ঢাকার দিন গুলি যতই শেষ হয়ে আসছিল ততই আমার মন খারাপ হতো । কানাডা আসার জন্য যখন এপ্লাই করলো আমার হাজব্যান্ড মনে হতো কি জানি হলে ভালো !আর না হলেও আফসোস নাই । আমি খুব অল্পতে সুখী মানুষ । আমার জন্ম আর বেড়ে ওঠা যেমন বড় পরিবারে আবার বিয়ের পরে একটি বড় পরিবারের দায়িত্ব পেয়ে গিয়েছি।সুতরাং এতো মানুষের সান্নিধ্য ছেড়ে আমরা অজানার উদ্দেশ্য পাড়ি দিচ্ছি ।শুধু কল্পনায় ছিল কানাডা বরফে ঢাকা কোন দেশ , সেই ভয়ে বঙ্গ বাজার থেকে মোটা জ্যাকেট কিনেছি সবার জন্য । যাহোক সমস্ত কান্না ভেজা চোখ গুলোকে কাচের দেয়ালের ওপাশে রেখে আমরা উঠলাম ক্যাথেপ্যাসেফিকে হংকং হয়ে প্যাসিফিক পাড়ি দিয়ে আসা । চার ঘণ্টা যাত্রা শেষে ৮ ঘণ্টার বি রতি । আর এই স ম য় আমার মেয়েদের ২য় দফা কান্নার তোড়জোড় চলছে । প্রশ্ন এক টাই আমরা কেন যাব? সবার জন্য খারাপ লাগছে । আমাদের ও খুব মন খারাপ কিন্তু কি আর করা । হংকং এয়ার পোর্ট অত্যন্ত চমতকার । পাহাড় পর্বতের ভিতর দিয়ে প্লেনের ওঠানামা দেখলাম ,কিন্তু উপভোগ করতে পারছি না । আমার সেই ঢাকা এয়ার পোর্ট ই ভালো ।
আমরা ৫ জন ছাড়া সব যাত্রী চাইনিজ । আমি ম্যাপ দেখছি আর বোঝার চেষ্টা করছি কোথা দিয়ে যাচ্ছি । এটুকু ই জানি প্যাসিফিক পাড়ি দিচ্ছি ,কোন এক সময় এয়ার হোস্টেসদের ডাকে ঘুম ভাঙল্‌ । দিত্বীয় দফা ঘুমের শেষে শুনি আমরা এংকোরেজ এয়ার পোর্টে আলাস্কায় । নামতে হলো না ওয়াশরুমে ফ্রেস হতে যাত্রীরা বের হলো আর প্লেনে ফুয়েল নিল । চারিদিকে যতটুকু দেখতে পেলাম শুধু বরফ । সেখান থেকে ৮ ঘন্টা পরে টরোন্টো এয়ার পোর্ট এসে নামলাম । আমাদের এক বন্ধু এয়ার পোর্টে ছিল স্ত্রী সহ , আমার আত্মা খুশিতে ভরে উঠল ওনাদের দেখতে পেয়ে । ওনারাও নতুন বাড়ী কিনে টরোন্টো থেকে মিসিসাগা তে এসেছে । খাবারের টেবিলে গল্পের সময় ভাবীকে জিজ্ঞেস করলাম কতদিন দেশে যান না ? উনি বললেন ৩ বছর । আমার বিস্ময় কাটে না কিভাবে সম্ভব দেশ, বাবা মাকে ছেড়ে এতদিন বিদেশে পরে আছেন । সে আমাকে আরোও বুঝিয়ে দিল আসছেন , বুঝবেন , শিখবেন এখানে ওয়ান ওয়েতে আসার মত , যেতে পারবেন না সহজে । আসলে তাই হলো যে আমি সবাইকে বলে এসেছিলাম প্রতিবছ র দেশে যাব কিন্তু ৮ বছর পরে প্রথম দেশে গিয়েছিলাম ।
আমাদের জন্য আগেই বাসা ভাড়া করা ছিল , আমাদের এক দেশী ভাই পরের দিন নিতে আসল টরন্টো থেকে । সেও সারাপথ জ্ঞান দিল , কি করিলে কি হইবে । তা ভালোই লাগলো একবারে নিজের এলাকার লোক পেয়েছি, শুনাক না দুচার কথা ।


এবার আরেক বিস্ময়ের পালা যে বিল্ডিং এ উঠেছি সেটা বাংগালী পাড়ায় না । কিন্তু মানুষ গুলো দেখতে আমাদের মতই , কালো তবে একটু বেশী খস খসা । ভাবলাম দেশী লোকজন , ভালোই হলো । প্রচন্ড ঘুম চোখে নিয়েও সবাই মিলে নীচে নামলাম মানূষ দেখার জন্য । দেখি এদের ভাষা অন্য । ৩৫০ টা বর্ণ মালা দিয়ে কথা বলে । মানে তামিল , পরে শুনেছি তামিল টাইগার রা এই খানে থাকে । সুতরাং বাঙ্গালী দেখতে হলে আমাদের অনেক দূরে যেতে হবে । আমরা থাকতাম ডন মিলস আর এগ্লিন্টন , আর ড্যানফোর্থে দেশী লোকের আড্ডা আর এখানে তামিলদের খনি ।
যেখানেই যাই ৫ জন একসাথে , যাতে না হারাই । আবার যে রাস্তা দিয়ে যাই খুব খেয়াল করে আশে পাশের জিনিস দেখে রাখি সেই যে হারানোর ভয় । আমার তিন মেয়ে সময় পেলেই কান্না করতো দেশে যাবে বলে । আমাদের উত্তর নাই ।এবার বলি আমাদের সেই দেশী ভাই কিন্তু অনেক উপকার করেছে । ইঞ্জিনিয়ার নুরুল ইসলাম । এখানে আসার পর সবাইকেই আপগ্রেড করতে হয় , যেমন লিংক স্কুলে যেয়ে ইংরেজী শেখা ( অনেকে হয়ত ভাবে সে সব জানে ), ডাইভিং লাইসেন্সের জন্য রিটেন পরীক্ষা দেয়া । সেই ভাই আমার হাবিকে এক টা বই জোগাড় করে দিয়ে বলল ৫ দিন পর আমি আসব আপনি পরীক্ষা দিবেন । উনি ঠিক সময় মত আসলেন , বলেন তোমাকে আলাদা করে নেবার মত সময় আমার নাই , আজই তুমি পরীক্ষা দিবে । যতই বলি আমি কিভাবে প রীক্ষা দিব !আমি তো জানি ই না কি আছে ওই বইতে ,সারাদিন আমার হাজব্যান্ড ভাজা ভাজা করছে সেই পুস্তক । যাহোক শেষ পর্যন্ত ভয়ে গেলাম পরীক্ষা দিতে শর্ত দিলাম ,এক ঘণ্টা পরে দিব কারন আমাকে পড়তে হবে । যাহোক কিভাবে যেন পাশ করে গেলাম ।


আমরা এসেছি আগস্টের ৬ তারিখে এখানে , আমাদের কল্পনার সম্পূর্ন ঊল্টো চিত্র। চারিদিকে সবুজ আর ফুলে ফুলে ভরা ।চমতকার প রিবেশ ,ঢাকার সেই কোলাহল নেই , নেই যানজট । তবুও মন পরে আছে সেই অচিনপুরে । আর অপেক্ষা করছি স্কুল কখন খুলবে আর বাচ্চারা কান্না ভুলবে ।

 

চলবে-

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন