পর পর বেশ কয়েকদিন অসহ্য গরমের পর তাপমাত্রা কিছুটা কমায়, হালকা স্বস্তিদায়ক সামারের আবেশ নিতে অফিসের ফাঁকে ফাঁকে অনেকেই চান্স পেলে একটু খোলা জায়গায় হেটে বেড়িয়ে আসে ৷ চমৎকার উথাল পাথাল বাতাসে ৫ নম্বর পার্কিং লটের উইন্ড টার্বাইনটাও যেন খুশিতে বন বন করে ঘুরছে ৷ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই মনে পড়ে গেলো কয়েক বছর আগেরএকটা ঘটনা ৷ তখন সবে কলেজের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর হিসাবে আমার চাকরিটা পাকা পোক্ত করার আয়োজন চলছে ৷ প্রথম দায়িত্ব ছিল এই ছোট্ট নন-গ্রীড-টাইড টার্বাইনের ইনস্টলেশন সুপারভাইজ করা ৷  কাজ প্রায় শেষ, বিভিন্ন কন্ট্রাক্টরদের কাজের ফিরিস্তি নিয়ে তাদের পেমেন্ট পর্ব চলছে ৷ ৪ কন্ট্রাক্টরের ৩ জনই পু্র্ব ইউরোপের আর একজন ব্রায়ান ছিল শুধু খাটি কেনেডিয়ান – ওর সাথেই টুক টাক যা একটু কথা বার্তা হতো ৷ রোদে পোড়া লালচে মুখের গভীর বলিরেখাতেই যা বয়সের ছাপ, না হলে তার কাজ দেখে কোনো ভাবেই বোঝার উপায় নেই যে বয়স ষাটের উপর ৷ কথায় কথায় বলতো, “আমার ষাট বছরের জিবনে কখনো এরকম দেখিনি” বা “ষাট বছরে কম তো আর দেখলাম না” ৷  আর আমি বলতাম, “রিটায়ার করে কটেজে গিয়ে থাক না কেন, তাহলে তো আর আর এইসব দেখতে হয় না ৷ এরকম কথা শুনে সে কেমন জানি আনমনা হয়ে গিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে মন দিত ৷ প্রায় মাস তিনেকের কাজে এটা বেশ একটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল ৷ শেষ দিন সারাদিন কাজ করে সব ঠিক ঠাক হয়েছে বোঝার পর তাকে অফিসে আসতে বললাম চেক নেয়ার জন্য ৷ আমার বস, যে  চেক সাইন করবে, একটা মিটিংএ থাকায় ব্রায়ানকে আমার ডেস্কের কাছে এনে বসালাম ৷ কিছুক্ষন এদিক ওদিক তাঁকিয়ে এক পর্যায়ে বললো, এই চাকরিটা পেতে তোমাকে কি ধরণের পড়াশুনা করতে হয়েছে ?
কেন, তোমার কি এরকম চাকরি পছন্দ ?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চক চকে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আগ্রহ নিয়ে বললো, “আমার মেয়েটা আর ২ বছর পর ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করবে; এরকম একটা অফিসের চাকরি সে নিশ্চই পেয়ে যাবে, কি বল ?”
আমি বললাম, “অবশ্যই, সে আরো অনেক ভালো চাকরি পাবে”৷
বৃদ্ধ বলে চলেছে, “সু’র যখন ৫ বছর বয়স তখন ওর সরকারি চাকুরে মা ‘চলে’যায় ৷ জেদ ছিল, তাই মেয়েকে পড়াতে সরকারের একটা পয়সাও নেইনি ৷ সিঙ্গেল প্যারেন্ট হিসেবে ওকে রেইজ করেছি ৷ মেয়েও অনেক ভালো করছে, জানো, ছুটিতে বাড়িতে এলেও দেখি সে কম্পিউটার নিয়ে  মহা ব্যাস্ত থাকে ৷ পড়া শেষ করে সু যেদিন তোমার মতো একটা চাকরিতে জয়েন করবে, যেদিন বুঝতে পারব তাকে তার বাবার মতো হাড় ভাংগা খাটুনি করে সংসার চালাতে হবে না, সেদিন আমার সব মেশিন পত্র ডোনেট করে রিটায়ার করবো”৷ আমাদের দেশের সব বাবাই সীমা পরিসীমা ছাড়িয়ে ছেলে মেয়েদের জন্য স্বপ্ন দেখে, রোজগার করে; এর কোনো ব্যাতিক্রম নাই ৷ বৃদ্ধের ঘামে ভেজা, রুক্ষ মুখমন্ডল আর অদ্ভুত দ্যুতিময় চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম এদেশেও তাহলে এমন আছে !
এমন বাবা দেখার প্রথম অভিজ্ঞতায়ই সম্ভবতঃ আমার চোখে কখন যে পানি এসে গেছে টের পাইনি ৷ আশ্চর্য্য ! এতো দুর্বল হয়ে গেলাম কবে ?

ছবি :- সৌজন্যে Family Law

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন