অনেকদিন থেকেই  ভাবছিলাম সম্পর্ক নিয়ে কিছু একটা লিখা যায় কিনা । আমার কাছে মনে হয়েছে ‘সম্পর্ক’ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বর্তমান বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে এটি প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় । বিষয়টির ব্যাপকতা উপলদ্ধি করে ভাবলাম এটি নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে কিছু লেখা যায়কিনা । আজকের লেখায় আমি শুধু আলোকপাত করবো কেন এই বিষয়াটি আমি লেখার  জন্য বেছে নিলাম।

আমরা যদি মহা বিশ্বের কথা ভাবি, গ্রহ, উপগ্রহ,  নক্ষত্র সবাই সুশৃঙ্খল ভাবে সম্পর্কিত এবং সবাই একটি নিয়ম মেনে চলে ঘুরছে। যদি আমাদের গ্যালাক্সীর কোথায় ভাবি, পৃথিবী, শনি, মঙ্গোল, নেপচুন, প্লুটো ইত্যাদি  নয়টি গ্রহ সূর্যকে কেন্দ্র করে  অহরহ ঘুড়ছে. আবার, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চন্দ্র ঘুরছে ।  সবাই যেন একটি শিকলে বাধা নিয়ম করে নিজ নিজ কাজ করে চলছে । অর্থাৎ, সবার মধ্যে রয়েছে একটি নিবিড় সম্পর্ক। আবার যদি একটু হাইস্কুলের বিজ্ঞানের মতো করে ভাবি, কার্বন চক্র, নাইট্রোজেন চক্র, কিভাবে কার্বন, নাইট্রোজেন অনু চক্রাকারে পরিবেশে সমতা বজায় করে চলছে । আবার প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে আরো মজার সম্পর্ক । প্রাণী নিঃশ্বাসের মাধ্যমে যে অক্সিজেন নিচ্ছে তা পাচ্ছে উদ্ভিদ থেকে । আবার উদ্ভিদ যে কার্বনডাইঅক্সাইড পাচ্ছে তা আসছে প্রাণী থেকে। সম্পর্কের কি অদ্ভুত মহিমা। এসব তথ্য  আমাদের প্রায় সবারই জানা কথা । তবে আমরা যেটা জানিনা  বা ভুলতে বসেছি অথবা গুরুত্ব দিয়ে ভাবছিনা সেটা হলো প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে আমরা যেভাবে  ‘ সম্পর্ক ‘  শব্দের সাথে সম্পর্কিত সে সম্পর্ক কে কিভাবে মূল্যায়ন করতে হয়, সেই সম্পর্ককে কিভাবে লালন পালন করতে হয়, সম্মান করতে হয় । আর তাইতো, প্রবাস জীবনে, দেশ থেকে হাজার হাজার  মাইল দূরে থেকে পত্রিকা খুলে দেখি, কিভাবে একজন পথভ্রষ্ট যুবক শুধুমাত্র প্রেম নিবেদনে সাড়া নাপেয়ে জন সমক্ষে একটি নিরস্ত্র নিরীহ বালিকাকে চাপাতি  দিয়ে নির্মম ভাবে কোপাচ্ছে আর অন্যান্যরা ভয়ে দৌড়াচ্ছে । আবার কেউ নিজ টেলিফোনে ভিডিও করছে. বাহ কি অদ্ভুত সম্পর্ক । অথচ যারা মেয়েটিকে সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে দৌড়াচ্ছে অথবা ফেসবুক-এ ভিডিও আপলোড করে অভিপ্রায়ে ভিডিও করছে যাদের হবে মধ্যে একটি সম্পর্ক  রয়েছে । এত সেটা হলো: এরা  সবাই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, এরা  সবাই একই দেশের সন্তান।

একটি  পরিবারের ভিতর  বাবা-মা, ভাই-বোন, নানা-নানী, দাদা-দাদী, চাচা-চাচী, খালা-খালু, ফুপা-ফুপী, মামা-মামী  ইত্যাদি সকলের সাথে  একটি নিবিড় সম্পর্ক-এর ভিত তৈরী হয় । নানাবিধ কারণে কখনোবা আর্থিক, কখনোবা বাপ্-দাদার রেখে যাওয়া  সম্পত্তি, অথবা কোনো তুচ্ছ কারণে এই নিবিড় সম্পর্ক ছিন্ন হয়. এই ছিন্নতা কখনোবা হয় সাময়িক  কখনোবা হয় স্হায়ী, একেবারে কাগজেকলমে উকিল নোটিশ দিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়. ভালোবাসা দিবসে ফুল দিয়ে যে সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল যুবক-যুবতীর মধ্যে বাবা-মা-র মতে অথবা অমতে বিয়েও করছিলো তারা, কিন্তু কতইনা তুচ্ছ কারণে সে সম্পর্ক আর টিকেনি । একদা যে যুবক-যুবত চাঁদনী  পসর রাতে ‘এস নিপো বোনে ছায়া বীথি তোলে …..’ গান গেয়ে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখেছে । তারাই কতইনা  না তুচ্ছ কারণে সম্পর্কের ইতি ঘটিয়েছে । একে ওপরের সাথে ভালোবাসাতো অনেকদূরের কথা পরস্পরের মুখ দেখাদেখি তো নায়িই, এমনকি ফেস বুকে ব্লগ । আবার, বাবা-মার্ কোথায় যদি বলি, ইদানিং বাংলাদেশে তথা তাবৎ দুনিয়ায় কিছু যুবক-যুবতী একটি বিশেষ  ধর্মীয় তত্ত্বে দীক্ষিত হয়ে অনায়াসে ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা করছে । পত্রিকা খুলে অবাক হয়ে দেখি, এদের বাবা-মায়েরা এদের লাস পর্যন্ত নিতে রাজী হয়নি । অথচ এই বাবা-মাই  এদেরকে পেটে ধরা থেকে নানাবিধ কষ্ট করে মানুষ করার চেষ্টা করেছিল । হায়রে সম্পর্ক!! ছেলেবেলায় বইয়ে পড়েছিলাম, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যা সাগর মা-কে দেখার জন্য দোমোডোর নদী  সাঁতরিয়ে ছুটে  গিয়েছিলো মায়ের কাছে, আবার আমরাই অসহায় মা-কে বিছানায় একে ফেলে স্ত্রী,-ছেলে-মেয়েদের সাথে নিয়ে আনন্দ করতে ছুটে যাই, কক্সবাজার, থাইল্যান্ড অথবা মালয়েশিয়ায় । যাওয়ার পথে ফ্যাল ফ্যাল করে থাকিয়ে থাকে অসহায় মা, অস্ফুট গলায় বলে,” ভালো থাকিস ব্যাটা, ফি আমানিল্লাহ’….

সম্পর্ক শুধু পরিবারেই সীমাবদ্ধ থাকেনা । নিবিড় সম্পর্ক  থাকে বন্ধুত্বে. সম্পর্ক  থাকে প্রতিবেশীর  মাঝে । এমন কি আমি দেখেছি, শুনেছি টেলিভিশিনের বিজ্ঞাপন দেখে অথবা কারো কাছ থেকে শুনে রক্ত দিতে ছুটে চলেছে হাসপাতালে এমন মানুষের জন্য যাঁকে সে জীবনে কোনোদিন দেখিই নি । অথচ সম্পর্কহীন সম্পর্কে  সহজেই  নিজ গায়ের রক্ত দান করছে অপরিচিতের মাঝে । অবচেতনভাবে তৈরী হচ্ছে সম্পর্কের মালা ।

দীর্ঘ প্রবাস জীবনে সম্পর্ককে আরো অনেক ভিন্নমাত্রায় দেখার সুযোগ হয়েছে । নিজের দেশ ত্যাগ করে একটু ভালোভাবে থাকার  জন্য আত্মীয়স্বজন,বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে নতুন একটি দেশে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে এসে, প্রথম প্রথম অনেক কষ্ট করতে হয় । নিজের প্রফেশনাল লাইনে কাজ পেতে অনেক কাঠখড়, চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে হয়তো দেখা মেলে সোনার  হরিণ,”প্রফেশনাল চাকুরী”। কিন্তু, সেই  চড়াই-উৎড়াই মাঝে অনেকেই অনেক ‘survival job –এ’ যুক্ত হয়ে পড়েন । এধরণের চাকুরী নিয়ে আমরা অনেকেই যারা দীর্ঘ দিন ধরে আছি, আমরা উপহাস করি । কোথাও দাওয়াতে গেলে সকলের মাঝে চাকুরী নিয়ে কথা বলে টিটকারি মারি।  তাই বাধ্য হয়ে এই অভিবাসী ভাই/বোনেরা অনেকসময় নিজ আত্মীয়, কাছের বন্ধু-বান্ধব, এমন কি বাংলাদেশী কমিউনিটি মাড়ায় না, ঘৃনায়, অপমানে এবং লজ্জায়। আবার, উল্টা চিত্রও আছে. প্রবাস জীবনে অনেক ভালো মানুষ দেখেছি যারা আত্মীয় নন, এমনকি চেনা পরিচিতিও নন, শুধু বাংলাদেশ থেকে এসেছি  শুনে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, সৎ উপদেশ দিয়েছেন। অনেক লাইন ঘাট দেখে দিয়েছেন । আপন করে নিয়েছেন সম্পর্কের জালে ।. আবার আমরাই কেউ কেউ নিজ কমিউনিটি-র কারো পিছনের কান কথা শুনে সেই সম্পর্ক ছিন্ন করেছি, মনে আঘাত দিয়েছি তাদেরই, যারা একসময় আত্মীয় স্বজনহীন এই প্রবাস জীবনে বিভিন্ন ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো ।

আমার কাছে মনে হয়েছে সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সম্পর্ক তৈরী এবং সম্পর্ক ধরে রাখা দুই জরুরি ব্যাপার । সম্পর্ককে ছিন্ন করে, অবজ্ঞা করে কাউকে খুব বড় হতে কখনো দেখিনি।  বরং, পৃথিবীতে যারা  বড় হয়েছেন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সবাই নিজ নিজ নাড়ির/ শিকড়ের সাথে, বন্ধুদের সাথে, মানুষের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন, সুসম্পর্ক তৈরী করতে হবে পরিবারের মাঝে, প্রতিবেশীর মাঝে, মানুষে মাঝে, প্রকৃতির মাঝে । আর তাই, আমার এই ধারাবাহিক লেখা শুরু করলাম, আমি বিশদ ভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো কিভাবে একটি সুসম্পর্কময় সুন্দর, সুখী পৃথিবী রচনা করা যায়, যেখানে ছেলে-মেয়েরা বাবা-মা’কে ভালোবাসবে, গুরুজনকে সম্মান করবে, শুধু  ১৪-ই ফেব্ৰুয়ারাই ভালোবাসা দিবস নয় । প্রতি দিবস, প্রতি মুহূর্ত ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দিবে তাবৎ মানুষকে। জয় হোক সুসম্পর্কের, জয় হোক মনুষত্বের।।।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভালবাসলে ভালবাসা পাওয়া যায়
পরবর্তী নিবন্ধআকবর বাদশা, নদী ও হাঙর – ৩
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

4 মন্তব্য

  1. অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়ে ভালো লাগলো. কোনো না কোনো ভাবে সম্পর্কের মায়াজালে আমরা সবাই আবদ্ধ. আমার কাছে এই সম্পর্ককে ধরে রাখা, লালন করা অনেকটাই উপলব্দির বিষয়. অন্য এক লেখায় উল্লেখ করেছিলাম আমার এক আত্মীয়র কথা, যিনি সারারাত কষ্টকর একটি কাজ করে এসে ভোর বেলায় উনার মাকে ফোন না দিয়ে ঘুমাতে পারেন না. আবার আর একজনকে দেখি যিনি ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে সারা মাসে একবার ফোন করে মা বাবার প্রতি উনার দায়িত্ব সম্পাদন করেন. সুতরাং উপলব্দিতে না আসলে কোনো বিষয়ই আসলে বিষয় না. আপনার লেখায় অন্তত আমার নিজের উপলব্দি আরো বেড়েছে. অনেক ধন্যবাদ জাকারিয়া ভাই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে প্রাঞ্জল এই লেখার জন্য. ভালো থাকুন.

  2. sorry ভাই আপনার ফোনটা ধরতে পারি নাই তবে আপনার এ লেখার আমার কোনো ধরণের চেকিংয়ের দরকার হতো না। ভালো লিখেছেন। আপনি এতো বেস্ততার মধ্যেও যে লিখেছেন, অনেক ধন্নবাদ।
    আসলে আন্তরিক সম্পর্কটা অনেকটা হারাতে বসেছে এখন , বরং ম্যাটেরিয়ালিস্টিক সম্পর্কটাই প্রাধান্য পাচ্ছে আর সে কারণেই অনেক সমস্যা দেখা জাস্ছে। গতবার দেশে গিয়ে ইটা বেশি লক্ষ করেছি, খুবই দুঃখজনক, আমার দেশ ছাড়া থেকে এ পর্যন্ত দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে, শুধু মাত্র একটি বিষয়ের উন্নতি আমি দেখিনি বিন্দুমাত্র, আর সেটা হলো মানসূহের অন্তরের উন্নতি। Anyway, we can only do our part and inspire others, and pray to the Almighty.

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন