চিন্তাশক্তি এবং প্রগাঢ় মনোবল আপনাকে নিয়ে যেতে পারে অনেক দূর !

এ মাসটি আমাদের মিনিস্ট্রিতে বাৎসরিক রিপোর্ট পাঠানোর মাস, তাই বেশ বেস্ততায় কাটছে দিনগুলি। তথাপি এ সময়ের শ্রেষ্ট বিজ্ঞানী এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার জীবনে অনুপ্রেরণাদানকারীদের মধ্যে একজন, মিঃ স্টিফেন হকিং তার মর্তুকালে আমার কিছুটা সময় অবস্যই ডিজার্ভ করেন। অস্ট্রোফিজিক্স এবং নিউরোলজি এই দুইটি বিষয় বরাবরই আমার প্রিয় বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম ছিলো, যদিও আমি জীবনে কোনোটাই পেশা হিসেবে নেই নি বা নিতে পারি নি। মিঃ স্টিফেন হকিং সম্মন্ধে আমি দেশে থাকতে খুব অল্প অল্প জানতাম। কিন্তু ৯০ এর দশকের ফিনল্যান্ডে পড়াশুনা অবস্থায় একবার ছুটি কাটাতে ইংল্যান্ডে যাই। সে সময়ে অনেকদিনের কাঙ্খিত ম্যাডাম তুসোর জাদুঘরে যাই। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই তৎকালীন লিভিং লিজেন্ড মিঃ স্টিফেন হকিং এর প্রতিকৃতি।

তার হুইলচেয়ারে বসা ওই শারীরিক অবস্থা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম, এবং মনে মনে বললাম, ” এ কি করে একজন বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী হলো “. যাহোক ফিনল্যান্ডে ফিরে গিয়ে শুরু করলাম তাকে নিয়ে জানাশুনা। পড়লাম তার অতি জনপ্রিয় বই ” A Brief History of Time”. হয়ে গেলাম তার ফ্যান। বলা হয় আইনস্টাইন এর পর উনিই প্রথম ওই মাত্রার পদার্থবিদ।

যাহোক আমার আশ্চযের্র বা অনুপ্রেরণার বিষয় যেটি, তা হলো। তার ওই শরীর নিয়ে উনি কিভাবে এতো দূর আগালেন। উনার ২১ বছর বয়সে যখন Lou Gehrig’s diseaseটি হয় তখন বলা হয়েছিল যে উনি উনার ২৫তম জন্মদিন দেখতে পারবেন কি না সন্দেহ। কিন্তু সমস্ত জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এই বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী বেঁচে গেলেন ৭৬ বছর এবং দাপটের সাথে। এবং উন্মোচন করে গেলেন বিশ্বভ্রমান্ডের অবাক করার মতো অজানা সব দিক।

হাত-পা বা মাথা ঘাড় ইত্যাদি নড়াচড়ার মতো অবস্থাতো ছিল না তার, তারপর কথাও বলতে পারতেন না তিনি। পরবর্তীতে তার এক ছাত্রের আবিষ্কৃত মেশিন দিয়ে তার চিন্তা এবং মনের ভাবকে কথায় পরিনিত করার মাধ্যমে গবেষণা থেকে শুরু করে বক্ত্রিতা পর্যন্ত চালিয়ে গেছেন। তার শরীরের অনেক জিনিস অকেজো হলেও তার চিন্তা শিক্তি এবং মনোবল ছিল অটুট, তার প্রমান আমরা তার সৃষ্ট অভূতপূর্ব জিনিসগুলির মধ্যে দেখতে পাই। আমি এই জিনিসটি চিন্তা করে অনেক অনুপ্রাণিত বোধ করি, কারণ আমাদের জীবনে কোনো অঙ্গহানি তো দূরের কথা, কোনো রকম একটা বিপদ বা স্ট্রাগগল হলেই বিচলিত হয়ে যাই, কি করবো ভেবে পাই না এবং অনেক সময় give up করে দিতে চাই। আমরা আমাদের বাহ্যিক দিকটাতে ক্ষত হলে সেটার প্রভাব মন এবং চিন্তাশক্তির উপর ফেলে নিজেকে নাজেহাল করে ফেলি। এই বেক্তি সেটা করেন নি, তার চিন্তা শক্তি যেহেতু অক্ষত ছিল তাই তিনি সেটাকে কাজে লাগিয়ে সবাইকে তাকে লাগিয়ে একর পর এক জটিল গবেষণার কাজ করতে থাকেন।

আমি তখন বিদেশে পড়ি, সীমিত আয়এ চলতে হয়ে; তারপর পড়াশুনা শেষে কানাডা এসে চাকরি পেতে হিমশিম খেতে হয়, ইত্যাদি বিষয়ের কারণে বেশ টার্ম-অয়েলের মধ্যে ছিলাম। তাই সেই ম্যাডাম তুসোর জাদুঘর থেকে আনা তার ছবিটি আমার পড়াশুনার ডেস্কের এক কোণায় রেখে দিয়েছিলাম নিজেকে আশাবাদী আর মোটিভেট করার জন্য। যখন মনে হতো life leaves me hanging অথবা কোনো কিছুতে কিছু হসছে না, তখন ওর দিকে তাকাতাম আর কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেতাম এই ভেবে যে, হাত পা, নাকমুখ সব কিছু তো আছে, আর তাছাড়া চিন্তা করা বা স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা তো হারিয়ে যাই নি অতএব শেষ চেষ্টা না করা পর্যন্ত হাল ছাড়াছাড়ি নেই। যাহোক আল্লাহর রহমতে আমার সেই অবস্থা এক সময় কেটে গেলো। চিন্তা শক্তি দিয়ে উনি কত দূরে পৌঁছে গেছেন। উনার ” A Brief History of Time” বইটি পড়তে পড়তে অনেক সময় স্ট্রিট-কার বা সাবওয়ের স্টেশন মিস করেছি, উনি উনার লেখার মাধ্যমে আমাকেও নিয়ে গেছেন সেই Black-Hole এর সুপার ম্যাগনেটিক ফিল্ডে, যেখান থেকে আলো পর্যন্ত বের হতে পারে না।

চিন্তা এবং মনের শক্তি দিয়ে অনেক সময় শারীরিক ব্যথাও দূর করা যায়। আমি একবার আমার এক বড় ধরণের সার্জারির সময় বেশ কয়দিন হাসপাতালে ছিলাম। তখন আমার অপারেশনের জায়গায় বেশ বেথা অনুভূত হতো যদিও আমি অনবরত পেইনকিলারের উপর ছিলাম। সেই সময় কিছু বই এবং সেগুলির বিষয়বস্তু আমাকে বেশ স্বস্তি দিতো। আমার কাছে কোরান, বাইবেল থেকে শুরু করে ডিকেন্স, হুমায়ুন সবার বই ছিল, যখন যেটা ভালো লাগতো। আমার মনে আছে, আমার প্রচন্ড বেথার দিনে আমি পড়ছিলাম সুনীল গঙ্গোপধ্যায়ের “পূর্ব পশ্চিম” এর শেষ পর্ব , এবং আমি ঠিক বইটির গল্পের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার জায়গাটাতে ছিলাম এবং পড়ছিলাম কলকাতাস্থ অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার, শিল্পী, কলাকুশলী, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যক্রম। মনে হসছিলো আমি সেই সময়ে চলে গেছি। আমি যদিও তখন ৩২টি সেলাই নিয়ে বেশ বেথায় আক্রান্ত তবুও কিছুটা ভালো লাগছিলো। যাহোক চিন্তা এবং মনের শক্তি দিয়ে অনেক কিছুই করা যায়।

আমাদের চিন্তা এবং মনের শক্তি দিয়ে হয়তো আর একজন স্টিফেন হকিংস কখনো হতে পারবো না কিন্তু, আমি নিশ্চিত আপনি যদি আপনার মন এবং চিন্তা শক্তিকে প্রফুল্ল রাখেন তাহলে আপনি অন্তত আপনার ক্যাপাসিটির শিখরে পৌঁছাতে পারবেন ইনশাল্লাহ ! আর সেটাইতো দরকার। আপনি কতটা সফল হলেন বা আপনি কতটা উপরে উঠলেন, আমাকে ঠিক সেখানে যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমাকে শুধু আমার বেস্টটা দিতে হবে এবং আমার নিজের ক্যাপাসিটির সর্বোচ্চ শিখরে উঠতে হবে। আর সেটি একমাত্র করতে পারে আপনার একটি খোলা এবং প্রফুল্লচিত্ত মন। আসুন আমরা মিঃ হকিংএর অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের যা চলে গেছে, বা অকেজো হয়ে গেছে তার পিছনে সময় নষ্ট না করে, যা আছে বা যত টুকু আছে তাই দিয়েই এগিয়ে যাই সামনের দিকে। সফলতা আসবেই ইন্শাল্লাহ।
“Problem talk creates problems, solution talk creates solutions.”– Insoo Kim Berg & Steve de Shazer

অবশেষে প্রয়াত মিঃ হকিংসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এবং তার বিদেহী আত্মার প্রতি শান্তি কামনা করে শেষ করছি।

বিঃ মুকুল
টরন্টো

১ মন্তব্য

  1. Look up at the stars and not down at your feet. Try to make sense of what you see, and wonder about what makes the universe exist. Be curious. – Stephen Hawking

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন