ফ্লোরিডা থেকে:

প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি কোথায় আমি ? একটা তুমুল হৈ হৈ রৈ রৈ করা জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। খুব উঁচু নয় ,যেন একটা পাহাড়ী নদী খুব ত্রস্ত ব্যস্ত দৌড়াতে দৌড়াতে এক জায়গায় এসে লাফ দিয়ে পড়েছে যেখানে , সেখানে তৈরী হয়েছে খরস্রোতা একটি পুকুরের মত , খুব বড় নয়। রাত , কিন্তু হাল্কা অন্ধকার , লেনিনগ্রাদের জুন মাসের রাতের মত । জলের উপরে সাদা ফেনা দেখা যায়। চিনতে পারলাম । কারেলিয়ার কীভাচ জলপ্রপাত , পেত্রোজাভোদস্ক । মনে পড়ল একজন মানুষের কথা। আর্দ্রা নক্ষত্রের আর্দ্র আঁখি বেয়ে ঝরে পড়লো কয়েক ফোটা অশ্রু কীভাচের জলে।
অনেক দিন আগের কোন এক গ্রীষ্ম। জার্মান বন্ধুদ্বয় মার্ক এবং আক্সেল জলে ঝাপ দিয়েছে, পেত্রা ও গ্যাব্রিয়েলা দুই রূপসী সহ সারা গ্রুপ তীরের থেকে উৎসাহ দিচ্ছে তাদের। পদ্মা নদীতে সাঁতরিয়ে অভ্যস্ত , আমারও বীরত্ব দেখানোর প্রয়োজন ছিল। ঝাপ দিলাম। বরফ ঠান্ডা জল। স্রোত ঠেলে আছরাতে চায় পাথরে পাথরে,খাবি খেতে লাগলাম। মার্ক আক্সেল ছিল তীরের কাছাকাছি ,সেখানে স্রোত ছিল কম, আমি পুকুরের মাঝখানে , হাতে পায়ে ঠান্ডায় খিচ লাগার দশা। খাবি খাচ্ছিলাম, ইতিমধ্যেই নাকে মুখে প্রচুর জল পথ খুঁজে নিয়েছে পাকস্থলী পর্যন্ত , আক্সেল লক্ষ্য করেছিল, ওর সাহায্য নিয়ে রক্ষা পেলাম। উঠে ঠক ঠক করে কাঁপছিলাম। যে বীরত্ব না দেখালেও চলতো, কিন্ত বয়েসটা ছিল বখাটে।
পরের দিন তুমুল জ্বর এল। পেত্রোজাভোদস্ক ইউনিভার্সিটি হোস্টেলে আমাদের সামার ক্লিনিকাল রোটেশনের গ্রুপটির থাকার বন্দোবস্ত । বিশাল বিল্ডিং ফাঁকা , সব ছাত্র ছাত্রী সামার ভেকেশনে। বিল্ডিংয়ের যে উইং এ আমার থাকার বন্দোবস্ত সেখানে আমার দলের আর কেউ ছিলনা। জ্বর ,মাথা ব্যথা, গলা ব্যথায় কাবু ছিলাম, চোখ ছিল জবা ফুলের মত লাল। অস্বস্থির সীমা ছিলনা। বিছানা ছেড়ে জলের কেটলি হাতে কিচেনে গেলাম।। সে প্রাচীন হোস্টেল গুলোতে প্রতি উইং এ থাকতো কমন কিচেন এবং এক উইং এ থাকতো ছেলেদের রেস্টরুম , অন্য উইংএ মেয়েদের । স্নানঘর ব্যাজমেন্টে, ছেলেদের মেয়েদের আলাদা ।
স্টোভের সামনে জল গরম করছিল একটি মেয়ে , সারা হোস্টেলে সম্ভবত একমাত্র জীবিত প্রানী। অসম্ভব উজ্জ্বল দুটি চোখ, হাল্কা নীল রংয়ের; সোজা লম্বা নাক, কাঁধ পর্যন্ত সাদা ও বাদামী রংয়ের মিশেল চুল , হাল্কা পাতলা শরীর এবং শরীরের মাপের সাথে খাপ খাইয়ে বুকের বন্ধুরতা, না বেখাপ্পা ধরনের বড় , না চোখ এড়িয়ে যাবার মত ছোট । হাল্কা নীল রংয়ের টি শার্ট চোখের সাথে মিল রেখে ও ডার্ক ব্লু জিন্সের প্যান্ট । মুখে এক অনাবিল কম্রতা।
“প্রিভেত ”
“প্রিভেত” হাসলো ও , চমৎকার ছোয়াচে ,ঠিক গায়ে লাগার মত হাসি । ফুল যেমন গন্ধ ছড়ায় স্বতস্ফুর্ত, রামধনু ছড়ায় বর্নাভা, কিছু নারী আছে যাদের মধ্যে রয়েছে এমন কিছু এক আকর্ষন যা ব্যাখ্যা করা যায়না। কিছু নারী আছে যাদের দৃষ্টি প্রখর এবং ইনটুইশন তীক্ষ্ন।
“লেনিনগ্রাদ থেকে সামারের ক্লিনিকাল করতে এসেছি । ”
“তাই ? কিন্তু তোমাকে খুব অসুস্থ দেখাচ্ছে , শরীর খারাপ নাকি?”
“জ্বর”
আমার মা হলে যা করত, সে চট করে হাত দিয়ে আমার কপাল স্পরশ করে বলল ,”ইস তুমি যে পুড়ে যাচ্ছ , কোন ওষুধ খেয়েছ ? চল তোমাকে শুইয়ে দিয়ে আসি , আমি পানি গরম করে দিচ্ছি। ”
সে আমাকে রুমে শুইয়ে দিয়ে নিজের রুমে যেয়ে জ্বরের ওষুধ নিয়ে এল , চা করে দিল গরম , বলল এখন ঘুমাও , আমি বিকেলে এসে দেখে যাবো আবার। বিকেলে একটু ভালো বোধ হলো । কথা হলো , নামটি খুব পরিচিত একটি রাশান নাম। ২য় বর্ষের সাহিত্যের ছাত্রী, গিয়েছিল সামারের বিনির্মাণ দলে। কাজ শেষ করে ফিরেছে , রাতটি কাটিয়ে পরেরদিন চলে যাবে গ্রামে ২ সপ্তাহের জন্য , তার পর ফিরে আসবে , শুরু হবে ক্লাশ।
সময়টা ছিল ছিল সারা পৃথিবীর হাজার মানুষের মত আমারও জীবনের ক্রান্তিকাল । সমাজতন্ত্রের নামে স্ট্যালিনীয় একনায়কতন্ত্র , অকাতর, হত্যা ,নির্যাতন, সন্ত্রাস ইত্যাদির যে তথ্য গুলো ছিল লোহার সিন্দুকে তালাবদ্ধ তা বেড়িয়ে আসতে শুরু করেছে । দেশ ও সমাজতন্ত্রের শত্রু বলে লক্ষ কোটি মানুষকে গুলাগ নামের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে, ইউক্রেনে যে কুখ্যাত “গালোদোমর” (দুর্ভিক্ষ) লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে তা ছিল সম্পূর্ন ভাবে পার্টি ও রাষ্ট্রের দ্বারা তৈরী । ইউক্রেনের ক্ষুধিত মানুষ যাতে ওখান থেকে বেড়িয়ে এসে অন্যত্র সেই খবর পৌঁছে দিতে না পারে বা বিশৃংখলার সৃষ্টি করতে না পারে , সে জন্য সৈন্য দিয়ে ইউক্রেনের বর্ডার ঘিরে রেখেছে বিশ্ব মানবতার পাহারাদার সম্প্রদায়।
ফরাসি বিপ্লব যেমন একদিকে সামন্তবাদের ধ্বংস সাধন করেছে অন্যদিকে হত্যা করেছে লেভোয়সিয়ের এবং আন্দ্রে শেনিয়ের মত শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। রক্তের যে বন্যা বিপ্লবীরা বইয়েছে , সেই প্লাবনে নিজেরাই ভেসে যেয়ে পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে এক নায়ক নেপোলিয়নের। রুশ বিপ্লব এসেছিল নির্মম ধনতন্ত্রের ভিত্তি নাড়িয়ে পৃথিবীর শোষিত মানুষের মুক্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে কিন্তু সেই বিপ্লবেরও পথ পরিক্রমা ছিল অবিকল তাই। শুধু তাই নয় তার ধ্বংসের মাত্রা ও সদূর প্রসারী ফলাফল হল আরও বেশী গুরুতর । ফরাসি বিপ্লবের গিলোটিন জীবন হারিয়েছিল ৪০ হাজার , রুশ বিপ্লবের ধ্বংস যজ্ঞে জীবন হারালো প্রায় ৬০ মিলিয়ন। তৈরী হল মানব সভ্যতার সবচেয়ে কুখ্যাত নরপিচাশদের একজন কমরেড যোসেফ ভিস্সারিওন স্ট্যালিন।
জিউস পিতা ক্রনস (Kronos) ভয় পেত তার সন্তানদের, যে তারা তাকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে নেবে । তাই সে যে কোন সন্তানের জন্মের সাথে সাথে গিলে ফেলতো টুপ করে। ফরাসি বিপ্লব এবং রুশ বিপ্লব তাদের সন্তানদের গিলে খেয়েছে ক্রনসের চেয়েও বড় নৃশংসতায়।
একজন মানুষ আর একজন মানুষের মত নয় তা তারা একে অন্যের যত সদৃশই হোকনা কেন। তাই যখন পেরেস্ত্রইকা চোরাবালিতে ,গরবাচেভ উল্টা পথে হাঁটছেন এবং “বিপ্লবেই মুক্তি” এই মোহ কাটতে শুরু করেছে, একটি বিরাট দৈত্যাকার রাস্ট্র বিলুপ্তির ডেল্যুশনে ভুগছে আমি তখন ব্যস্ত থেকেছি সাহিত্যের বই নিয়ে । খুব সামান্য একজন মানুষ , কাফকার মানব-কীট গ্রেগরের চেয়েও ছোট , আমি বইয়ের জগতে নিয়েছি আশ্রয়। সের্গেই ইয়েসিনিন আমাকে পাগল করে দিয়েছিল । পুশকিন , আফানিসিয়ি ফেত , তিউতচেভ ,দস্তয়ভস্কী আমাকে ডাক্তারী পড়ার ফাঁকে ফাঁকে রেখেছিল সম্মোহিত করে।
মাত্র কিছুদিন আগেই গ্যেটের ফাউস্ট পড়ে যেমন অভিভুত হয়েছি : “খামুস মুহুর্ত ! তুমি সুন্দর ” তেমনি থমাস মানের ফাউস্টের বিশুদ্ধ প্রেমের যন্ত্রণা আমার মধ্যেকার শূন্যতাকে ( void) দিয়েছিল এক বিশ্ব বিলয়ী কলেবর ।
ঠিক এমনি সময়ে আমার তার সাথে পরিচয় । আমি ছিলাম অসীম মহাসমুদ্রে ভাসমান দিকভ্রান্ত কলম্বাস আর সে ছিল আমার গুয়ানাহানি (Guanahani) দ্বীপ।
খুব শীঘ্রই জেনে গেলাম যে সেও আমার মতই কবিতার পাগল । সে যেয়ে নিজের রুম থেকে কবিতার বই নিয়ে এল , সুন্দর আবৃত্তি করে শোনালো তার প্রিয় কিছু কবিতা, তার মুখে প্রথম আবিস্কার করলাম রুশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথকে । মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে পরিচয় অথচ কত সহজেই সে স্থান করে নিল আমার হৃদয়ে সমস্ত জীবনের জন্য। শরৎ সাহিত্য পড়া হয়ে গিয়েছিল স্কুলের দরজা পেরুবার আগেই। শরৎ চন্দ্রের নায়িকারা ছিল ধ্যানে জ্ঞানে । সেই রকম একজন নারীর সাথে আমার পরিচয় হবে সুদূর সেই বন , জল ও জলপ্রপাতের দেশ কারেলিয়ায় এমন কাকতালীয় ভাবে তা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি।
চলবে
শাহাব/ মে ১৪,২০১৬
পাদটিকা :
**ক্রনস : গ্রীক মাইথোলজী – জিউসের পিতা। ভবিষ্যতবানী করা হয়েছিল যে তার এক সন্তান তাকে সিংহাসন চ্যুত করে ক্ষমতা দখল করবে । তাই রেয়া , তার স্ত্রী, যখনই কোন সন্তানের জন্ম দিত সে তখনই তাকে গিলে ফেলত। এভাবে সে তার ৫ সন্তানকে গিলে ফেলে। রেয়া ৬ষ্ঠ সন্তান জিউসের জন্ম দেয় গোপনে ক্রীট দ্বীপে এবং আইডা পর্বতের এক গুহায় তাকে লুকিয়ে রেখে নবজাতকের কাপড়ে পেচিয়ে একটি পাথর তুলে দেয় ক্রনসের হাতে ৬ষ্ঠ সন্তান বলে । ক্রনস যথা রীতি গিলে ফেলে । জিউস গোপনে বড় হয়ে তার পিতাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তার পেট কেটে তার পূর্ববর্তী ভাই বোনদের ( ডেমেতার , হেস্টিয়া, হেরা,হেডিস ও পসেইডন) উদ্ধার
করে ।
** গুলাগ- রাশিয়ান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প
** গলোদোমর (Holodomor) ১৯৩২-১৯৩৩ সালে স্ট্যালিনের পলিসি দ্বারা সৃষ্ট ইউক্রেনের দুর্ভিক্ষ যাতে ২.৫-২.৭৫ মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়।
** লেভোয়সিয়ের -কেমিষ্ট ,১৭৯৪ সালের ৮ই মে গিলোটিনে হত্যা করা হয়।
**কবি আন্দ্রে শেনিয়ের ১৭৯৪ সালের ২৫ শে জুলাই গিলোটিনে হত্যা করা হয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে রোবেসপিয়েরের নির্দেশে। ২ দিন পরে রোবেসপিয়ের নিজে গিলোটিনে নিহত হওয়ার মাধ্যমে “রেইন অব টেরর” শেষ হবে । ১৯২১ সালে কবি আন্না আখমাতভার স্বামী কবি নিকোলাই গুমিলেওভকে হত্যা করা হয় একই অভিযোগে। গোর্কী লেনিনের কাছ থেকে তার মুক্তির অর্ডার নিয়ে পেত্রোগ্রাদ ছুটে যেয়ে জানতে পান যে তাকে ইতিমধ্যেই ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়েছে।
১৯৩৮ সালে কবি ওসিপ মেন্ডেলস্টামকে গুলাগে পাঠানো হয় এবং সেখানে সে মারা যায়, বলা হয় রোগে কিন্তু বিশ্বাস যোগ্য নয়। মেন্ডেলস্টাম বলেছিলেন: “কেবল মাত্র রাশিয়াতেই কবিতাকে শ্রদ্ধা করা হয় কেননা এখানেই কবিতার কারনে হত্যা করা হয়। এমন কোন স্থান আছে কি যেখানে কবিতাকে মার্ডারের এত কমন মোটিভ হিসেবে ব্যবহার করা হয়?”
** গ্রেগর- ফ্রান্ক কাফকার বিশ্ববিখ্যাত গল্প “মেটামরফসিস” এর মূল চরিত্র । একদিন ঘুম থেকে জেগে সে আবিস্কার করে যে সে এক ষড়পদী কীটে পরিনত হয়েছে। যান্ত্রিক সমাজে একজন মানুষ ও তার সত্তা যে কত নগন্য তার ট্রাজিক বোধ।
**ফাউস্ট – জার্মান উপকথার নায়ক, ক্রিস্টোফার মার্লো,গ্যাটে ও টমাস মানের লেখনীতে যে বিশ্ব সাহিত্যের এক অমর চরিত্র
** গুয়ানাহানি দ্বীপ ( বর্তমান বাহামার সান সালভাদর দ্বীপ) কলম্বাস যখন ক্লান্ত এবং মহাসাগরে বিভ্রান্ত এই দ্বীপ তার চোখে পরে প্রথম ।

১ মন্তব্য

  1. পরবর্তী পর্বের আপেক্ষার পালা শুরু হলো।
    সুন্দর লেখার জন্য ধন্যবাদ।
    তাহলে রাজলক্ষীর সাথে দেখা হয়েছিলো ” জল ও জলপ্রপাতের দেশ কারেলিয়ায় “?
    সে কি রাজলক্ষী না পার্বতী?

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন