বেশ কয়েকদিন ধরে একটানা কাজ করে হাঁপিয়ে উঠেছিল সেঁজুতি । তাই অফিস থেকে বহু কষ্টে একদিনের ছুটি ম্যানেজ করেছে নিজের জন্য অনিমেষের ছুটির সাথে মিলিয়ে। সেঁজুতির ইচ্ছা সারাদিন দু’জন মিলে একটু ভাল সময় কাটাবে । বাইরে ঘুরবে । দুপুরে একসাথে কোন ভাল রেস্টুরেন্টে পছন্দের খাবার খাবে। কথার ফুলঝুড়ি ছুটাবে। কিন্তু সকালে অনিমেষকে ঘুম থেকে ডাকতেই সে বেশ বিরক্ত হয়ে বললো “ আজ অফিসে যাবে না? সকাল সকালেই এত ডাকাডাকি করছো কেন? আমাকে একটু ঘুমাতে দাও প্লিজ।“ সেঁজুতির অনিমেষের এমন কথায় ভীষণ মন খারাপ হলো। কেন না সেঁজুতির প্লানটা অনিমেষকে আগেই বলেছিল। কিন্তু অনিমেষ একদমই ভুলে গেছে। তাই সেঁজুতি আর কোন কথা না বাড়িয়ে নিজে রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়লো বেশ কিছুটা অভিমান নিয়ে। সে নিজের গাড়ীটা একটা Go Train Station এ পার্ক করে রেখে টিকেট কেটে উঠে বসলো এক্সপ্রেস ট্রেনে। অনেক দিন ট্রেনে উঠা হয় না।তাই আজকের দিনের সুজোগটা হাতছাড়া করা যায় না। সে ট্রেনে উঠার সাথে সাথেই ট্রেন চলতে শুরু করলো।

অনিমেষের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে। যদিও ওরা দুজন পড়তো ভিন্ন ডিপার্টমেন্টে । কিন্তু লাইব্রেরীতে বসে নোট করার সময়ে ধীরে ধীরে কাছে আসা। ভাল লাগা । অতঃপর বিয়ে। তারপর একটা সময়ে জীবনের প্রয়োজনে বিদেশে পাড়ি জমানো। তাদের দুজনের ছোট্ট সংসারে অভাব হানা দিতে পারেনি কখনো। কিন্তু ব্যস্ততা যেন দুজন মানুষকে করে দিয়েছে অনেক অনেক দূরের। অনিমেষকে মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না সেঁজুতি । ওর কেবলই মনে হয় কি হবে এত ধন সম্পদ দিয়ে। যদি নিজের মত করে সময়কে না উপভোগ করা যায়! যে মানুষটা তার প্রতিটা বিষয়ে ছিল অতি আগ্রহী সে কিনা তাকে ইচ্ছা করে এড়িয়ে গেল। এসব কথা ভাবতে ভাবতে সেঁজুতির চোখে পানি এসে গেছে । সে নিজেকে সামাল দিতে ট্রেন থেকে জানালা দিয়ে তাকালো বাইরের দিকে দেখলো প্রকৃতির রঙের বিচিত্র সম্ভার । তার মন ভাল করার জন্যই গাছগুলো সেজে আছে বিচিত্র রঙে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় যতটা মন খারাপ লাগছিল ট্রেনের উঠার পর ধীরে ধীরে মনের মাঝের জমানো মেঘগুলো যেন দূরে সরে যেতে লাগলো। তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো রবীন্দ্রসংগীত “ মধুর বসুন্ত এসেছে মধুরও মিলন ঘটাতে আমাদের…।“ পরক্ষনেই মনে হল ধ্যত এগানটা আজ আমার জন্য না। আবার মনে হল কেন আজ এ গানটা আমার জন্য হবে না ? অবশ্যই আমার জন্য। অনিমেষ সাথে আসেনি তাতে কি! আজ একটা দিন আমি আমার মত করে কাটাবো। আমার যা যা ভাল লাগে তাই করবো। সেঁজুতির চিন্তার সাথে প্রকৃতিরও যেন দারুণ বোঝাপড়া আছে। আজ সকাল থেকে ছিল আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। মেঘগুলো কেটে গিয়ে সেখানে চারদিক আলো করে সূর্য উঠেছে। ট্রেন লাইনের পাশ দিয়ে বয়ে চলা লেকের পানি আছড়ে পড়ছে তীরে। যদিও সেখানে কোন লোকজন চোখে পড়ছে না বাইরে প্রচন্ড ঠাণ্ডার জন্য। ট্রেন থেকে দেখতে খুব ভাল লাগছে সেঁজুতির। তার মাঝে মাঝেই চোখ বন্ধ হয়ে আসছে কিন্তু যে করেই হোক সে আজ একটা মুহূর্তও ঘুমিয়ে কাটাতে চায় না। অবশেষে ট্রেন থামলো ডাউন টাউনে। সেঁজুতি ঠিক করেনি কোথায় যাবে। সামনেই হারবার ফ্রন্ট। সে আনমনে হারবার ফ্রন্ট ধরে হাঁটতে লাগলো । তারপর বসলো একটা বেঞ্চে। দেখতে লাগলো লেকের বুকে ভেসে থাকা জাহাজগুলোকে। আর মনে মনে ভাবছে ইস এখন যদি অনি আসতো চলে যেতাম ঐ দ্বীপে। পার করে দিতাম সারাটা দিন সবুজ আর নীলের মাঝে। তার আবার কান্না পাচ্ছে। মনে হচ্ছে এভাবে রাগ না করলেও পারতাম। একটু দেরী করলেই অনি আসতো সাথে। এরকম সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সে আবার উঠে পড়লো। তার হঠাৎ মনে পড়লো আজ তো এখানে একটা জব ফেয়ার আছে। একটু ঢু মারলে মন্দ হয় না। সে পা বাড়ালো ওয়েস্টিন ক্যাসেলের দিকে। ভিতরে ঢুকেই দেখে সেখানে লোকে লোকারণ্য। বিভিন্ন প্রভিন্স থেকে লোক এসেছে তাদের প্রতিষ্ঠানের সুনাম কে তুলে ধরে লোক নিয়োগে সাহায্য করতে। সেঁজুতির যদিও চাকুরী আছে কিন্তু তারপরও সে ইচ্ছা করেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্য নিলো , কথা বলল তাদের সাথে , সংগ্রহ করলো বিভিন্ন Souvenir. অনেকটা সময়ই সে এখানে কাটিয়েছে বুঝতে পারলো যখন পেট স্মরণ করিয়ে দিল ক্ষুধার কথা । সে তাড়াতাড়ি ছুটে গেল ফুড কোর্টে । কিন্তু সে কোন খাবারের অর্ডারই দিতে পারলো না নিজের জন্য। আজ যে তার জন্য একটা অন্য রকম দিন। সে একা খাবে কি করে অনিকে রেখে। তাই শুধু কফি হাতে নিয়ে এসে বসলো জানালার পাশে একটু নিরিবিলি দেখে । কফিতে সেঁজুতি যখন চুমুক দিতে যাবে তখন পিছন থেকে অনিমেষ বলল “ Happy Anniversary my dear Joti.” আর পিছন থেকে বাড়িয়ে দিল ১২টি লাল গোলাপ। আজ যে তাদের ১২তম বিবাহ বার্ষিকী । সেঁজুতি খুব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে অনিমেষের দিকে। সে কিছু বলতে পারছে না। অনিমেষই বলল তুমি ভেবেছো আমি ভুলে গেছি, তাই না? আমি কতদিন ধরে অপেক্ষা করছি তোমাকে চমকে দেবার জন্য এটা কি জান? সেঁজুতি ব্যাগ থেকে কাল বেল্টের সোনালী ঘড়ি অনিমেষকে পড়িয়ে দিতে দিতে বলল না আমি কিচ্ছু জানি না।।

 

(ছবি:-সৌজন্যে Metrodeal)

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন