আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপক বিস্তারের ফলে মানুষের সামাজিক সম্পর্কেরও ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। অনেক পুরানো স্মৃতি মনে পড়ে যখন অনেক দিন পরে কোনো স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী বা চাকুরী জীবনের প্রাক্তন কোনো সহকর্মীর সাথে যোগাযোগ হয়। ফেসবুকের কল্যানে বাংলাদেশে বা কানাডায় আমার ছাত্রজীবন বা চাকুরী জীবনের বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সাথে এখন নিয়মিত-ই  যোগাযোগ হয়। আর যোগাযোগ হলেই দীর্ঘসময় আলাপচারিতা-স্মৃতিচারণ চলতে থাকে । কয়েকদিন আগে হাইস্কুল ছাত্রজীবনের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে কথা বলেছি অনেক্ষণব্যাপী। তখন থেকেই এ বিষয়ে স্মৃতিচারণ লেখার কথা ভাবছিলাম।

 আমার ছাত্র জীবন শুরু হয় ১৯৬৫ সালে আমার পৈতৃক বাড়ি গোপালগঞ্জের চরবয়রা-ঘোনাপাড়া প্রাইমারি স্কুলে। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে আমরা বাবার চাকুরীস্থল যশোরে চলে আসি। যশোরের মডেল স্কুলে লেখাপড়ার পরে আমাদের পরিবার যশোর থেকে ঝিকরগাছা , কোটচাঁদপুর ও পরে ১৯৭০ সালে ঝিনাইদহ স্থানান্তরিত হয়। আমার বাবা পুলিশ ডিপার্টমেন্টে চাকুরী করতেন। তার একস্থান থেকে আর একস্থানে বদলি হলে আমাদের বাসাও সাথে সাথে সেখানে বদলি হয়ে যেত। যে কারণে আমার স্কুল ছাত্রজীবনে অনেক গুলি স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ হয়েছে। 

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ঝিনাইদহ থেকে বাবার বদলি হয় যশোর সদর কোতোয়ালি থানায়। এ সময় আমি যশোরের ঐতিহ্যবাহী  সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন ( হাই স্কুল ) -এ ভর্তি হই। যশোরে যাদের বাড়ি তারা সবাই এ স্কুলটি সম্পর্কে জানেন। তিন বছর পরে বাবা যশোরের শার্শা থানায় বদলি হলে আমরাও শার্শায় স্থানান্তরিত হলাম। শার্শা পাইলট হাইস্কুল থেকে  ১৯৭৬ সালে এস এস সি পাশ করার পর আমার স্কুল ছাত্রজীবনের সমাপ্তি । 

বাবার বদলিযোগ্য চাকুরীর কারণে এভাবে আমাকে অনেক স্কুলে লেখাপড়া করতে হয়েছে। তাই আমার স্কুল ছাত্র জীবনের বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা বেশি। যাদের পিতা -মাতা এ ধরণের চাকুরী করেছেন তাদের সবার অবস্থা আমার মতোই। তবে এতগুলি স্কুলে লেখাপড়া করলেও স্কুল ছাত্র জীবনে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য শার্শা পাইলট হাই স্কুল। এখান থেকেই কৈশোরের গন্ডি পেরিয়ে তারুণ্যের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় অতিক্রম করি। এ স্কুল থেকেই আমি এস এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। এ স্কুলে লেখা পড়ার সময়ের অনেক স্মৃতি মনে পড়ে। স্কুল ছাত্রজীবনের শেষ পর্যায়ের বন্ধুবান্ধবের অনেকের সাথেই এখনও সাথে  সম্পর্ক রয়েছে। শার্শা স্কুলে লেখাপড়ার সময়ের কিছু স্মৃতি  নিয়েই আজকের কথা ।

১৯৭৪ সালে আমি শার্শা পাইলট হাই স্কুলে আমি ক্লাস নাইন-এ ভর্তি হই। যশোর জেলা সদরের একটি ঐতিহ্যবাহী স্কুল থেকে থানা লেভেলের একটি স্কুলে এসে প্রথম দিনেই আমার খুব খারাপ লাগছিল। সম্মেলন স্কুলের বিশাল ভবন শত শত ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের জমজমাট পরিবেশ ছেড়ে প্রায় গ্রামের মতো শার্শা স্কুলের টিনশেড স্কুল ভবনের স্বল্প সংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের সাথে লেখা পড়া করতে হবে বলে মনটা বিদ্রোহ করে উঠলো। কিন্তু উপায় কি ! বাবা তো চাহিবামাত্র আবার যশোর বদলি হয়ে যেতে পারবেন না !! 

 তবে প্রথম ক্লাশেই স্যারের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলাম। কারণ স্যারের প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দিতে পারছিলাম। প্রথম ক্লাস ছিল মান্নান স্যারের ইংরেজি ক্লাস। মফস্বল স্কুলের শিক্ষক হলেও মান্নান স্যারের ইংরেজি খারাপ ছিল না। আমার জবাবের প্রতিক্রিয়ায় স্যার সুন্দর করে ‘থ্যাংক ইউ’ বলছিলেন। পরবর্তী ক্লাস ছিল নাজিম স্যারের বাংলা গ্রামার ক্লাস। তার ক্লাসে আমার নুতন অভিজ্ঞতা ! বাংলা ‘বাগধারা’ ও ‘এককথায় প্রকাশ ‘ বিষয়ের ক্লাসে তিনি ছাত্রদের যে সব প্রশ্ন করছিলেন কেউ কেউ সেগুলির জবাব সঠিক জবাবদিতে পারছিলনা। এ জন্য তিনি তাদের যেভাবে প্রায় সর্বশক্তি দিয়ে বেত্রাঘাত করছিলেন সেটা দেখে আমি তো ভয়ে অর্ধোমৃত ! এভাবে যে কেউ মারতে পারে সেটা আগে আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে ছাত্রদের দেখলাম নির্বিকার ভাবেই সেটা সহ্য করে নিল। স্কুল শেষে বাসায় এসে আমি মা-কে বললাম যে আমি এই স্কুলে পড়বো না। মাকে স্কুলের ছাত্রদের পেটানোর ঘটনার বর্ণনা করলাম। বাবা রাতে বাসায় এলে মা তাকে বললেন  যে আমার ছেলে কে যেন মাষ্টাররা এ ভাবে না মারেন সেটা যে তিনি স্কুলে বলে রাখেন। বাবা অবশ্য বললেন লেখাপড়া ঠিকমত করলে মাস্টাররা মারবে কেন । 

প্রথম দিন স্কুলে গিয়েছিলাম কালো  প্যান্ট  ও কমলা রঙের হাফশার্ট পরে। মনে পড়ে শার্টের পকেটের ওপর ইংরেজি  স্টিকার লাগানো  ছিল। চামড়ার সেন্ডেল ছিল পায়ে। আমি লক্ষ্য করলাম  আমার ক্লাসের ছাত্রদের তুলনায় আমি কমবয়সী। ক্লাশের অনেকেই লুঙ্গি পরে এসেছিল। পায়ে রূপসা সেন্ডেল। আর  মেয়েৱা সালোয়ার কামিজ বা দু’একজন শাড়ি পরিহিত ছিল। পরে অবশ্য জেনেছি যে তাদের কেউ কেউ ৫/৬ মাইল দূর থেকে গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হেটে আসতো। রাস্তা কাঁচা ছিল বলে বৃষ্টির দিনে চপ্পলের কাদা পিঠ অবধি উঠে আসতো । এদের সাথেই শার্শা পাইলট হাইস্কুলে আমার লেখাপড়া শুরু হল।  

ছোট বেলা থেকে আমি ছাত্র হিসাবে খারাপ ছিলাম না। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের এ ভাবে পেটানোর দৃশ্য দেখে ভয়ে এবং নিয়মিত লেখা পড়ার কারণে আমার প্রথম অর্ধববার্ষিকী পরীক্ষায় যে ফলাফল হল সেটা দেখে আমার শিক্ষক ও সহপাঠীরা বেশ অবাক হয়ে গেছিল।  সবাইকে টপকে আমি ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছিলাম ! ক্লাসে যে বন্ধুরা বরাবর  ফার্স্ট ও সেকেন্ড হত তারা এতে অবাক হয়ে গেল এবং কিছুটা হিংসা করা শুরু করল। কেউ কেউ তো বলেই ফেললো , দারোগার ছেলে বলে নাকি আমাকে ফার্স্ট করা হয়েছে !!

এ ভাবে ক্লাস নাইন থেকে ফার্স্ট হয়ে ক্লাস টেন-এ উত্তীর্ন হই। ততদিনে আমার স্কুলে মার খাওয়ার ভয় অনেকটা কমে গেছে এবং ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের সাথেও সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সবাই এখন বন্ধু-বান্ধবী। শার্শা থেকে ৬/৭ মাইল পায়ে হেটে কন্নাদাহ গ্রামে বন্ধু রাজ্জাকের বাড়িতে গেছি দাওয়াত খেতে। কাগজপুকুর গ্রামে ওহাব ,পান্তাপাড়ার বদর,মোর্শেদ ,সামলাগাছির ফজলু ,ইয়াকুব  ও লিয়াকাতদের বাড়িতেও বেড়াতে গেছি  ও রাত্রিযাপন করেছি। এ ছাড়া শার্শা দফাদার পাড়ার মেঘনা,শেলী ও আলেয়া আপাদের বাড়িতে গিয়েছি বহুবার। অনেক অনেক মধুর স্মৃতি বিজড়িত সেসব দিন-রাত্রি। সেসব কথা বলতে গেলে অনেক সময় বা ধৈর্য্যের প্রয়োজন। তবে শুধুমাত্র দুএকটা বিষয় দু’একটা বিষয় উল্লেখ করছি।

ছোট বেলা থেকে আমি নিতান্তই শান্ত শিষ্ট ভালো ছেলে ছিলাম না। বাসা বা বাড়িতে মামাতো-ফুপাতো ভাইবোনদের সাথে বা স্কুলে বন্ধুবান্ধবদের সাথে অনেক দুষ্টামি করেছি। অন্যদেরকে সেটা করতে উদবুদ্ধ করেছি। একটা ঘটনা উল্লেখ করছি। তখন বছরের মাঝামাঝি সময়। টিফিন পিরিয়ডে ক্লাশে দুষ্টামি চলছে। কোন স্যার কি স্টাইলে পড়ান শিক্ষকের চেয়ারে বসে আমি তা অভিনয় করে সবাইকে দেখাচ্ছি। অন্যরাও শিক্ষকদের পড়ানো বা হাঁটাচলার নকল করে হাসি-ঠাট্টায় মত্ত। কখন যে টিফিন শেষের ঘণ্টা বেজেছে খেয়াল করিনি। এমন সময় দেখি দরজায় রেজাউল স্যার দাঁড়ানো। স্যার আমার দুয়েকটা বাক্য শুনেছেন। এমন বিব্রতকর অভিজ্ঞতা জীবনে কমই হয়েছে। স্যার ক্লাশে ঢুকে সরাসরি মারপিট না করলেও ৮/১০ মিনিট আমাকে ঝাড়লেন !

ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রেম-প্রীতি বা রোমান্সের আনাগোনা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে । বন্ধুদের সাথে আমিও তার যথাযথ ইন্ধনদাতা! আমাদের বাসা স্কুলের থেকে মারতো দুশো গজের মধ্যে। নিজেদের সোজা রাস্তা বাদ দিয়ে ঘোরাপথে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছি। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হাঁটব বলে। একদিন পরীক্ষাশেষে হৈ হৈ করে বের হয়েছি। পোতাপাড়াগামী নজরুল ছিল এক বান্ধবীর প্রতি খুবই দুর্বল।মূল সড়কে ওঠার আগেই নজরুল বন্ধুদের বলল সবাই আস্তে হাট ,মেয়েরা আসুক। ওদের পেছন পেছন যাব। পিছন থেকে সাইকেলে চেপে আসতে সময় ইংরেজি গ্রামার শিক্ষক নূর ইসলাম স্যার তার কথা শুনে ফেললেন। বললেন ,‘তাই নাকি? আচ্ছা আগামীকাল মজা বোঝাব’ ! পরদিন পরীক্ষার হলে নূর  ইসলাম স্যার  কাছে এসে তার পিঠে ধুম করে এক কিল দেন !!

এ রকম আরো যে কত ঘটনা আছে ! একবার একটি ঘটনা পুরো স্কুল ব্যাপী তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। স্কুলে ছাত্রীদের জন্য একটি কক্ষ ছিল যেখানে তারা টিফিন পিরিয়ড বা ক্লাস না থাকলে বসে সময় কাটাতো। সেখানে একটি মাটির কলসীতে তাদের জন্য খাবার পানি রাখা থাকতো। একদিন সকালে একছাত্রী পানি খাবার জন্য কলস থেকে পানি ঢালতে গেলে পানির সাথে পায়খানার গন্ধ পেল। পায়খানার একটি টুকরাও পানির সাথে গ্লাসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সে লাফ দিয়ে দূরে সরে যেয়ে জোরে জোরে চিৎকার শুরু করল। তার চিৎকার শুনে হেডস্যারসহ আরো অনেকে ছুটে আসলো। ঘটনা দেখে হেডস্যার সাংঘাতিক ক্ষেপে গেলেন। সেদিনটা খুব খারাপ গেছিল আমাদের। সারা স্কুলে বিরাজ করছিল থমথমে পরিবেশ। সকল ক্লাসে হেডস্যার ইস্যুকৃত নোটিশ পড়ে শোনানো হল এবং এই ঘটনার জন্য তীব্র নিন্দা জানানো হল। তবে কে বা কারা এটা করেছিল সেটা জানা যায়নি।

এভাবে বিভিন্ন হাস্য কৌতুক বা ঘটনাবলীর মধ্যেদিয়ে শার্শা পাইলট স্কুলের লেখাপড়া শেষ করে এস এস সি পরীক্ষার সময় এসে গেল। ক্লাস টেন-এ  ছাত্র সংখ্যা ছিল ২৩/২৪ ( সঠিক সংখ্যা মনে নাই) । টেস্ট পরীক্ষায় মাত্র ১৮ জন উত্তীর্ণ হয়েছিল। আমাদের হেডস্যার খুব কড়া ছিলেন। তাই তিনি ঐ ১৮ জন এর সাথে বিশেষ বিবেচনায় আর মাত্র ২ জনকে এস এস সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছিলেন। আমরা শার্শা স্কুল থেকে মাত্র ২০ জন ছাত্রছাত্রী এস এস সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। সে বছর ( ১৯৭৬ ) এস এস সি পরীক্ষার পাশের হার ছিল খুবই কম। যশোর বোর্ডে মাত্র ৪৩ % । আমি একাই সেবছর প্রথম বিভাগে উত্তীর্ন হয়েছিলাম। সবাই পাশ করেছিল বলে হেডস্যারের কি আনন্দ ! আমাকে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন ,তুই আমার স্কুলের মানসম্মান রেখেছিস। তুই লেখাপড়ায় আরো ভালো করিস আল্লাহের কাছে এই দোআ করি। বাবার সাথে দেখা হলেও তিনি তার কাছে আমার ভূয়সী প্রশংসা করেন।

স্কুলের লেখাপড়া শেষ করার কয়েকদিনের মধ্যে বাবা শার্শা থেকে কুষ্টিয়ার দর্শনায় বদলি হলেন।সাথে সাথে আমাদের শার্শা বাসা দর্শনায় স্থানান্তরিত হল। তবে আমি যশোরের সরকারি মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ে এইস এস সি তে ভর্তি হয়ে আমার কলেজ ছাত্র জীবনের শুরু করেছিলাম। কলেজ ছাত্রজীবনের স্মৃতি নিয়ে লেখার প্রত্যাশা ব্যাক্ত করে আজকের লেখা শেষ করছি।

 

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন