মা- বাবা কে হারিয়েছি ১৫ বছর আগে। যখনই মনে পড়ে তখনই প্রাণটা হাহাকার করে উঠে। এখন মনে হয় তাদের জীবোদ্দশায় কেন আরো সেবা করতে পারিনি। পরে আবার নিজেই নিজেকে শান্তনা দেই যে আমি আমার তৎকালীন সামর্থ অনুযায়ী তাদের সেবা করার চেষ্টা করেছি। বিশেষ বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে মা=বাবা কে নিয়ে সবার জীবনেই এ ধরণের চিন্তা-ভাবনার উদয় হয়ে থাকে। সম্প্রতি ,আমার ভাগিনার একটি ফেসবুক পোস্টে আমার মা-বাবা ও অন্যানো ঘনিষ্ঠ জনদের কিছু ছবি দেখে আজ আবার আমার মনে এই ভাবনাটির উদয় হয়েছে। তাই মা-বাবার স্মৃতি চারণ করে বন্ধু সুকান্ত বিশ্বাসের সংগৃহিত একটি লেখা সকলের পঠনের জন্য হুবহু উল্লেখ করলাম:…….


নদীর ধারে দাড়িয়ে বাবা দলছুট কয়েকটি পাখির দিকে আঙ্গুল তুলে আমাকে বললেন,
— ‘এরা আর কোন দিন তাদের দেশে ফিরে যেতে পারবে না। কেন জানিস?’ আমি বললাম,
— ‘জানি না বাবা। কেন ফিরে যেতে পারবে না?’
— ‘এদের সঙ্গী, শিকারির হাতে ধরা পড়েছে। এরা এখনো তার সন্ধানে আছে। যদি কখনো খুঁজে পায় তাহলে একসাথে যাবে।’ বাবা বললেন।
— ‘যদি খুঁজে না পায়?’ আমি জানতে চাইলাম।
— ‘খুঁজে না পেলে এরাও একদিন কোন শিকারির হাতে ধরা পড়বে, বাজারে বিক্রি হবে।’ বাবার মুখ তখন বিষণ্ণ লাগে দেখতে।
ছোট বেলায় আমাকে নিয়ে বাবা শীতের অথিতি পাখি দেখতে নিয়ে যেতেন। শীতের শেষে না ফেরা পাখি গুলোর জন্য তার অনেক মায়া হত। শীত চলে যাচ্ছে, তাই পাখি দেখতে গ্রামে যেতে চাইছে।
গ্রামের বাজার থেকে কিছু দূর হেটে রাস্তার পাশে একটা শত বছরের পুরনো বট গাছ। বাবা সেই বটতলার মাচায় বসে পাখি দেখবেন। আমিও বলেছি বাবাকে সময় করে নিয়ে যাবো।

রাত বারোটর সময় দরজায় টোকা শুনে বিছানা থেকে উঠে আসি। দরজা খুলে দেখি বাবা দাড়িয়ে আছেন দরজার সামনে। এতো রাতে বাবার রসগোল্লা খেতে ইচ্ছে হল। আমি বললাম,
— ‘বাবা তোমার সুগার লেবেল অনেক বেশী মনে আছে? ডাক্তর…’
— ‘তুই কি আমাকে রসগোল্লা খাওয়াবি না? হ্যা কিংবা না বল।’ বাবা একটু রেগে গেলেন মনে হচ্ছে।
আমি ফ্রিজ থোকে মিষ্টি বের করে খেতে দিলাম। বাবা খাবে না। দোকানে গিয়ে বসে খাবেন। আমি বললাম,
— ‘এতো রাতে কোন মিষ্টির দোকান খোলা নেই বাবা।’ এবার আরেকটু বেশী রেগে বাবা বললেন,
— ‘দোকান কোথায় খোলা আছে জানি না। আমি দোকানে বসে, রসে ডুবানো রসগোল্লা খাবো।’
বাবার সাথে আমার এই কথা গুলো আমাদের শোবার ঘর থেকে শুনছে মলি। আমি প্যান্ট পড়ে গাড়ির চাবি নিয়ে তৈরী হলাম। মলি বিরক্ত হয় নি বোঝা গেল, যখন সে আমাকে বললো,
— ‘স্টেশন রোডে একটা দোকান খোলা পেতে পারো।’
বাবা লুঙ্গী পড়েই গাড়িতে উঠলেন। স্টেশন রোডের সেই দোকানে বসে বাবার মিষ্টি খাওয়া দেখে চোখে জল এসে গেল আমার। কি শিশু সুলভ আচরণ!
মনে পড়ে শৈশবে বাবা রাতে বাড়ী ফিরে মাঝ রাতে আমাকে আর বুবুকে ঘুম থেকে তুলে মিষ্টি খাইয়ে দিতেন। মুখে অর্ধেকটা মিষ্টি নিয়ে চোখ ঘুমে ঢলে পড়তাম আমরা দুই ভাই বোন। বাবা আলতো করে দুই গালে হাতের স্পর্শ দিতেন।
পুরোটা খাওয়া শেষ করে জল খাইয়ে মুখ মুছে দিত গামছা দিয়ে। তখন বাবার চোখে কি আনন্দ! আমারো তেমনই আনন্দ লাগছিলো বাবার রসগোল্লা খাওয়া দেখে।
আমার বৃদ্ধ বাবাকে দেখে বুঝতে পারলাম মানুষ কিভাবে শিশু থেকে বড় হয়ে আবার শিশু হয়ে যায়। আটাত্তুর চলছে বাবার। বছর খানেক হল এমন পাগলামি বেড়েছে। মা মারা যাওয়ার পর থেকে।
মা মারা যাওয়ার পর একা গ্রামে রাখা সম্ভব ছিল না বাবাকে। বাবা গ্রাম ছেড়ে আসতেও রাজী হচ্ছিলেন না। রান্না বান্না কে করবে? দেখা শোনা কে করবে? এইসব বুঝিয়ে শুনিয়ে বাবাকে আমার কাছে নিয়ে এলাম। প্রথম কয়েকদিন খুব সমস্যা হয়।
সকালে ঘুম থেকে উঠে পাগলের মত হয়ে যেত হাটার জন্য। সকালে তিন চার কিলো মিটার না হাটলে তার ভালো লাগে না। সেক্টরের পার্কে হাঁটতে নিয়ে যাই। তাতে বাবার মন ভরে না। সকালে উঠে প্রায় প্রতিদিন শুনতে হত,
— ‘আমাকে এভাবে কতোদিন খাঁচায় বিন্দি করে রাখবি? বনের পাখি বনে ছেড়ে দে বাবা।’
রাতে বাবা ঘুমায় না। সারারাত জেগে থাকে। শোবার ঘর থেকে রান্নাঘর হাঁটাহাটি করে। রাতের বেলা বসে বসে সিগারেট খায়। দিনের বেলা দারোয়ানকে দিয়ে সিগারেট আনিয়ে বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখেন।
মলি প্রতিদিন রান্নার আগে বাবার কাছে জানতে চায়,
— ‘বাবা আজ আপনার কি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে?’
বাবা হয়তো বলবে পাবদা মাছ অথবা মৌরলা মাছ। বাবার পছন্দের খাবার গুলো ঘরে মজুদ রাখে মলি। মলির বাচ্চা হবে মাস চারেক পর। এই শরীর নিয়ে নিজ হাতে বাবার পছন্দের খাবার রান্না করে।
কথায় কিংবা কাজে বাবা মনে কষ্ট পাক আমি মনে প্রাণে চাই না। বাবার প্রতি বিরক্ত হতে আমি কখনোই চাই না। কিন্তু আমি অনুভব করলাম ক্রমে ক্রমে আমার মনের মধ্যে বাবার প্রতি বিরক্তির জন্ম নিচ্ছে। এমন গোপন বিরক্তি যা মানুষ কথায় কিংবা কাজে প্রকাশ করে না।
পৃথিবীর সব ভালো মানুষের মনেও হয়তো এমন গোপন বিরক্তি ঘাপটি মেরে থাকে। আমি কতোটা ভালো মানুষ তা আমি জানি না, কিন্তু আমি একজন ভালো সন্তান। তারপরেও আমাকে কেন গোপন বিরক্তি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে বুঝতে পারছি না।
আমি হয়তো আর ভালো সন্তান নেই। আমিও মন্দ সন্তান হয়ে গেছি। পৃথিবীর সব ভালো মানুষ গুলোই কি আমার মতো এমন মন্দের সাথে লড়তে লড়তে হেরে যায়? আমি কি হেরে গেছি?

সেই রাতের পর থেকে আমাকে অনবরত আমার সাথে লড়ে যেতে হচ্ছে। রাতে কয়েকবার বাথরুমে যেতে হয় বাবাকে। অন্ধকারে আমাদের শোবার ঘরের দরজাকে বাথরুমের দরজা মনে করে খোলার চেষ্টা করতো। আমি উঠে দরজা খুলে বাথরুমে নিয়ে যেতাম।
সেদিনও ভুল করে আমাদের দরজার সামনে দাড়ায় কিন্তু চাপ সামলাতে পারে নি। দরজার সামনেই প্রস্রাব করে দেয়। লুঙ্গীও ভিজে যায়। বাবা সরারাত না ঘুমিয়ে বসে থাকে।
সকালে ঘুম থেকে জেগে আমি বাবার চোখে মুখে ভয় দেখতে পেলাম। ছোট বাচ্চা যখন টেবিল থেকে খাবারের প্লেট ফেলে দিয়ে ভেঙে ফেলে ভয় পায় তেমন ভয়। বাবা ভয়ে ভয়ে আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন,
— ‘চাপ সামলাতে পরি নি বাবা…’ আমি বাবার পিঠে হাত দিয়ে বলি,
— ‘কোন সমস্যা নেই বাবা, এমন হতেই পারে।’ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার চোখে জল প্রায় এসে যাচ্ছিলো।
— ‘ছোটকালে কতো কষ্ট দিয়েছি তোমাদের।’ বাবার মুখে স্বস্তির ছাপ দেখতে পেলাম। বাবার মনে কোন কষ্ট পায় নি।
সেদিন থেকেই আমি বুঝতে পারলাম মানুষ মাঝে মাঝে তার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কিছু একটা অদৃশ্য শক্তি মানুষকে ঠেলে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়। তার তীব্র ইচ্ছা গুলোকে দুর্বল করে দেয়। তখন সে ভালো চিন্তা করতে চাইলেও পারে না।
মনের মধ্যে মন্দের প্রভাব বেড়ে যায়। মন্দ শক্তিশালী হয় ভালো পরাজিত হয়। বাবার প্রতি আমার বিরক্তি যতোই মুছে ফেলি ততোই মাথা তুলে। মানুষ তার মনোভাব চেপে রাখতে পারে না। কোন না কোন ভাবে সে প্রকাশ পাবেই।

বয়স হলে মানুষ কিছু কিছু অনুভূতি হারিয়ে ফেলে। কারো অবহেলা গায়ে মাখার শক্তি থাকে না। তখন শুধু সে ভালবাসাই ভালো বোঝে অবহেলা বোঝে না। বাবার এখন সেই বয়স।
বাবা রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খায় আমি বাঁধা দেই না। সিগারেট খেয়ে শরিরের যে ক্ষতি হচ্ছে বাধা দিলে মনে যে কষ্ট পাবে তা হয়তো আরও বেশী ক্ষতি হবে। আমার বিরক্তি যদি প্রকাশ পেয়ে যায় সেও এক ভয়!
শীত চলে যাচ্ছে। পাখি গুলো চলে যাওয়ার সময় হল। বাবা এর আগেও জানতে চেয়েছেন,
— ‘আমরা কবে যাচ্ছি?’ আমি বললাম,
— ‘যাবো সময় করে, দুই দিনের জন্য।’
তারপর প্রায় এক মাস কেটে গেছে। আমি ভুলে গেছি কিন্তু বাবা অপেক্ষায় আছে গ্রামে যাওয়ার জন্য। সামনে আমার অফিসের অনেক কাজ। এক দিনের জন্যও ছুটি নেয়া সমস্যা। বাসায় ফিরতে রাত এগারোটা কখনো তারও বেশী হয়।
সেদিন বাসায় ফিরতেই বাবা সামনে এসে বললেন,
— ‘তুই কয়েক দিনের জন্য আমাকে গ্রামে রেখে আসতে পারবি?’
আমার আসলে তখন খুব ক্লান্ত লাগছিলো। মেজাজটাও ভালো ছিল না। হঠাৎ একটু উত্তেজিত হয়ে বলি,
— ‘গ্রামে গিয়ে তুমি করবেটা কি শুনি? কে আছে তোমার ওখানে?’
— ‘আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবি?’ বাবা বললেন।
— ‘কি করবে তুমি টাকা দিয়ে?’
— ‘রাত বারোটায় হাওড়া এক্সপ্রেসে ট্রেন চলে। আমি একা চলে যেতে পারবো বাবা।’
— ‘ঠিক আছে এখন ঘুমাও কাল দেখা যাবে।’
বাবা কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। সারা রাত আমার আর ঘুম হলো না। আমি জীবনে প্রথম বাবার সাথে এতোটা উত্তেজিত হলাম। ইচ্ছে হচ্ছিলো বাবার সাথে একটু কথা বলি। সেই অদৃশ্য শক্তিটা আমাকে পিছন থেকে আটকে রাখলো। আমাকে বিছানা থেকে উঠতে দিল না।
মানুষ যখন পরনির্ভরশীল হয়ে যায় তখন তার ইচ্ছে গুলো তার চার পাশে কেমন ঘুরঘুর করে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আগামী শুক্রবারে বাবাকে গ্রামে নিয়ে যাবো। দুই চার দিন থাকবো সেখানে বাবাকে নিয়ে।
পরদিন অফিসে বসের সাথে কথা বলে ছুটি নিলাম। কিন্তু আমি বাসায় এলে বাবা আর তার ইচ্ছের কথা বলে না। আমাকে দেখে ভয়ে ভয়ে দূরে সরে থাকে।
হাওড়া এক্সপ্রেসের টিকিট কাটলাম। তিন দিন পর বৃহস্পতি বার রাত বারোটায় ট্রেন। বাবাকে বললাম, কিন্তু বাবা খুব আগ্রহ দেখালো না।
মলি বাবার কাপড় ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে দুই দিন আগেই। সকালে বাবার স্নানের জল গরম করে বাবার ঘরে ঢুকে দেখে বাবা ঘুমিয়ে আছে। বাবা এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না। গায়ের কম্বলটায় অর্ধেক শরীর ঢাকা। ডান কাত হয়ে শুয়ে আছে।
মলি বাবার কাঁধে হাত দিয়ে ঘুম থেকে জাগাতে চেষ্টা করে, শরীর ভীষণ শক্ত। মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে বালিশে। খানিকটা ভিজে গেছে বালিশ। মলি আমাকে ফোন করে বাড়ি আসতে বলে। অফিস থেকে ছুটে আসি আমি। বাবার খাটের নীচে পড়ে আছে ছাইদানি তার চারপাশে কয়েকটি সিগারেটের ফিল্টার।
আমার বাবা দলছুট ঋতুবিহারী পাখি দেখতে চেয়ে ছিল তা আর দেখা হল না। নিজের সাথে দলছুট পাখির কোথাও কি মিল খুঁজে পেয়ে ছিল? হয়তো পেয়ে ছিল।
আমার ভবিষ্যত সন্তানের একটা কাল্পনিক মুখ ভেসে উঠলো চোখের সামনে। সেও কি একদিন এভাবে আমাকে কষ্ট দিবে? আমাকে অবহেলা করবে? বিরক্ত হবে? আমাকেও তার বোঝা হয়ে বেঁচে থাকতে হবে কয়েকটা দিন?
আমি নিজেকে আবিস্কার করলাম দলছুট পাখিদের দলে। মানুষের ভিড়ে আমিও নিঃসঙ্গ এক মানুষ। সম্পর্ক আর ভালোবাসার মাঝখানে যে ফাঁকা জায়গাটুকু থাকে সেখানে কিছু একটা অজ্ঞাত কারণ বসবাস করে।
তাই হয়তো সবাই একদিন দলছুট ঋতুবিহারী পাখি হয়ে নিঃসঙ্গ ঘুরে বেড়ায় উড়ে যাওয়ার আগে।

(ছবি: সৌজন্যে Oslochurch)

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন