(এক)

কোলকাতার হাওড়া রেলষ্টেশন মানে চব্বিশ ঘন্টা মানুষের ভীঁড়। যাত্রীর সমাগম। বসা তো দূর দাঁড়াবার জায়গাই পাওয়া যায় না। তদূপরী ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি চলতেই থাকে। এমতবন্থায় হাওয়ায় ভেসে আসে ফ্যাচ্ ফ্যাচ্ করে কাঁন্নার শব্দ। মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল, কিশোরী কন্যা। সন্ধানী দৃষ্টি মেলে এদিক ওদিক দেখতে থাকি। এতবড় রেল ষ্টেশন। অনবরত একটার পর একটা যাত্রীবাহী ট্রেন এসে ঢুকছে ষ্টেশনে। তন্মধ্যে ক্রমাগত বিশাল জন সমুদ্রের ঢেউ উপছে পড়ছে গায়ের ওপর। সুস্থিরভাবে দাঁড়াতেই পাচ্ছি না। ইত্যবসরে দুটো লোকাল ট্রেন প্লাটফর্ম থেকে ছেড়ে দিতেই নজরে পড়ে. একটি যুবতী মহিলা বেঞ্চিতে বসে কাপড়ে মুখ ঢেকে কাঁদছে। ওর বেশভূষায় সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিলং করে বলে মনে হোল। কিন্তু ষ্টেশনে কেন?

স্বভাবসুলভ কারণে আমার প্রচন্ড কৌতূহল জেগে ওঠে। এক-পা দু-পা করে এগোতে থাকি। মেয়েটির কাছাকাছি পৌঁছতেই আমার ওকে চেনা চেনা মনে হোলো। একটু ঠাহর করে দেখতেই আমি চমকে উঠি।-আরে, এ তো অনিন্দিতা। আমাদের সাথে পড়তো। ও’ এখানে, এ অবস্থায়! কি হয়েছে ওর? এভাবে কাঁদছে কেন? কিন্তু ওর বিবর্তন চেহারা লক্ষ্য করে পড়ে যাই বিস্ময়ের ঘোরে। এতবড় উচ্চবিত্ত এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের গৃহবধূ রেল ষ্টেশনে বসে কাঁন্নকাটি করছে, কিন্তু কেন? ওর আশে-পাশেও কাউকে দেখছি না। ব্যাপারটা কি!

মনে আছে, অনিন্দিতার শুভ পরিণয়ের করুণ কাহিনী। কত কান্ড-কীর্তণ করে ওর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। যা কখনো ভোলার নয়। ওকে আমরা ‘নন্দিতা’ বলে ডাকতাম। নন্দিতার মুখাকৃতি ঠিক নেপালী মেয়েদের মতো। ওর নাক চোখমুখ একেবারে ভোতা। নেই বললেই চলে। ওর ঠোঁটের একটু উপরে শুধু ছিদ্র দু’টোই দেখা যেতো। তার মধ্যেই নাকে নোলক পড়তো। প্রতিদিন লাল ফিতে দিয়ে মাথার ঝুটি বাঁধতো। যেমন কয়লার মতো কালো কুঁচকুচে গায়ের রঙ, তেমনি মুক্তোর মতো ধবধবে সাদা ওর দন্তপংক্তি। তন্মধ্যে চোখদু’টো সামান্য ট্যাড়া। স্কুলের ছেলে-মেয়েরা সবাই হাসাহাসি করতো। ওর অলক্ষ্যে ওকে নিয়ে রঙ্গ ব্যঙ্গ করতো।
নন্দিতা মুখে কিছু না বললেও বুঝতে পারতো। ভিতরে ভিতরে বিব্রোতবোধ করতো। অপদস্থ হতো। বিশেষ করে মহিলা অঙ্গনে। মন-মানসিকতা সারাক্ষণ বিষাদে ছেয়ে থাকতো। কিন্তু ওর শরীর চর্চা এবং সুদর্শণ কেশ-বিন্যাশ ক্লাসের সবাইকে হার মানাতো। তেমনি ওর চমকপ্রদ প্রসাধনের বাহার। সাজতে খুব ভালো বাসতো। দু’হাত ভর্তি রঙ-বেরঙের কাঁচের চুড়ি, নাকে নোলক। একদম শাঁওতালী মেয়েদের মতো দেখতে লাগতো। তন্মধ্যেও ওর শান্ত-স্নিগ্ধ মুখমন্ডলে এক ধরণের সৌন্দর্য্য ছিল, লাবণ্যতা ছিল। শারীরের গঠনও ছিল আকর্ষণীয়। যা নিজেও জানতো না। তখন ও’ চৌদ্দ বছরের কিশোরী কন্যা, বাড়ন্ত শরীর। যৌবন যেন ছুই ছুই করছে। কিন্তু হাইস্কুলের গন্ডি পার হয়ে অমাবস্যার চাঁদের মতো সেই যে অদৃশ্য হয়ে গেল, প্রকাশ্যে আর দর্শণ দেয় নি। সবার অলক্ষ্যে নন্দিতা চুপিচুপি নাইট কলেজ করতো। এছাড়া বাড়ি থেকে কোথাও বের হতো না। সারাদিন মনমরা হয়ে চার-দেওয়ালের ভিতর পড়ে থাকতো। অথচ ওর মাতা-পিতার এতটুকু দুঃখ ছিল না। ওকে ‘নন্দু’ বলে ডাকতেন। ওনাদের দুইপুত্র আর নন্দিতা একমাত্র কন্যা। ওনাদের একান্ত ইচ্ছে ছিল, নন্দিতাকে সুশিক্ষায়-দীক্ষায় স্বাবলম্বী করে তুলবেন। এম.বি.বি.এস ডাক্তার হবে। জনগণের সেবা করবে। নন্দিতার চিকিৎসায়, সেবা-শুশ্রূষায় সুস্থ্য-সবল হয়ে উঠবে লাখো লাখো মানুষ। আত্মগর্বে বাবা-মায়ের বুক ভরে উঠবে। সার্থক হবে নন্দিতার জনম। এও কি কম সৌভাগ্যের কথা। কিন্তু একদিন তাদের আঙ্গিনাতেও যে সানাই বেজে উঠবে, বরযাত্রী আসবে, নন্দিতা ছাদনা তলায় যাবে, বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে, ঘর-সংসার হবে তা স্বপ্নেও কেউ কল্পনা করেনি। যেন শাপে বর। আশ্চর্য্যজনকভাবে ঘুরে গেল নন্দিতার ভাগ্যের চাকাটা।

অপ্রত্যাশিতভাবে একদিন হঠাৎ রায়চৌধুরী মশাই-এর (নন্দিতার পিতৃদেব) কাগজের একটি বিজ্ঞাপন নজরে পড়ে, “পাত্রী চাই।”
শহরের এক বিশাল ইন্ডাষ্ট্রিয়াল কোম্পানীর মালিকানার একমাত্র উত্তরাধিকারী। বংশের প্রতীক। অগাধ সম্পত্তির মালিক। পাত্রী কাজেকর্মে পারদর্শী কিংবা গুণবতী এবং সুদর্শণা বাঞ্ছণীয় নয়। কিন্তু তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বাক্যে ও ব্যবহারে সংযম অতি আবশ্যক। পাত্রীপক্ষ নির্দ্বিধায় ওয়েল-কাম। ঠিকানা…..!
শুধুমাত্র পাত্রের পরিচিতি। না ছিল পাত্রের বিবরণ, না ছিল পাত্রের শিক্ষাগত যোগ্যতার কোন ডিগ্রি, মেডেল।

অবিশ্বাস্যকর মনে হলেও রায়চৌধুরী মশাই বিষয়টি নিয়ে একটু চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু যখন ভেরিফাই করে দেখলেন, পাত্র হাত ছাড়া করলেন না। ভাবলেন, এই সুবর্ণ সুযোগ। মেয়ে আমার রাজরানী হবে। সুখে থাকবে। আভিজাত্যসম্পন্ন ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের কূলবধূ হবে, আর কি চাই! এ তো কল্পনাই করা যায় না।

পাত্রের গুণ বিচার না করে বিনা দর্শণেই রায়চৌধুরী মশাই এককথায় নন্দিতার বিবাহ পাকা করে ফেললেন। শুনে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই অবাক। বলে,-‘এ আবার কেমন বিয়ে? পাত্র-পাত্রীর মুখ দর্শণ হোলো না। একান্তে নিঃভৃতে দু’জনে মুখোমুখি বসে আলাপচারিতা হোলো না। পাত্র নিশ্চয়ই বোবা, কালা। কেউ বলে,-‘ল্যাংড়া-লুলা, হয়তো বা অন্ধ!’
আবার কেউ কেউ বলে,-‘দ্বিতীয় পক্ষও হতে পারে!’

হাজার প্রশ্নের ভীঁড় জমে ওঠে মানুষের মনে। -‘নিশ্চয়ই পাত্রের কোনো ক্ষোট আছে!’

দেখা গেল অনুমান একেবারে মিথ্যে নয়। পাত্রের চেহারা ও বেশভূষায় স্মার্ট্নেস্, ব্যক্তিত্বের ছাপ তো দূর, পুরুষ মানুষের কোনো লক্ষণই নেই। বড়লোক বাপের একমাত্র অলস কর্মবিমুখ হেবলাকান্ত পুত্র গোবরগণেশ রঘুনাথ আচার্য্য। যার নিজস্ব বিবেক-বুদ্ধি, বিচার-বিবেচনা ও ভালো-মন্দের বোধশক্তি তো নেই-ই, হৃদয়কে আকৃষ্ট করবার মতো বাহ্যিক সৌন্দর্য্যরে কোন বৈশিষ্ঠই পাত্রের নেই। এহেন নির্বোধ, ভাবলেশহীন, আবেগ-অনুভূতিহীন একজন অপদার্থের সাথে পবিত্র বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হবার চে’ সারাজীবন কুমারীত্ব নিয়ে বেঁচে থাকা ঢের ভালো।

নাঃ, এ বিয়ে হতে পারে না। নন্দিতা ছাদনা তলায় যাবে না। কক্ষনো না, কিছুতেই না, ইম্পসিবল। হোক সে লগ্নভ্রষ্ঠা, কুলক্ষণী। মাতা-পিতার মান-সম্মান হানী। নন্দিতার গায়ের রঙ কালো, কুৎসিৎ, দেখতে বিশ্রি, এটাই ওর অপরাধ? এই জন্যই ওর প্রতি এমন অবিচার? এতবড় ছলনা? বিশ্বাসঘাতকতা? ওর ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য নেই? ও’ কি চায় না চায়, একথা একবারও ভেবে দেখলো না কেউ!
গলায় দড়ি দিয়ে মরবে নন্দিতা। তবু এই নির্বোধ নিস্কর্মা অযোগ্য পাত্রের গলায় কখনোই সে মালা দেবে না। দিতে পারে না। স্পষ্ট কথা নন্দিতার।

রায়চৌধুরী মশাই সেকেলে মানুষ। সংস্কারপ্রবণ মন-মানসিকতা। বংশ পরস্পরা সামাজিক ও পারিবারিক চিরাচরিত রীতি-নীতি তিনি অনুসরণ করে আসছেন। তিনি সার্বিক বিচার-বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যা নেবেন, সেটাই সর্বশেষ বিবেচিত হবে। সেখানে অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম দেখা দিলে রায়চৌধুরী মশাই পারেন নি তা মেনে নিতে। শোনামাত্রই ওনার হার্টএ্যাটাক হয়। তিনি চেয়ে ছিলেন, কন্যার ঘর-সংসার, সুখী দাম্পত্য জীবন। ওনার একমাত্র কন্যাকে পাত্রস্থ করে তিনি মহাপ্রয়াণে শায়িত হবেন। পরলোকে গিয়ে তিনি মহাশান্তি পাবেন। এটাই ছিল ওনার একান্ত ইচ্ছা।

কিন্তু বিধি বাম। দায়ত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ রায়চৌধুরী মশাইএর একান্ত ইচ্ছা বিধাতার মঞ্জুর হোল না। অচীরেই দেখা দেয় বিপদ সংকেত। যমে মানুষে টানাটানি। নন্দিতার বিবাহ গেল চূলোয়। সানাই-এর পরিবর্তে রায়চৌধুরী বাড়িতে বেজে ওঠে অমঙ্গলের বাঁশী। রায়চৌধুরী মশাই এর প্রাণহানীর আশক্সকায় নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া।

রায়চৌধুরী পরিবারে কার যে নজর লেগে ছিল, প্রায় ছ’মাস মৃত্যুর সাথে লড়াই করে তিনি বিপদমুক্ত হলেন ঠিকই কিন্তু বাকশক্তি হারিয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। অগত্যা, পিতৃদেবের হৃদয়বিদারক দূরাবস্থার অনুতাপ অনুশোচনায় অবলীলায় নন্দিতাকে হেবলাকান্ত পাত্র রঘুনাথের সাথেই বিবাহের সম্মতি দিতে হয়ে ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য রঘুনাথের। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর হৃদয়পদ্মে জীবন দেবতার আসনে ওর এতটুকু ঠাঁই হোলো না। নন্দিতা পারে নি, রঘুনাথকে স্বামীরূপে গ্রহণ করতে। সর্বান্তকরণে মেনে নিতে। স্বামীর স্বীকৃতি দিতে। রঘুনাথ প্রতিনিয়ত স্বামীত্বের আধিপত্য ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। শুধু তাই নয়, নন্দিতার সবুজ সুকোমল হৃদয়ের ভক্তি-শ্রদ্ধা-প্রেম-ভালোবাসা, চাওয়া পাওয়া, কামনা বাসনা সবকিছু থেকে ক্রমাণ¦য়ে অবহেলিত হতে থাকে। রঘুনাথ ‘রাঙাবৌ’ বলে ডাক দিলে নন্দিতা কখনো সাড়া দিতো না। ওর সংস্পর্শেও কখনো আসতে দিতো না। সব সময় উপেক্ষা করে চলতো। অথচ কত ধূমধাম করে নহবৎ সাজিয়ে একেবারে রাজকীয় কায়দায় নন্দিতার শুভপরিণয় সুসম্পন্ন হয়েছিল। আমন্ত্রিত অথিতিরা উপস্থিত ছিলেন, শহরের এম.এল.এ, ম্যাডিক্যাল ডাক্তার, প্রফেসর, শিক্ষক-শিক্ষিকা, আইনজীবি, বিভিন্ন ধনী ব্যবসায়ী এবং গণ্যমান্য আরো অনেকে।

কথায় বলে,-‘অন্ধের কিই বা দিন, কিই বা রাত। অনুভব্যে রাত-দিন দুই-ই সমান।’

ঠিক তাই। প্রাণহীন, অর্থহীন সংসার নন্দিতার। ধূসর মরুভূমির মতো নিরস, নিস্প্রেম, নিরুৎসাহিত দাম্পত্য জীবন। সুখ নেই, আনন্দ নেই, হৃদ্যতা নেই, আন্তরিকতা নেই, ভালোবাসা নেই। নেই কোনো আকর্ষণ, জীবনে চাওয়া পাওয়ার স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা কিছুই নেই। শুধুমাত্র অর্থ-বিত্ত-ঐশ্বর্য্য কি সব! কিন্তু কতদিন? নন্দিতা রক্তে মাংসে গড়া সাধারণ একজন নারী। দেব-দেবী নয় যে, পাথরের মূর্তির মতো নীরব নির্বিকারে সহ্য করবে। কিইবা পরিচয় ওর? কুমারীও নয়, বিধাবাও নয়। তা’হলে?

(দুই)

নন্দিতার একঘেঁয়ে নিঃসঙ্গ নিরানন্দের জীবন। রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এলে একাকীত্বে নিরবিচ্ছিন্ন মনটা ওর ধূসর কূয়াশায় ছেয়ে যায়। মানসিক শূন্যতাবোধে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। একা লাগে। অগত্যা, একরাশ ক্ষোভ-দু:খ, মনবেদনায় তারুণ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে সুকোমল যৌবনে একান্ত কাক্সিক্ষত কামনা-বাসনার ইচ্ছা-আবেগ ও প্রেম-ভালোবাসার তীব্র অনুভূতিগুলির গলা টিপে পৃথিবীর সমগ্র মায়া-মোহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেছে নেয় নির্বাসিত জীবন। কখনো রঘুনাথের মুখপানে ফিরেও তাকাতো না। অথচ ওর আগমনেই অব্যক্ত আনন্দানুভূতিতে কি নিদারুণ এক অন্তর্নিহীত তাৎপর্য্য সৃষ্টি হয়েছিল রঘুনাথের দেহে এবং মনে। যখন ওর ভাষায় বয়ান করবার মতো ক্ষমতা ছিল না। বোঝাবার ক্ষমতা ছিল না। আর ছিল না বলেই নন্দিতার প্রেম-ভালোবাসা, আবেগ-ইচ্ছানুভূতিগুলি যখন এতিমের মতো গুমড়ে গুমড়ে মাথাকূটে কেঁদে মরছিল, একই ছাদের নীচে বসবাস করেও তখন কি নীরব নির্বিকার আচরণ রঘুনাথের। মুহূর্তের জন্যেও কখনো ওর হৃদয়কে কাঁপায় নি, রেখাপাত করে নি। কখনো ভাবান্তরও হয় নি যে, দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর নিবিড়তম সম্পর্ক কত মধুর, কত আনন্দদায়ক এবং কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। এমনকী কখনো চৈতন্যেদয়ও হয় নি, মনুষ্য জীবনে দু’টি মানব-মানবীর আভ্যন্তরীণ সম্পর্কের গোপন রহস্যই বা কি!

মানুষ পরিবর্তনশীল। সময়ের বিবর্তনে পৃথিবীর রূপ, রঙ যেমন বদলে যায়, ঠিক তেমনই সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে ঋতুর মতো বদলে যায় প্রতিটি মানুষ। মানুষের জীবন। তাদের ধ্যান-ধারণা, নিজস্ব রুচীবোধ, মন-মানসিকতা। যেমন করে বদলে গেল নন্দিতার নির্বোধ নিস্কর্মা আনস্মার্ট হেবলাকান্ত স্বামী রঘুনাথ আচার্য্য। স্বয়ং বিধাতাই বুঝি ওর উপর ভর করেছিল, তা কে জানে!

দেখা গেল, সময়ের বিবর্তনে রঘুনাথের অভাবনীয় রূপের দর্শণে শুধু বিস্মিতই নয়, প্রত্যেকটি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চুম্বকের মতো। একেবারে অভিভূত হয়ে কল্পনায় দেখতে থাকে, বিগতদিনে রঘুরাথের শিশুসুলভ আচরণের সেই দৃশ্যগুলি। যখন কারণে অকারণে হেঃ হেঃ করে হাসতো। দাঁতে খুঁট খুঁট করে নখ চিবোতো। কে দেখলো, কি ভাবলো, কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিল না। না ছিল সুষ্পষ্ট সুন্দর সাবলীলভাবে গুছিয়ে কথা বলার ঢং, না ছিল চলার ঢং। তন্মধ্যে সাংঘাতিক তোতলায়। যা ওকে অপছন্দ করার একটা কারণ। তদুপরী ওর পরিধানের একমাত্র বস্ত্র ছিল ফোতুয়া আর পায়জামা। পায়ে স্যান্ডেল। শুট-টাই তো দূর, কখনো বুট জুতো পড়ে হাঁটতেই পারতো না।

কথায় বলে,-‘সোনা ব্যাকা হলেও সেটা সোনাই। তার মূল্য কখনো কমে যায় না।’

ঠিক তাই। শত হলেও রঘুনাথ একজন পুরুষ মানুষ। বিবেক-বুদ্ধির বিকাশ সম্পূর্ণ না ঘটলেও শরীরে ফিটনেস আনার জন্য নিয়মিত জিমে যাওয়া শুরু করলে একজন হাট্টা গাট্টা সুঠাম সুদেহী তরুণ যুবকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তিন বছর বৈবাহিক জীবনে প্রিয়তমা স্ত্রী বনাম নারীর কোমল সান্নিধ্যে যেতে না পারলেও নারীজাতি সম্পর্কে অন্তত কিছুটা জ্ঞান প্রাপ্তী ঘটেছে বৈাক! তাতে ওর শরীরে ও মনে প্রভাব পড়ে। প্রতিক্রিয়াও ঘটে। যখন দৃঢ়ভাবে জানতে ও বুঝতে সক্ষম হয়, ওর রাঙাবৌ নন্দিতা এয়োস্ত্রীর কোনো ধর্ম পালন করে না। সংসারের কোনো রীতি-নীতি মানে না। রঘুনাথকে মানুষ বলে গণ্য করে না। এসবের প্রতিবাদ করার ওর কি কোনো অধিকার নেই? শ্বশুড়বাড়ি পছন্দ না হোলো বাপের বাড়ি চলে গেলেই তো পারে!
কিন্তু তখন ওর অভাব ছিল সাহসের। কতবার দৃঢ় মনে পরিকল্পনা করেছিল, একদিন স্বামীত্বের দাবী নিয়ে সশরীরে নন্দিতার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াবে। নিজের আইনত অধিকার ছিনিয়ে নেবে। কিন্তু ভয় হোতো অশান্তির। আচার্য্য পরিবারে তামাশা হোক, পাড়ার লোক জানাজািন হোক, হাসাহাসি করুক, মাতা-পিতার মান-সম্মান ক্ষূন্ন হোক, এসব কোনমতে বরদাস্ত করতে পারবে না রঘুনাথ। অগত্যা, সর্বদা নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। পেইসেন্স রাখে। অপেক্ষা করে থাকে সময় আর সুযোগের।
এভাবেই ধীরে ধীরে একটু একটু করে সম্পূর্ণ বদলে যায় রঘুনাথ। ততদিনে মনের শক্তি বাড়ে। মনের দৃঢ়তা বাড়ে। নিজের উপর আস্থা রাখে। ওর চাল-চলন, কথাবার্তা, বেশভূষায় মনে হয় যেন কোনো অজ্ঞাত কূলশীল ব্যক্তি। ফতুয়ার পরিবর্তে পরিধানে লেদারের জ্যাকেট, জিন্সের প্যান্ট। হাওয়ায় উড়ছে আতরের গন্ধ। চোখে দামী ফ্রেমের সান্গ্লাস। পায়ে ফ্যাশেনাবল জুতো। একগাল ধোঁয়া ছেড়ে নায়কসুলভ আচরণে প্রসন্ন মেজাজে গাড়ি থেকে নামতেই চমকে ওঠে পাড়া-প্রতিবেশী। চমকৃত করে প্রতিটি মানুষকে। একেবারে এতখানি পরিবর্তন? এ অসম্ভব সম্ভব হোলো কেমন করে?

দৃশ্যটি অবিশ্বাস্যকর হলেও সেটি ছিল সম্পূর্ণ বাস্তব সত্য এবং অবিস্মরণীয়। চেনাই যাচ্ছে না রঘুনাথকে। ঘন তৃণের মতো দুইবাহু ভর্তি পশম। গালের দু’পাশে সুসজ্জিত দাড়ি। সর্বোপরী ওর উজ্জ্বল গৌরবর্ণের মুখাকৃতিতে পৌরষের আবির্ভাবে আভিজাত্য ও মিশ্রব্যক্তিত্বের প্রগাঢ় ছাপটাই শুধু লক্ষ্যণীয় নয়, প্রশংসণীয় বটে। চোখে তাক লেগে যায় সবার। আর সেটা প্রমাণিত করতে রঘুনাথ দৃঢ়ভাবে মনস্থির করে, বিগত দিনগুলি ভুলে গিয়ে জীবনকে নতুন করে নতুন রঙে সাজাবে। বিবাহ বন্ধন সূত্রে রঘুনাথ আজ ন্যায্য অধিকারের দাবীদার। একদিন সরাসরি রাঙাবৌ নন্দিতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে দুহাত প্রসারিত করে প্রেম আহ্বান জানাবে। শ্বাশ্বত লজ্জায় রাঙাবৌ এর মুখখানা নূয়ে পড়লে সজোরে ওর উষ্ণ বক্ষে প্রেমালিঙ্গনে ওকে জড়িয়ে ধরবে। আবার পরক্ষণেই ভাবে, ওইবা হার মানবে কেন? কেনই বা নিজের আত্মসম্মান ক্ষুন্ন করবে! ওতো কোনো অপরাধ করেনি! কখনো অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করেনি! কিন্তু রঘুনাথ কিছুতেই নিজের মনকে পোষ মানাতে পারেনা। নন্দিতার ঘরে ঢুকলেই ওর মনকে কেমন দুর্বল করে দেয়। অদ্ভুদ একটা শিহরণে শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলিতে একটা ঝটকা লাগে। হঠাৎ অদৃশ্য এক মায়ায় গভীরভাবে লিপ্ত হয়ে অনুভব করে, মনের মধ্যে রস সঞ্চার হবার একটা তীব্র অনুভূতি। যা পূর্বে কখনো এমন ঘটেনি। এক অভিনব আনন্দানুভূতি কখনো অনুভব করে নি। বিস্মিত হয় মনে মনে। প্রশ্ন করে নিজেকে, এর নামই কি প্রেম, ভালোবাসা? ভালোবাসায় এতো আনন্দ?

শাস্ত্রে বলে,-“জগতে নারীই হলো সৃষ্টির প্রধান উৎস।”

একজন মমতাময়ী বিদূষী নারীর আবেগমিশ্রিত কোমল স্পর্শ শুধু মধুময়ই নয়, মিরাকলও বটে। যার শান্ত-স্নিগ্ধ-শীতল ছায়াতলে একজন বিবাহিত পুরুষ মানুষের সুখ আর মনের শান্তি সর্বদা বিরাজ করে। কিন্তু কখন? যখন দু’টি মানব-মানবীর আত্মার মধুর মিলনে লীন হয়ে জন্ম নেয় স্বচ্ছ, পবিত্র এবং সুকোমল ভালোবাসা। কিন্তু রঘুর সাথে কোন সম্পর্কই তো নেই নন্দিতার। তা’হলে?

অনেকের ধারণা, কোনো ডাক্তার, কবীরাজ কিংবা ওঝাবৈদ্য নয়, ধৈর্য্যশীলা, সহনশীলা পতিব্রতা স্ত্রীর মধুর ও কোমল সান্নিধ্যেই বদলে গিয়েছে রঘুনাথ।

অথচ এতো কিছু ঘটে যাচ্ছে নন্দিতার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। একই ছাদের নীচে বসবাস করেও রঘুর কিভাবে দিন কাটছে, কিভাবে রাত অতিবাহিত করছে, ওর কোনো খবরই রাখে না। ওর প্রতি এতটুকু আগ্রহ নেই। উৎসাহ নেই। আকর্ষণ নেই। এমনকী ওর মুখের দিকেও কখনো তাকায় নি। কিন্তু পরিবারের একজন সদস্য বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলে সেটা দৃষ্টিগোচর হওয়া খুবই স্বাভাবিক। যা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি নন্দিতা। সন্ধ্যের পর থেকে নোটিশ করছে, রঘুনাথের কোনো সাড়া শব্দ নেই। এমনিতেই ও’ কথা কম বলে। যেটুকু বলে বাড়ির চাকর বাকরের সাথেই বলে। আজ ওরাও বাড়িতে কেউ নেই। সব দেশে গেছে বেড়াতে। রঘুনাথের মাতা-পিতাও বেরিয়েছেন তীর্থ যাত্রায়। গয়া, কাশি, বৃন্দাবন ঘুরে তবেই ফিরবেন। তাই বোধহয় একটু বাইরে ঘুরতে বেরিয়েছে। অন্ধকার নেমে এলেই ফিরে আসবে ক্ষণ। কিন্তু কোথায় রঘু?

সময় ক্রমশ বয়ে যায়। সন্ধ্যে পেরিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। চারদিক অন্ধকার। রঘুনাথকে ঘরে বাইরে কোথাও নজরে পড়ছে না। এতবড় দালান বাড়ি, জন শূন্যতায় একেবারে খাঁ খাঁ করছে। রাস্তার কুকুরগুলি সমানে ঘেউ ঘেউ করছে। কেঁপে উঠছে নন্দিতা। গা ছম ছম করছে। কোনো পাত্তা নেই রঘুর। নন্দিতা সারারাত নীরব বোবা কাঁন্নায় দু’চোখের পাতা এক করতে পারে নি। মনের সাথে নানান দ্বন্দ্ব, দ্বিধায়, দুঃশ্চিন্তা ভাবনায় হৃদয়ের কোণে জমে থাকা পূঞ্জীভূত সমস্ত গ্লানি, ক্ষোভ, দুঃখ, মান-অভিমান, অভিযোগ সব কখন যে দূরীভূত হয়ে যায়, টেরই পায়নি। ঝড়ে যায় ওর শারীরিক, মানসিক অবসাদ, বিষন্নতা। পড়ে যায় টেনশনে। কিছু না বলে, না জানিয়ে কোথায় গেল রঘু!
কিন্তু কি আশ্চর্য্য, হঠাৎ এক সীমাহীন ইচ্ছানুভূতির অতল গহ্বরে ক্রমশ তলিয়ে যায় নন্দিতা। খুঁজে পায়, জীবনের প্রকৃত অর্থ। আবিস্কার করে বেঁচে থাকার সাধ। আজ যেন ও’ প্রকৃতিতে সম্পূর্ণ বিসর্জিত। নিয়তির কাছে আত্ম সমর্পিত। স্বপ্নের কাছে ধরাশায়ী। মন-বাসনার প্রকোষ্টে কারাবন্দি। যেন নিবেদিত প্রাণ। মন-মানসিকতার কি অদ্ভুদ বৈপরীত্য আজ নন্দিতার। ইচ্ছে করছে, মুক্ত-বিহঙ্গের মতো দূর নীলিমায় হারিয়ে যেতে। পুর্ণোদ্যামে খুশীর পাল তুলে জীবন জোয়ারে ভেসে বেড়াতে। আরো কত কি!
হঠাৎ পতিব্রতা, পবিত্রতা ও কোমলতায় ওর এই আকুলতাকে উপেক্ষা করে এতো মায়া-মমতা আর ভালোবাসার তীব্র অনুভূতিগুলি এতদিন কোথায় যে লুকিয়ে ছিল নন্দিতার, ও’ নিজেও জানে না। ভিতরে ভিতরে অনুভব করে, এক অভিনব ইচ্ছানুভূতির তীব্র জাগরণ। কি নিদারুণ এক শিহরণ। একটা কোমল অনুভূতি। যা রক্তের স্রোতের মতো ওর সমস্ত শিরা-উপশিরায় সঞ্চালিত হতে থাকে। ছুঁয়ে যায় ওর হৃদয়পটভূমি। শুনতে পায় প্রাণস্পন্দন। যা কল্পনা শক্তিকে উদ্দীপ্ত করে। বিকশিত করে। আর সেটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে গিয়ে অবলীলায় শরীরের সমন্ত অনুভূতি দিয়ে তিন বছরের বৈবাহিক জীবনে নন্দিতা প্রথম অনুভব করে, রঘুনাথকে ভালোবাসার একটা মধুর আবেশ ছড়িয়ে পড়ছে ওর দেহে, মনে। জমে ওঠে হাজার প্রশ্নের ভীঁড়। সে এক ব্যাখ্যাতীত ভাবনার উৎপত্তি হয় ওর মস্তিস্কের স্নায়ুকোষে। কিছুতেই ভেবে কূল পায়না, এতদিন যাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো. অবজ্ঞা করতো। প্রতিনিয়ত যাকে উপক্ষো করে চলতো, আজ তাকেই একপলক দর্শণের অপেক্ষায় মন প্রাণ ওর আনচান করে উঠছে। মরিয়া হয়ে উঠছে। ওর কি আজ সত্যিই রঘুর জন্য মন কেমন করছে? রঘুকে আপনার করে কাছে পাওয়ার জন্যই কি ওর মন প্রাণ এমন ছটপট করছে? তবে কি সত্যিই রঘুনাথকে ভালোবেসে ফেললো নন্দিতা? ও মাই গড্! ইট ইস আনথিঙ্কেবল! আনবিলিএবল! সূর্য্য কি আজ পশ্চিম দিকে উঠেছে না কি?
(তিন)

ভাবনার অতল সাগরে বিচরণ করতে করতে নন্দিতার অগোচরে সুদীর্ঘ রজনী কখন যে পেরিয়ে চলে গিয়েছে ভোরে, ওর হুঁশ নেই। জানালার পর্দা ভেদ করে ঊষার আলো এসে পড়েছে বিছানায়। রঘুনাথ তখনও নিখোঁজ। কোনো পাত্তা নেই ওর। সন্ধ্যে থেকে এতবড় একটা রাত প্রায় আট ন’ঘন্টা পার হয়ে গেল, রঘুনাথ বাড়িতে নেই। যা পূর্বে কখনো ঘটেনি।
অজানা আশক্সক্ষায় অপ্রস্তুত নন্দিতা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। ওর ঠোঁট কাঁপে। বুক কাঁপে। কি করবে, কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে, কিছুই স্থীর করতে পারে না। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় খাঁচার পাখীর মতো দোতলার বারান্দার এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারী করতে থাকে। গাড়ির আওয়াজ শুনলেই রঘুনাথ এসেছে ভেবে দৌড়ে সদর দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। মনে মনে বলে,-ওকে জবাব দিতেই হবে, কেন এতবড় শাস্তি দিলো?

কিন্তু কোথায় রঘু? কেউ কোথাও নেই। নন্দিতা ভয়ার্ত কণ্ঠে স্বগতোক্তি করে ওঠে,-‘তবে সারারাত রঘু গেল কোথায়? বাড়ি ছেড়েই চলে যায় নি তো! হে ভগবান, ওকে রক্ষা করো। রাস্তাঘাটও ঠিকমতো চেনে না। কোথায় গিয়ে আঁটকে থাকবে, কেউ জানবে না। যদি সত্যিই তাই হয়, রঘুকে কোথায় খুঁজবে! কোথায় যাবে! ভাগ্যিস বাড়িতে আজ কেউ ছিল না। নইলে এতক্ষণে হৈচৈ পড়ে যেতো। কিন্তু রঘুনাথ? ওকে এখন কোথায় খুজে পাবে!’

আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে গলার স্বর ভারি হয়ে আসে নন্দিতার। অপরাধীর মতো কাঁন্নাজড়িত কণ্ঠে বলে ওঠে,-‘এ আমায় কি শাস্তি দিলে রঘু! একটিবার আমাকে ইনফর্ম করতে পারলে না! তোমায় খুঁজে পাওয়া না গেলে কি জবাব দেবে নন্দিতা? কি কৈফেয়ৎ দেবে ও’? পাড়ার লোকজন সব জানাজানি হয়ে যাবে যে!
বলতে বলতে আবেগ ও উদ্বেগের সংমিশ্রণে মোমের মতো গলে যায় নন্দিতা। দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে বলে,-‘নাঃ, কিছু একটা করতেই হবে। যেভাবেই হোক, রঘুনাথকে খুঁজে বের করতেই হবে!

রাত পোহাতেই ঊষার প্রথম সূর্য্যরে স্নিগ্ধ নির্মল কোমল আলোয় রঘুনাথকে খুঁজতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে নন্দিতা। কিন্তু এতবড় শহর, শহরের চারদিকে মানুষের ভীঁড়। যানবাহনের ভীঁড়। রঘুনাথকে কোথায় খুঁজবে! কার কাছে যাবে! ওর কোনো বন্ধু-বান্ধবও নেই। কিন্তু নন্দিতা ওকে খুঁজে পাবে কোথায়? রঘুনাথ বাড়ি থেকেই বের হয়নি কোথাও। গতকাল সন্ধ্যের পর তিনতলার ঠাকুরঘরে কখন যে ঢুকে বসে ছিল, নন্দিতা জানেই না। বেচারা মানসিক ক্লান্তিতে ঠাকুরঘরেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ডিনার করতেও ওঠে নি। সারারাত ঠাকুরঘরেই ঘুমোচ্ছিল। দিনের আলো ফুটে উঠতেই প্রতিদিনকার মতো যথারীতি ঘুম ভেঙ্গে যায় ওর। চোখ মেলে দ্যাখে, ও’ ঠাকুরঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে। রঘুনাথ লাফ দিয়ে ওঠে। দারজা খুলে ঠাকুরঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসে। সদর দরজার আওয়াজ শুনে উপরতলা থেকে গলা টেনে নীচে তাকিয়ে দ্যাখে, রাঙাবৌ নন্দিতা উদ্ভ্রান্ত হয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্রুত জামা প্যান্ট পড়ে নন্দিতার পিছু পিছু রঘুনাথও বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। অথচ তখনও জানে না রাঙাবৌ নন্দিতা যাচ্ছে কোথায়!

ঊষার প্রথম প্রহর। বাইরে বেশ মনোরম আবহাওয়া। ঝুরু ঝুরু মিহিন বাতাস আমোদিত হয়ে আছে রঙবেরঙের ফুলের সৌরভে। প্রকৃতির বুকে যেন নেমে এসেছে রাশি রাশি উচ্ছাস, আনন্দোৎচ্ছলতা। পূর্ব দিগন্ত জুড়ে আবির লালে বিকশিত করা তরুণ সূর্য্যরে শান্ত, স্নিগ্ধ কোমল নির্মল হাসোৎজ্জ্বল একটি আনন্দময় সকাল, একটি নতুন দিন। যেদিকে তাকায় সবই নতুন লাগে, ভালো লাগে। সর্বত্রই যেন এক অভিনব বৈচিত্র্যের সমাহার, অভিনবত্বের পসরা। অপূর্ব! মনে হয় সমগ্র পৃথিবীটা যেন এক অভাবনীয় বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য্যে ঘেরা। যার চারদিকে এক বর্ণনাতীত ভালোলাগার উপাদানে আচ্ছাদিত এবং সমৃদ্ধ।
প্রকৃতির মন মাতানো রূপ বৈচিত্র্যের মুগ্ধতা ও উচ্ছাসে অব্যক্ত ভালোলাগার আবেশ দেহে, মনে ছড়িয়ে পড়ে রঘুনাথের। স্বতঃস্ফূর্ত মনে সুরের মূর্ছণায় একটি অটোরিক্সায় চেপে বসে। নন্দিতাকে ফলো করতে করতে ভিক্টোরিয়া ম্যামোরিয়াল হয়ে ইডেন গার্ডেনে এসে প্রাতঃভ্রমণের এক নতুন অভিজ্ঞতায় ওকে অত্যন্ত চমকৃত করে। মনকে করে প্রভাবিত। দেখা দেয় প্রতিক্রিয়া। যা সম্পূর্ণ নতুন চেতনা, এক নতুন বিস্ময়। কিন্তু কিছুতেই ভেবে কূল পায় না, এই সাত সকালে রাঙাবৌ নন্দিতা যাচ্ছে কোথায়?
নন্দিতার পিছু পিছু সারা শহর ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে প্যেঁছায় হাওয়া রেল ষ্টেশনে। চারদিকে প্রচন্ড মানুষের ভীঁড়, যাত্রীর ভীঁড়। কিন্তু ভীঁড়ের মধ্যে হাঁটাচলা রঘুনাথের একদম অভ্যেস নেই। কখনো প্রয়োজনই হয়নি। তন্মধ্যে নন্দিতাকে অবজার্ভ করা, রঘুনাথের পক্ষে খুবই মুশকিল। অগত্যা, কোনো অপশনই নেই ওর। মনে মনে অস্বস্তিবোধ করলেও যাত্রীর ভীঁড় ঠেলে রঘুনাথ এগোতে থাকে। কিন্তু মুহূর্তের এ্যাবসেণ্ট মাইন্ডের কারণে ভীঁড়ে মধ্যে দুজনে দুদিকে ছিটকে যায়। নন্দিতাকে ওর আশেপাশে কোথাও নজরে পড়ছে না। রঘুনাথ পড়ে যায় বিপাকে। কোন দিকে যাবে, দিক নির্ণয় করতে পারে না। রঘুনাথ উন্মাদের মতো হন্যে হয়ে সন্ধ্যানী দৃষ্টি মেলে প্ল্যাটফর্মের এমাথা থেকে ওমাথা খুঁজতে থাকে। ইত্যবসরে হঠাৎ কাকে যেন দেখতে পেয়ে ’রঘু’ বলে ডেকে ওঠে নন্দিতা। একেবারে অবেগমিশ্রিত কণ্ঠস্বর। মান-অভিমান, অনুযোগ, অভিযোগের লেশমাত্র নেই ওর কণ্ঠস্বরে।
অবিশ্বাস্য হলেও থমকে দাঁড়ায় রঘুনাথ। দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত হয়, নন্দিতা প্ল্যাটফর্মেই আছে। ষ্টেশন ছেড়ে যায় নি। তার পর মুহূর্তেই একরাশ বিস্ময় নিয়ে মনে মনে বলে,-‘কিন্তু তাই বা কিকরে সম্ভব! কথা বলা তো দূর, নন্দিতা ওকে সহ্যই করতে পারে না। প্রচন্ড হেট করে। মানুষ বলেই গণ্য করে না। আজ বাড়ি ছেড়ে এতদূরে এসে, এ তো ভূতের মুখে রাম নাম। না, না, এ হতে পারে না। সব মনের ভ্রম।

ততক্ষনে দুটো তিনটে লোকাল ট্রেন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেড়ে যেতেই ষ্টেশনের ভীঁড় খানিকটা হাল্কা হয়। রঘুনাথ কয়েকজন যাত্রীর ফাঁক-ফোকর দিয়ে দেখতে পায়, একটু দূরে একটা বেঞ্চিতে বসে কাকে যেন খুঁজজে নন্দিতা। ওর চোখেমুখে বিভীষিকা, মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। মুখখানাও শুকিয়ে একেবারে গর্তে ঢুকে গিয়েছে। সাজ-সজ্জার বালাই নেই। কেশ-বিন্যাশ এলোমেলো। প্রসাধনে অর্ডিনারী শাড়ি। খুব অস্বাভাবিক লাগছে। ব্যাপারটা কি!

স্বস্তি পায় না রঘুনাথ। প্রচন্ড বিচলিত হয়ে পড়ে। হবারই কথা। শত হলেও নন্দিতার বিবাহিত স্বামী ও’। রীতিমতো শাস্ত্র মতেই মন্ত্র উচ্চারণে পবিত্র বিবাহ বন্ধনে দুজনেই আবদ্ধ। দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক না থাকলেও একই বাড়িতে একই ছাদের তলায় বাস করছে দুজনে। নন্দিতার প্রতি ওর একটা দায়িত্ব আছে। কর্তব্য আছে। ওকে এ অবস্থায় এতবড় রেল ষ্টেশনে একা রেখে যাওয়া…..!
আর ভাবতে পাচ্ছে না রঘুনাথ। বৈবাহিক জীবনের দীর্ঘ তিন বছর পর আজ ও’ নন্দিতার খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। মাত্র কয়েক ফুট দূরত্বের ব্যবধান। যার অপেক্ষায় রঘুনাথ এতদিন প্রহর গুনছিল। এই সুবর্ণ সুযোগ, নন্দিতাকে ইম্প্রেস করার। ওর সুকোমল হৃদয়ে ঠাঁই করে নেবার। কিন্তু নন্দিতার মিস বিহেইভ সম্পর্কে ওর অজানা নয়। ওকে আন্ডার এষ্টিমেট করবে জেনেও, লুক ডাউন করবে জেনেও, রঘুনাথ সরাসরি নন্দিতার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। মার্জিত কণ্ঠে বলে,-‘তুমি ষ্টেশনে কি করছো নন্দিতা? কাউকে রিসিভ করতে এসেছ বুঝি?’

রঘুনাথ কথা বলছে ঠিকই কিন্তু শ্বাশত লজ্জা আর আবেগের সংমিশ্রণে অপ্রস্তুত নন্দিতার ব্যতিক্রম মুখাবয়ব লক্ষ্য করে ওর বুঝতে কিছু আর বাকী থাকে না। অথাৎ কাহিনীর ক্লাইমেক্স ওকে অত্যন্ত বিস্মিত করে। যা কখনো কল্পনা করে নি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে অভিমানে ফেটে পড়লেও প্রচন্ড ইমোশনাল হয়ে পড়ে। আবেগের প্রবণতায় আপ্লুত হয়ে প্রেমিকসুলভ কণ্ঠস্বরে বলে ওঠে,-‘কথা বলো নন্দিতা। এক্ষুণিই লোকজন এসে ভীঁড় করবে। সেটা কি ভালো হবে।’

ওদিকে রঘুর কথা শেষ না করেই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে নন্দিতা। নিজের কানদুটোকে কিছুতেই ওর বিশ্বাস হয় না। মনে মনে বলে, এ কি, রঘুনাথ? ও’ এখানে? এলো কোথা থেকে? তবে কি সত্যিই ও’ বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল? কোথায় যাচ্ছে ও’?
কিন্তু এসব কথা নন্দিতা বলবে কিসের জোরে? কোন সূত্রে? কোন অধিকারে? কোনো সম্পর্কই তো রাখেনি। যাকে এতদিন স্বামীর দরজা দেয়নি। যার মুখপানে কখনো চোখ তুলে চেয়ে দ্যাখে নি।

পলকমাত্র দৃষ্টিপাত করেই শরমে চোখের পাতাদু’টো চকিতে নূয়ে পড়ে নন্দিতার। বিড় বিড় করে বলে,-‘জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে না কি ও’! এ-ই ওর সেই রঘুনাথ? ওর অবহেলিত, নিগৃহীত স্বামী? ভাবাই যায় না। একেবারে আমূল পরিবর্তন ওর! এ কেমন করে সম্ভব হোলো? কিন্তু ওতো আজ নিজেই রঘুর কাছে ধরা পড়ে গেল। কি বলবে এখন ও’! কি জবাব দেবে! বলার আর বাকী থাকে কিছু!
আজ ওর মনে হয়, সৃষ্টিকর্তা রঘুকেই ওর জীবন সঙ্গী রূপে পাঠিয়েছেন। ওই ওর পরিপূরক। ওই ওর জীবনের সব। ওকে অস্বীকার করা সাধ্য কার। কিন্তু আবেগ-অনুভূতিহীন নিরস নিরুচ্ছাস, নি¯েপ্রম রঘুর হৃদয় আকাশেও যে একদিন ভালোবাসার গ্রহণ লাগবে, প্রেমের পত্তন ঘটবে, তা কখনোও আশা করে নি। অথচ ভিতরে ভিতরে দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের টানাপোড়ণে মুখ তুলে তাকাতেই পারছে না নন্দিতা। আজ এতদিন পর শরীরের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে অনুভব করে, ওর বৈবাহিক জীবনের পূর্ণতা। সার্থকতা। খুঁজে পায় নারীর অস্তিত্ব, আপন সত্ত্বা। স্ত্রীর পূর্ণ মান-মর্যাদা।

ইতিমধ্যে মৃদুস্বরে রঘুনাথ বলে ওঠে,-‘বাড়ি চলো রাঙাবৌ।’ বলে ডান হাতটা প্রসারিত করে দেয়।
চকিতে অব্যক্ত ভাষায় উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো চোখের তারাদু’টি জ্বলজ্বল করে ওঠে নন্দিতার। বিস্ময়ে অভিভূতের মতো বড় বড় চোখ মেলে রঘুর মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে।
প্রসন্ন হয়ে রঘুনাথ বলে,-‘কই, এসো! এতো কি ভাবছো। এসো, এসো, উঠে এসো।’
সলজ্জে দ্রুত এগিয়ে এসে রঘুনাথের বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে নন্দিতা। ফিস্ ফিস্ করে বলে,-‘তোমার রাঙাবৌকে একা ফেলে কোথায় যাচ্ছিলে রঘু?’
অস্ফূট হেসে ফেললো রঘুনাথ। গভীর সংবেদনশীল দৃষ্টি মেলে বলল,-‘আমি তো কোত্থাও যাই নি রাঙাবৌ।’
-‘তবে কাল সারারাত কোথায় ছিলে?’
একগাল হেসে রঘু বলল,-আমি তো গতকাল সারারাত ঠাকুরঘরেই শুয়ে ছিলাম। কখন চোখ লেগে গিয়ে ছিল, টেরই পাই নি।’
বড় বড় চোখ মেলে নন্দিতা বলে,-তাহলে এতো সকালে ষ্টেশনে এলে কি করে?
-`সে তো তোমায় দেখতে পেয়ে পিছু পিছু ফলো করে ষ্টেশনে চলে এসেছি।’

‘এ্যাঁ?’ বলে অপরাধীর মতো ক্ষমা প্রার্থীর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।
নন্দিতাকে প্রেমালিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে রঘুনাথ বলল,-‘জো হুয়া, সো হুয়া। আব ভুল যাও। চলো, ফিরসে শুরু করে জীবন।’
-‘ও.কে জী। আও চলে।’ বলে হোঃ হোঃ করে দুজনেই হেসে ওঠে। হাসিটা বজায় রেখে পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে হাওড়া রেল ষ্টেশনের বিশাল যাত্রীর ভীঁড়ে মিলিয়ে গেল দুজনে।

সমাপ্ত

(ছবি:- সৌজন্যে কালের কন্ঠ)

যুথিকা বড়ুয়া : টরন্টো প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন