আমার কানাডা আসার আসার গল্পটা একটু ভিন্ন , অন্যদের মতো উচ্চশিক্ষা অর্জনের অভিলাষ কিংবা উন্নত দেশের উন্নত জীবন পাওয়ার অভিপ্রায় ছিল না, কিন্তু সংসারের আর দশজনকে ভালো রাখাও যে দায়িত্বের মধ্যে পরে, সে চিন্তা থেকেই অনেকটা দেশান্তরী হওয়া । খুব ঘর কুনো মানুষ আমি । ঢাকা আর ফরিদপুর আমার গন্তব্য । আর এই আসার খুশী আর ফিরে যাওয়ার বেদনা আমাকে খুব কষ্ট দিত । আমার প্রিয় মুখ গুলোকে ফেলে আসতাম তাদের চোখের জল দেখতে চাইতাম না । সেই আমি এখন হাজার হাজার মাইল দূরে বসে স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই । ২০০৯ সালে জানুয়ারীতে শেষ বার দেশে গিয়েছি , বাবাকে দেখতে, দেখা হয়নি । আমি আসার ফিরে আসার সময় মাকে বলেছিলাম আবার আসব তোমার কাছে কিন্তু ক্যালেন্ডারের পাতা দু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জীবনের গল্পটা বদলে গেল !
আমার মা খুব শান্ত বা রাগী কোন টাই ছিলেন না । কেমন যেন একটা স্থির দিঘীর মত । আমাদের সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, বাবা তার অঘোষিত শাসনের দায়িত্বটা মাকে দিয়েছিলেন, কারন আমার বাবা আমাদের বকা দিয়ে নিজেই কষ্ট পেতেন । আমাদের যদি অসুখ করত বা বাইরে থেকে আসতে দেরী হতো আব্বা খাওয়া বন্ধ করে পায়চারি করতেন কিন্তু মা স্থির , বলতো সব ঠিক হয়ে যাবে , ওরা চলে আসবে । আবার মোবাইল এর কল্যানে আব্বা প্রতি ১০ মিনিট পরপর ফোন করে অবস্থান জেনে নিতেন, মা শুধু অপেক্ষা করত ।
বাবা তার চাকুরীর কারনে প্রায় ১৪ বছ্ র দেশের বাইরে ছিলেন ।আর ওই সময় টা আমাদের ৭ ভাইবোনকে দেখাশোনার সম্পূর্ন দায়িত্ব মায়ের । বাবা যখন দেশে আসতেন চাইতেন তার ছেলে মেয়েরা সাথে থাকুক , কলেজ, ভার্সিটির ক্লাশ ২/৪ দিন নাই বা করলো । কিন্তু মায়ের কাছে ওই আবদার টিকত না । আমাদের গ্রামের বাড়ির আত্মীয় স্বজন , তাদের ডাক্তার দেখানো , পরীক্ষা দেওয়া সব কিছুর জন্য আমাদের বাসায় আসতে হতো । মা কি ভাবে যে এতো কিছু সামাল দিতেন !

আমাদের জন্ম সোনার চামচ মুখে নিয়ে নয়। একজন সাধারণ চাকরিজীবী বাবার পরিশ্রম আর আমার মায়ের কষ্টের ফসল আজকের আমি বা আমরা ভাই-বোনেরা। ১৯৭৭ সালে ছোট একটি বাড়ি করে আব্বা আমাদের ফরিদপুরের কমলাপুরে নিয়ে আসেন । এরপর দেখেছি তাদের নতুন যাত্রার লড়াই। আবার ৮১ সাল থেকে ৯৫ মায়ের একার লড়াই সবাইকে নিয়ে । অন্য মহিলারা যেখানে প্রবাসী স্বামীর টাকা দিয়ে সম্পত্তি আর গহনা বানাত আমার মা প্রতিটি টাকা খরচ করতেন আমাদের জন্য আর অভাবী আত্মীয় স্বজন্দের পিছনে । আরোও কত কষ্ট যে মা করেছেন এখন বুঝি । তিলে তিলে সব গড়ে তুলেছেন তিনি আর যখনই ছেলেমেয়েরা বড় হলো আর তার পড়ন্ত জীবনের শান্তি উপলব্ধির সময় হলো তখনই মা চলে গেলেন।

মার মনে অনেক সাধ থাকলেও কখনো বলতেন না। বলতেন তোরা যখন অনেক টাকা আয় করবি তখন সব ইচ্ছে পূরণ করব। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি এখন টাকা দিয়ে কি করবে যদি তোমাকে অনেক টাকা দেয়া হয় , মা আশে পাশের অনেক জনের নাম বলেছিল তাদের জন্য কি করতে চায় মা । ভাবতাম আমার যখন ভালো চাকরি হবে অনেক টাকা আয় করব, মায়ের ইচ্ছেগুলো পূরণ করব! আগে যখন মার হাতে অল্প কিছু টাকা দিতাম কিংবা কোনো উপহার দিতাম,দেখতাম মা কত খুশী । যানতাম মা ওই টাকা টা কাউকে দিয়ে দিবে তবু ও মার হাসি মুখটা দেখতে খুব ভালো লাগত । মা চাইতো আমরা বলি মা তুমি না থাকলে আমাদের এত দুর আসা হতো না অথচ তাঁর সামনে কখনো এই চিরন্তন সত্য বলা হয়নি। বাবা বলতেন আজ এই তোমরা সাত তারা সেটা তোমার মায়ের জন্য । তখন মা বলতেন, এখন বুঝবি না, যখন আমি থাকব না তখন বুঝবি ‘মা’ কি ছিলাম। মা বিশ্বাস কর এখন প্রতিটি দিন আর প্রতি মুহূর্তে বুঝি তুমি কি ছিলে। তোমার ছায়া কত বিশাল সেটা আগেও বুঝেছি কিন্তু কখনো বলা হয়নি। কারণ ভেবেছিলাম বলার বহু সময় বাকি। অনেক কিছু দেখাতে চেয়েছিলাম তোমাকে , অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গায় নিয়ে যেতাম এই তো ছিল ভাবনায় ।

তুমি অসুস্থ্য জেনেও আমার যাওয়া হলো না , ভেবেছিলাম আমার সাথে আবার দেখা হবে তোমার । কি স্বার্থপর সন্তান আমি । তুমি চলে যাবার প রেও কতবার মনে হয়েছে আবার যদি ফোনে কথা বলতে পারতাম তোমার সাথে । মা তুমি জানো না আজ এই কি বোর্ড কতবার থেমে গেছে তোমাকে নিয়ে একটু লিখব বলে ! আজ আমি নিজে অনেক টাকা আয় করি , ইচ্ছে করলেই তোমার ছোট ছোট চাওয়া গুলো সব পূরন করতে পারি । তুমি ই শিখিয়েছো ছেলে আর মেয়ে বলে কথা না নিজের অবস্থান থেকে সঠিক কাজ টি করে যেও ।
তোমার বিন্দু বিন্দু ভালোবাসায় এই দেহ গঠিত, কিছু ফেরত দেওয়ার আগে কেন চিরঋণী করে চলে গেলে। একটিবার ফিরে এসে দেখে যাও এই জীবনে তোমাকে কতটা প্রয়োজন। কি সুখে কি দুঃখে সৃষ্টি কর্তার পরেই তোমার কথাই মনে পড়ে । বিধাতাকে প্রশ্ন করি আমার মাকে কি আর একবার ফিরিয়ে দেয়া যায় না !!!

 

2 মন্তব্য

  1. রোকেয়া আপা, মাকে নিয়ে এতো আবেগ ভরা লেখা আমি আগে কখনো পড়িনি। জগৎ সংসারের সব কাজ শেষ করে নিজে একটু প্রশান্তি পাওয়ার সময় চলে যাওয়ার আক্ষেপ আপনার লেখায় ফুটে উঠেছে অসাধারণভাবে। আপনার আম্মার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি.

  2. ধন্যবাদ মসিউল ভাই যত দূরেইযাই , নিজেকে ক্ষ মা করতে পারি না যাদের জন্য এই আমি , খুব স্বার্থপর মনে হয় নিজেকে ।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন