আমরা নিজেরা যেমন দেশে থাকে মনে করতাম, তেমনি যারা এখনো এখানে আসনেনি তারাও অনেকে মনে করেন এই দেশটি হয়তো স্বর্গের মতো, কোনই ঝামেলা নেই। জীবন একেবারে প্রাকৃতিক টাটকা মধুর মত। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। এখানে মধুও যেমন আছে তেমনি তিতোও আছে। এখন কথা হলো কোনটা বেশি এবং কতটা সহনীয়।
সাম্প্রতিক এবং ১০/১৫ বছর আগের কিছু ঘটনার মাধ্যমে আমি দেখাবো যে আমার উপরের বক্তব্য কতটা সঠিক, এবং পরে বলবো, তাহলে কেন পড়ে আছি এখানে। প্রথমে সম্প্রতিক ঘটনায় আস। আমাদের আইন মন্ত্রী (জুড়ি উইলসন) যিনি কি না এখন ভূতপূর্ব, জাস্ট কিছু দিন আগে পদত্যাগ করলেন। কেউ তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেন নি, তবে তার মতে যে কারণে পদত্যাগ করেছেন তার কারণ তিনি বলেছেন তাকে প্রধানমন্তীর অফিস থেকে এখানে একটি বড়ো কোম্পানির (SNC Lavalin) বিরুদ্ধে আইনানুগ বেবস্থা না নিতে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে, এবং সেটিকে তিনি অনৈতিক মনে করেছেন তাই পদত্যাগ করেছেন। তবে প্রথমে কোনো কথা বলেন নি। পরে বিরোধী দলের দাবিতে তাকে পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে মুখ খুলতে হয় এবং এখানে প্রধামন্ত্রীর অফিস থেকে তাকে তার মতামত বদলাতে কোনো চাপ প্রয়োগ করা হয় নি এবং তিনি ভয়ে দেশও ছাড়েন নি, বরং সবার সামনে তার কথা বলে গেছেন।
কে দোষী সে বিষয়ে আমি জাসছি না কারণ তদন্ত চলছে, সত্য বের হবেই এবং প্রধান মন্ত্রীর অফিস জড়িত থাকলে ওই কিছু লোকের কারণ তাদের পুরা ক্ষমতার হাতছাড়াও হয়ে যেতে পারে। এই উদাহরণ আছে। যাহোক Trueaduর মতো একজন পপুলার এবং মেজরিটি সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তারই আইনমন্ত্রী তারই অফিসের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, অনেক দেশে এটা সম্ভব হয় না, একারণে দোষ-ত্রূটি যাই থাক সিস্টেমকে সাধুবাদ দিতেই হবে।
এবার আসি দ্বিতীয় ঘটনায়। গতোকাল আমাদের নিউ ব্রান্সউইক প্রদেশে এক বেক্তি প্রায় ১৭ বছর একটি ভুল মার্ডার কেসে জেল খাটার পর ছাড়া পেলেন। এই সময় আইন মন্ত্রীর বক্তব্য ছিল “federal Justice Minister David Lametti quashed the conviction, saying Assoun should be granted a new trial because he was a victim of a miscarriage of justice”. আইনের এই ভুলটাকে তিনি নিজে স্বীকার করে নিলেন। এই রকম দেশেরও ভুল হয় এবং হতেও পারে, কিন্তু সেটি স্বীকার করার এবং পরবর্তীতে সেই ভুল যাতে না হয় সে জন্য কাজ করার মানসিকতা এদর আছে।
তৃতীয় ঘটনায় আসি। গত কয়দিন আগে আমাদের একজন বাংলাদেশী ভাইয়ের গাড়ি দুইটা গুন্ডা অস্ত্রের মুখে ছিনতাই করে নিয়ে যায়। যাহোক উনি পুলিশকে জানান, এবং বেশ কয়েক ঘন্টা পরে জিপিএস ফলো করে পুলিশ তার গাড়ি খুঁজে পেতে সক্ষম হন। এসব ঘটনা অহরহ হয় না, আর হলে অন্তত অনেক ক্ষেত্রেই তার প্রতিকার হয়। যাহোক ওই যে বললাম ছিনতাইকারী এখানেও আছে।
চতুর্থ ঘটনা। প্রায় ১৫ বছর আগে, তখন মাইক হারিস ক্ষমতায়। Walkerton নামক ছোট শহরে ট্যাপের পানিতে ইকোলাই ছড়িয়ে যায়।  ৫০০০ মানুষের শহরের ২৫০০ অসুস্থ হয়, মারা যায় সাত জন। তদন্তে বের হয়ে আসে যে তৎকালীন Walkerton’s local public utilities commission (PUC) এর প্রধান Stan Koebel বানোয়াট রিপোর্ট দেন যাতে পানিতে কোনো সমস্যা আছে বলা হয় নি। এক্ষত্রে তৎকালীন ক্ষমতাসীন কংসেরভেটিভে প্রিমিয়ারকে টেস্টিফাই করতে হয়েছিল, এবং Mr. Stan Koebelকে চোখের পানি মুছতে মুছতে ভুল স্বীকার করতে দেখেছি এবং তিনি গিল্টি প্লি করে জেল খেটেছেন।
পঞ্চম ঘটনা। ফেডারেল লিবারেল এর সাম্প্রতিক জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী জ-কেরেচেন ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কুইবেক প্রদেশে ফেডারেলিজমকে চাঙ্গা করতে কিছু বিজ্ঞাপনের জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলার ফান্ড দেওয়া হয়, কিন্তু প্রশ্ন উঠে সেই টাকা তারা নিজেদের পৃষ্টপোষকদের পিছনে খরচ করেছেন। জ-কেরেচেন তৎকালীন অডিটর জেনারেলকে তদন্তের অর্ডার দিলেন এবং তারপর তিনি ক্ষমতা ছাড়লেন তবে তদন্ত চললো।  আসলো সেই লিবেরেলেরই আরেক প্রধানমন্ত্রী, জ-কেরেচেন এর তুখোড় ফিনান্স মিনিস্টার পল মার্টিন, তবে প্রায় ২৫ বছরের ইতিহাসে প্রথম মাইনোরিটি গভর্নমেন্ট নিয়ে। বুঝতেই পারছেন ওই স্ক্যান্ডাল প্রভাব পড়েছিল। আস্তে আস্তে লিবেরেলের ওই ঘটনায় জড়িত থাকার বেপার বের হতে লাগলো, অবশেষে বিরোধী দলের চাপের মুখে তিনি মাত্র দুই বছরের মাথায় পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচন দিলেন এবং লিবারেল ভরাডুবি খেলো, আসলো কংসেরভেটিভ Mr. Harper এবং চললো ১০ বছর, এর পর আসলেন Truedu.
ষষ্ঠ ঘটনা। কয়েক বছর আগে এক পুলিশ (Mr. Forcilo) চাকু হাতে মানুষিক ভারসাম্যহীন এক যুবকে স্ট্রিট-কার এর মধ্যে আত্মরক্ষর নামে একে একে ৯টি গুলি করে মেরে ফেলেন। প্রমাণিত হলো উনি অতিরিক্ত ফোর্স ব্যবহার করছেন। অবশেষে বিচার হলো, এবং উনি এখন জেল খাটছেন।
 সপ্তম ঘটনা। অনেক আগের কংসেরভেটিভ প্রধানমন্ত্রী যিনি কি না আমাদের NAFTA চুক্তির অন্যতম কারিগর, তিনি জার্মানের একটি কোম্পনির কাছে থেকে অস্ত্র কেনার ডিলে কিছু বেক্তিগত সুবিধা নিয়েছিলেন বলে জানা যায় ।  সেই খেসারত সে ক্ষমতা থেকে যাওয়ার অনেক দিন পরেও দিতে হয়েছে, যেটির আমি সাক্ষী।
যাহোক, আর বেশি কিছু বলতে চাসছি না।  উপরোক্ত ঘটনাগুলি আমাদের বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান সহ অন্য অনেক দেশে ঘটে এবং বেশি বেশি ঘটে তবে তফাৎটা কি ??? তফাৎ এইটাই যে এখানে ওগুলি করে পার পাওয়া খুবই কঠিন এবং ওগুলি করলে আপনি কোন পার্টির নেতা বা কোনো মন্ত্রণালয়ের আমলা তাতে কিছু আসে যায় না, আপনাকে আজ হোক কাল হোক জবাবদিহি করতেই হবে। ফাক-ফোকোরে ২/১টি কেস হয়তো এদিক-সেদিক বা দেরি হতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরা খেতে হবে। এখন এমন একটি দেশের সাথে উন্নয়নশীল একটি দেশের apple to apple তুলনা হয়তো করা যাবে না, কিন্তু সিস্টেমের জবাবদিহিতার নুন্নতম একটি ধারাতো থাকতে হবে যেটি আমাদের দেশের মতো অনেক দেশে নেই এবং অনেক ক্ষেত্রে One step forward two step backword এর মতো।
অন্যের কথা জানি না, তবে আমি এখানে বাস করে যে প্রচুর অর্থ উপার্জন করছি, প্রচুর নাম-কাম করছি তা ঠিক না। দেশে প্রিয়জন ফেলে এখানে আছি, প্রিয় জায়গাগুলি ফেলে আসছি, তার পরেও কেন আছি। ঐযে ওই জবাবদিহিতা, একটু নিরাপত্তা। আমার ট্যাক্সের টাকা দিয়ে ক্ষমতায় থাকা লোকজন বিলাসিতা করে গা ভাসাবেন আর আমি সরকারি কোনো অফিসে আমার কাজে গেলে আমাকে একজন ক্রিমিনালের মতো মনে করে আমার যত দিক থেকে ১২টা বাজানো যায় সেই চেষ্টা করবেন এগুলি অন্তত ফেস করতে হসছে না। বরং ওই সমস্ত রাঘব বোয়ালদের থেকে আমি এবং আমার মতো অনেক প্রবাসীই কিছুটা হলেও এখানে বসে দেশের জন্য কিছুটা করছেন। প্রতি মাসে দেশের জন্য কাজ করে জাস্ছেন। $১০০/২০০/৫০০ যে যা পারছেন মাসে মাসে দেশে পাঠাচ্ছেন। আমি নিশ্চিত এই মুহূর্তে যারা এটি পড়ছেন তাদের এমন কেউ নেই যে দেশে টাকা পাঠান না। কিছুটা হলেও দেশের রেমিটেন্সে অবদান রাখছি।
প্রায় ৭ বছর আগে আমার কেটি বড়ো সার্জারি হয়। আল্লাহর রহমতে অত্তান্ত successful হয় এবং আমি যেটুকু care পাওয়ার দরকার তা পেয়েছি। আমার খরচ হয়েছে মাত্র $৭.৫০ কারণ আমার রুমে আমি আমার মাথার কাছে ফোন নিয়েছিলাম। তবে আমি আমেরিকাতে কয়েকটি জায়গায় খোঁজ নিলাম এবং জানতে পারলাম যে আমার যদি ইন্সুরেন্স না থাকতো (প্রায় ৫ মিলিয়ন লোকের ওখানে ইন্সুরেন্স নেই) তাহলে ওই সার্জারিতে খরচ হতো প্রায় $৮০,০০০ এর মতো।  এখন কথা হলো কানাডাতে কে দিলো এই $৮০,০০০? হাঁ, এখানকার সার্বজনীন স্বাস্থ বেবস্থাই সে খরচ দিয়েছে, যেটির সুবিদা প্রতিটি নাগরিকই পেয়ে থাকে। আর এই টাকার যোগান আসে আমাদের মতো অসংখ মানুষের ট্যাক্স এর মাধ্যমে। হাঁ, বছরে আমাকে হাজার হাজার ডলার ট্যাক্স দিতে হয়, এবং  নিজের কষ্টের আয়ের টাকা থেকে, কিন্তু তারপরেও আমি সন্তুষ্ট যে সেই টাকা কাজে লাগছে।
এই ট্যাক্সের টাকা থেকেই আমরা পাসছি সামাজিক নিরাপত্তা, নিরাপদ সড়ক, এই শীতে হাজার হাজার টন বরফ পরিষ্কার, পরিষ্কার পরিছন্ন রাস্তা ঘাট ইত্যাদি। আর ঐর যে বললাম, এই ট্যাক্সের টাকাও কিছু অসৎ লোক দুই নাম্বারি করার চেষ্টা করে কিন্তু তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয় এবং করে খুব একটা পার পায় না। একেবারে শোনার হরিনের আশায় আসলে আপনি নিরুৎসাহিত হবেন। যদিও এক এক জনের সন্তুষ্টি এক এক রকম তথাপি তবে অন্তত নিজের মত করে চলার স্বাধীনতা আছে।  কাউকে হুজুর বা স্যার বলে মুখে ফেনা উঠতে হয় না। সকালে বাসার থেকে বের হয়ে একটিও মিথ্যা কথা না বোলে, একটিও অসৎ পয়সা না কামিয়ে সংসার করা যায় এইতো এটাই অন্তত আমার কাছে বড়ো পাওয়া, আর তাইতো স্বর্গপুরী বা ইউটোপিয়া না হলেও পরে আছি এখনো।
typo ত্রূটি মার্জনীয়।
সবাই ভালো এবং warm থাকবেন।
মুকুল

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন