আমরা যারা প্রবাসে থাকি,আমাদের মধ্যে একদল মানুষ আছেন একটু সুযোগ পেলেই, একটু দোষ –ত্রূটি দেখলেই নিজেদেরকে হেয়ো করে কটাক্ষ করে কথা বলি। এখনতো আবার সোস্যাল মিডিয়ার যামানা। একটু কিছু হলেই সোস্যাল মিডিয়াতে সকল বাংলাদেশিদেরকে একেবারে ধুয়ে দেই। আমি ব্যাক্তিগতভাবে এই স্ট্রেটেজিতে বিশ্বাস করিনা। এভাবে নিজের কমুনিটির মানুষদেরকে ছোট করে কখনো ভালো কিছু অর্জন করা সম্ভব না। আমাদের কি ভালো কোনো দিক নেই? সমালোচনা যদি করতেই হয়, ভালো কিছুবলে শুরু করে তারপর সমালোচনা করলে হয় না? এইমাত্র যেটা বললাম এটা হচ্ছে পজিটিভলি এনালাইসিস। আমার উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয়, তাহলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের গুটিকতক নেগেটিভ দিক গুলিকে বড় করে না দেখে ঠান্ডা মাথায় চিন্তাকরুন ওই নির্দিষ্ট নেগেটিভ দিকগুলি থেকে উত্তরণের পথ কি কি আছে. উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, ধুরুং, বাংলাদেশী কোনো গ্রোসারি স্টোরে গিয়ে মাছ কিনে বাসায় এসে দেখলেন পচা মাছ অথবা বড় মাছ কইলে এনেছেন, বাসায় এসে মাছের টুকরাগুলিকে একসাথে করে দেখলেন ২/১ টুকরা হিসাবে মিলছে না. আর অমনি, সোশ্যাল মিডিয়াতে সমগ্র বাংলাদেশী গ্রোসারি স্টোের নিয়ে জ্ঞানগর্ভ পোষ্ট দিলেন। এতে করে কি লাভ হচ্ছে: অন্যান্য বাংলাদেশী ব্যাবসায়ীরা যারা সত্যিকারভাবে সৎ উপায়ে ব্যবসা করছেন তারাও বিপাকে পড়ছেন; আবার, আমাদের আত্মীয়স্বজন /বন্ধু/বান্ধব যারা বাংলাদেশে আছেন তারাও ভাবছেন আমরা প্রবাসে যেয়েও চরিত্র বদলাতে শিখিনি। অথচ, সবাই কিন্তু এরকম করছে না।

যাক ওসব কথা। এখন আমি যেটা বলবো একটু মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করুন। আমি সম্পূর্ণ টপিক্সটাকে একেবারে ইউ টার্ন করে অন্য একটি টপিকস বলছি। অর্থ্যাৎ, প্রবাসে সাদা বা ককেসিয়ানদের নিয়ে। মোটামুটিভাবে সাদা জাতি বললে চোখের সামনে ভেসে উঠে, একেবারে ভদ্র জাতি, অমায়িক, সদা সত্য কথা বলে, সময়ের প্রতি অত্যন্ত সজাগ, পরিশ্রমী, পরনিন্দা বিমুখ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই যে কথাগুলো বললাম এটাকে বলে জেনেরালাইজেসেশন অর্থাৎ তামাম সাদা জাতিকে এক করে এক কাতারে ফেলে প্রত্যেক সাদা মানুষকে মূল্যায়ন করলাম। এটাই হচ্ছে মহাভুল। কখনোই, assumption করা যাবে না। বিশ্বাস করুন, আজ সকালে অনেক ভোরে আমার ছেলেকে কেনেডি সাবওয়ে তে নেমে দিতে গেলাম। আপনেরা অনেকেই হয়তো জানেন, কেনেডিসাবওয়ের স্থানে কনস্ট্রাকশনের কাজ হওয়াতে বেশ ক্রিটিকাল অবস্থা। আগে থেকে না জানলে গাড়ি নিয়ে যেয়ে কাউকে ড্রপ করা বেশ কঠিন। তার মধ্যে কাকভোরে জনমানুষ নাই বললেই চলে। এমন অবস্থায় একজন আফ্রিকান বংশভুত মহিলা আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। সুন্দরকরে বুঝিয়ে দিলেন। তাহলে , কি দাঁড়ালো, আমরা বাংলাদেশহীরা এই গোত্রীয় মানুষদেরকে তো একেবারেই চিড়িয়া খানায় ঢুকিয়ে দিয়েছি। এটা ঠিক না।

আরেকটি উদাহরণ দেই, গতকাল আমাদের অফিসে আমাদের দুজন কলিগের লাষ্ট অফিস ছিল। দুজনেই আরো ভালো চাকুরী নিয়ে অন্য কোথায় জয়েন্ট করতে যাচ্ছে। দুদিন আগে আমি ডিরেক্টরের সাথে কথাবললাম আমরা কিছু টাকা তুলে ফুলের তোড়া ও গিফটকার্ড কিনে ওই কলিগ দুজনের হতে দিতে পারি কি না। ডিরেক্টর সঙ্গে সঙ্গে রাজি. এবার দুই/একজন কলিগদের সাথে আলাপ করলাম কত টাকা করে তোলা যায় । একজন বললো এক ডলার, একজন বললো দুই ডলার। আমি শুনে তো হতবম্ভ। এঁরা বলে কি !! আমরা বাংলাদেশিরাহলে একেকজন কমপক্ষে ৫/১০ ডলারের নীচে কথাই বলতাম না। যাক, পরে আমি উদ্যোগ নিয়ে মোটামুটি অফিসে যারা ছিল, সবার কাছে কাগজ কলম নিয়ে টাকা তুলতে গেলাম। অধিকাংশ কলিগরা ২ ডলার করে দিয়ে প্রায় ৩০ ডলারের মতো হলো. আমার ধারণা ছিল, দুজনকে দুটি ফুলের তোড়া বাবদ বাজেট ২০ ডলার আর দুজনকে একটি করে পঁচিশ ডলারের গিফট কার্ড দিলে বাজেট প্রায় ৭০ ডলার এর মতো। দিনশেষে উঠলো ৩৬ ডলার। পরে বুদ্ধি করে সবাইকে ইমেইল করলাম। পরের দিন সকালে মাত্র ২/১ জন ইমেইলের সারা দিলো. আরোও গুটিকয়েকজন ২ ডলার, কীয় ৫ ডলার করে দিলো. প্রায় ৫০ ডলারের মতো হলো। আরো কমপক্ষে ১০/১২ জন বাকি। এঁরা ২ ডলার করে দিলেই টার্গেট কমপ্লিট হয়ে যায়। এঁরা সবাই অফিসেই আছে। এঁরা আপনাদের ভাষায় সাদা জাতি। এঁরা প্রত্যেকে আমার ইমেইল পেয়েছে কিন্তু কোনো সাড়া নাই. আবার এঁদের সবার কাছে গেলাম কেউ বললো, লাঞ্চের সময় দিবো, কেউ বললো টাকা গাড়িতে আছে। যাহোক, টেনেটুনে প্রায় ৬০ ডলারের মতো হলো। বাকি টাকার রিক্স নিয়ে ওয়ালমার্টে গেলাম। আল্লাহ-র অশেষ কৃপায় ওই বাজেটের মধ্যেই পার পেলাম। কিন্তু আমি এঁদের অনেকেরই আসল চেহারা দেখতে পেলাম। মনে মনে বললাম, আর যাই হক, আমাদের বাংলাদেশিরা অন্ততঃ এরকম চেহারা দেখাতেন না ।

এ তো গেলো টাকা পয়সার কথা। এবার বলি ভদ্রতার কথা. এক কলিগের সাথে গাড়িতে যাচ্ছি। কলিগ মহিলাটি গাড়ি চালাচ্ছে। এক সময় এস্টার-বাক স্টোর দেখে মহিলাটি বললো, তুমি কি কিছু মনে করবে আমি যদি এখানে কিছু কিনে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম প্রশ্নেই আছে না। তুমি যা খুশি কেনো . ড্রাইভ থ্রুতে গাড়ি থেমে মহিলাটি নিজের জন্য একটি হট চকলেট নিয়ে সা করে গাড়ি চালিয়ে চলে গেলো। আমাকে একটিবারও বললো না ‘ তুমি কিছু খাবে?” এই হচ্ছে ভদ্রতা। এখন, আমি যদি ব্রাউন মানুষ না হয়ে সাদা মানুষ হতাম, তাহলে উপরের উদাহরণ দুটি উল্লেখ করে ফেস বুকে কি বিরাট পোষ্ট দিতাম, “আহা!! , আমরা সাদারা কি কখনো ভালো হবো না। ভালো হতে পয়সা লাগে না ইত্যাদি ইত্যাদি। না, এঁরা কখনোই টা করবে না। এসব করারই বা এঁদের সময় কোথায়?

আরেকটি কথা বলে আজকের লেখা ইতি টানছি; সেটা হচ্ছে ভাষার কথা. আমার দীর্ঘ প্রায় ৯/১০ বছরের এঁদের সাথে অর্থাৎ আপনাদের ভাষায় সাদা দের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এঁরা অল্প শিক্ষিত হোক বা অর্ধ শিক্ষিত হোক এঁরা অবলীলায় বাবা/মা এমনকি অফিসে বসদের সামনে “এফ” ওয়ার্ড দিয়ে কথা বলে। আমি হলপ করে বলতে পারি , আমাদের বাংলাদেশিরা কোনো বাংলায় “চ” শব্দ দিয়ে পরিবারে বা কর্মক্ষেত্রে কোনো কথা বলে না। তাহলে দেখুন, কে বলেছে আমরা অসভ্য জাতি? শুধু ২/১ জনের কথা আলাদা। বিশেষ করে, টরেন্টোতে সম্প্রতি বাংলাদেশী কিছু লুটেরা যারা দেশ থেকে টাকা/পয়সা জোচ্চুরি করে, লুট করে এখানে বুকে বাতাস লেগে নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, এঁদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে. আমি আজ এপ্রসঙ্গে যাচ্ছি না। আমি শুধু এটুকু বলবো, প্লিজ কমিউনিটিতে একটু কিছু হলেই তাবৎ বাংলাদেশিদের নিয়ে কটু কথা বলবেন না। এতে কমুনিটির ক্ষতি ছাড়া লাভ হয় না।

উপসংহার : ভালো/মন্দ, দোষ-ত্রূটি সব কিছুর মধ্যেই থাকে, সব জাতির মধ্যেই থাকে . খারাপ কে না ঘেটে চলুন, ভালো কে ফোকাস করি। ভাগ্যচক্রে ভিনদেশে এসেছি কিন্তু, আমাদের শেকড় বাংলাদেশ। সামনের দিকে আগাই. আমি গর্বিত কানাডিয়ান বাংলাদেশী। বাংলাদেশ আমার গর্ব, আমার অহংকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে – শেষ পর্ব
পরবর্তী নিবন্ধবসন্ত অতিথি
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন