দেশের নাম চকবরকত ।
কিভাবে আমি সেই দেশে গিয়েছিলাম মনে নেই। কবে গিয়েছিলাম তাও কুয়াশার ধুঁয়াশায় ঢাকা। কেন গিয়েছিলাম মনে আছে, বলবো সময়ে।
সম্ভবত গিয়েছিলাম বিজয়পুর থেকে গরুর গাড়িতে চড়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে । পীচ এসফাল্ট নয়, নরম মাটির পথ। পথে খানা খন্দ গর্ত আর গোবরের স্তুপ।
ডান দিকে ধানখেত ডানের দিগন্ত ছুঁয়ে, বাম দিকে ধানখেত বাম-দিগন্তের করপুটে কর রেখে। দূরের আকাশে গলা বাড়িয়ে ছিল লম্বা লম্বা সুপুরি গাছ । আর তালগাছগুলো উস্কো খুস্কো অগোছালো চুলের কৃষকের মত। নারিকেল গাছের পাতা আকাশকে বাঁকা পিঠ দেখিয়ে নড়ছিল। রোদ ছিল ঝরঝরে কৃষানীর আঁচলের মত, তবে সোনালী রোদ নয়, তামায় তাতানো আগুনে পোড়া।সেই দেশে একজন মাত্র গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন।
একজন পীর।

ঢাকা নামের অন্য একদেশে আমি থাকতাম। সেই দেশে তখন কালো চশমা পরে টগবগ করে হাঁটতেন সেই সময়ের “এক নম্বর” । অনেক মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তিনি রাতে রাতে ঘুমাতে ভয় পেতেন। তাকে পিছন থেকে একদল উন্মত্ত ঐরাবত তাড়া করতো। চোখ বুজলেই দৌড়াতে শুরু করতেন, দৌড়াতেন সারা রাত, ক্যান্টনমেন্টের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ঐরাবতগুলো ছিলো তার ফাঁসে শ্বাস-রুদ্ধ এককালের বন্ধুদের আত্মা, যাদের তিনি গুনে গুনে হত্যা করিয়েছিলেন । সবচেয়ে বেশী তাড়া করতো যে, সে তাকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলতো। শুধু এক পা, একটি পায়ের দূরত্ব অতিক্রম করতে পারতো না রজ্জু গলার কর্নেল।
ছেড়া গেন্জি ঘামে ভিজে জেগে উঠতেন তিনি কালো চশমা খুলে।
জল খেতে গিয়ে মনে হতো রক্ত পান করছেন। যদিও জল, বাংলার মাঠে মাঠে নিহত নামহীন অজস্র মানুষের রক্তের সাথে মিশিয়ে আরো অনেকের রক্তের নোনা স্বাদ টের পেতেন। তাতে তার তৃষ্ণা আরো বাড়তো। মুক্তিযুদ্ধের আগুনে বিশুদ্ধ আরো বহু বহু ধমনীতে ছিল বহমান রক্ত যেখানে ছিলো তার দু:স্বপ্নের জন্ম-ঠিকুজি।
বিষকাঁটা এরা তার বিশাল পরিকল্পনার পথে।

তিনি ঘন ঘন রাষ্ট্রিয় সফরে যেতেন বিভিন্ন পীরের দেশে । আসতেন চকবরকত রাষ্ট্রের রাজধানীতেও। সেখানকার রাষ্ট্রপ্রধান তাকে মৃতদের কুনজরের থেকে রক্ষা-তাবিজ দিতেন। আর দিতেন রাষ্ট্র চালনার আক্কেল । কারা মিত্র, কারা নয়, কাদের গলা কাটতে হবে তিনি পই পই করে চিনিয়ে দিতেন। এই দ্বি-পাক্ষিক রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা ব্যবহার করে পীর দেশের মানুষের যথেষ্ট “উ” এবং “অ” “পকার” করেছেন। কথাগুলো হয়তো নিরপেক্ষ নয়। “ঢাকা” দেশের মত “না ঢাকা” দেশের লোকজনও দুর্মুখ। তারা বহু অযথা কথা বলে এবং সব কথায় নাকি কান দিতে নেই।
তবে এই পীর বা এই কালো চশমার “বীর” সম্পর্কে এই গল্প নয়।
গল্প হলো সেই পীরের দেশ নিয়ে।
সেখানে টাকা পয়সার লেনদেন হতো বেশ।
যেখানে গরু ছাগল ভেড়া বকরি আর নিরীহের চেয়েও নিরীহ কৃষকেরা বাস করে সেই সব জায়গায় সেই আমলে কোনো ব্যাংক কোন শাখা খুলতো না। কিন্তু ক্ষমতার চেরাগ এখানে একটি ব্যাংকের শাখা খুলিয়েছিল।সেই শাখায় গরুই হাঁটতো মূলত, স্তুপ স্তুপ গোবর ডিপোজিট করে। মাঝে মধ্যে দু একজন মানুষ যেতো টুপি মাথায়। কিছুদিন আগেও এই টুপি-গোষ্ঠির অন্য বিশেষণ ছিলো কিন্তু এখন তারা সাচ্চা।
এই দেশপ্রেমিকদের সেবা করার জন্য আমার এক আত্মীয় সেই ব্যাংকে গিয়েছিলো ম্যানেজার হিসাবে। কলকাতা থেকে পূর্ব বাংলায় আসা পোস্টমাস্টার বাবুর যে দশা হয়েছিল প্রায় এক শতাব্দী আগে, এই ভদ্রলোকের অবস্থা তার চেয়ে ভালো ছিলো না।
তার বড় কষ্টে দিন কাঁটছিলো। যাই হোক, আমার যে শত্রুর শত্রু, মায়ের পেটের বিষফোঁড়া বোন, সবে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে শেষ করেছে। বাবা বললো, তাকে ঐ ভদ্রোলোকের কাছে দিয়ে আসতে।
না এমনেই নয়। এটা কোন নারী ব্যবসা নয়।
ঐ লোক কিছুদিন আগে দেনমোহর- কাবিন- কবুল ইত্যাদি ঝামেলা অতিক্রম করে তার বৌকে আমাদের বাসায় রেখে গিয়েছিল ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার জন্য ।
সে আমার বোন নয়, ঘসেটি বেগম।

আমার রং ও বর্ণাভার তালিকায় তখনও বাস্তব জগতের ধূসর রংটি যুক্ত হয় নি। আমি ছিলাম ভেদা মাছের মত। কাদা কাদা ছিল আমার পার্থিব বস্তু-বোধ। ট্রেনে পচন, বাসে ঝাঁকুনি, তারপরে গরুর গাড়ী । আজাব আর কাকে বলে। সারা রাস্তা মায়ের পেটের শত্রুর বকা শুনতে শুনতে কানের খৈল কান ছেড়ে ঝাঁপ দিয়েছে। তারপরেও গিয়েছি। পুরুষের কাজ, এগিয়ে যাওয়া, পছন্দ না হলেও। তার মানে আত্মহত্যা করা নয়। অবশ্য আত্মহত্যা করলেও খারাপ হতো না।


তবে আমার চকবরকত দেশটি খুব ভালো লেগেছিল।
গাছ পালা ছায়া অনেক। ঝুঁটিওয়ালা লাল মোরগ, প্যাঁক প্যাঁক করা হাঁস, চিনাবাদামের মত গোটা গোটা “লাদা” নিস্ক্রমণ করা বকরি, আর দার্শনিকের মত দাঁড়িওয়ালা চোয়াল নাড়ানো ছাগল এর আগে এত কাছ থেকে দেখি নি। ভোরের আলো হবার আগে পাখির আনন্দ-কোলাহল, কিচির-মিচির আর মোরগের আজান। পাখি সেখানে নিজেই গায়। লাল ও গোল সূর্য ওঠে মাঠ ছাড়িয়ে অনেক দূরে পূবের বারান্দায় আর সন্ধ্যায় অস্ত যায় মাঠ পেরিয়ে অনেক দূরে পশ্চিমের চৌহদ্দীতে । ভালোবেসে বাঁকা হয়ে চেয়ে থাকে বকফুল।চেয়ে থাকে সমস্ত অন্তরাত্মা উজাড় করে দিয়ে।

আমি “ঢাকা” দেশের কীট-সুজন, শহরেই জন্ম, শহরেই বড় হয়েছি। এ সবই আমার নতুন অভিজ্ঞতা। অমন আদিগন্ত মাঠ দেখার সুযোগ আমার আগে হয় নি। সাপ যেমন এঁকে বেঁকে হাঁটে তেমন করে রাস্তাও যে খেতের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে হারিয়ে যেতে পারে এই ধারণা আমার ছিলো না। শহরের মত রাস্তার আবর্জনা, ড্রেনের গন্ধ, বাসের ভো, ট্রাকের পশ্চাৎ নির্গত ধূঁয়া, রিক্সার টুংটাং বা পায়ের উপর দিয়ে রিক্সার চাকা উঠে যাবার সৌন্দর্যের বাইরেও যে একটা জগত আছে, আমি এই প্রথম জানতে পেরেছিলাম।

আমার তখন সবে নাকের নীচে দিকচক্রবালের ক্ষীণ রেখার মত একটি ঈষৎ কালো রেখা দেখা দিতে শুরু করেছে। রাতে রাতে গন্ধম বাগানে হাঁটার তীব্র ইচ্ছা হতে শুরু করেছে। পাশের বাড়ির “তরু”র কথা কল্পনা করতাম। ওর বেণী ত্রিবেণী স্তন ইত্যাদি নিয়ে কৌতুহলে মাথা কিলবিল করতো বলে সহজে ঘুম আসতো না। আর কষ্টের ঘুম যখন আসতো, লুঙ্গির নীচে নড়াচড়া শুরু করতো এক তাগড়া ও বুদ্ধি-বিবেকহীন চিকা । চোখে এত এত রং ও বর্ণাভা ধরা পড়তে শুরু করেছে যে রীতিমত অবাক হয়ে ভেবেছি ওই রং গুলো আদৌ আগে ছিলো, না ছিলো না? ১-২-৩ বছরের বড় বন্ধুদের কাছে জানতে পেরেছি, ছিল। শুধু আমার চোখে সব রং দেখার “রড” “কোণ” গুলো তখনও সাবালক হয় নাই। বিড়ি ফুঁকে দেখেছি, ভালো লাগে নাই, কিন্তু বন্ধুদের কাছে খাটো হতে চাই নি। চালিয়ে গেছি। অভ্যাসের সিঁড়ি বেয়ে ভালো লাগতে শুরু করেছে যখন, তখন বাবার হাতে মার খেয়েছি।তা সত্ত্বেও বাবার পকেট থেকেই দুচারটা সিগারেট যে চুরি করি নাই তা নয়।
এ ছিল সেই সময়টা যখন “ঢাকা” দেশের অঘাটায় ঘন ঘন ফাঁসীর উৎসব হতো আর গট গট করে হাঁটতেন কালো চশমার “এক নম্বর”।
এখন সে সময়টা ভুলে গেছে সবাই, আমিও। কালো চশমার সেই “এক নম্বর”কে অনেকেই পীর মনে করে । কিন্তু আমার যৌন জাগরণের সমান্তরালেই ঘটেছিল পিতৃহত্যা, রক্তপাত ও স্বপ্নের নিধনযজ্ঞ। চলছিল বলেই আমার একটার কথা মনে করতে গেলে, অন্য অনেক কথা অবিকল মনে আসে সারি সারি পিঁপড়ের মত।

অবশ্য মরণ ও মড়ক এর আগেও এই দেশে ছিল। সর্বহারা ও গণবাহিনীর কচুগাছের মত গলাকাটার উৎসব ও তাদের ধরার নাম করে রক্ষীবাহিনীর সন্ত্রাস ও যুব-সমাজের নিপীড়ন ছিল বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে। যারা গ্রামে থেকেছে তারা খুব জীবন্তভাবে মনে করতে পারে। আমি পারি না। ঢাকা শহরে থাকার এই ছিল সুবিধা, ওই ঘটনাগুলো নিজের চোখে ও চামড়ায় গেঁথে যায় নি। তাই মাঝে মাঝে স্মৃতিবিভ্রম হয়, মনে হয় ৭১ এর পরে বাংলাদেশে রক্ত আর ঝরে নি।

বৌ যার, তার জিম্মায় বোনকে রেখে আমি গরুর গাড়িতে চড়ে বসি। সেই অনিন্দ্য আপাত শান্তির চকবরকতের মেঠো চিত্রের ঢাল বুকে ও দৃষ্টিতে গেঁথে বর্ডার পার হয়ে আসি।
ওটা অন্য দেশ, সম্পূর্ণ ভিন্ন, কৈশোরের দেশ।
স্মৃতির কুঝ্বটিকার আড়ালে।
আমার দেশ ঢাকা, যার ৩২ নম্বর সড়কের সিঁড়িতে উবু হয়ে ছিল বিশাল ঝাঁঝর বুক। অদূরে ছিটকে পড়েছিল ট্যোবাকোর পাইপ আর জেলের নিরাপত্তায় নিহত হয়েছিল আমাদের আয়তাকার আশা। আমি কি কিছু ভেবেছি গরুর গাড়িতে বসে বসে? মনে পড়ে না। আমাদের এত রক্তে অর্জিত বিজয়কে এত সহজে লুন্ঠিত হতে দেবার তারা কি শুধুই শিকার নাকি ক্ষমতান্ধ প্রকৌশলীও?

দুটি মহিষ আমাকে নাচাতে নাচাতে নিয়ে এসেছিল অন্য এক দেশে।
নাম তার বিজয়পুর । সেখানে রিক্সা চলে, বাস চলে, ট্রেন ও গরুর গাড়ি চলে। আমি এক রাতের অতিথি হয়েছিলাম এক বাসায়, আত্মীয় নয়, বোন জামাইয়ের কলিগের বাসায়।
ভদ্রলোক ছিলেন খুবই ভদ্র, তার বৌ আরও বেশী ।
উষ্ণ ও নম্র দম্পতি।
তাদের একটা ছেলে ছিল ছোট এবং একটা মেয়ে আমার মতই বয়েস। আমার মত বয়েস বলেই সে দেখতে ছিল আমার চেয়ে বেশী প্রস্ফুটিত। মেয়েরা এমনিতেই একটু আগে ফোটে।
ছেলেরা স্লো, শরীরেও, মগজেও।
ওর চোখ দুটো ছিলো বড় বড় পদ্মফুলের মত।চোখের তুলনা পদ্মফুলে হয় না, কিন্তু ওর চোখ দুটো আসলেই ছিলো পূর্ণফোটা পদ্মফুলের মত।
এত্তো এত্তো বড় !
একটুও বেমানান ছিলো না ওর মুখে। মনে হয়নি গ্রাম্য মেয়ের মুখে “এলিয়েন” চোখ। ওকে তৈরী করার সময় ঈশ্বর হয়তো খুব ভালো মুডে ছিলেন । অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে । কী যে মায়াবী চেহারা!
শুধু তাই নয়, চোখগুলো ছিলো, আমি নিশ্চিত, এক জোড়া চুম্বক।
হয়তো তাও নয়, মনে হয়েছে ওই চোখেদের হাত পা আছে। যেন বুকের চামড়া, মাংস ও পাজড় ভেদ করে খুব দৃঢ় অকম্পিত একটি হাত আমরা হৃৎপিন্ডটা হ্যাচকা টান মেরে বের করে নিয়ে গেছে।
নিজে সে ছিল তার বেণীর চেয়ে সামান্য মোটা, লম্বা ও সোজা।
চিকন হবার কারণে মনে হয়েছে আমার চেয়েও লম্বা। একই কৃশকায়তায় তার ঈষৎ উঁচু বুকে মনে হয়েছে তালশাঁস লুকিয়ে আছে। ঠিক কেন তালশাঁস, কেন কাঁচা পেয়ারা, গাব, কদবেল নয় তা আমার মনে নেই। মনে আছে সেদিকে তাকিয়ে আমার কেমন যেন খাবি খাওয়ার ভাব হয়েছিল।


যে কখনও খাবি খায় নি তার মনে হতে পারে খাবি খাওয়া মানে বমি বমি ভাব হওয়া কিন্তু আসলে তা নয়। হঠাৎ স্রোতের ঘুর্ণিতে পড়ে গেলে ডুবা-উঠা-আবার ডুবার যে শ্বাসহীন ক্রিয়া-প্রক্রিয়া চলে, খাবি খাওয়া হল সেই জিনিস।
আমি তার স্তনের সৌন্দর্যে খাবি খেয়েছিলাম।
ভেদা মাছ হলেও মনে হয় মনটা ইচড়ে পেকে গিয়েছিল অথবা কাঁচা ছিল কাঁচা বরইয়ের মত। একটা কিছু যে এবনরমাল ছিল সেটা এখন ঠিক বুঝতে পারি। এখন কোন বুকই মাথায় অমন বোমারু বিমানের ঝাঁ ঝঁ শব্দ করে না।

আমরা এক টেবিলে বসে খেয়েছিলাম । সে একটাও কথা বলে নি কিন্তু চোখ দিয়ে যে আমার মাথা চিবিয়েছে সেটা আমি মাথার হঠাৎ ভারশূন্যতায়ই টের পেয়েছি। মেয়েরা ছেলেদের দিকে, ছেলেরা মেয়েদের দিকে চোরা চোখে তাকাবে এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।কিন্তু ওর ছোট ভাইটা তখনও এই কেমিস্ট্রির জটিলতা জানতো না। সে বোনকে এই নিয়ে কিছু একটা ঠাট্টা করেছিল, “ছেলে পছন্দ হয়েছে বুঝি ?”
বলা বাহুল্য, যতদূর মনে পড়ে আমি সেখানে বিয়ে করতে যাই নাই এবং আমি ছাড়া সেখানে অন্য কোন ছেলের উপস্থিতিও ছিল না । কিন্তু মেয়েটির হঠাৎ কী হল, যেন হিরোশিমার সমান বিস্ফোরণ ঘটলো বিজয়পুর নামক দেশটির এপিসেন্টারে । সে তার ভাইকে সংহার করতে উদ্যত হলো মা কালীর খড়গ হাতে। সে কী চিৎকার চেচামেচি। কুরুক্ষেত্রের বমশেলের শব্দের মত শব্দ।
শেষ পর্যন্ত মা ক্ষেপে গিয়ে মেয়েটিকে ঠেলতে ঠেলতে একটি খালি রুমের ভিতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিলো।
এই শিকল তুলে দেবার দৃশ্যটা খুব চোখে পড়ে।
৭৫রের নভেম্বর মাসে এমন শিকল তুলে দেয়া দরজার উল্টা অন্ধকারে সাংঘাতিক কিছু ঘটেছিল।
আলতু ছুটে এসে চেচিয়ে বলেছিল, “জেলখানায় নেতা গো মাইরা ফালাইছে, হায় হায়!”
আমরা তখন ঘুমাচ্ছিলাম।
আরমোড়া ভেঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার।

কী থেকে কী যে হয়ে গেল!
একটা সুন্দর স্মৃতিময় সন্ধ্যা হতে পারতো কিন্তু হলো অসুন্দর ও কদাকার। দরজার অন্যদিক থেকে দানবী কিশোরীর দক্ষ-যজ্ঞের শব্দ আসছিল, সে দরজা ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছিল এত শক্তিতে যে সারাটা বাড়ি যেন থরথর করে কাঁপছিল।
ওর মা চোখ মুছতে মুছতে বলেছিল, “বাবা মনে কিছু করো না, আমাদের মেয়েটা অসুস্থ।ওর প্রায়ই এমন হয়, আমরা কন্ট্রোল করতে পারি না। ওর যখন রাগ ওঠে আমরা সবাই যেন ওর হাতে জিম্মি। কত মারধোর করেছি, কোন কাজ হয় নি।”
নূতন বা ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। এ বাড়ি এ নিয়ে অভ্যস্ত । কিন্তু অপরিচিত অতিথির সামনে হয়তো প্রথম। বন্দিনীর রুমটির ভিতরে কোন আসবাব পত্র বা ভাঙ্গার মত কিছু ছিলো না। ছিল শুধু সিমেন্টের ফ্লোর। বসতেও ফ্লোর, ঘুমাতেও ফ্লোর। যেন ওই রুমটার ব্যবহার ওই একটাই, ওই “ইয়ং ক্যাপটিভের” রাগ সংহারের জেল খানা। তার চিৎকার ও গালাগালি শোনা যাচ্ছিল দীর্ঘক্ষণ, তারপরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ।
রাত বাড়ছিল ধীরে ধীরে। কেউ তাকে শিকল খুলে বের করে আনে নি।
গৃহস্বামী বসেছিলেন ভিতরের ঘরে পাথরের মূর্তির মত, একটা কথাও বলেন নি।
গৃহিনী কাঁদছিলেন নীরবে। ভাইটা কুকড়ে গিয়ে বই নিয়ে বসেছিল।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল।
“প্রতিটি সুখী পরিবার অবিকল একই রকমের সুখী, প্রতিটি অসুখী পরিবারের দু:খ ভিন্ন ভিন্ন”, আমি তখনও তলস্তয় পড়ে একথা জানি নি।
জীবন শিখিয়েছিল।

ঢাকায় ফিরে এসে শুনি জাপানি প্লেন, ফাঁসী ও মৃত্যুর মহামারী নাড়িয়ে দিয়েছে দেশ। ফাঁসির পরে ফাঁসির প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রতিটি ক্যান্টনমেন্ট। যারা ঝুলছে বেছে বেছে প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধা। রাজাকার সব ছিলো নেতৃত্বে, আর্মিতে একজনও ছিলো না।
কালো চশমার দু:স্বপ্নের নাম মুক্তিযুদ্ধ।
সবাই ভুলে গেলেও, সত্য এই – কালো চশমার দু:স্বপ্নের নাম মুক্তিযুদ্ধ।
ঢাকা থম থম করছে।
আমার কৈশরের ঢাকা, থম থমের “নাইটমেয়ারের” দেশ।
ইতিহাস বোবা শিক্ষক, ইতিহাস কাউকেই কোনোদিন কিছু শিখায় নি।

আহা দেশগুলো !
ঢাকা, চকবরকত, বিজয়পুর।
ছোট ছোট দেশ।
মসৃন তাদের সীমান্ত! কোন পাসপোর্ট ভিসা কাস্টমস নেই। শুধু ফুল আর ফুল আর ঘাস-শিশির-পাখি । পাখি উড়ে যায় এক সীমান্ত ছেড়ে অন্য সীমান্তে।
সময় উড়ে যাওয়া চিল।
মেয়েরা সুন্দর, সুন্দর বুকে নীলপদ্মের ঝিল।
রক্ত, কান্না ও ফাঁসি।
শিকল দেয়া দরজার অন্ধকারে পিশাচের অট্টহাসি।
ডাকিনী, নাগিনী, হায়েনা, তক্ষক ও তস্করের ভীড়ে সেই দিনগুলোতে আমার দেখা হয়েছিল বাইপোলারের ঝড়াক্রান্ত কোনো এক মানসিক প্রতিবন্দী মেয়ের সাথে।
পদ্মফুলের মত বড় বড় চোখ ছিলো তার। ঈশ্বরের অকল্ক মুডের সময়ে তৈরী।
তার পিতা- মাতা মূর্তির মত বসে থাকতো রুদ্ধ-দ্বার হতাশার বিবরে।
তাদের চোখ দিয়ে ঝরতো অশ্রু, ডালা ভাঙ্গা আহত বৃক্ষ-কষের মত শব্দহীন,
অশ্রু না রক্ত, কেউ বুঝতে পারে না ।

অক্টোবর ১৯, ২০১৮
ওকালা

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন