আমার ২০১৯ এর রেজুলেশন ( Resolution ) ছিলো নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত  গতিতে গাড়ি চালাবো না। রাস্তার সংবিধিবদ্ধ আইনের দৃষ্টিতে ছোট এই অপরাধটি করতে করতেই এমন একটা রেজুলেশন নিয়েছিলাম কিনা ঠিক মনে করতে পারছি না। এই নূতন বছরে আমার রেজুলেশনটা হলো পানীয়ে এলকোহল এর মাত্রাটা কমাতে হবে। বিস্মরণ বর্তমানে আমার একটি অন্যতম বিমারি। তবে ২০২০ এর মহান এই রেজুলেশন টা যে সেই পানীয়ের নহরে সাতার কাটতে কাটতেই নিয়েছি তা অস্বীকার করার সাহস আমার নেই। ভণ্ডামি। বাংলায় বললে কানে কেমন যেন একটুখানি বিকট লাগে। নাহ্.. নিজেকে এতোটা নীচে নামাতে চাই না। তাই ইংরাজিতে ই বললাম ‘ হিপোক্রেসি’! আমি একজন হিপোক্রাট। তবে তার মাত্রাটা কতোটুকুন? ওটা নির্ধারণের দায়িত্ব আপাততঃ জীব বিজ্ঞানীদের ওপরে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এই হিপোক্রেসি না থাকলে মানব কুলে জন্মের কৌলিন্যটুকু থাকে কি করে? অন্য প্রাণীদের থেকে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ মনে করার এটাও যে একটি বড় বৈশিষ্ট্য!

যতোটুকু মনে পড়ে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুটা আগের ঘটনা। আমার বয়স আট পেরিয়ে নয় এর পথে হাঁটছে। দক্ষিণের মাঠে সোনালী শস্যের ঘ্রাণ। সন্ধ্যার বাতাসে মিহি সুরের মতো শীতের আগমনী বার্তা। বাড়ির বৈঠক খানায় সেদিনের সান্ধ্য আড্ডায় পড়শীরা যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছিলো তা শৈশব হৃদয়ের নরম জমিনে এমন ছাপ ফেলেদিলো যে সময়ের ধূলো তাকে কখনোই ঢেকে দিতে পারেনি। ঘটনাটি আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম পত্তাশীর। পত্তাশী তখনকার বৃহত্তর বরিশাল জেলার একটি গ্রাম। আমাদের বাড়ীটা সে সময়ের বৃহত্তর খুলনা এবং বরিশাল জেলার সীমান্তে হওয়ায় এটা পার্শ্ববর্তী জেলার ঘটনাও বলা যায়। সপ্তাহান্তে বসা গ্রামীণ হাট থেকে ফেরার সময় কে বা কারা পথের পাশে একটি গাছে এক তরুণের ঝুলন্ত দেহ আবিস্কার করে। তার নাম সম্ভবত ছিলো পরিমল। আত্মহত্যার কারণটি পরিস্কার নয়। তবে শার্টের পকেটে পাওয়া ছোট চিরকুট থেকে ধারণা হয় প্রেম ঘটিত। চিরকুটে লেখাছিলো ‘অণু তুমি আর কারোর সাথে এমন কাজ করিও না’..! এতোদিন পরে ছেলেটির নাম সঠিক মনে না করতে পারলেও চিরকুটের ঐ লেখাটুকু এখনো হুবহু মনে আছে। ছেলে-মেয়েদের হৃদয় ঘটিত লেনদেনের টানা-পোড়ন, ক্ষরণ-বিচ্ছুরণের বিষয়ের তীব্রতা সে বয়সে তো দূরের কথা এ বয়সেও আমি তা তেমন বুঝি না। সৌরমণ্ডলের সব প্রাণীকুল যেখানে বেঁচে থাকার জন্যে নিয়ত সংগ্রামে লিপ্ত থাকে সেখানে হৃদয় সরোবরে এমন কি সুনামির  সৃষ্টি হয় যে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়! শুনেছি এক ধরনের বিষণ্ণতা আছে যা মানুষকে আত্মহননে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু এটা তো মানুষের জিন-ক্রোমোজোম গত সমস্যা। প্রেমিক বা প্রেমিকাকে হারিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়া তো তা নয়। আমার কাষ্ঠ হৃদয়ে হয়তো এটা কোনদিনই উপলব্ধিতে আসবে না।

জন্মের সাথে মৃত্যুর নিশ্চয়তার মতোই প্রায় চিরন্তন আমাদের জীবনে চাওয়া পাওয়ার দ্বন্দ্ব।  একদিকে চাওয়া এবং পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা আমদেরকে উদ্বুদ্ধ করে কোন কিছু অর্জনের জন্যে ছুটে চলতে, কখনো বা মরিয়া হয়ে উঠতে। অন্যদিকে তার অনিশ্চিত ফলাফলের শঙ্কা আমাদেরকে টেনে ধরে পিছনের দিকে। বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী / স্নায়ু বিশেষজ্ঞ সিগমান্ড ফ্রয়েড ( Sigmund Freud ) এ বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন.. “people are simply actors in the drama of their own minds, pushed by desire, pulled by coincidence. Underneath the surface, our personalities represent the power struggle going on deep with us”. 

আমাদের মনোজগতে এই দুই পরাশক্তির ভারসাম্যতার সমীকরণ প্রতিটা মানুষের ক্ষেত্রেই ভিন্ন। শুধু তাই নয় প্রতিটা মানুষের ক্ষেত্রে এর রকমফের ও ভিন্ন। আর সে কারনেই দেখি কেউ এভারেস্টকে জয় করার জন্যে জীবন দিয়ে দিয়েছে আবার কারোর কাছে এটা নিছক বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। বৈচিত্র্য।  বৈচিত্র্য প্রতিটি প্রাণীর চরিত্রে । বৈচিত্র্য প্রকৃতির। আর তাই ই এই সৃষ্টি এতো সুন্দর!

পৃথিবীতে সবচেয়ে জটিল তত্ত্ব-উপাত্ত সম্ভবত “বায়োকেমিক্যাল এলগোরিদম” ( Biochemical Algorithm ) যার সাথে আমাদের আবেগের সরাসরি সম্পর্ক। এটিকে কখনো কোন নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। প্রতিটা মানুষের ক্ষেত্রেই এটি যেমন ভিন্ন তেমনি স্হান,  কাল, পাত্র ভেদে একজন মানুষের ক্ষেত্রেও এর মাত্রার ভিন্নতা দেখা দেয়। যাহোক বলছিলাম তরুণ-তরুণী,  যুবক-যুবতীদের ( যে কোন বয়সের নর-নারীর মধ্যেই এটা হতে পারে ) মাঝে হৃদয় ঘটিত লেনদেনের টানা পোড়েনের কথা। ভালোবাসাবাসির চুম্বকীয় এমন আকর্ষণ বিকর্ষণের উপরও এই বায়োকেমিক্যাল এলগোরিদম এর প্রবল প্রভাব। আর সে কারনেই পাওয়ার পূর্বে কোন মানস বা মানসীর স্বপ্নের জানালায় দিনমান পড়ে থাকে যে মন, যাকে পেতে ব্যার্থ হলে কখনো বা আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে চায় প্রেম সুষমায় পূর্ণ কোন হৃদয়, সেই  তাকেই পাওয়ার পরে সময়ের ব্যবধানে হয়তো তীব্র আকর্ষণ রূপ নেয় বিকর্ষণে। এমন উদাহরণ আমাদের সমাজ জীবনে খুবই নৈমিত্তিক। এর সম্ভাব্য কারণগুলোর জটিল ব্যাখ্যায় ডুবে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাতেও যে কোন সঠিক নির্দেশনা পাওয়া যাবে নিশ্চিত বলা যায় না। সুতরাং শুধু বলা যায় “সময় এবং প্রয়োজন”। 

গত পর্বে বলেছিলাম স্কুল জীবনের বন্ধু নাজমুলকে স্মরণ করবো। ছিপছিপে গড়নের সদাহাস্যজ্বল নাজমুল।  যাকে দেখলেই মনটা কেমন যেন ভালো হয়ে যায়। যে কোন আড্ডায় সাদামাটা একটি বিষয় নিয়েও তরল-ঘন যে কোন রকমের হাস্যরস সৃষ্টি করতে পারাটা ছিলো যার একটি বিশেষ গুন। নাজমুলকে ভাবলে যে বিষয়টি মনের উঠোনে এখনো তারা হয়ে ভাসে তা হলো স্কুল মাঠে আমাদের ফুটবল খেলার সময়টা। নাজমুল কখনো মাঠে খেলতে নামতো না। কিন্তু গোটা সময়টাতেই মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে অনর্গল ধারা ভাষ্যকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতো। তার এই রসাত্মক ধারাভাষ্যকে তুলনা করতে গেলে এই পেশায় আমার দুজন প্রতিভার কথা মনে পড়ে। একজন ছিলেন ক্রিকেটের ধারা ভাষ্যকার  পশ্চিম বাংলার অজয় বসু (লাস্ট নামের অংশে ভুল থাকতে পারে), অন্যজন হলেন ফুটবলের ই ইংলিশ ধারা ভাষ্যকার জন হেল্ম (John Helm)। নাজমুলের ধারাভাষ্যে রসের মাত্রাটা আরও বহুগুন বেড়ে যেতো যখন সেলিম শিকদার তথা অফিসার বল পায়ে পেতো। বলাবাহুল্য দীর্ঘ ঘন্টাদেড়েক ধরে খেলা চলাকালীন সময়ে সেলিম শিকদার বল পায়ে পেতো বড়জোর ১০ বার..! 

খেলার মাঠে আমাদের সেদিনের বিকেলটা ছিলো অন্যদিনের বিকেলগুলো থেকে একটু আলাদা। কিছু সময় ধারাভাষ্য দেয়ার পর তার চিরাচরিত ভূমিকা ছেড়ে নাজমুল খেলতে নামলো। তাও বিশেষ ভাবে কোন এক পক্ষের হয়ে নয়। বল যখন পায়ে পেয়েছে যাকে ইচ্ছে হয়েছে পাস দিয়েছে। খুব বেশী সময় খেলেনি। আবারও ধারা ভাষ্যকারের পদে ফিরে এসেছিলো। নাজমুলের দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে,  নৈমিত্তিকতার রুটিন থেকে বেড়িয়ে সেদিনের বিকেলটা এতটুকুই শুধু ছিলো ব্যতিক্রম। কিন্তু ভোরের সূর্য স্কুল প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই অকস্মাৎ এক বিষাদের ছায়া ঢেকে দিলো শুধু স্কুল নয় গোটা মোড়েলগঞ্জের ঝলমলে সকাল। বাসার অনতি দূরে একটি আম গাছের ডালে নাজমুলের ঝুলন্ত দেহ!? আত্মহত্যা!! কেন?? সঠিক উত্তরটি হয়তো নাজমুল ই দিতে পারতো। কিন্তু কার সাধ্য আছে সে প্রশ্ন এখন তার কাছে পৌঁছে দেয়? যতটুকু জানা যায় এবং মনে পড়ে তার কোন চাচাতো বা মামাতো বোনের সাথে এই হৃদয়েরই দেয়া নেয়ার কোন বিষয় ছিলো। যেটা একটুখানি জানাজানি হয়ে গেলে অভিভাবক মহলের পর্যায় থেকে তা একরকম না এর পর্যায়ে চলে যায়। আহ্.. আমাদের সমাজ!? চলবে…

(ছবি:- google)


আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন