-মোঃ মনিরুজ্জামান

মানুষের জীবনের অতীত কর্মকান্ডই পরবর্তীকালে স্মৃতি হিসাবে বিরাজ করে । অতীত স্মৃতি আনন্দ বেদনা উভয় প্রকারই হতে পারে। অনেক সময় মানুষ তার অতীত স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, বর্তমানের সাথে তুলনা করে শান্তনা পেতে চায়। বর্তমান কাজ কর্ম জীবনযাত্রা নির্বাহকালে অনেক সময় চট করে অতীত কোন স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে উঠে। আর তখনই বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। ক্ষনিকের জন্য মানুষ হয়ে পড়ে আনমনা।

এমনই এক ঘটনাপ্রবাহে গতকাল আমার অতীত কর্মকান্ডের কিছু ঘটনাবলী মনে পরে যায়। তবে ঘটে  যাওয়া ঘটনার বর্ণনায় না যেয়ে আমার কর্মজীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময়ের  অতীত স্মৃতি চারণ করতে চাই।

যে সময়ের কথা উল্লেখ করতে চাই সেটা ১৯৯২ সালের মে মাস থেকে ১৯৯৫ সালের শেষ সময় পর্যন্ত। সাড়ে তিনটি বছর আমি বাংলাদেশে সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলাম। আমার চাকুরীকালীন প্রায় বিশ বছর সময়ের মধ্যে এটি একটি স্মরণীয় অধ্যায়। সময় অর্জন করেছি বিভিন্ন অভিজ্ঞতা। ১৯৯২ এর মে মাসে আমি তখন আমার প্রিয় তথ্য অধিদফতরে ( পি আই ডি )’ সংবাদকক্ষে রাতের শিফটে কাজ করি। শবে মাত্র খুলনা আঞ্চলিক অফিস থেকে ঢাকায় বদলি হয়ে এসেছি। ঢাকায় আসলে প্রথমেই পি আই ডিতে সবাইকে সংবাদ কক্ষে কাজ শুরু করতে হয় সংবাদ লেখন,অনুবাদ সম্পাদনার কাজ শেখার জন্য। এ সময়ে একদিন কৃষি মন্ত্রণালয়ে তথ্য কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত আমার ব্যাচমেট ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ( নাম উল্লেখ করতে চাই না) আমাকে জিজ্ঞাসা করল কৃষি মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে রাজি আছি কিনা। আমি রাজি থাকলে নিয়োগের জন্য আমার নামও সে প্রস্তাব করবে বলে আমাকে জানাবে। সে কৃষি মন্ত্রণালয়ে আর কাজ করতে চায় না ,কারণ তার নিজের ( উল্লেখ্য ,আমার ঐ  ব্যাচমেট বন্ধু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একজন সুলেখক ও গবেষক) লেখা ও গবেষণার কাজে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারছে না। প্রস্তাবটি আমার কাছে যেমন অপ্রত্যাশিত ও আকর্ষণীয় তেমনি চ্যালেঞ্জিং ছিল।

আকর্ষণীয় এবং  চ্যালেঞ্জিং কেন সেটার একটু ব্যাখ্যা না দিলেই নয়। উল্লেখ্য , বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় একটি বড় মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১২/১৩ টি পরিদফতর/অধিদফতর ,বেশ কয়েকটি কৃষি বিষয়ক গবেষণা সংস্থা এবং অনেকগুলি দেশি-বিদেশী সরকারি/বেসরকারি কৃষি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান। এ মন্ত্রণালয়ের গবেষণা সংস্থায় ঐ সময় ৪৫০ জন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী কর্মকর্তা ছিল।  এ মন্ত্রণালয়ে ঐ সময় মন্ত্রী ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় মেজর জেনারেল (অবঃ) মজিদ-উল হক (প্রাক মুক্তি যুদ্ধ কালীন  পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু)। তিনি তৎকালীন বি এন পি সরকারের মন্ত্রিসভার একজন সিনিয়র ও প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন। তিনি একই সাথে কৃষি, সেচ ,পানি উন্নয়ন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী  এবং প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মও দেখাশুনা করতেন। এখানে মন্ত্রী মহোদয়ের ব্যাক্তিত্ব ও চরিত্র সম্মন্ধে সামান্য আলোকপাত করছি। তিনি সামরিক বাহিনীর একজন সাবেক কর্মকর্তা হলেও আচার আচরণে একজন নিপাট ভদ্রলোক ছিলেন। প্রায় সত্তরের কাছাকাছি বয়স হলেও তাঁর স্মৃতি শক্তি ছিল প্রখর। তাঁর দৃষ্টির সামনে অনেকেই দেখেছি একদম ঠান্ডা হয়ে যেতেন। আমার মনে হয়েছিল, তিনি একনজর দেখলে সঙ্গে সঙ্গে একজন মানুষের ভিতর বাহির সবকিছু দেখতে পারতেন। তাই তাঁর সাথে মিথ্যা কিছু বললে তিনি সেটা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারতেন।

এরকম একজন হেভিওয়েট বা প্রভাবশালী মন্ত্রীর তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতে আমাদের সিনিয়র জুনিয়র অনেকেই আগ্রহী ছিল। তিনি সরকারের তিনটি মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্বে ছিলেন বলে প্রতি মন্ত্রণালয়ে একজন করে মোট তিনজন তথ্য কর্মকর্তা তার প্রাপ্য থাকলেও ঐ তার  তথ্য কর্মকর্তা ছিলেন একজন। এই তিন মন্ত্রণালয়ের কাজই আমার ঐ ব্যাচমেট বন্ধু একা করতেন বলে মন্ত্রী তাকে অনেক ভালোবাসতেন। কাজেই যখন এই প্রস্তাব আসে তখন এটা আমার কাছে অত্যান্ত আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল। এছাড়া ইতোপূর্বে কোনো মন্ত্রণালয়ের তথ্য বা জনসংযোগ কর্মকর্তার কাজ করার কোন অভিজ্ঞতাই আমার নাই। তাই এটা ছিল আমার জন্য অবশ্যই একটি চ্যালেঞ্জিং জব। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমি সফলতাও লাভ করেছিলাম। সেটা আমি ঐ মন্ত্রণালয়ের কাজ শেষে বিভিন্ন মাধ্যমে উপলদ্ধি করেছি।

কৃষি মন্ত্রণালয়ে কাজ করার প্রস্তাবে রাজি হওয়ার পর সেখানে নিয়োগ প্রাপ্তির ঘটনাবলী ছিল আরো কঠিন বা চ্যালেঞ্জিং। এবার সে প্রসঙ্গে আসছি। আমার ব্যাচমেট ঐ বন্ধু অনেক কষ্টে মন্ত্রী মহোদয়কে তার অব্যাহতির প্রস্তাবে রাজি করাতে সক্ষম হয় একটি কঠিন শর্তে। সেটি হল ,মন্ত্রী মহোদয় বললেন “যে তোমার  স্থলাভিষিক্ত হবে সে যেন তোমার মত হয়” ,তা না হলে আবার তাকে পরিবর্তন করে দিতে হবে। মন্ত্রী মহোদয় তাকে অনেক ভালোবাসতেন ও স্নেহ করতেন। তার কাজ কর্মে মন্ত্রী মহোদয়ের অগাধ আস্থা ছিল। ঠিক সেরকম আস্থাভাজন আরেকজনই তিনি চাচ্ছিলেন। তাই মন্ত্রী মহেদেয়ের ইচ্ছা ও আমাদের দফতর প্রধানের প্রস্তাব অনুসারে তার সাথে পি আই ডি’তে কর্মরত তথ্য কর্মকর্তাদের কয়েকজনের প্রাথমিক সাক্ষাতকারের আয়োজন করা হয়। মন্ত্রী মহোদয়  ৪/৫ জন কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেন। এদের মধ্যে আমিও ছিলাম। মন্ত্রী মহোদয় তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে বেশ কিছুক্ষন আমাকে দেখলেন এবং অল্প কিছু প্রশ্ন করলেন। প্রশ্ন গুলি ছিল আমার পেশাগত ও ব্যাক্তিগত।

সাক্ষাৎকার নেবার পর বেশ কিছুদিন চুপচাপ। এখানে উল্লেখ্য ,এসময়ে মন্ত্রী মহোদয়ের একান্ত সচিব ছিলেন একজন সুন্দরী মহিলা। তিনি ১৯৮৩ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। মন্ত্রী মহোদয় তার একান্ত সচিব ও তথ্য কর্মকর্তার সাথে পরামর্শ করে একদিন আমাকে আবার কৃষি মন্ত্রণালয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে আমার দফতর প্রধানের কাছে ফোন করলেন। দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার মানে তিনি আমাকে মনোনীত করবেন বলে আমার বন্ধু জানালেন। তাই অনেক শংকা ও কিছুটা আশা নিয়ে একদিন বিকালে তার একান্ত সচিব আপার কাছে গেলাম। তিনি আমাকে দেখে লোকজনের মাঝেই অনেকটা হৈ হৈ করে উঠলেন এবং বললেন ,তুমি মন্ত্রী মহোদয়ের পছন্দের তালিকায় প্রথম। তিনি ও আমার ব্যাচ মেট বন্ধু অর্থাৎ মন্ত্রী মহোদয়ের তথ্য কর্মকর্তা আমাকে কিছুক্ষন পরে মন্ত্রী মহোদয়ের কক্ষে নিয়ে গেলেন। মন্ত্রী মহোদয় আমাকে আবার একনজর দেখলেন এবং বললেন, ‘আমি পি আই ও ( পি আই ও-প্রধান তথ্য অফিসার যিনি আমাদের দফতর প্রধান) কে বলে দিয়েছি ,তুমি ২/১ দিনের মধ্যে এখানে জয়েন কর।’ মন্ত্রী মহোদয়ের স্পষ্ট ও সরাসরি কথায় আমি চমকিত হয়েছিলাম। সেসাথে আমার যেন শরীরে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। প্রবল উত্তেজনা ও কৌতূহল নিয়ে পি আই ডি’তে আসলে বন্ধুবান্ধব অনেকেই জিজ্ঞাসা করল কি খবর। আমি তাদের জানালাম এবং পি আই ও মহোদয়ের সাথে দেখা করে তাকেও জানালাম। তিনি বললেন ,তুমি কালই যোগদান করতে পারো ,আমি তোমাকে রিলিজ করে দিতে বলে দিচ্ছি। এভাবেই ১৯৯২ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে কৃষি মন্ত্রণালয়ে আমার কাজ কর্ম শুরু হয়েছিল ( সঠিক দিন তারিখ মনে নাই ) ।

কৃষি মন্ত্রণালয়ে আমার নিয়োগপ্রাপ্তির পরবর্তী  সাড়ে তিন বছর আমার কর্মজীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় । এ সময়ের মধ্যে আমার কর্মজীবন ও ব্যাক্তিগত বা পারিবারিক জীবনেও অনেক ঘটনাবলী ঘটেছিল। এ সব ঘটনাবলীর  কিছু কিছু আমি ইতোপূর্বে কয়েকটি লেখাতে বর্ণনা করেছি। পরবর্তীতে বাকি বিষয়ের উপর লেখার ইচ্ছা রেখে আপাতত শেষ করছি।

.

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন