-মোঃ মনিরুজ্জামান

পরদিন ২৪ মার্চ আমাদের ইগুয়াজু সফরের শেষ দিন। বিকাল তিনটার ফ্লাইটে সাও পাওলো হয়ে প্রাইয়া গ্রান্ডে( PRAIA GRANDE )যাওয়ার কথা। তবে সকালে আমরা ইগুয়াজুর বিখ্যাত বুড্ডিস্ট টেম্পল ও মিউজিয়াম দেখতে যাবো। হোটেলের ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট করেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমরা প্রথমেই শহরের অদূরে পারানা নদীর তীরে নির্মিত বৌদ্ধ মন্দির দেখতে গেলাম। ইগুয়াজুতে বসবাসরত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদ্যোগে ১৯৯৬ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরা কখন এবং কিভাবে এদেশে এসে বসতি স্থাপন করেছিল সেটা সময় স্বল্পতার কারণে জানতে পারিনি। মন্দিরের ভিতরে গৌতম বৌদ্ধের বড় মূর্তি ছাড়াও প্রবেশ পথ ও মন্দির সংলগ্ন বাগানে শতাধিক বৌদ্ধ মূর্তি  সাজানো রয়েছে। এশিয়ার বাহিরে বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশে এতো বড় ও সুন্দর বৌদ্ধর মন্দির থাকতে পারে সেটা না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করতাম না। মন্দিরের চারিদিকের প্রাকৃতিক পরিবেশ ঠান্ডা ও বেশ চুপচাপ। মন্দিরের বাহিরে সুশৃঙ্খল ভাবে সাজানো বাগানের প্রান্ত নদীর পাড়ে শেষ হয়েছে। নদীর ওপারে প্যারাগুয়ের  বিস্তীর্ণ জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা দেখা যায়। এ সব জায়গা দিয়ে স্মাগলাররা নদী পেরিয়ে দু’দেশের মধ্যে বিভিন্ন পণ্য আনা নেয়া করে।

 

 

ছবি:-ইগুয়াজু বৌদ্ধ মন্দিরের বাহিরের দৃশ্য ,ইগুয়াজু,ব্রাজিল

 

 

 

উল্লেখ্য ,বুড্ডিস্ট ছাড়াও ইগুয়াজুতে বেশ কিছু মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনও বসবাস করে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এশিয়া ও মধ্যেপ্রাচ্চের অনেক ইমিগ্রান্ট এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। ইগুয়াজুতে মুসলিমদের একটি সুন্দর মসজিদ আছে। ১৯৮২ সালে আল আসকা মসজিদের অনুকরণে ওমর ইবন আল খাত্তাব মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। সময়ের অভাবে আমরা মসজিদটি দেখার সুযোগ পাইনি। বৌদ্ধ মন্দির দেখে ফেরার পথে ‘MUSEU DE CERA DREAMPALD’ দেখতে গেলাম।  এটি একটি WAX REPLICA মিউজিয়াম। আমরা যেহেতু দুপুরের খাবার পর এয়ারপোর্ট রওয়ানা দেব, তাই মিউজিয়ামের ভিতরে যাওয়ার সময় পেলাম না। হোটেলে ফিরে ডাইনিং রুমে দুপুরের খাবার খেয়ে বেলা সাড়ে বারোটার দিকে আমরা ইগুয়াজু এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।

গল এয়ারলাইন্স এর একটি বিমানে আমরা ইগুয়াজু থেকে বিকাল  তিনটায় সাও পাওলো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। সাও পাওলো এয়ারপোর্টে পৌছালাম বিকাল সাড়ে পাঁচটায়। সাও পাওলো থেকে বাসে করে প্রাইয়া গ্রান্ডে যেতে হবে। সন্ধ্যা সাতটার সময় ‘কমেটা’ ট্রাভেলস কোম্পানির একটি বাসে প্রাইয়া গ্রান্ডের উদ্দেশ্যে  বাস ছাড়লো। সাও পাওলো শহরের বাহির দিয়ে বাইপাস রোড  দিয়ে  রিও ,সান্তোস ,প্রাইয়া গ্রান্ডে  ও অন্যানো স্থানে বাস যাতায়াত করে। সাও পাওলো এয়ারপোর্ট থেকে প্রাইয়া গ্রান্ডের দূরত্ব ৯৮ কিলোমিটার। পথে প্রচুর জ্যাম থাকায় আমাদের প্রাইয়া গ্রান্ডে পৌঁছাতে রাট দশটা বাজলো। আগেই বলেছি আমাদের বন্ধু ও কলিগ রিনালদোর বাড়ি প্রাইয়া গ্রান্ডে। এ শহরে বিচ এলাকায় তার একটি ছোট এপার্টমেন্ট আছে । আমরা উবের ট্যাক্সিযোগে রিনালদোর এপার্টমেন্টে যখন পৌছালাম তখন রাট ১১টা বাজে। বিচের প্যারালালে বড় রাস্তার পাশে রিনালদোর এপার্টমেন্ট। আমরা লাগেজ এপার্টমেন্টে রেখে ফ্রেশ হয়ে বাহির হলাম রাতের খাবারের জন্য। তখনও বিচের আশেপাশের অনেক কাফে -রেস্টুরেন্ট খোলা আছে। এটা রিনালদোর শহর। তাই আমরা তাকে দায়িত্ব দিলাম কোথায় খেতে যাবো সেটা ঠিক করতে। তবে রাত বেশি হওয়ায় সে এপার্টমেন্টের কাছাকাছি তার পরিচিত একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। সেখানে খাবার শেষে বিচে কিছুক্ষন ঘোরাফেরা করে এপার্টমেন্টে ফিরে ঘুমের আয়োজন করতে শুরু করলাম। এখানে এক রুমে মেয়েরা ও আরেক রুমে ছেলেরা থাকার ব্যবস্থা করা হল। এটি একটি সিঙ্গেল এপার্টমেন্ট হলেও আমরা সবাই নিজেদের সুবিধামতো শোয়া-বসার জায়গা করে নিলাম।

উল্লেখ্য, রিনালদোর বাড়ি ব্রাজিলে হলেও সে কানাডায় থাকে দীর্ঘদিন। প্রাইয়া গ্রান্ডের অদূরে ‘পোহা’ এলাকায় তার পৈতৃক বসতি। ১৯৯৫ সালে কানাডা যাওয়ার আগে সে ‘পোহা’ এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতো। রিনালদোর মা তার জন্য প্রাইয়া গ্রান্ডের এ এপার্টমেন্টটি কিনেছিল গ্রীষ্মকালীন সময়ে বসবাসের জন্য। বর্তমানে  তার বাবা মা বা কোনো ভাইবোন  জীবিত নাই। গ্রামের বাড়িতে তার কাজিনরা থাকে। বয়স ৫৫ বছর হলেও সে এখনো সিঙ্গেল এবং বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে তার নাই। রিনালদো বছরে একবার তিন মাসের জন্য এখানে এসে থাকে ও সহায় সম্পত্তির হিসাব নিকাশ ও দেখভাল করে।

প্রাইয়া গ্রান্ডে সম্পর্কে রিনালদোর কাছে থেকে আগেই শুনেছি। এটি একটি ছোট শহর হলেও আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা আছে। শহরটি পরিকল্পনা মোতাবেক গড়ে তোলা হয়েছে। সমগ্র ব্রাজিলের মধ্যে প্রাইয়া গ্রান্ডে প্রথম শহর যেখানে ইনফরমেশন হাইওয়ে (FIBRE OPTIC INTERCONNECTION) নেটওয়ার্ক দ্বারা শহরের সকল অফিস ও গুরুত্ত্বপূর্ণ স্থাপনা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের সাথে সংযুক্ত। শহরের সব গুরুত্বপূর্ণ অফিস,বাবসাকেন্দ্র ,পাবলিক প্লেস ইত্যাদিতে স্থাপিত বারো শত ভিডিও ক্যামেরা দ্বারা এ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সরাসরি সংযুক্ত। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের পরে ভিডিও সার্ভিলেনস  সংযোগ স্থাপনকারী শহর হিসাবে প্রাইয়া গ্রান্ডে বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। সম্প্রতি গৃহীত আর একটি প্রকল্পের আওতায় আরো নয় শত ভিডিও  সার্ভিলেনস ক্যামেরা স্থাপিত হলে এ শহর সারা বিশ্বের মধ্যে আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিক দিয়ে প্রথম স্থানে পৌঁছে যাবে।

সাও পাওলো স্টেটের সব চাইতে বড় শপিং মল লিটরাল শপিং প্লাজা ( LITORAL SHOPPING PLAZA ) প্রাইয়া গ্রান্ডে অবস্থিত। এছাড়া সাও পাওলো  মহানগরীর কাছে প্রাইয়া গ্রান্ডেই সবচেয়ে বড় বিচ ও রিসোর্ট এরিয়া। সেজন্য এখানে ট্যুরিস্টদের ভিড়ও প্রচুর। আটলান্টিকের পূর্ব পাড় ঘেঁষে  অনেকগুলি ছোট বড় বিচ আছে প্রাইয়া গ্রান্ডে। শহরের পশ্চিম প্রান্ত থেকে পাহাড় সারি মনে হয় দেয়াল দিয়ে শহরটিকে ঘিরে রেখেছে। প্রাইয়া গ্রান্ডে বিচ এলাকা ছাড়াও ট্যুরিস্টদের আকর্ষণের আরো কিছু জায়গা আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পাহাড়ে হাঁটা বা  বা হাইকিং এর ট্রেইল  TRILHA  DO  RIO  DO  BOI , MALACARA  CANYON  , CANYONS  & PERAUS  APARADOS  DA  SERRA , ইটাইপু ফোর্ট (FORTALEZA DE  ITAIPU), আর্ট প্যালেস (PALACIO  DAS  ARTES)  ইত্যাদি। রক ক্লাইম্বিং বা পাহাড়ে হাঁটতে যাদের ভালো লাগে তাদের জন্য প্রাইয়া গ্রান্ডের এ সব ক্যানিয়ন অত্যান্ত আকর্ষণীয় একটি এলাকা ।

প্রাইয়া গ্রান্ডের সবচেয়ে বড় বিচের নাম গিলেরমিনা (GUILHERMINA BEACH) । এ বিচ টি প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ । রিও’র কাপাকবানা   বিচের  সাথে এ বিচটির অনেক সাদৃশ্য আছে। বিচের প্যারালালে চার লেনের চওড়া রাস্তার উপর হোটেল রেস্টুরেন্ট ও স্যুভেনির দোকানের ছড়াছড়ি। এ বিচের মাঝামাঝি রিনালদোর এপার্টমেন্ট। এপার্টমেন্টের জানালা খুলে রাখলে আটলান্টিকের জলরাশির গর্জন শোনা যায়।  সেইসাথে উন্মুক্ত পরিবেশের বিশুদ্ধ বাতাস উপভোগ করা যায়। আমরা দু’দিন এখানে থাকবো এবং পরের দিন ২৭ মার্চ সাওপাওলো থেকে টরোন্টোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো। এ দু’দিনে আমরা বিচ এলাকা ও শপিং মলে যাবো। পরদিন পাহাড়ে হাইকিং ও ক্যানিয়ন দেখতে যাবো। সুযোগ পেলে ইটাইপু ফোর্টেও যাবো। পরিকল্পনা অনুযায়ী পরদিন সকালে রিনালদোর বাসার সামনে বিচের একটি রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট করে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। বিচের পার্শবর্তী ফুটপাথ রং বেরংএর পাথর দিয়ে সুন্দর ডিজাইন করে নির্মাণ করা হয়েছে। শুধু প্রাইয়া গ্রান্ডে নয়,আমি লক্ষ্য করেছি ব্রাজিলের সব শহরের ফুটপাথ রং বেরংএর পাথর দ্বারা তৈরি। এ সব ছোট ছোট পাথর দিয়ে বিভিন্ন নকশা বা ডিজাইন করে ফুটপাথের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফুটপাথ  থেকে বেশ কিছুদূর পর্যন্ত বালির স্তর ও তার পরেই জলরাশি তীরে এসে পড়ছে। ফুটপাথ ও বালির উপরে  হকারদের চলমান গিফট ও স্যুভেনির দোকান এবং  হরেক রকম জুস ও সফট ড্রিঙ্কস এর দোকান দেখতে পেলাম। এ ছাড়া অনেকে ছাতা আকৃতির তাবু ও চেয়ার বিছিয়ে শুয়ে বসে সময় কাটাচ্ছে। আমরা বিচের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। সেজন্য ফুটপাথের  নিচে বালির চরে নারকেল ও ঝাউ গাছের ছায়ায় একটি রেস্টুরেন্টে বসলাম। আটলান্টিকের দিক থেকে প্রবাহিত বাতাসে অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের ক্লান্তি দূর করে দিল। সেখানে বসে আমরা ব্রাজিলের জনপ্রিয় স্ন্যাকস ‘পাস্তাইস’ ও ডাব / জুস খেলাম।

 

 

ছবি:- প্রাইয়া গ্রান্ডের  সবচেয়ে বড় বিচ ‘গিলেরমিনা’ (GUILHERMINA BEACH)বিচ

 

 

একসময় আমরা বিচে নামার জন্য তৈরি হলাম। ইতোমধ্যে বিচে প্রচুর লোক পানিতে নেমে  সাঁতার ও হৈ হুল্লোড় শুরু করেছে। আমরাও অনেকক্ষণ পানিতে সাঁতার কেটে শরীর  ঠান্ডা করলাম। তবে আমি ও এস্থের সবার আগে পানি থেকে উপরে এসে ভিজে পোশাক চেঞ্জ করে সেই রেস্টুরেন্টের গাছের ছায়ায় বসলাম। আমরা সবাই একত্র হলে সিদ্ধান্ত নিলাম এখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে নেবো। প্রচন্ড রৌদ্রের তাপ ও রাস্তার ওপারের রেস্টুরেন্টে যাওয়া আসার ঝামেলা এড়ানোর জন্যই আমরা এ সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের মতো অনেকেই এখানে দুপুরের খাবার খাচ্ছে। খাবারের মধ্যে সী ফুড ছাড়াও অন্যানো আইটেম আছে। আমরা সালাদ ও সি ফুডসহ তিন প্রকার খাবারের অর্ডার দিলাম। খাবার পরিমান অনেক ও রান্নার মানও ভাল। অনেক সময় নিয়ে তৃপ্তি সহকারে খাবার খেয়ে সেখানে আমরা বিকাল  সাড়ে চারটা পর্যন্ত থাকলাম। পরে লোকাল বাসে করে প্রাইয়া গ্রান্ডের সবচেয়ে বড় মল লিটরাল শপিং প্লাজার  উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।

লিটরাল প্লাজা প্রাইয়া গ্রান্ডে শহরের বাহিরে হাইওয়ের পাশে একটি বিশাল বিস্তৃত শপিং মল। একপাশে সাও পাওলো থেকে আটলান্টিক কোস্টের শহরগুলির সাথে সংযোগকারী ‘এস পি -১৬০’ হাইওয়ে এবং অপরপাশে সুউচ্চ পাহাড় শ্রেণীর পাদদেশে পরিকল্পিতভাবে এ মলটি নির্মাণ করা হয়েছে। মলের চারিদিকে একহাজার গাড়ির পার্কিং লট ও মল থেকে শহরে যাতায়াতের বাস স্টেশন। মলটির চারিদিকের সবকিছু দেখে মনে হল এটির রক্ষনাবেক্ষন ব্যবস্থা অনেক উন্নত। আমেরিকা কানাডার যে কোনো বড় মূল থেকে এটা কোন অংশে কম নয়। আমরা বাস থেকে নেমে মলের ওয়াকওয়ে দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। বিশ্বের সব উন্নত মলের মতোই সব কিছু এখানে আছে। আমরা ঘুরে ঘুরে সব কিছু দেখছি। ফাঁকে ফাঁকে এস্থের ও মার্গারেট কিছু কিছু কেনা কাটা করছে। আমি একটি ভ্যারাইটি স্টোর থেকে এক কার্টুন মার্লবোরো সিগারেটে কিনলাম। মলে আমরা সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত ঘুরাফেরা করে বাস স্টেশনের দিকে গেলাম। বাসে রিনালদোর এপার্টমেন্টের সামনে যখন নামলাম রাত আটটার বেশি বাজে।

 

ছবি:-প্রাইয়া গ্রান্ডে-সাও পাওলো  হাইওয়ের পাশে লিটরাল প্লাজা  শপিং মলের সামনে ভ্রমণ সঙ্গীদের সাথে

 

 

 

এপার্টমেন্ট থেকে ফ্রেশ হয়ে আবার আমরা বিচে আসলাম। রাত তখন দশটা বাজলেও বিচের কাফে রেস্টটুরেন্টে প্রচুর জনসমাগম। এবার আমরা বড় রাস্তার পাশে একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। সেখানে সেলফ সার্ভিস বুফে থেকে পছন্দমতো খাবার নিয়ে আমরা রাতের খাবার শেষ করলাম। এখানে খাবারের দাম কিছুটা বেশি। তবে নিজের পছন্দ মতো খাবার খেতে পেরে দামের প্রতি কেউ আর মনোযোগ দিলাম না। খাবার শেষে বিচের ফুটপাথ ধরে অনেকক্ষন হাঁটাহাঁটি করলাম। এ সময়ে আমরা রিও’র বিচে হাঁটার স্মৃতিচারণ করছিলাম। রিও’র বিচ গুলি যেনো সব সময় আমাকে আকর্ষণ করে। আসলে সব বিচ এলাকার বৈশিষ্ট প্রায় একই হলেও কোনো কোনো বিচের অবস্থান, নিরাপত্তা ও ব্যাবস্থাপনা ,পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, থাকা খাওয়ার হোটেল-রেস্টুরেন্ট ইত্যাদির কারণে কোনো কোনো বিচ কথা বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকে। রাত গভীর হলে বিচের ভিড় হালকা হয়ে এলো। আমরাও এপার্টমেন্টে ফিরে এলাম ঘুমানোর জন্য।

পরদিন সকালে এপার্টমেন্ট থেকে আমরা বাহির হলাম সকাল নয়টায়। বিচ রোডের একটি রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা ঐ দিনের কর্মসূচি মোতাবেক পাহাড়ি ট্রেইল ও ক্যানিয়ন দেখতে রওয়ানা হলাম বেলা দশটার দিকে। লোকাল বাসে প্রায় ঘন্টাখানেক লাগলো মালাকারা (MALACARA) ক্যানিয়নের যাবার রাস্তার কাছে যেতে। প্রাইয়া গ্রান্ডে শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে পাহাড়ের সারি। এ পাহাড় শ্রেণীর মধ্যে দিয়ে শুরু রাস্তা ও চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তিন কিলোমিটার পরে মালাকারা ক্যানিয়ন। এ সব সরু ট্রেইল বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে অন্যানো ক্যানিয়ন পর্যন্ত গেছে। যাওয়ার রাস্তা বেশ দুর্গম ও কষ্টসাধ্য। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক এস্থের এ ট্রেইল ও ক্যানিয়ন দেখতে যেতে রাজি হল না। মার্গারেট ও যেতে আপত্তি করলো। আমরা বাকি চার জন ক্যানিয়ন দেখতে যেতে আগ্রহী। এস্থের ও মার্গারেট ক্যানিয়নের প্রবেশ পথের রাস্তার পাশে গ্রামীণ হস্তশিল্প সামগ্রীর দোকান ও রেস্টুরেন্টে বসে আমাদের ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে বলে জানালো।

ট্রেইলে হাঁটার জন্য রানিং সু বা কেডস পরা আবশ্যক। আমরা এপার্টমেন্ট থেকে এজন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছি। তাই আর দেরি না করে আমরা  ক্যানিয়নে যাবার ট্রেইল ধরলাম।ছাত্র জীবনে সেবা প্রকাশনীর অনুবাদ করা ওয়েস্টার্ন উপন্যাস গুলিতে পাহাড়ি ট্রেইল ও  ক্যানিয়ন সম্পর্কে পড়েছি। তাই ক্যানিয়ন দেখার জন্য বেশ কৌতূহল ছিল।  ক্যানিয়নে যাবার পাথুরে রাস্তার দু’পাশেই জঙ্গল।  আমাদের সাথে অন্যানো আরো ট্যুরিস্টরাও হেঁটে চলেছে। প্রথম এক কিলোমিটার হাঁটতে খুব একটা অসুবিধা হল না। তবে আস্তে আস্তে পথ উপরের দিকে উঠতে শুরু করলে একটু কষ্ট অনুভব করলাম। একসময় পথ আবারো নিচের দিকে নেমে গেল। আমরা বেশ কৌতূহল নিয়ে পাহাড়ি জঙ্গলের সৌন্দর্য দেখছি আর হাঁটছি। একসময় রাস্তা কিছুটা চওড়া হয়ে নিচে পাহাড়ি ঝর্নার কাছ দিয়ে নিচে একটি বড় জলাধারে যেয়ে জমা হচ্ছে। এখানে দেখলাম ছোট বড় বিভিন্ন ধরণের রক বা পাথর। তার মধ্যে দিয়ে ঝর্ণার পানি কুল কুল রবে বয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে উঁচু পাহাড় ও তার মাঝে এই ক্যানিয়ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। আমরা মুগ্ধ নয়নে প্রকৃতির এ সৌন্দর্য দেখছি আর ছবি তুলছি।  এই জায়গাটিকেই  মালাকারা ক্যানিয়ন বলা হয়। ক্যানিয়নের পরিষ্কার পানিতে নেমে আমরা হাত পা ভেজালাম। পাথরের উপর বসে বেশ কিছুক্ষন চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।

 

 

ছবি:- মালাকারা  ক্যানিয়ন ,প্রাইয়া গ্রান্ডে ,ব্রাজিল

 

 

একসময় ফেরার ট্রেইল ধরলাম। ফেরার পথে উঠানামায় বেশ পরিশ্রম হল। আধাআধি পথ যাওয়ার পর ট্রেইল দু ভাগ হয়ে একটি ফেরার পথে ও অপরটি ‘TRILHA  DO  RIO  DO  BO’এর দিকে গেছে। আরো তিন কিলোমিটার পরে ওপর ক্যানিয়ন। তবে আমরা মালাকারা ক্যানিয়ন যাওয়া আসাতেই ইতোমধ্যে ক্লান্তি বোধ করছিলাম।  তাই আমরা ফেরার পথে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। ট্রেইলের কষ্টসাধ্য যাত্রা পথ শেষ করে আমরা যখন সমতল রাস্তায় ফিরে এলাম তখন বেলা দুইটা বাজে। ক্যানিয়নে প্রবেশের পথের পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে এস্থের ও মার্গারেট কে নিয়ে আমরা বাসে করে বিচের সেই  রেস্টুরেন্টের কাছে নামলাম যেখানে আমরা গতকাল দুপুরের খাবার খেয়েছি। হাঁটাহাঁটির ক্লান্তিতে আমরা ইতোমধ্যে ক্ষুধার্থ। দেরি না করে খাবারের অর্ডার দিয়ে ওয়াশ রাম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলাম খাবার রেডি। খাবার শেষ করে রিনালদোর এপার্টমেন্টে ফিরে এলাম কিছুক্ষন রেস্ট নিতে। দীর্ঘদিন পরে উঁচু নিচু পাহাড়ি পথে হেঁটে আমরা ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। তাই প্রাইয়া গ্রান্ডেতে আমাদের  অন্য সব কর্মসূচি বাদ দিয়েছি। সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত এপার্টমেন্টে শুয়ে বসে কাটালাম।

সমুদ্র ও বিচের রাতের দৃশ্য দেখার জন্য আমরা সন্ধ্যার পরে আবার বিচের সেই রেস্টুরেন্টে এসে বসলাম। গত দু’দিনে নিয়মিত আসার জন্য রেস্টুরেন্টের মালিক ও কর্মচারীরা আমাদের ইতোমধ্যে চিনে গেছে। তাই খাতির যত্নও বেশি করছে। নারকেল গাছের ছায়ায় বসে আমরা যার যার পছন্দের ড্রিঙ্কস নিলাম। সমুদ্রের গর্জন ও বাতাস ,রেস্টুরেন্টের অডিও প্লেয়ার থেকে ভেসে আসা  সঙ্গীত ও ফুটপাথের দোকানের ক্রেতা বিক্রেতাদের কথোপকথন ইত্যাদির সমন্বয়ে বিচের এখানকার পরিবেশ আমার কাছে বেশ উপভোগ্য মনে হল। আজ প্রাইয়া গ্রান্ডে আমাদের শেষ রাত। তাই খাবার পরেও অনেক্ষন আমরা বসে ব্রাজিল ভ্রমণের স্মৃতি চারণ করলাম । এক সময় বিচের কোলাহল থেমে  গেলে আমরাও এপার্টমেন্টে ফিরে এলাম।

ছবি:-প্রাইয়া গ্রান্ডের  গিলেরমিনা বিচে যে রেস্টুরেন্টে বসে আমরা বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছি সেখান থেকে তোলা

ব্রাজিলে ভ্রমণের আজ আমাদের শেষ দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠে কানাডা ফেরার কথা মনে হতেই ভীষণ খারাপ লাগল। কিভাবে তিন সপ্তাহ সময় অতি দ্রুত অতিবাহিত হয়ে গেল সেটা ভাবতেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম। অবশ্য এটা ঠিক যে ব্রাজিল বিশ্বের একটি বড় দেশ। এতো অল্প সময়ে আমরা আর কিই বা করতে পারতাম ! আমরা ব্রাজিলের দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের কোস্টাল বেল্টের কিছু জায়গা দেখতেই আমাদের সময় শেষ হয়ে গেল। মধ্যে ও উত্তরাঞ্চলের আমাজন এবং আরো কত কিছুই তো দেখতে পারলাম না। এসব নিয়ে আলোচনা করতে করতে আমরা এপার্টমেন্ট থেকে বিচের সেই রেস্টুরেন্টে এসে বসলাম ব্রেকফাস্ট করার জন্য। ব্রেকফাস্ট করে ঘন্টাখানেক সেখানে বসে শেষ বারের মতো আটলান্টিকের গর্জন ও সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। অতঃপর এপার্টমেন্টে এসে যার যার লাগেজ প্যাক আপ শুরু করলাম। আমার যাকিছু কেনাকাটা তার সবই আমার সুটকেসে প্যাক করতে পারলাম। গ্রেস,মার্গারেট ও এস্থের অতিরিক্ত সুটকেস কিনেছে। বেলা সাড়ে বারোটার দিকে আমরা রিনালদোর এপার্টমেন্ট ছেড়ে প্রাইয়া গ্রান্ডের বাস স্টেশনে রওয়ানা দিলাম।  প্রাইয়া গ্রান্ডে থেকে দুপুর দুইটায়  কমেটা বাসে করে রওয়ানা হলাম সাও পাওলো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।

রিনালদো অবশ্য আমাদের সাথে যাচ্ছে না। সে আরো দুমাস তার বাড়িতে থাকবে। সে আমাদের বাস স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিতে  এলো। বাস ছাড়ার প্রাক্কালে তার সাথে সব শেষ সৌজন্য বিনিময় করলাম।  এ সময় সবাই বেশ আবেগ প্রবণ  হয়ে পড়েছিলাম। তিন সপ্তাহ একত্রে থেকে সবাই যেন এক ওপরের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। বাস ছাড়া পর বিষণ্ণ মনে অনেকক্ষণ বসে রইলাম। এক সময় বাস সান্তোস স্টেশনে দাঁড়ালে আমরা হালকা স্ন্যাকস খেয়ে নিলাম। বিকাল সাড়ে পাঁচটায় সাও পাওলো এয়ারপোর্টে পৌছালাম। ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস সেরে রাত নয়টায় এয়ার কানাডার ড্রিম লাইনার বিমানে আরোহন করলাম। কানাডা সময় ভোর ছয়টায় আমরা সুস্থ শরীরে ও বহাল তবিয়তে টরন্টো পিয়ারসন বিমান বন্দরে অবতরণ করলাম। সেই সাথে আমাদের তিন সপ্তাহের ব্রাজিল ভ্রমণের পরিসমাপ্তি হল।

 

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন