ফ্লোরিডা থেকে:-

ঘুম থেকে উঠে একটি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেখলাম।
Shimanto Chowdhury.
তার দেয়াল ঘুরে দেখলাম, কয়েকটি লেখা পড়লাম, তার পোস্ট করা কয়েকটি গান শুনলাম এবং মনটি ভালো হয়ে গেল। এমন নয় যে মন খারাপ ছিল। ভোর ৫ টায় মন খারাপ থাকা ভালো লক্ষণ নয়।
“This girl, I don’t want to die for. I want to live for her. “ জানি না বাক্যটি সীমান্তর না অন্য কারো, কিন্তু ঠিক এই কথাটিই আমি বলতে চাইছিলাম।
তবে তার আগে আর একটু গৌরন্দ্রিকা সেরে নেই।

গত সপ্তাহান্তটি কাটিয়েছি প্রিয়বন্ধু আনোয়ার ইকবাল কচি ভাই এবং শেফালী ভাবীর সাথে ভার্জিনিয়ায়।
আমি আর আমি, মানে আমার সে।
আগামী বছর লেবার ডে ছুটির সময়ে আমরা একটি সাহিত্য সমাবেশ করবো আটলান্টায়।তা নিয়ে কিছু আলোচনা করার প্রয়োজন ছিল। আর সুপ্ত ইচ্ছা ছিল ভার্জিনিয়ার শরতের পাদপ পত্রের স্বর্গীয় রং দেখা, যা রাশিয়ায় থাকাকালীন সময়ে আমার সত্ত্বায় গেঁথে গিয়েছিল। মন্ট্রিয়ল থাকাকালে তা তীব্রতর হয়েছে। নিউ ইয়র্কের তিন বছর কিছুটা স্তিমিত ছিল ওই বিশাল শহরের রেসিডেন্সী করার নারকীয় ব্যস্ততায়।কিন্তু সাউথ ডাকোটার তিনবছর তা কলেবরে বেড়ে পৌঁছেছিলো এর শীর্ষচুড়া বা যাকে বলে কালমিনেশনে।সাউথ ডাকোটা শরৎ আমি খুব মিস করি আর তার ভুট্টা খেতের মাথায় হাত বুলিয়ে ধাওয়া প্রেইরির উদাস বাতাস।
আমি তখন লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে বাংলা বর্ণমালার সিকোয়েন্স ভুলে গেছি ( এখনও মনে করতে পারি নাই, তবে দিব্যি লেখকের আত্মপ্রসাদ খাচ্ছি), কিন্তু তারপরেও এই রংয়ে বুঁদ হয়ে থাকতাম রাশিয়ার রাস্তায় দেখা কোন কোন মাতালের মতো।
অথবা আমারই যৌবনে দেখা কোন কোন প্রেমে বুঁদ উন্মাদ পাগলের মত।
সেই রংয়ের জগত ছেড়ে এসেছি দু হাজার ছয় সালে।
আর দেখি নাই।
চোখ দুটো তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে।
বাংলাদেশে যারা চাকরিহীন, নিয়মিত খেতে পায় না, যাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের নরক পার হবার ভয়ে বুক দুরুদুরু, আদৌ পার হবে কিনা না “শহীদ” হয়ে যাবে, না ধর্মঘট-দুর্বৃত্তদের দৌড়াত্বে হবে বেওয়ারিশ লাশ, তাদের কাছে আমার এই “তৃষ্ণা” বুর্জোয়া আদিখ্যেতা মনে হবে।
আমারও হতো।
এখন আমি বাস করি অন্য তীরে যেখানে ঘাস সবুজতর মনে হয়।

যা হোক, কচি ভাইয়ের সাথে সারাদিন কাঁটিয়েছি। দেখেছি “ল্যুরে ক্যাভার্ন”। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না স্ট্যালাক্টাইট, স্ট্যালাগমাইট, পাতালহ্রদ ও অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সজ্জিত এমন একটি গুহা। সদ্য কৈশোর পার হয়ে যৌবনে পা দিয়েছে সতেজ সৌন্দর্যের দুহিতা, কেইটলিন নামের একটি মেয়ে আমাদের সরল সহজ বর্ণনায় বুঝিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর অন্ত:র্জগতের বিভিন্ন বৈচিত্রের রহস্য।
গুহার অপার্থিব সৌন্দর্য, আলো আঁধারির ইন্দ্রজাল সেই মেয়েটিকে আরো সুন্দর মনে হয়েছিল।
কিন্তু সে নয়, আমি ঘুরে ফিরে যার ছবি তুলেছিলাম, সে আমাকে বলছিল,
“তোমার ছবি তোলার উৎপাতে কেইটলিন কী বলছে, আমি তা মোটেও শুনতে পারছি না”।
৭ মিলিয়ন বছর আগে যে বিশাল স্ট্যালাক্টাইটটি গুহার সিলিং থেকে পড়েছিল এবং যা এখনও মেঝেতে পড়ে আছে, তার ইতিহাস শোনার চাইতে আমার অন্য অনেক কিছু বেশী ভালো লাগছিল। গুহার সিলিংয়ে প্রাসাদসম যে ডেকোরেশন তৈরি করে গিয়েছে প্রকৃতির যে শক্তি বা শক্তিরা তাই বিম্বিত হয়েছে পাতাল হৃদের স্বচ্ছ জলে । ফলে মনে হয়েছে উপরে নীচে সর্বত্র কী এক মহাশিল্পীর হাতের যাদুস্পর্শ আমার চারিদিকে।
জীবন্ত নারী সেই সৌন্দর্য্যকে অ্যাম্প্লিফাই করে।
নারী সৌন্দর্য শুধুই কামনা প্রজ্বলনের কাঠ বা কয়লা নয়।অন্তত আমার কাছে নয়।
আমি কোন অচেন্দ্র-চেতন সত্তা নয়। নারী সৌন্দর্যে অবগাহন করে উপলব্ধি করেছি যে, কোনো মহাশিল্পীর মহাসৌন্দর্য সৃষ্টির এনসাম্বলের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে নারী।
“সেন্টার পিস”, ইংরেজীতে যাকে বলে।

গুহা থেকে বের হয়ে কচি ভাই আমাদের নিয়ে গেছেন ন্যাশনাল পার্কের পাহাড়ি রাস্তায়, যেখানে প্রতিবছর এসময়েই গাছগুলো নানা রংয়ে সাজে, এবছর তারা সাজে নি।
সবে একটু ছোঁয়াচ আসতে শুরু করেছে। তার মানে আমরা একটু আগে চলে এসেছি।
কিন্তু কুয়াশায় ঢাকা ছিল সব, কিচ্ছু দেখা যায় নি।
কুয়াশা না শৈল শিখরে উড়ে আসা মেঘ তাও বুঝে উঠতে পারি নি।
লের্মন্তভের কবিতার একটা লাইন মাথায় ঘুরছে অবসেশনের (obsession) মত: “নোচেভালা তুচকা জোলাতাইয়া” সোনালি মেঘ রাত্রযাপন করতে এসেছিল (শৈল চুড়ায়) ।
মেঘেরা তাই করে, উড়ে আসে, রাত্রি যাপন করে, তারপরে আবার উড়ে চলে যায়। মানুষ যেমন কোথা থেকে আসে, কোথায় যে যায়! এই যেমন আমরা উড়ে এসেছি, চলে যাবো রাত্রি যাপন করে।
তবে মেঘ বা কুয়াশা, যাই হোক সোনালি সে ছিলো না।
ছিলো বিধবার সাদা শাড়ির আঁচলের মত।
রং দেখা হয় নি।
যেমন দেখা হয় নি “সাকুরা ব্লসম”।
এপ্রিলে সেই জাপান গিয়েছিলাম ঈশ্বরের বাগানে পুষ্পায়ন দেখার জন্য। কিন্তু এ বছর সাকুরার প্রস্ফুটন শেষ হয়ে গিয়েছিল ১ সপ্তাহ আগে, আমাদের জন্য অপেক্ষা করে নি।
আমরা অধরার পিছু ছুটি, সে হাতছানি দেয় কিন্তু ধরা দেয় না। হয় তো সেই ভালো, সেই আমাদের ছোটায় এবং বাঁচিয়ে রাখে।

ভার্জিনিয়া থেকে ফিরে এসেই বিরক্তিকর সর্দি, মাথাব্যথা, কফ, কাশিতে কাবু হয়ে পড়ি।সর্দি তেমন কোন রোগ নয়, এর চেয়েও জটিল রোগ আছে এবং মানুষের রোগ নিয়ে কাজ করাই আমার কাজ। অসুস্থ হবার সময় মোটেও নেই, ৫ দিনই রোগী দেখতে হয়েছে । গোঁদের উপরে বিষফোঁড়া একেই বলে।
এরই মধ্যে সাহিত্য সমাবেশের বিভিন্ন ফোন কল, বাজেট, ফান্ড রাইজিং, ওয়েবসাইট ডোমেইন ইত্যাদি নিয়ে কাজ।
“নাই কাজ খৈ ভাজ” এমন পরামর্শ দিয়েছিলেন কোন গুনীজন। কিন্তু আমার কাজ প্রচুর, খৈ ভাজার দায়িত্বও নিয়েছি। বৌ বলে, “তোমার সব কিছুর জন্যই সময় আছে। আমার জন্য মুহূর্তও নাই।”
মেয়েরা কেন যে এই মুহূর্ত চেয়ে চেয়ে পেরেশান হয়, বুঝি না।
বলি, “ফুল গাছ আছে, বিড়াল আছে, ক্রোসিটিং আছে…..”
রান্না করো, তৃপ্তি ভরে খাই। ভালোবাসা দিতে চাও, আজলা ভরে নিই। তারপরেও অভিযোগ করা খাটে না।”
বলে বোকার মত দাঁত বের করে হাসি।
এই করে করে ত্রিশ বছর।কত বৃষ্টি কত মেঘ, কত ঝর্নার জল, ঝরা পাতা, আগত বিগত বন্ধু !
সে যে কেন পালিয়ে যায় নি, বুঝি না। বিদেশে কিছু নেহায়েতই ভালোমানুষ আছে, সে তাদের একজন।
“না চাহিলে যারে পাওয়া যায়…..” এই সে।
না, চেয়েই পেয়েছি। তীব্র ভালোবেসে।
অমূল্যকে যেন মূল্যহীন বলে না ফেলি।

গত ক’দিন আমার সর্দির সাথে কী তার যুদ্ধ! বিশাল এক হাড়ি জল গরম করে তাতে রসুন কেটে, সরিষার তেল এবং এক-দুই চামচ সোডা ঢেলে এনে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসিয়ে দেয় ফুটন্ত জলের হাড়ির সামনে। “স্টিম ইনহ্যালেশন” যাকে বলে, সর্দির চিকিৎসার রাশিয়ান ভার্সন। সরিষার তেল সেখানে বাঙ্গালি ব্যন্জন। ওটা আমি শিখিয়েছি। ওরা সরিষার তেল নয় সূর্যমুখীর তেল ব্যবহার করে।
হয়তো সরিষার তেলের কারণেই……
যাহোক, নরক সম্পর্কে যাদের কোন ধারনা নেই, অল্প মূল্যে তারা স্টিম ইনহ্যালেশনের এই নরক জার্নিটি করে দেখতে পারে।

শরীর ঘেমে যখন ঝরনার মত ঝরতে থাকে, তখন সে ভিজা গেন্জি জামা টেনে খুলে তোয়ালে দিয়ে গা মুছে অন্য জামা গেন্জি মোজা পরিয়ে কম্বলের নীচে শুইয়ে দিয়ে গরম চা এনে দেয়।
কবিগুরুর সেই কবিতাটির কথা মনে পড়ে যেখানে কবিভার্যা নির্বোধ কবিটিকে এত যত্ন ভালোবাসা দিয়ে সাজগোজ করে রাজপ্রাসাদে পাঠিয়েছিল। রাজা তার কবিতায় মুগ্ধ হয়ে উপহার উপঢৌকন দিতে চেয়েছিল বিশাল কিছু কিন্তু কবি চেয়েনিয়েছিল রাজার গলার মালাটি তার প্রিয়তমার জন্য। ( সর্দিতে জমে যাওয়া মগজ, কবিতার নামটি কোন মতেই মনে করতে পারছি না)।
কৈশোরে সেই কবিতা পড়ে ঐ বৌটির মত একটি বৌ কামনা করেছিলাম।
কোথাও বসে কেউ তা শুনেছিলো হয়তো।
রাজমাল্য জোটে নি, তবে পেয়েছি চেয়েছি যা।
এবং আমি সুখী।
তাকে যৌবনে ভাষা শিখানোর চেষ্টা করি নি। ভুল করেছি, নইলে আমার লেখাগুলো পড়তে পারতো। ছাই পাশ যাই লিখি, তার কথা প্রায়ই থাকে। আমার উপন্যাসে সে নিজেকে ঠিকই খুঁজে পেতে পারতো।
এক জীবন চলে যায় ভুলগুলো ধরতে, কিন্তু অন্যজীবন পাওয়া যায় না।
পেলে তাকেই চাইতাম এবং বাংলা ভাষায় গুটি গুটি কথা বলতে শিখাতাম।

মাথা জ্ঞানে গিজ গিজ করে, অকথ্য অথর্ব জ্ঞান। নেট, গুগল, উইকিপিডিয়া আছে, ভাবি জ্ঞান আর দরকার নেই।কিন্তু পেশা চাবুকের মত। আমেরিকায় ডাক্তারি করতে হলে পড়াশুনো চালিয়ে যেতে হয়।শিখতে না চাইলেও জোর করে শেখায়। ফাঁকিবাজদের এই হলো উচিত শিক্ষা। আবার জন্মালে
উটকো ঝামেলা এড়িয়ে শুধু বাংলাদেশে ডাক্তারি করবো।

৫ দিনের জন্য অরল্যান্ডো এসেছি “আমেরিকান একাডেমি অব পিডিয়াট্রিকস” এর কনফারেন্সে। সর্দি সাইনাস প্রেসার সৃষ্টি করেছে। এন্টিবাইওটিক, এডভিল গিলে কাল সারাদিন কাটিয়েছি।
তারপরে হোটেলে এসে ঘুমিয়েছি দেয়ালের দিকে দাঁত কিড়মিড় করে ।
৫ টায় ঘুম ভাঙ্গলো।
একটু ভালো বোধ করছি। মনটা ফুর ফুর করছে।
নাহার মনিকার কয়েকটি অপূর্ব সুন্দর কবিতা পড়েছি আজকের “বাঙ্গালী” কাগজের পাতায়। কী ভাষার প্রবাহ, চিত্রকল্প ও উপমা! এমন কবিতা পড়লে মন স্থির হয়, ব্লাড প্রেসার কমে আসে।
এখন সেই ১৯৭৯ সালে বার্মিংহামে গাওয়া জগজিৎ সিং ও চিত্রা সিংয়ের দ্বৈত গজল শুনছি আর দুলছি।(Shimanto Chowdhury র পোস্ট)।কী কন্ঠ! প্রকৃতিতে বিস্ময় আছে, মানুষের সমাজেই কি বিস্ময় কম?

এখন গিয়ে ঢুকবো সেমিনারে, সারাদিনের জন্য।
৩০ বছর ধরে যে আমার যত্ন করছে, আমি যার থেকে গ্রহণ করে করেই ঋৃণী, কী তাকে দিতে পেরেছি জানি না, তাকে ফোন করে বলবো, “I love you”. আমেরিকায় ওই কথা সবাই বলে, আমিও বলি।
কিন্তু সে কি জানে যে, “I really mean it” ?

নভেম্বর ৩, ২০১৮
অরল্যান্ডো, ফ্লোরিডা।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন