বিশ্বের নেতৃস্থানীয় অলাভজনক প্রতিষ্টান ব্র্যাক আমার পেশাগত জীবনে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কারণ আমার জীবনের প্রথম চাকুরী ‘ব্র্যাক’ এ আর প্রথম চাকুরীর ইন্টারভিউও এর প্রতিষ্টাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের কাছেই। আমাদের মতো সাধারণ কর্মীদের কাছে উনি আবেদ ভাই হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন। ৭৫ মহাখালীর ব্র্যাকের পুরাতন ভবনের তিন তালায় ছিল আবেদ ভাইয়ের অফিস। ব্র্যাকের চার বছরের (১৯৯৩-১৯৯৭) কর্মকালীন সময়ে অনেকবারই আবেদ ভাইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে, বলা বাহুল্য, ভয়ে ভয়ে। অন্তরভেদী দৃষ্টি দিয়ে যখন তাকাতেন, মনে হতো খোলা বইয়ের মতো আমাকে পুরোটাই পড়ে ফেলেছেন। একজন মানুষের ব্যক্তিত্বর ধার যে কতটা প্রখর হতে পারে, আবেদ ভাইয়ের সংস্পর্শে আসার আগে তা কখনো বুঝতে পারিনি। অথচ চলাফেরা, বেশভুষা এবং কথাবার্তায় ছিলেন অতি সাধারণ। ব্র্যাকের “পাবলিক অ্যাফেয়ার্স এন্ড কমিউনিকেশন” বিভাগে কাজ করার সুবাদে বিভিন্ন দেশের দাতা সংস্থার জাদরেল কর্মকর্তাদের সাথে আবেদ ভাই এবং সেই সময়ে ব্র্যাকের উপদেষ্টা, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক চৌধুরীর ব্রিফিংয়ে উপস্থিত থাকার সুযোগ হতো মাঝে মাঝে। পরম বিস্ময়ে লক্ষ্য করতাম বাংলাদেশের উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ এবং ব্র্যাকের প্রতিটি শাখা উপশাখার কাজ নিয়ে আবেদ ভাই কতটা ওয়াকিবহাল। আমার সহকর্মী ওবায়দুল্লাহ জাকির ভাই মজা করে আমাকে বলতেন, “ টিটো, দেখেন বাংলাদেশের বেশিরভাগ এনজিও ঘুরে দাতাদের পেছনে। আর এই দাতারা ঘুরে আবেদ ভাইয়ের পেছনে”। ব্র্যাকের চার বছরের চাকরির জীবনে অনেকবারই এর বাস্তব প্রমান দেখার সুযোগ হয়েছে।

সাধারণ উন্নয়ন কর্মী হিসেবে বা আবেদ ভাইয়ের দেশি মানুষ হিসেবে, যে কারণেই হউক আমাকে স্নেহ করতেন আবেদ ভাই। ব্যক্তিগত কাজেও মাঝে মাঝে ডাক পড়তো। কেউ কেউ  ধমক খেলেও আবেদ ভাইয়ের ধমক খাওয়ার দুর্ভাগ্য আমার কখনো হয়নি। তবে ব্র্যাকের Annual Report এবং BRAC Diary প্রকাশের সময় এবং মান নিয়ে কিছুটা চিন্তিত থাকতেন। ১৯৯৭ সালের মে মাসে ব্র্যাকের চাকরি ছেড়ে আর একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ActionAid এ যোগ দেই। কেন জানিনা আমার ব্র্যাক ছাড়া নিয়ে উনি খুশি হতে পারেননি। যদিও আহামরি কোনো Position ছিল না আমার। এখনো পরিষ্কার মনে আছে, চলে আসার দিন বিদায় নিতে গিয়ে দেখি আবেদ ভাই ফারুক ভাইয়ের রুমে বসে গল্প করছেন। কাচুমাচু হয়ে কাছে গিয়ে বললাম, “ ভাই, আজকে আমার  ব্র্যাকে শেষ অফিস”। আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে স্মিতহাস্যে বললেন, “যেতেই হবে ?”।কোনো উত্তর দিতে পারিনি। চার বছরের সব স্মৃতি এসে ভর করলো চোঁখের উপর। চোঁখের কোণে জমে উঠা পানি মুছে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসলাম ফারুক ভাইয়ের অফিস রুম থেকে।

আজ আমাদের প্রিয় আবেদ ভাই নেই । মনে পড়ছে আমাকে বলা আবেদ ভাইয়ের শেষ বাণী, “যেতেই হবে?”। বলতে ইচ্ছে করছে, শুধু অফিস নয়, জগৎ সংসারের সব মায়া কাটিয়ে আমাদের সবাইকেই একদিন যেতে হবে, পাড়ি দিতে হবে না ফেরার দেশে। এটাই শাশ্বত সত্য। কিন্তু আপনার মতো “Legacy” রেখে চলে যাওয়ার ভাগ্য এবং কর্ম সব মানুষের হয়না। কোনো লোভ, মোহ তাকে তার লক্ষ্য ও সংকল্প  থেকে টলাতে পারেনি।  নিভৃতচারী, প্রচার বিমুখ এই গুণী মানুষটি জীবনভর মানুষের কল্যানেই কাজ করে গেছেন কোনো প্রতিদানের আশা না করেই। এই মানুষটি বিশ্বাস করতেন মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করাও  একটি ইবাদত। প্রার্থনা করি, ওপারে পরম করুনাময় আল্লাহ্পাক আবেদ ভাইয়ের আত্মাকে শান্তিতে রাখুন।

সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে   

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন