হিজলকান্তি প্রামাণিক পাপিষ্ঠ।
সে দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিদেশেই মরে পচে গেছে।

***************
তবে কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। সব সত্যের লেঙুরেই কিছুটা অসত্য ঝুলে থাকে।
হিজল কান্তি দেশে এসেছিল, কিন্তু সে ছিল অন্যদেশ!

অ্যামিরেতের প্লেনের গহ্বর থেকে বের হয়ে এল অনেকগুলো মানুষ। পিপড়ের দঙ্গলের মত ইয়ত্তাহীন। প্লেনে, লে-ওভারে, রাস্তায় কেটেছে ৩৭ ঘন্টা। মাথা কেমন কেমন করছে প্রামাণিকের। যেন এক আস্ত আলকাতরার ড্রাম বইছে
খিচ মেরে থাকা ঘাড়ের উপর।চোখ জ্বালা করে ঠিকড়ে বের হয়ে আসতে চাইছে অক্ষিকোটর থেকে। ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে আছে যেন অনন্তকাল। অনেকগুলো কাউন্টার, প্রতিটি কাউন্টারের চার কোনায় চারজনের স্টেশন। কোনটায় একজন, কোনটায় একজনও নেই। লাইন বড় হচ্ছে, হয়তো আরো কোন প্লেন এসে নামলো। লম্বা পাইথনের চেয়েও লম্বা লেজ লাইনের।
ভবঘুরে প্রামাণিক। অন্য এয়ারপোর্টে তিন মিনিট লাগে ইমিগ্রেশন পার হতে, এখানে দেড় ঘন্টা চলে গেছে। সে বিদেশি পাসপোর্টধারীদের লাইনে ।কিছু সাদা মানুষের মুখ কালো হয়ে আছে। আবার কিছু মানুষের মুখে সব সত্ত্বেও হাসি। কথা বলছে, ভাষা বোঝা যায় না। হয়তো বাংলাদেশে প্রবেশের প্রথম ইমপ্রেশন নিয়ে হাসাহাসি। ইমিগ্রেশনের এই কাউন্টারগুলো বাংলাদেশকে ভালোলাগা ও ভালোবাসার পূর্বরাগের জন্ম দেয়।লাগেজ বেল্ট বিস্ময় ক্লাইমেক্সে পৌঁছায়। সামনের কালো চুলের মেয়েটা এসেছে ইতালির ফ্লোরেন্স থেকে। এই প্রথম। ইউ এন থেকে এদেশের স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষার উপরে একটা অ্যাসাইনমেন্ট তার।
প্রশ্ন করে, “কি এত চেক করে এত সময় নিয়ে?”
“পাসপোর্ট।”
“এত কি দেখার আছে?”
“ পবিত্র গ্রন্থের মতই পাসপোর্ট, কত রহস্য লুকানো তাতে, সব বোঝাও যায় না, সময় তো লাগতেই পারে।”

ইয়াদভ দাঁড়িয়েছে পেছনে। দিল্লির ব্যবসায়ি। লাইনে দাঁড়াতেই ফোন বাজে। বলছে, “এইতো ইমিগ্রেশনে আছি, ২০ মিনিটেই বের হবো, একটু অপেক্ষা করো।” দেড়ঘন্টার মাথা কাটা গেছে। বাইরে অপেক্ষা করছে যে, সে যেন বাঙালি নয়। ফোনের পরে ফোন। মানুষ এত ধৈর্যহীন হয় কী করে? ইয়াদভ উশখুশ করে। বলে, “দেখছো একজন মানুষও নড়ছে না। কাউন্টারে কাজ করছে যে ক’জন তার চেয়ে দ্বিগুন অফিসার ওদের তদারকি করছে।
“Too few Indians, too many Chiefs.” হিজলকান্তির মনে পড়ে। কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। কী-ই বলার আছে।চিফদের কারো হাতে ওয়াকি-টকি, কারো হাত খালি। ওরা হাঁটছে এক কাউন্টার থেকে অন্য কাউন্টারে, একজনের পিছনে তিনজন।রাষ্ট্রিয় নিরাপত্তার কাজ।যেন তেন নয়। ব্যস্ত, ভীষণ ব্যস্ত ওরা, অথচ লাইন নড়ছে না, এক ইঞ্চিও না।একাত্তুরের মার্চ মাসের মত still mate.
কিন্তু আশা ছিল তখন। আশাদের মাটি চাপা দিয়েছে
পিতা পুত্র ভাই ভাগিনারা। ইয়াদভ জানবে কী করে যে, দক্ষ শ্রমিকরা বিদেশে চলে গেছে, অদক্ষদের নিয়ে দেশ চালাতে চিফরা হিমশিম খাচ্ছে।

***************

হিজলকান্তি প্রামাণিকের নাম রাখা হয়েছিল যখন, কেউ ধারণাও করতে পারে নি, ১৭ বছর পরে তার সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধটি হবে জলে ডোবা হিজলকুঞ্জে লুকিয়ে থেকে। গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে থাকবে হিজলকান্তির হিজল প্রাণ।
ঘটনাটি ঘটে খা খা রৌদ্রের দিনে দুপুরে।

এখন যেমন দিনে দুপুরেই সব কিছু ঘটে, স্বাধীনতার ফল-মূল কুড়ায় বিশিষ্টজন। গায়ে কেরোসিন ঢেলে প্রতিবাদী নারীকে ধর্ষকের প্ররোচনায় হত্যা করে দঙ্গল দঙ্গল মুখ-ঢাকা ডাকিনী-প্রেতিনী।এবং মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয়ক হয় হত্যা উৎসবের। এবং মুক্তিযোদ্ধা প্রতিবাদী হলেই হয়ে যায় রাজাকার, দিনে-দুপুরে।

বয়েস তখনও আঠারো হয় নাই। আঠারো হয়েছিল যুদ্ধের পরে গ্রামের কিছু অতি স্বাধীনের ক্ষমতার দাপটের দাঁত ভাঙতে গিয়ে। ভেবেছিল পাকিস্তানিরা শত্রু। কিন্তু কৈশোর যে আহাম্মকের স্বপ্নদোষের প্রদোষ, বুঝতে সময় লাগে নি।
দেশ ছাড়তে হয়েছিল।
প্রতিজ্ঞা করেছিল জালিম-মুক্ত দেশে ফিরে আসবে। যার কারণে দেশছাড়া হয়েছিল, বহু পল্টন খাওয়া সেই নেতার দাফন সম্পন্ন হয়েছে রাষ্ট্রিয় মর্যাদায় মাত্র কিছুদিন আগে।
‘স্বাধীনতা পোকায় খাওয়া স্বপ্নের সোনার আপেল’-হিজলকান্তি ভাবে। একটা দোয়েল খাড়া লেজ নাড়ে পতাকার ব্রাহ্মন পৈতার মত।

***************
ঝাড়ু….. ঝাড়ু….চোঙ্গা ফুঁকছে ফেরিওয়ালা ।
আগে গলায় হাঁক দিত। উন্নতির নমুনা দেখে হিজলকান্তি।
রিক্সা টিং টিং করছে। মটরবসানো রিক্সা।
জোরে জোরে কথা বলে হেঁটে যাচ্ছে মানুষের মত দুইজন।
বিই-বি বিই-বি হর্ণ দিচ্ছে কালো একটা গাড়ি। ড্রাইভারের ডান হাতে হুইল, বাম হাতের তর্জনি নাকের টানেলে। জোরে গলা খাকারি দিয়ে থুক করে কফ ফেলছে হিজাবপরা একজন মহিলা। একটা দমকা হাওয়া একমুঠো ধূলো উড়িয়ে চোখ ঢেকে দিল। দুই ঘন্টার ট্রাফিক জ্যাম অতিক্রম করে গাড়ি থেকে বের হতেই পায়ের বুড়ো আঙুল মাড়িয়ে ভট্ ভট্ করতে করতে চলে গেল একটা সিএনজি।

***************
অবশেষে দেখা হল।
আগে ছিল ফুল এখন আগুন। ফুল মাতাল করতো, কিন্তু আগুন পুড়িয়ে দেয়।যেন কনীনিকা গলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
ফিরতে না ফিরতেই মেসেঞ্জার হাম্বা হাম্বা করে:
“আমার হাত ধরে একটু হাঁটবে না?”
“অবশ্যই।”
“তাই বুঝি ভাইকে সাথে নিয়ে এসেছ? হি হি হি।”

***************
ব্লাউজের পেছনের জানালা গলে উদোম পিঠ চুল দিয়ে ঢাকা।
আঙুলের মৃদুস্পর্শে বিদ্যুত চমকায়। হাত আর পিঠ- প্রাগৈতিহাসিক চকমকি পাথর। সিএনজির অপ্রশস্থ নিবিড়তা।
ইচ্ছেরা ওড়াউড়ি করে। ইচ্ছেরা বেপোরোয়া ও বিভ্রান্ত।
কেঁপে ওঠে ইথার, শিরশির করে শিড়দাড়া ও কাঁচলবন্ধ যুগল কপোতি। থামো, সুস্থির হও। বুনো অনুভূতিতে বুনো হাত দিতে নেই। আঙুলের স্পর্শ দেশলাইয়ের স্পর্শের মত, বোঝ না?বিষকাঁটার মত গালে ঘষে মসৃনগাল। ব্লাউজের বুতাম খোলা হয় নাই, অনস্পর্শই ছিল আসোয়ান বাঁধ, প্লাবন হয় নি।
হতে পারতো। অনেকদিন আগে। মনে পড়লো।

***************
আকাশ বলে কিছু নেই কিন্তু আকাশের রং আছে। তোমার আমার মধ্যে এখন আর কিছু নেই কিন্তু একটা বর্ণাভা আছে। প্রেম হল দুইজন মানুষের মধ্যে তারহীন বিদ্যুতের চলাচল।বিদ্যুতের সুইচ অন অফ করা যায়, প্রেমের কোন সুইচ নেই, জন্মক্ষণ আছে। আমাদের ভালোবাসার জন্মক্ষণটি মনে করতে পারি। ভালোবাসার সব সময় স্বেচ্ছা মৃত্যু হয় না, ভালোবাসাকে মেরে ফেলা হয়, পারিপার্শ্বিকতার ইঁদুরকলে ফেলে নৃশংস স্বাধীনতায়।

***************
বিজলিকে কি দড়ি দিয়ে বাঁধা যায় ?
যায় না।
কেন বাঁধতে চাও?
কেন মন ভার করে থাকো? মাদুর পেতে আছো, কিন্তু আমি যে জানু গেড়ে বসতে ভুলে গেছি।
মাদুর নয়, শীতল পাটি?
ও আচ্ছা!
ঠিক মনে পড়ে না কোনটা মাদুর, কোনটা শীতলপাটি….
দৃষ্টি লেপ্টে থাকে উড়ন্ত প্রজাপতির ডানার নকশায়।
মন ছোট ছোট বর্গাকার অথবা আয়তাকার কচি ধানের খেতে বসে থাকা একঝাঁক সাদা বকের মত ব্যস্ত। ধীর-স্থির মনে হতে পারে কিন্তু তা দৃষ্টির বিভ্রম। বকগুলো খাদ্য সন্ধানে ব্যস্ত।
তুমি ঠিক বুঝবে না, আমি যা বুঝাতে চাই।
ভাষার দোষ নয়, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার তারতম্য।
প্রেমিক ও ধর্ষক দুজনেই যৌন উদ্দিপনা অনুভব করে, কিন্ত তুমি জানো কোনটা কি।

***************
জামরুল গাছে কয়েকটি ফুল ধরেছে আর কয়েকটি জায়মান জামরুল। আমার সমান বয়সী কদবেল গাছটি আমার চেয়েও দশগুন লম্বা। ও কোথাও যায় নি, কোন দেশ ঘোরে নি।কত কিছু দেখে নি, কত কিছু শোনে নি। উতাল হয় নি দেশী বা বিদেশী ভালোবাসার ঝঞ্ঝা ঝাপটায়। অথচ আমার চেয়ে কত বড় সে ! বৃক্ষ দাঁড়িয়ে মরে, মানুষ নতজানু হয়। সরীসৃপের মত পেটে হাঁটে স্বার্থের সন্নিহিত কাদায়।
আমি মানুষ অথবা…. নয়।

****************
টক বরই দিয়ে লাউ রান্না করেছো?
বাহ্!
কই মাছ? সর্ষে ইলিশ ?
অসামান্য!
কিন্তু আমি….. আমি…. খেতে পারি না, অনেকদিন বাইরে তো… সয় না।
একটু চা, চিনি ছাড়া।
পোড়া বাড়ির চমচম, কুমিল্লার দই? সর্বনাশ।
বিস্কুট ? না, কিচ্ছু না।
সইবে না। বিদেশে চলে গেলে মানুষ কত কিছু যে হারায়, সব চেয়ে প্রিয় যা, বা সবচেয়ে প্রিয় যে, তাও।

****************
আমি কোথায়? ট্রাফিক জ্যামে দাঁড়িয়ে আছি।
কোথায়?
ঠিক জানি না। একেবারেই চিনতে পারছি না রাস্তাটা।
কি অসহায় লাগে! একটি রাস্তাও চিনতে পারি না। একটি মোড়ও। আগে যেখানে গাছ ছিল, সেখানে উঁচু ইমারত, আগে যেখানে মাঠ ছিল, সেখানে মল। মুত্র ও মলের মিশ্রণ নয়, শুধু মল।খাল ভরাট করে প্রশস্থ রাস্তা। পুকুর ? পুকুর নেই, চুরি হয়ে গেছে । সংসদভবন চেনা যায় না। বঙ্গভবন কি এখন কওমি মাদ্রাসা? সরু সরু রাস্তায় আকাশচুম্বী বহুতল অপরাধ, ফায়ার এক্সিটবিহীন। আমি কি একদিন এই পথ দিয়ে হেঁটেছি? শ্বাস নিয়েছি কার্বন এই কণা?
আমি কি গ্রহান্তর থেকে এসেছি?

****************
কবি আল মাহমুদ মারা গেছেন।
মায়ের হারানো ‘সোনার নোলক’ খুঁজতে গিয়ে হারিয়েছিলেন বিবেক। পর্বত সমান কবি, সমুদ্র সমান পাপ। পর্বত সমুদ্রকে ধারণ করতে পারে না কিন্তু সমুদ্র পর্বতকে নিমজ্জিত করতে পারে। কবি কি এই সত্য জানতেন? হয়তো নয়, অথবা…..
মানুষ জেনেও ভুল পথে হাঁটে। ঋৃণ খেলাপি হয়, ব্যাংক নি:স্ব করে, হত্যা করে, নির্বাচন লুন্ঠন করে, পতিতালয়ে যায়।
ওসব কি ঠিক পথ? কেন তা নিয়ে হৈ হৈ হয় না?
চলছে সর্বব্যাপী মৃত কবির প্রক্ষালন, নিমজ্জন ও পশ্চাতে প্রহার। দেনা-পাওনা-জামাত-জয়বাংলা-বদি-ইয়াবা-বিচ্যুতি ইত্যাদির তুমুল ঝড়-বৃষ্টি -বিতর্কের এই দেশে কে-কবি, কে-বুকে ভর করে হাঁটে? মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে। লাখো লাখো মানুষের মেলা, বই মেলা অথচ গালির পুরীষ পাহাড় অবলুপ্ত করেছে একজন কবির সৃষ্টির পর্বত।

“প্রভাত ফেরি প্রভাত ফেরি
আমায় নেবে সঙ্গে
বাংলা আমার বচন,আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে।”
এই বঙ্গে এই কবি ছাড়া অন্য কেউ অপরাধ করে নি।

***************
আতাফল গাছে পাতাগুলো ঘন সবুজ, তাদের ফাঁকে টুনটুনি; টুন টুন করে লেজ নাড়ছে। একটা শেয়াল দাঁড়িয়ে আছে দূরে। দিনে সচরাচর শেয়াল দেখা যায় না। আগে, শৈশবে, শেয়াল ছিল খুব খারাপ। মুরগি চুরি করতো। এখন ওরা বিরল। ওদের তাড়িয়ে স্থান দখল করে নিয়েছে অন্যেরা। বিবেকের জমি, হৃদয়ের নদী, মাঠ-ঘাট-পতিত জলাশয়, সংসদ, মাদ্রাসা, মুখ ঢাকা মেয়ের সতীত্ব, শিশু-বালকের পায়ুপথ সব কিছু ওদের দখলে।
ওরা মরুভূমি থেকে নিয়ে এসেছে পাপের সাইমুম।

***************
ধোপাদের বাড়িগুলো নেই আর। নদীর তীরে বাতাসে দুলছে দড়ি টেনে রৌদ্রে শুকোতে দেয়া নানা রঙ্গের কাপড়।
নদী মরে গেছে। বিশাল যে বেলদারেরা পাল্কি বহন করতো, নৌকা ও গুদারা বাইতো, তারা উবে গেছে কর্পুরের মত, যেন কোনদিন ছিলোই না এই বিশাল জনগোষ্ঠি। তাদের ভিটেগুলোতে এখন সুন্দর সুন্দর জাপানি বাগান, ইয়েনের দেয়াল, রঙিন চাল, আর হিজাবে মুখ ঢাকা সাকুরা ব্লসম।

বেদেরা ঘর বেঁধেছে অতীতে। নৌকা বাওয়ার খাল শুকিয়ে গেছে। খালের ঠিক মাঝখানে বিশাল ইট সুরকির মসজিদ, মিনার ও মাইক, মেয়েদের মাদ্রাসা। প্রিন্সিপালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পোকায় খাওয়া দাঁত, মুখে দুর্গন্ধ। তার লম্বা হাত অনেক দূর পৌঁছায়। বলে, “অমন ঢং করিও না মাইয়্যা, সোবাহানাল্লা কও, আল্লা চাহে তো পরীক্ষায় পাশ করাইয়া দিমু।” বিশাল মাঁদারগাছের মত স্থানীয় নেতার প্রচ্ছায়ায় তার স্ফীত লিঙ্গে গুই সাপের মত হাত-পা গজায়।

***************
গ্রামের বাজারটি ছোট হয়ে গেছে। বটগাছের নীচে টিনের যে ঠাকুর ঘরটি ছিল, সেখানে প্রতিমা নেই। তা-ই বাজারের সবচেয়ে বড় দোকান এখন, গ্রামের বিশাল নেতার। জীবন দাসের মিষ্টির দোকানটি আছে আগের মতই, জীবন দাস নেই।
খালের দক্ষিণে যা-ই ছিল, পদ্মা গিলে খেয়েছে। তারপরে ভাঙন থামিয়ে পলি এনে খাল ভরাট করে গেছে। খালের যেখানে গুদারাঘাট ছিল, সেখানে এখন প্রাইমারি স্কুল।
গুদারা পার হয়ে ডান দিকে পাহাড়ের মত উঁচুতে ছিল জোছনা আপাদের বাড়ি। অল্প বয়েসে বিয়ে হয়েছিল তার এবং স্বামী মারা গিয়েছিল বিয়ের পর পরই। জোছনা আপার রূপ ছিল ভরাট জোছনার মত। চাহিদাও নাকি ছিল প্রচুর, সর্বভূক আগুনের মত। সে তার মধু মৌচাকে ধরে রাখে নি, বিলিয়েছে অকাতরে । পঞ্চায়েত তাকে গ্রামছাড়া করেছিল, ৬ দফা ঘোষণার সালে। ৬ দফায় প্রতিশ্রুতি ছিল, জোছনা আপা প্রতিশ্রুতি ছাড়াই…..
বয়েস ছিল ছোট তবুও তার আগুনের মত রূপ চোখে ভাসে, নাকে আসে ঘ্রাণ। ঘরে তালা দিয়ে তাদের চলে যাবার দিনটি ছিল রৌদ্রময়। আকাশে ছিল সাদা মেঘ। অশ্রু থলো থলো নয়নবুদ্বুদ। নবনীত নারীর মত গাছে টস টসে রোয়াল ফলগুলো চেয়েছিল।লেজ নাড়িয়েছিল শালিক। সেই রাত ছিল পৌর্ণমাসী, রজ:স্বলা বোষ্টমীর মত।
শূন্য বাড়িতে আমরা খেলা করেছি। বহুকাল আগের কথা! এই মাত্র বাড়িটি পার হয়ে এলাম। দেয়াল দিয়ে একটি সুন্দর রিসোর্ট করা হয়েছে সেখানে। সুন্দর সুইমিং পুল, গোলাপ আর গোলাপ, পারস্যের গোলাপের মত অকুমারি।

যে বার বিশাল গগন শিরীষ গাছটি দুফালা হয়েছিল উন্মত্ত বজ্রের করাতে, “আছিয়া’ আপার গর্ভ হয়েছিল অজ্ঞাত ভাবে। নীলমণি লতার মত অ-হল্য যৌবন ছিল তার। এখন এসব কোন খবরই নয়। তখন চৌদ্দ গ্রামে ছিল কেনেডির কিউবা সংকটের চেয়েও বিশাল ব্রেকিং নিউজ। ছিছির মেঘে ঢেকে গিয়েছিল গ্রামের নীচু আকাশ। রহমত চাচা মামলা ঠুকেছিল বাচ্চু মিয়ার বিরুদ্ধে। বাচ্চু মিয়া কিছুই স্বীকার করে নাই। সাক্ষী প্রমাণের অভাবে মামলা খারিজ হয়ে গিয়েছিল। আছিয়া আপাও মুখ খুলে নাই।
কেন যে সাক্ষী প্রমাণ না রেখে ভালোবাসায় করমচা-লাল হতে গিয়েছিল অকারণে……
“প্রেমের মড়া জলে ডোবে না”, মরে দেখাক না কেউ আছিয়া আপার মত, আসলেই ডোবে কি না!

তাদের বাড়িটির পাশ দিয়ে যাচ্ছি। ছোট ছোট ছাপড়া তুলে বস্তি গড়েছে পদ্মার ভাঙ্গনে উদ্বাস্ত এক ডজন জয় বাংলা। ম্যাজিশিয়ানের ভোজবাজির মত বদলে গেছে গ্রাম। বাঁশ ঝাড় কেটে ফেলা হয়েছে। মাঝি বাড়ি ভেসে গেছে জলে।
আশু ডাক্তারের চিতা….ভস্ম এখন।

****************

একটি কালো সুপুরি গাছ নদী থেকে স্নান করে তীরে দাঁড়িয়ে ভেজা শাড়ি বদলাচ্ছে। তার চিমসানো বুক দেখা যায়।
স্তন নয়, শিথিল কুচকানো চামড়া। দুধ ছিল হয়তো কখনও, এখন বুড়িগঙা। অথচ বয়েস ত্রিশ পয়ত্রিশের বেশি নয়। শৈশবে বঞ্চনা দেখেছি দিকে দিকে, প্রাচুর্য প্রায় ছিলই না। এখন প্রাচুর্য থৈ থৈ, আর বঞ্চনা অথৈ। অথচ সবাই নাকি কমপক্ষে দু’বেলা খেতে পায়।

***************
সব ভেঙে নিয়ে গেছে নদী, সব। রথ খোলার চিলতে খানেক
জমি টিকে আছে শুশুকের পিঠের মত, কেন কে জানে? তামার রথটি নেই, কোথায় গেছে কে জানে? “পেটে ক্ষুধা ও বাসস্থানের সংকট যখন, তখন প্রতিমাকে বিসর্জন দেয়া হয় প্রথম” কে যেন বলে, “মা গো মা, তুমি এখন যাও, সুদিনে ফিরিয়ে আনবো।”
সুদিন কোনদিন আসে নি, স্বাধীনতা এসেছে।নির্বাচিত কিছু মানুষের জন্য।
রথ খোলার সেই চিলতে জমিতেও কত কত ঘর, ছিন্নমূল শরনার্থীর বস্তি, পায়খানা, নেড়িকুত্তা, নির্বাচনের পোষ্টার।পোষ্টারে ভোট প্রার্থীর মাথার উপরে বঙ্গবন্ধুর ছবি, বেশ বড় করে।আর তাঁর স্বপ্নময় চোখের নীচে বিনিদ্রার কালি।

কালিঘরটি খুঁজে পেলাম অক্ষত। শৈশবের মা কালী তার বিশাল দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ডান পা এখনও বিশাল হা মুখো সিংহের পিঠের উপর। মায়ের হাতে খড়গ,গলায় নর-মুণ্ডের মালা, রক্ত- লাল জিভ। সে নাকি রাতে রাতে অসুর দমন করে। অথচ অসুরদের ছবি দেয়ালে দেয়ালে পোস্টারে সাটা, একজনও দমন হয় নাই।
মা কালীর বামপাশে মহাদেব, মাথায় জটা, গলায় জড়ানো ফনা তোলা কাল নাগিনী। পাশে বসা টানা-চোখের মায়াময়ী গাভী। দুই পাশে দুই ভয়ংকর রাক্ষস, ছোট। এতবড় এনসেম্বল অথচ রাক্ষসদের স্থান কত কম। ওরাই জগত জুড়ে আছে কেন্দ্রবিন্দুতে। ধর্মের একটাই সমস্যা, বাস্তবকে ছোট করে দেখায়, অবাস্তবকে বড়। ইহজগত ও জীবিত মানুষের মূল্য নেই, পরকাল নিয়ে পরাকাষ্ঠা দেখায়, আর ধর্ষণ করে।
নারী, পুরুষ, শিশু, কেউ নিরাপদ নয়।

***************
পদ্মা ছিল সমুদ্রের মত, অথবা সমুদ্রের চেয়েও বড়। তখনও আমি সমুদ্র দেখি নি, পদ্মার সীমারেখা ছিল না। কাল-বৈশাখির ঝড়ে প্রায়শই জেলেরা নদী থেকে ফিরে আসতো না। এই রথ খোলায়, এই ভয় উদ্রেককারী প্রতিমার সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়তো রোরুদ্যমান লোকালয়। কান্নার স্বর গিলে ফেলত বাতাসের স্বন। অথচ সেই উত্তাল পদ্মার মৃত একটি প্রবাহে অনেকগুলো ডাল ফেলে ‘জাগ’ দেয়া হয়েছে, মাছেদের সুখ ও নিরাপত্তার আশ্রয় তৈরি করে। আর পাতাহীন পুষ্পপ্লাবিত শিমুলগাছের ছায়ায় একটা রোয়া ওঠানো নেড়ি কুকুর শুয়ে ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে। শ্বাস নি:শ্বাসে উঁচু নীচু গতিময় তার পেটের চুপসানো বেলুন। কুকুরটির জন্মভূমির নাম বাংলাদেশ, কওমী মাতার জন্মভূমি, যেখানে মেয়েরা মেয়েদের পুড়িয়ে মারে মাদ্রাসায়। আমি এই দেশের জন্যই যুদ্ধ করেছিলাম। প্রকৃত পক্ষে এই হল স্বাধীনতা, এই কুকুরের মত ঘুমিয়ে থাকা, কেন যে এই দেশের নাম ‘নুসরাত রাফি’ নয়? ভালোই তো নাম- হিজলকান্তি ভাবে। তার চোখ ঝাপসা হয়ে টপ টপ করে ঝরে পড়ে কয়েক ফোটা বা কয়েক দল কৃষ্ণচুড়ার শোনিত সংশয়।

এপ্রিল ২০, ২০১৯

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন