সেপ্টেম্বর ৩ তারিখ সোমবার, টরন্টো দূর্গা বাড়ীতে, বন্ধুবর বড়ভাই সুদিপ সোম রিংকু, ধর্মীয় আচারের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করেছেন তাঁর চিরকুমার কাকা কমরেড পান্নালাল সোম এর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। ভক্তি ও ভাবে আত্মার স্বর্গপ্রাপ্তি কামনায় সমাবেত হয়েছিলেন শতশত ভক্ত বৃন্দ। কীর্তন পরিবেশন করেন শ্রী হিমাংশু গোস্বামী। সৌভাগ্য হয় জন্মান্তরবাদ নিয়ে কিছু কথা শোনার।

৮৪ লক্ষ পশু কূল নামক জনমে যাতে আসা যাওয়া না করতে হয়, স্বর্গ ই যেন হয় স্থায়ী ঠিকানা এর জন্য হয় প্রার্থনা, সম্পন্ন হয় শাস্ত্রীয় কার্য।

পুরাণ এবং গীতায় বর্নিত আছে, আত্মা অবিনশ্বর। আত্মার ধ্বংস বা ক্ষয় নেই, তেমনি বৃদ্ধিও নেই। দেহের নয়, বরং আত্মারই বিচার হবে। তাই ভাল-মন্দের কর্মফল আত্মাই ভোগ করবে। আত্মার আহার-নিদ্রা বা বিশ্রাম নেই। আত্মা যতক্ষন দেহে থাকে, ততক্ষন আত্মার জন্য দিন এবং এক দেহ থেকে অন্য দেহ ধারন করার পূর্ব মূহূর্ত পর্যন্ত সময় আত্মার জন্য রাত। দিন যতটুকু রাতও ততুটুকু। অর্থাৎ দেহে আত্মার যত সময় অবস্থান, তেমনি আবার নতুন দেহ ধারন করতেও ততটুকুই সময় লাগবে (ব্যতিক্রমও হয়)। মানুষ যেমন ঘুমের ঘোরের স্বপ্নের কথা ভুলে যায়, তেমনি আত্মাও নতুন দেহ ধারন করার পর প্রায় সবই ভুলে যায়। যারা পূর্ব জন্মের কথা মনে রাখতে পারে তাদের জাতিস্বর বলা হয়।

আত্মা নারী কিংবা পুরুষ নয়। তাই কর্মই নির্নয় করবে কে কোন লিঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহন করবে। আর একটা কথা হচ্ছে আত্মা আমি নই, বরং আত্মাটা আমার। আত্মা জাতি অংশ। মৃত্যুর সময় দেহের পঞ্চভুত প্রকৃতির পঞ্চভুতের সাথে মিশে যাবে। এ যার-যার বিশ্বাস। অন্যের বিশ্বাসের ঘার মটকানোর স্পর্ধা আমি করিনা।

তবে নিজে যেটা বিশ্বাস করি, এই জগতে কিছু মানুষ তাদের কর্মের দ্বারা, নিজেদের ইহকাল এবং পরকালের রিজার্ভেসন ঠিক করে রাখেন। তাঁরা ইতিহাস হয়ে আসেন না, তাঁদের থেকে শুরু হয় ইতিহাস। আমার সার্চ ইঞ্জিনের সাধ্যের মধ্যে, যেটুকু জেনেছি। পান্না লাল সোম, জন্ম মৌলভীবাজার জেলার করিমগঞ্জ চা বাগানে। ১৯৪১ সালের ১৮ই অক্টোবর। চা বাগানের পাতা আর কুঁড়ির সাথে কেটেছে শৈশব। কাছে থেকে কৈশোরের কাঁচা হৃদয়ে গেঁথেছেন চা শ্রমিকদের বঞ্চিত হওয়ার দিনপঞ্জি। তখনকার দিনে যোগাযোগ ব্যাবস্থায়, বরমচাল নামক অখ্যাত স্টেশনে নেমে, পদব্রজে ৭-৮ কিলোমিটার হাটা কিংবা ট্রাক্টরই ছিল একমাত্র মাধ্যম। সেই দুর্গম এলাকায় বেড়ে উঠা, জন্মথেকে পঙ্গু মানুষটি, শত প্রতিকূলতা পিছনে ফেলে, কৃতিত্বের সাথে মেট্ট্রিক পাস করেন। সেই যুগে এই কৃতি ছাত্র পান্নালাল সোম, শ্রীমঙ্গল থানা সদর কিংবা মৌলভীবাজার জেলা সদরে কলেজে ভর্তি হলে, অনায়াসেই হয়ত ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারতেন। ওকিল হলেও তাতে কেউ আপত্তি করার কথা নয়। কিন্তু তা না করে চা বাগানে গুদাম বাবু হিসাবে যোগদান করলেন।

কি জানি? হয়ত অমলকান্তির মত রোদ্দুর হতে চেয়েছিলেন।পড়েছেন বিশ্ব পাঠশালায়।দেখেছেন মেহনতী মানুষের জীবনের জোয়ালে নুইয়ে পরা যুদ্ধকে। কাল মার্ক্সে উজ্জিবিত হয়েছেন মানবতার দ্বারা নির্মিত মানুষ হয়ে উঠার। সমাজতন্ত্র আন্দোলনের কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন নয়, লড়াই করেছেন নিজেকে সত্যিকার কমিউনিস্ট করে গড়ে তোলার। কমরেড পান্নালাল সোমকে আমি চিনি না তবে তাঁর সংগ্রামটাকে জানি। বেড়ে উঠেছি কমরেড বরুন রায়ের পূণ্য পদস্পর্শে ধন্য মাটিতে। বাম রাজনীতি করিনি কখনই, কিন্তু পাহারের মত নীতিতে আটল আদর্শের কাছে সমর্পন করেছি নিজেকে। কাছে বসে শুনেছি জসিম উদ্দিন মন্ডল কে, “গরিব না ঠকিয়ে কোন শালাই বড়লোক হতে পারেনি”।ইহাই বিজ্ঞান, ইহাই অংক, সেই অংক বুঝিতে হইবে অন্যতায় হইবে না। সমাজে ঘুণে ধরেছে সেতো অনেক কাল। কিছু মানুষের বিশ্বাস কে ঘুণে ধরতে পারেনা কখনই। রবিবার সুনামগঞ্জ জেলা এসোসিয়েশন এর পিকনিকে কথা হচ্ছিল এমনই এক ব্যাক্তিত্ব এই শহরের এক নিভৃতচারী, তবে আপদামস্তক সংগ্রামী, বাবু বিদ্যুৎ রঞ্জন দের সাথে। কি প্রচন্ড বিশ্বাস নিয়ে এখনও বলতে পারেন, দেখে নিও সঞ্জীব, এই সমাজ ভাংবেই। নতুন সমাজ গড়ে উঠবেই। আদর্শগত ভাবে এরা সবাই এবং কমরেড পান্নালাল সোম আত্মীয় বটে। বিপ্লবী যৌথ পরিবারের সদস্য। তাই কমরেড পান্নালাল সোম ও ছিলেন একই মন্ত্রে দিক্ষীত। ছিলেন খেটে খাওয়া মানুষের মাঝখানে, ভালবাসতেন মানুষকে, তাঁর সংগ্রামকে তিনি ভালবাসতেন। স্বপ্ন দেখেছেন দেশের মানুষকে দেখাবেন মুক্তির পথ। সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি, অশিক্ষা থেকে মুক্তি, ভাবনার পঙ্গুত্ব থেকে মুক্তি। উইল চেয়ারে বসে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে। দেশ মাতৃকার ডাকে যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। স্বিয় যোগ্যতায় বাপ-দাদার দেওয়া নামের আগে তৈরি করেছেন নিজের পদবী, কমরেড পান্নালাল সোম। সময়কে অনেক পিছনে ফেলে আসা উইলচেয়ারের জীবনকে, বর্তমান শ্রীমঙ্গল শহরের নিজ বাসভবন থেকে, মৃত্যুর পালকি এসে নিয়ে গেলো গত ২২ আগষ্ট। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়, বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড পান্নালাল সোমকে।তাঁর দেহ চলে গেলেও, চেতনার প্রস্তান হয়নি। কমরেডদের চেতনার রেনু প্রকৃতিতে মিশে থাকে। পরাগায়ন ঘটায়। হঠাৎ গনজাগরন মঞ্চে কিংবা স্কুল ইউনিফর্ম গায়ে তরুনদের রাজপথ কাঁপানো মিছিলে। মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, সুশাসন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত,একজন কমরেডের আত্মা স্বর্গপ্রাপ্তি কেও তাচ্ছিল্য করতে পারেন।

মোর লাগি করিয়না শোক, আমার রয়েছে কর্মফল, রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই, শুন্যেরে করিব পূর্ণ এই ব্রত বহিব সদাই’ হে কমরেড বিদায়।

 

 

 

 

 

 

 

হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব।
লেখক, সংগঠক, সাংস্কৃতিক কর্মী।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন