তখন আমার ক্লাশ টেন এ  পড়বার   একেবারে প্রথম দিকের কথা । তার কয়েকদিন আগেই আমরা শেষ করেছি বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । যেটা হতো প্রতি বছর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে তিন দিন ব্যাপী আমাদের বার্ষিক পরীক্ষার পরে । আর এই অনুষ্ঠান কে কেন্দ্র করেই আমরা মেতে থাকতাম আনন্দ আর উদ্দীপনা নিয়ে । আমরা অনেকেই সেখানকার অপরিহার্য শিল্পী ছিলাম , আর সাথে থাকত একঝাক উদ্দোমী সুদর্শন তরুণেরা । সেখান থেকেই আবিস্কার করলাম কোন একজোড়া চোখ আমাকে ফলো করে , কিন্তু চোখে চোখ পড়লেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয় দ্রুত , না বোঝার ভান করে এড়িয়েই যেতাম । কিন্তু প্রথম মাতাল ঘ্রাণের শিউলি ফুলের গালিচাময় উঠোনে আমার হৃদয় হরণকারীর আগমন ঘটল কোন একদিন । রাস্তায় দাঁড়ান দেখলাম , ফিট বাবু ,নীল জিন্স ,কিন্তু কোন কথা না বলেই চলে গেল , একটু পরেই তার বন্ধুর হাত থেকে পেলাম সেই চিঠি । জিজ্ঞেস করলাম কার চিঠি , বন্ধুটি বলল আমি শুধু বাহক ।

সেই চিঠি পড়াও যথেষ্ট কষ্ট সাধ্য ছিল , কে দেখবে আর কি ভাববে, অবশেষে পড়া হলো বইয়ের পাতার মধ্যে লুকিয়ে । চিঠিতে গতানুগতিক দু লাইনের পরেই দেখলাম সুন্দর করে কবিতা লেখা । খুব ভালো লাগলো কিন্তু উত্তর লিখলাম না । পরের দিন আমাদের বাসার সামনে দিয়ে কয়েকবার সাইকেল চালিয়ে গেল আমার সাথে দেখা রাস্তার সামনে , শুধু বললো তমার সাথে একটা কথা আছে , আমি দাঁড়িয়ে আছি , কোন কথা দূরে থাক , ওর হাত পা কাপা শুরু হলো মনে হয় , বেচারা উত্তরের আসায় পায়চারি করছে আমি তো না বোঝার চেষ্টা করলাম । তারপরের দিন বাহকের মারফত আবার চিঠি পেলাম ,তার পর থেকে চিঠি গুলোই হয়ে উঠে আমার আর ওর সাথে যোগাযোগের একমাত্র বাহন। প্রতিটি চিঠির সাথেই থাকত স্বরচিত কবিতা । মজার ব্যাপার ছিল আমাদের কোনদিন সামনা সামনি কথা হতো না , তাই ব্যাপারটা কেউ বুঝতে পারে নাই । এভাবে বেশ কয়েকমাস গেল ।

ছেলেটা ছিল খুব স্মার্ট , ওর নাম অপু ,কলেজে পড়ত , ভালো ক্রিকেট খেলত, কবিতা লিখত আর ও নিজেকে মাসুদ রানার হীরো মনে করতো । অন্যদের দের চেয়ে আলাদা ছিল খুব বই পড়ত। আর বাবু সব সময় ফিটফাট ।চিঠির ভাষাও একটু ভিন্ন ধরনের , হুমায়ন আহমেদের হিমু ওই সময় অতটা আমরা জানি না , যদি ও সেই চরিত্র পড়ত তবে হলুদ পাঞ্জাবী পরে হিমু হতো সিওর ।

এভাবেই চলতে ছিল আমিও মেট্রিক পরীক্ষার জন্য চিঠির দিকে তেমন মনোনিবেশ করতাম না , এভাবে ও ধরেই নিল আমি তাকে এড়িয়ে যাচ্ছি । আমার ও কিছু কনফিউশন ছিল , বুঝতে পারতাম না ওকে , আর ভয় তো ছিল ই কে জানবে আর কি হবে ।

শক্তিদেব আর নির্মলেন্দু গুন এর ভক্ত ( আমরা ভাবতাম এসব পড়লে চরিত্র নষ্ট হয় ) সে নাকি ” সাহস থেকে প্রেম ” ঝর ঝরা মুখস্ত করত কিন্তু সামনে আসলেই ওর নাভার্স ব্রেক ডাউন হতো । কথা বন্ধ হয়ে যেত । আমি ই ওকে লিখেছিলাম আমি আর চিঠির উত্তর দিতে পারব না , প্রচন্ড কষ্ট নাকি পেয়েছিল , তার পরেও চিঠি দিত,আর এদিকে আমি ব্যস্ত হয়ে যাই পড়াশুনা নিয়ে , সামনে পরীক্ষা । রেজাল্ট খারাপ হওয়া যাবে না , পরীক্ষার পরে ওর সাথে আমার দেখা হলো আবার । এবার কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করল আমি কোথায় ভর্তি হব আরোও কয়েকটা কথা ।

আমি আসলে একধরনের অভিমান থেকে দূরে সরে গেলাম , কলেজে যাওয়া আসার পথে দেখা হতো , দুই চারটা কথা ছাড়া কোন কথাই হতো না , চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত সেদিন নিলাম যেদিন ওর চিঠিতে লিখেছে ” বৈশাখী মেঘের কাছে জল চেয়ে তুমি কাদবে আমি চাইনা ” আমি আর কোন্ দিন ওর চিঠি হাতে নেই নি । দেখেছি ,কথা বলিনি, আস্তে আস্তে আমরা দূরে সরে যেতে থাকি ।

কোন একদিন জানতে পারলাম ও জার্মান চলে যাবে, কেন যাবে আমি আর জানতেও চাই নি, এক ধরনের রাগ ছিল ওর সাথে , ওর মনে কি ছিল আমি জানিনা । অনেক বার মনে হয়েছিল জিজ্ঞেস করি কার সাথে অভিমান করে যাচ্ছে । কি যে বাধা ছিল বলাও হলো না আর জানাও হয়নি । আস্তে আস্তে আমাদের পথটি আলাদা হয়ে গেল ।

আসলে প্রথম প্রেম বলে কথা, আর কোনদিন ও হাটিনি সে পথে হোচট খাবার ভয়ে ।

তবে যেখানেই থাকুক হয়ত ভালো ই আছে । সেই গান টা মাঝে মাঝে শুনলে নস্টালজিক হয়ে যাই ” যে ছিল দৃষ্টির সীমানায় , সে হারালো কোথায় কোন দূর অজনায় ” । জীবন যেখানে যেমন আমরা চলিব সেই পথ ধরে ।

(ছবি:-সৌজন্যে The Spruce)

১ মন্তব্য

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন