এসে আবার পড়ার উপকারিতা বোঝালো , কি আর করা । কিন্তু আমাদের যেতে হবে নায়েগ্রা ফলসের কাছে ছোট্ট শহর সেন্ট ক্যাথারিন্সে , ব্রক ইউনিভার্সিটি টা ওখানেই । মন বিষন্ন হয়ে গেল ! এভাবে আর কত দিন ভেসে বেড়াব ! আবার নতুন করে পরিচিত হতে হবে ! নতুন পরিবেশ, কেমন যাযাবর জীবন হয়ে গেল।

এমনি কোন এক দিনে আমরা মুভ করলাম । আসতে রাত হয়ে গেল , নিঝুম এক জায়গা । রাত দশটায় শুনশান নিরবতা । গা ছম ছম করা খারাপ লাগা । কিন্তু যখন জানতে পারলাম এই বিল্ডি এ একসাথে ২২ টা ফ্যামিলি মুভ করেছে আর সবাই ছাত্র । অনেক কষ্টের মধ্যেও আলোর মুখ দেখার চেষ্টা আর সান্ত্বনা ,সবার একই অবস্থা । সবার হাজব্যান্ড ছাত্র, ছাত্রী আছে ২/১ জন।
আমাদের এপার্টমেন্ট টা একেবারে স্কুলের বাউন্ডারির সাথে, সবার ওই বিল্ডিং এ বাসা নেবার এও একটা কারণ। একে একে অনেকের সাথে পরিচয় হলো, আর যাই হোক দেশী লোকজন তো পেলাম! ছেলে মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করার পর মায়েদের কাজ গ্রোসারি স্টোর খুজে বের করা। কারণ বাড়ির কর্তা রা এতটাই ব্যস্ত যে বাজার করার সময় নাই। বয়স কালে পড়া!! প্রায় দুই কিলোমিটার হেটে আমরা গ্রোসারি করতে গিয়েছি, খারাপ লাগেনি। কয়েকজনের একটা গ্রুপ। মজার আরেক টা ব্যাপার ছিল ইউনিভার্সিটি থেকে একজন আসত দুপুরে খাবার নিতে, আমরা তারকাছে খাবার পাঠিয়ে দিতাম আর বুঝে নিতাম আজকে রাতে হয়ত ওরা ল্যাবে থাকবে। এমন অনেক সময় গিয়েছে রাতে বাড়ি ফিরেনি , কারন এখানকার পড়াশুনা আর এসাইনমেন্ট খুব টাইম মাফিক করতে হয়।
আমি আমার ম্যাকডোনাল্ডসে র কাজ টা ছেড়ে এসেছি। তখন জানতাম না কেউ অন্য জায়গায় মুভ করে তখন সে আনইম্পলয়মেন্টে থাকতে পারে। যখন জানলাম তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। আমি ইতিমধ্যে এডাল্ট লার্নিং সেন্টারে অফিস সেক্রেটারি হিসেবে কাজের জন্য কম্পিউটার প্রশিক্ষণ এ ভর্তি হলাম, এখানেও কোর্সের শেষে সালভেশন আর্মির হেড অফিসে প্লেসমেন্টে পাঠালো। ওদের ফোন সিরিভ,ডাটা এন্ট্রি থেকে ব্যাংকিং সব কাজেই সহযোগিতা করতাম। কাজ এঞ্জয় করতাম, কিন্তু চিন্তা থাকত দুজন বেকার থাকলে কিভাবে চলবে? এখানে বলে রাখি আমরা যখন এখানে এসেছি তখন স্টুডেন্ট লোন পেতে এক বছর অন্টারিওতে থাকতে হতো। স্টুডেন্ট লোন টিউশন ফির সাথে ফ্যামিলি সাপোর্ট এর জন্য ও টাকা দেয়। তবে মনে রাখতে হবে ভালো চাকুরী হয়ে গেলে ছয় মাসের মধ্যেই ইন্টারেস্ট সহ লোন ফেরত দিতে হবে। ব্যাপার না, সবাই তো আশা নিয়েই এই বয়সে পড়তে গেছে।
একটা বিল্ডিং এ ২৪/২৫ টা দেশী ফ্যামিলি বেশীর ভাগ মহিলারা বাসায়,বাচ্চারাও খুব ভালো আছে এখানে। খেলা আর আড্ডা মনে হবে মিনি বাংলাদেশ। এমন কোন উইকেন্ড নাই দাওয়াত ছাড়া যেত। ঘুরে ফিরে সেই এক ই মুখ, কিন্তু আমাদের মত আড্ডাবাজদের জন্য খুব ভালো।
মেয়েরা যে স্কুলে ভর্তি হলো সব হোয়াইট টিচার আর স্টূডেন্ট ও একই গ্রুপের। এর আগে তারা এতো মাল্টিকালচার ছাত্র/ ছাত্রী পায় নাই। এখানে ছোট সিটি গুলোতে বেশীর ভাগ বয়স্ক মানুষেরা বাস করে আর কিছু প্রফেশানাল চাকুরী জীবিরা বাদ বাকী যারা কোন দিন ও কিছু করে না তারা। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন, সবাই সব জায়গায় থাকে। যাহোক প্রথম সেমিস্টার রেজাল্ট দেখে আমি বিস্মিত, আমার মেয়েরা লেখা পড়া তেমন না করেও “এ ” প্লাস। কৌতূহল হলো, জিওগ্রাফিক্যাল ডাটা নিয়ে বুঝতে পারলাম এখানে বেশীর ভাগ ই সিংগেল প্যারেন্ট। আরেক ভাবে বোঝা যায় যখন দেখবেন একটা স্কুলে ” ব্রেক ফাস্ট ফর লার্নিং প্রোগ্রামে বেশী স্টুডেন্ট থাকে “। আমি একটা জিনিষে বিশ্বাস করি যারা ভালো করার যেকোন জায়গা থেকেই করবে। স্কুল একটা ফ্যাক্টর মাত্র।

চাকুরী বা কাজ খুজি কিন্তু ছোট সিটিতে কাজ পাওয়া খুব কঠিন। আর বাস ছাড়া কোথাও যেতে পারি না। এর ই মধ্যে হঠাত খুব অসুস্থ্য হয়ে পড়লাম, হাস্পাতালে তিন দিন থাকার পর স্পেশালিষ্ট এর কাছে গেলাম ১০ দিনের মাথায়। তার ওখান থেকে বের হয়ে মাঠের মধ্যে দেখলাম একটা ওয়াল্মার্ট। উদ্দেশ্য ম্যাকডোনাল্ডসে কিছু খাওয়া আর কেনা কাটা। ঢুকেই মেইন দরজার সামনে এড দেখলাম ” হায়ারিং”। কোন চিন্তা না করেই ফর্ম নিয়ে এপ্লাই করে দিলাম। ধরেই নিয়েছি ডাকবে না তবুও চেষ্টা করা আর কি! বাসায় ফিরে আসার ঘন্টা খানেক পরেই ফোন পেলাম , আগামী কাল ইন্টারভিউ তে আস তে পারবে কিনা? সংগে সংগে রাজী হয়ে গেলাম। আর সেই গল্প পরের পর্বে।


চলবে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন