বিস্ময় আর রহস্যের এক আধার মানব মস্তিস্ক। ১.৩ কিলোগ্রাম ওজন বিশিষ্ট  এই বস্তুটি মানুষের, চিন্তা -ভাবনা,  আবেগ-অনুভূতি ও কার্যক্রমের অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিস্ক অবশ্য একা  কাজ করে না।  মন, শরীর ও  মস্তিস্ক একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। কিভাবে ?  একটি উদাহরণ দিলে হয়তো বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ধরা যাক টরোন্টোতে আমাদের সবার প্রিয় একজন মানুষ হুমায়ুন ভাই তার ঘরের মধ্যে হাঁটছেন। হুমায়ুন ভাই, আমি জানি আপনি ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটির চাইতে আপনার পংখীরাজ গাড়ী নিয়ে ঘোরাঘুরি করতেই বেশি পছন্দ করেন, তবু উদাহরণের জন্য আপনাকেই টেনে নিয়ে আসলাম। হাটতে যেয়ে অসাবধানতবশতঃ হঠাৎ হুমায়ুন ভাইয়ের  হাতের কনুই লেগে গেলো একটি টেবিলের কোণায়। মস্তিস্ক সাথে সাথে কনুই এর কাছে সংবাদ পাঠাবে ব্যথা অথবা সম্ভাব্য আঘাতের। শরীর (এক্ষেত্রে কনুই) সেই ব্যাথাটি অনুভব করবে। হুমায়ুন ভাইয়ের মন তখন আবেগে প্লাবিত হতে পারে।  ব্যথায় চরম বিরক্ত হয়ে হয়তো তখন তিনি বলে উঠবেন, “আঘাত পাবার আর জায়গা পেলাম না”। পুরো বিষয়টি ঘটে কয়েক সেকেন্ডে এবং “মস্তিস্ক – শরীর -মন” এর মধ্যে এক ধরণের  আন্তঃ সংযোগের মাধ্যমে।  অভিজ্ঞ, সফল কাউন্সেলররা  (Counsellor) এই তিনটি বিষয়ের পারস্পরিক সংযোগকে গুরুত্ব দিয়ে, বিবেচনায় রেখে তাদের কাউন্সেলিং কার্যক্রম পরিচালনা করেন। Trauma  Counselling এ এই মস্তিস্ক- শরীর ও মনের সম্পর্কের বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্ব বহন করে।  এসব গুরুত্বের কারণেই হয়তো বিস্তর গবেষণা চলছে এখন “Human Brain” নিয়ে। এখন পর্যন্ত  নিউরো সাইন্সটিস্টরা মানব মস্তিষ্কের  পুরো ক্ষমতা ও এর জটিল কার্যক্রমের পূর্ণাঙ্গ  রূপ আবিষ্কার ও বিশ্লেষণ করতে পারেননি। তারা বের করতে পারছেন না কিভাবে বালুর দানার আকার বিশিষ্ট  brain tissue এর একটি অংশে ১০০০০০০ নিউরোন থাকে এবং তারা প্রত্যেকে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে। কেন এবং কিভাবে এতো ক্ষমতাসম্পন্ন এই অঙ্গের প্রায় ৭৩% ই পানি। কম্পিউটার  বিজ্ঞানীরাও এখন মস্তিষ্কের সাথে সুপার কম্পিউটারের তুলনা করছেন। তুলনা  করছেন গতি ও কার্যক্রমের। গবেষণায় দেখা গেছে মানুষের মস্তিস্ক  ‘IBM’ এর  অত্যাধুনিক সুপার কম্পিউটার এর তুলনায় ত্রিশগুন বেশি গতিসম্পন্ন। একসময় হয়তো Brain রিসার্চ এ যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। বিজ্ঞানীরা মানব দেহের এই জটিল যন্ত্রের আরো রহস্য উন্মোচনে সক্ষম হবেন।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজের সুবাদে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন আচরণ খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ আমাদের হয়। অবাক হয়ে দেখি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষের বিভিন্ন রকমের প্রতিক্রিয়া। কারো মধ্যে দেখি সবকিছুতেই প্রতিহত (Fight) করার প্রবণতা, কেউ কেউ সমস্যা দেখলেই বেছে নেন পলায়ন করার (Flight)  মনোবৃত্তি আবার কেউ দেখি সামান্যতেই  জমে (Freeze) যান বা ব্ল্যাক আউট হয়ে যাওয়ার মতোই কি প্রতিক্রিয়া দেখাবেন, বুঝতে পারেন না।  এই প্রতিক্রিয়াগুলো কেন ঘটে এবং কিভাবে ঘটে তার কিছুটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় মনস্তত্ত্ববিদ Bessel Van der Kolk এর ২০১৪ সালে প্রকাশিত “The body keeps the score: Brain, mind and body in the healing of trauma” বইতে। মানব মস্তিষ্ক স্তরে স্তরে গঠিত। মস্তিষ্কের নিম্নের স্তরে আছে Reptilian brain  যা ক্ষুধা, তাপমাত্রা, অবসাদ ইত্যাদি আঁচ করে। মধ্যভাগে আছে Limbic System যা সবসময় বিপদ আঁচ করতে পারে। একে emotional brain বলা হয়। একেবারে উপরের অংশ হচ্ছে Neocortex বা rational cognitive brain। Bessel এই অংশকে বলেন ‘Watch Tower’ কারণ এটি limbic system এর দেয়া বিপদ সংকেত সত্যিই কিনা তা যাচাই করে। যাহোক Limbic সিস্টেম যখন বিপদের আঁচ করে তখন reptilian ব্রেইনের কাছে সংকেত পাঠায় এবং চালু করে Autonomic Nervous System।  Autonomic Nervous System তখন চালু করে তার survival response যা Fight, Flight এবং Freeze নামেই বহুল পরিচিত। Autonomic Nervous System এর আবার দুটি অংশ – Sympathetic Nervous System এবং Parasympathetic Nervous System। প্রথমটির কাজ হচ্ছে মানুষ বিপদ দেখে তা প্রতিহত করবে, পলায়ন করবে না একেবারে বরফ হয়ে যাবে সেটা ঠিক করা। আর দ্বিতীয়টির কাজ হচ্ছে বিপদ চলে যাবার পর শরীরকে ’rest & digest’ করতে সাহায্য করা। মোট কথা মস্তিষ্কের কম্যান্ড সেন্টার আমাদের অধিকাংশ ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াকেই নিয়ন্ত্রণ করে।

মস্তিস্ক বিষয়ক বিজ্ঞান নির্ভর আলোচনা আমার আগ্রহের বিষয় নয়, সেই আলোচনা করার সাধ্যও আমার নেই। আমার আগ্রহ এই বিস্ময়কর যন্ত্রের মহাবিস্ময়কর স্রষ্টাকে নিয়ে যিনি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মাথায় অসাধারণ এক ’Magical Machine’ বসিয়ে দিয়ে রেখেছেন। দিয়েছেন অজানাকে জানা আর যুগান্তকারী সব সৃষ্টির ক্ষমতা। কিন্তু তারপরেও মহাবিশ্বের বিশাল সৃষ্টির কতটুকুইবা  আমরা জানি। পবিত্র কোরআন এর সূরা হাদীদে (আয়াত ৪) আল্লাহ্পাক যখন বলেন, “ ——-তিনি জানেন, যা-কিছু মাটিতে প্রবেশ করে আর যা-কিছু মাটি থেকে বেরিয়ে আসে। জানেন, যা-কিছু ঊর্ধ্বলোক থেকে নামে ও ঊর্ধ্বলোকে যা-কিছু ওঠে”। আমি তখন মানুষ হিসেবে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্বতা নূতনভাবে উপলদ্দি করি। প্রাণের অস্তিত্ব ও গ্রহান্তরের আগন্তুকের (Alien) সন্ধানে মানুষ মহাকাশে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে অভিযান চালায় অথচ তার নিজের মস্তিস্কই পুরোপুরি আবিস্কার করতে পারে না। সৃষ্টির সেরা জীব হলেও এই ‘কুদরত’ বুঝার সামর্থ্য মানুষের নেই।

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন