যুদ্ধ যুদ্ধ এক অবস্থার মধ্যে আমরা। ২০৩ টি দেশে এ যুদ্ধাবস্থা চলছে। এসব দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ এখন গৃহবন্দী। ঘর থেকে বের হলে গুলি করার নির্দেশ যেমন আছে কোন কোন দেশে; তেমনি আছে জেল, জরিমানার আদেশ। আর্মি, পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ নিয়োজিত আছে মানুষকে গৃহবন্দী রাখার জন্য। অনেকে ভয়ে নিজ দায়িত্বে নিজেকে গৃহবন্দী করে রেখেছেন। বর্তমানের এ যুদ্ধ এক অদেখা শত্রুর বিরুদ্ধে। সেই শত্র‍ুকে ঘায়েল করার জন্য মরিয়া সবাই। আমি না বললেও আপনারা সবাই সেই অদেখা শত্র‍ুর নাম ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছেন। করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯)।

শত্র‍ুর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ অদেখা শত্র‍ুর আক্রমণে যিনি আক্রান্ত হন কোন কোন দেশে তিনিও এখন শত্র‍ু বিবেচিত হচ্ছেন। মারা যাওয়ার পরও সেই করোনা পজিটিভ মানুষটি সমাজের কাছে শত্র‍ু হয়ে যাচ্ছে। নির্মলেন্দু গুণের “যুদ্ধ” কবিতার কথা মনে পড়ছে “যুদ্ধ মানেই শত্র‍ু শত্র‍ু খেলা, যুদ্ধ মানেই আমার প্রতি তোমার অবহেলা।” অদেখা শত্র‍ু, দেখা শত্র‍ু । পত্রিকায় পড়লাম, ঢাকায় খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের পাশের কবরস্থানে করোনোর কারণে মৃত সন্দেহে স্থানীয় লোকজন লাশ দাফন করতে দেয়নি কয়েক ঘন্টা। এ রকম আরো কয়েকটি প্রতিরোধের খবর পত্রিকায় ও সোশ্যাল মিডিয়ায় পড়লাম। ইরাকেও নাকি এ রকম ঘটনা ঘটেছে। করোনার উপসর্গ নিয়ে বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে গেলে ভর্তি করছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। উপসর্গ ছাড়াও নাকি রোগীদের কোন কোন হাসপাতাল ভর্তি করছে না। আজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক ডীন ও আইন কমিশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, আমাদের প্রিয় ড. শাহ আলম স্যারের অসুস্থতার খবর পেলাম। তাঁর মত একজন স্বনামধন্য মানুষকেও নাকি একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ঘুরতে হয়েছে। তিনি কোন করোনা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে যাননি। এক গর্ভবতী নারীর খবর পত্রিকায় পড়লাম। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছেন আল্ট্রাসাউন্ড করানোর জন্য। যখন এক হাসপাতাল রাজী হয়েছে ততক্ষণে তাঁর গর্ভস্থ সন্তান মৃত্যুবরণ করেছে। সবার মধ্যে এক আতংক! অদেখা শত্র‍ুকে ভয়, অদেখা শত্র‍ু বহনকারী মানুষকে ভয়। ভাইরাসটি বহন করার সম্ভাবনা রয়েছে এমন মানুষকে ভয় (যেমনঃ প্রবাসী)। মানবিকতাহীন এক যুদ্ধংদেহী অবস্থা! একের প্রতি অন্যের অমূলক অবহেলা!!

কানাডায় আছি পাঁচ বছর হয়ে গেল। আমার শারীরিক অবস্থান কানাডায় হলেও মন পড়ে থাকে বাংলাদেশে। পাঁচ বছরে এমন কোন দিন নেই যে বাংলাদেশের পত্রিকা পড়িনি। কোন দিন বাদ যায়নি যে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলে খবর দেখিনি। টক শো দেখিনি। নাটক দেখিনি। দেখব না কেন? বাবা, মা, ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই বাংলাদেশে। জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশকে কি ভুলা যায়? আমার বাবা বয়োবৃদ্ধ। প্রায়ই ফোনে কথা হয়। ম্যাসেঞ্জারে কথা হয়। করোনার প্রাদুর্ভাবে বাবাকে নিয়ে বেশি চিন্তা হয়। অথচ বাবা আমাদের জন্য চিন্তা করেন আরো বেশি। দু’ দিন কথা না হলে পাগল হয়ে যান। বাবাকে বলি, আমরা ভালো আছি। করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশের যে প্রস্তুতি তাতে আপনার জন্য, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বাংলাদেশের মানুষের জন্য চিন্তা হয় আরো বেশি।

কানাডায় যেদিন থেকে স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত সবকিছু বন্ধ হলো সেদিন থেকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ভাষণের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন। প্রতিদিন সকাল ১১ টার দিকে তিনি জাতির সামনে উপস্থিত হন। মহামারীর এই সময়টাতে সকলকে তিনি ঘরে থাকার অনুরোধ করেন এবং তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে করোনা মোকাবেলার পদক্ষেপ তুলে ধরেন। এখন পর্যন্ত তিনি রাস্তায় সেনাবাহিনী নামাননি। বরং আয় রোজগার না থাকলে দেশবাসী কিভাবে তাঁদের দৈনন্দিন ব্যয় সংকুলান করবেন সে সব বিষয়ে তাঁর সরকারের পদক্ষেপসমূহ কী হবে তা জানান। এ ধরনের পদক্ষেপের কিছু অতিরঞ্জিত বাংলা অনুবাদ বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। সেসব পুরোপুরি সত্যি না হলেও একবারে মিথ্যে নয়। যেমন: প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের বাংলা তর্জমায় কেউ কেউ বলেছেন, প্রত্যেক নাগরিকের বাসায় বাসায় বাজার চলে যাবে, ব্যাংকে বেতনের টাকা কাজ না করলেও জমা হয়ে যাবে ইত্যাদি। বাসায় বাসায় সরকারী ব্যবস্থাপনায় বাজার চলে আসার বিষয়টি পুরোপুরি মিথ্যা, তবে স্থানীয় বেসরকারী সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবকদের পক্ষ থেকে কারো কারো জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে (সবার জন্য নয়)। এখানে কেউ যদি চাকুরী হারান তবে সরকারী ব্যবস্থায় এম্পলয়মেন্ট ইন্স্যূরেন্স (ইআই) ভাতা পেয়ে থাকেন। চাকুরীকালীন সময়ে কর্মীর বেতন থেকে ইআই খাতে নির্ধারিত টাকা কেটে রাখা হয় এবং চাকুরী হারালে সেই কর্মী যদি নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করেন তবেই তিনি ইআই ভাতা পান। করোনাকে পরাজিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী কিছু বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছেন যাতে সবাই ঘরে অবস্থান করেন। বেতন-ভাতার কথা চিন্তা না করেন। যেমনঃ যাঁরা ইআই ভাতা পাবেন না তাঁরা ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স বেনিফিট’ পাবেন। ব্যবসায়ীরা ঋণ পাবেন। স্টুডেন্ট লোন পরিশোধের সময় ছয় মাসের জন্য বন্ধ থাকবে। বন্ধকগ্রহীতা চাইলে ছয় মাস সময় নিতে পারবেন। ব্যাংকের সুদ কমিয়ে দেয়া হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কানাডার প্রতিটি রাজ্যও নিজ নিজ ক্ষমতাবলে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। প্রতিদিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সরকারের পদক্ষেপসমূহ জনগণের সামনে তুলে ধরেন। স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে মেয়রও একইভাবে সিটির বিভিন্ন উদ্যোগ সম্পর্কে প্রতিদিন জনগণকে আপডেট দেন। কানাডার সরকার প্রবাসী কানাডিয়ানদের কানাডায় ফেরত আনতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। প্রয়োজনে প্রবাসীরা যাতে ঋণ নিতে পারে সেজন্য ৫০০০ ডলার পর্যন্ত ঋণ গ্রহণের সুবিধা দিয়েছেন। করোনা আক্রান্ত জেনেও প্রবাসীদের দেশে প্রবেশ করতে বাঁধা দেননি। এখানকার কোন হাসপাতাল কাউকে চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে বলে শুনিনি। করোনার কারণে মৃত কারোর সৎকার হয়নি এ কথাও শুনিনি। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডামাডোল এখানেও বাজছে। কিন্তু তাতে অমানবিকতার কথা শুনিনি। মানুষের প্রতি মানুষের অবহেলার কথা পত্র-পত্রিকায় শিরোনাম হয়নি।

করোনার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসী ইনশাল্লাহ একদিন জয়ী হবে। কানাডা, বাংলাদেশসহ করোনা আক্রান্ত সবকটি দেশ মহামারীমুক্ত হবে। এ যুদ্ধ জয় একেক দেশ একেকভাবে অর্জন করবে। এ যুদ্ধ জয় কোন দেশ কতটা মানবিকতার সঙ্গে করতে পেরেছে ইতিহাস তা মনে রাখবে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন