ফ্লোরিডা থেকে:-

আজ মা দিবস , কিন্তু মায়ের চেহারাটি আমি এখন আর মনে করতে পারিনা। আমি শৈশবের অনেক কথা মনে করতে পারি, আমি যুদ্ধের কথা মনে করতে পারি, কিন্তু আমার মায়ের কথা মনে পড়েনা । গ্রোসারী বা সুপার মার্কেটের রিসিট গুলো যেমন কিছুদিন পড়ে ঝাপসা হয়ে যায় , লেখা গুলো আর পড়া যায়না বরং একটি মলিন সাদা কাগজ ছাড়া তাকে আর কিছু বলে চেনা যায়না আমার মায়ের স্মৃতি তেমনি।

আমার মা ছিলেন একজন খুব সাধারণ মানুষ। আমাদের একান্নবর্তী বিশাল পরিবারের একজন অবৈতনিক পেট চুক্তির কর্মচারী। আমার পিতা ছিলেন ক্ষণজন্মা এক কর্মী পুরুষ। সেই যুগে এই ধরনের পুরুষদের সমাজের প্রতি কমিটমেন্টের তালিকা যত বাড়ে তাদের স্ত্রীদের তত বেশী নীরবে নিভৃতে কাজ করেই জীবন কাটে। ঠাকুর বাড়ীর মৃনালীনি দেবীর মতই ছিলেন আমার মা, এক গাঁদা সন্তান সন্ততি আত্মীয় স্বজন মান সন্মান যতটা গুরুত্বপূর্ন ঠিক ততটাই অগুরুত্বপূর্ন সেই সবকিছুর সোল্ মেনেজার।

আমার মাকে “গো মাতা” ও বলা যায় কারন গরু যেমন কথা বলেনা , মা ও তাই । হয়তো যখন কথা বলার সময় ছিল , তখন কথা বলতে চেয়েছেন কিন্তু তার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী স্বামী বা দেবর গন বিষয়টি সময় মত মিটমাট করে দিয়েছেন । তাই তার সন্তানদের পিঠে যখন বৃষ্টির মত বেত পড়ে অন্যান্য মুরুব্বীদের হিতৈষী হাত বেয়ে তিনি রান্না ঘরে নীরবে অশ্রু ফেলেন। তিনি অবুঝ নন , বুঝতে পারেন যে লাঠি ছাড়া গরু হাল টানেনা, বেত ছাড়া সন্তানও মানুষ হয়না। বর্তমান কালের অনেক নারীর মত আমার মা ঘরের ফার্নিচার ছিলেন না , ছিলেন অন্য কিছু ।

মা লেখা পড়া জানতেন না। কাক ভোরে উঠে লাকড়ীর ধোয়ায় চোখ ফুলিয়ে সবার জন্য নাস্তা বানাতেন। সবার খাওয়া শেষ হলে যখন তার খাবার সময় আসতো , তখন দেখা যেত কিছু নেই। দাদি বলতেন “ঠিক আছে বৌ দুপুরে একটু বেশী করে খেয়ে নিও।”

থালা বাসন হাঁড়ি পাতিল ধুয়ে , আবার রান্না ঘরে ঢুকতেন দুপুরের খাবার তৈরী করতে, তারপরে তৈরী করতেন রাতের খাবার । তখন ফ্রিজ বলে কোন জিনিসের কথা তারা জানতেন না। সোনা দিয়ে ভরার এক মুখ ছিলনা ছিল অসংখ্য মুখ যাদের ভরার পর্যাপ্ত ছাইও ছিলোনা। কাপড় ধুতেন পুকুরে যেয়ে । হ্যা জলে নেমে শান্তি পেতেন কারন জল ধুয়ে নিয়ে যেত সব কিছু । সব দু:খ, ক্লান্তি। তার কোন অভিযোগ ছিলনা। তাকে আমি জায়নামাজেও কাঁদতে দেখিনি। তার কোন চাওয়া ছিলনা। বিড়াল কুকুরের আশা প্রত্যাশা থাকতে পারে কিছু মানুষ খুব অল্পতেই বুঝতে পারে যে তারা বিড়াল কুকুর নয়।

সম্ভবত নিজেই উর্বরা ও ফলবন্ত অসংখ্য বীজের ধারক ছিলেন বলেই তার হাতে সোনা ফলতো। তার হাত দিয়ে যে বীজটি মাটির গর্ভের স্নেহময়তা পেত তাই বেড়িয়ে আসতো সীমাহীন শক্তি ও ফলের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। মা তাই গাছ ভালোবাসতেন । মা আমার পুঁই লতায় মোটা মোটা তীব্র সবুজ পুঁই পাতার মত ছিলেন, ছিলেন তরতাজা শিমের মত সুন্দর , সতেজ ও পবিত্র। নিজেকে তিনি ঐ লতা পাতা প্রজাতির বলে চিনতে পেরেছিলেন কিনা জানিনা।

মা একবার স্বপ্ন দেখলেন ,তাকে একটা মস্ত বড় পাগলা কুকুর ধাওয়া করেছে । আমাদের গ্রামের ঝাড়, ফুঁক জানতেন যে “বঙা দাদা” তিনি ঝাড় ফুঁক করে মহা হুলুস্থুল বাঁধিয়ে আমাদের বাড়ীর পূব দক্ষিন কোনায় যে গাব গাছটি ছিল তাতে মস্ত বড় বড় দুটি গজাল পুতে দিলেন হাতুড়ী পিটিয়ে। আমি পাশেই ছিলাম, সেই হাতুড়ীর আওয়াজ
আজও মনে পড়ে , যেমন মনে পড়ে পূবের আকাশে এক রাতে দেখা গনগনে আগুনের লেলিহান মুক্তিদের হাতে থানা পুড়িয়ে দেবার পর , কিন্তু আমার মাকে মনে পড়েনা ।

তার সপ্তাহ খানেক পরেই যুদ্ধ লাগলো , আর মাসখানেক পরে বাবা গুলিবিদ্ধ হলেন। বাবাকে বাঁচিয়ে রাখলেন ঢাকা মেডিকেলের যেই মহান ডাক্তার তিনি অন্যান্য বুদ্ধিজীবিদের সঙ্গী হলেন বিজয়ের ২ দিন মাত্র আগে। বাবার বিজয় দেখার কথা ছিলনা কিন্তু বাবা দেখলেন। যার দেখা সম্ভব ছিল তিনি বাবার মত আরও হাজার মানুষের জীবন বাঁচিয়ে নিজে চলে গেলেন।

যুদ্ধ আমাদের একান্নবর্তী পরিবারকে চুড়ান্ত ভাবে ভেঙে দিল । যে পদ্মা আমাদের চার চারটি বাড়ী গিলে খেয়েও তার তীর ছাড়া করতে পারেনি , যুদ্ধ তা করল কত সহজেই। আমরা গ্রাম ছেড়ে নারায়নগন্জে চলে এলাম।

সবাই যখন খেলতো আমি বই পড়তাম,
সবাই যখন সিনেমা দেখতো আমি বই পড়তাম ।
সবাই যখন কিছু করতো আমি বই পড়তাম ,
সবাই যখন কিছু করতনা আমি তখনও বই পড়তাম ।

একজন সীমাহীন অকর্মন্য গ্রন্থ কীট যার অশিক্ষিত মা ভাবতো যে লেখা পড়া করে তার ছেলে এক বিরাট “আরকাটি” হবে । মা এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন , তাই যখন সেই বিরাট পরিবার ভেঙে ছোট হয়ে গেছে, যখন তার অর্ধেক সন্ততি ঘরের বাইরে চলে গেছে , যখন তার সময়ের স্বচ্ছলতা এসেছে, যখন তার প্রবল প্রতাপ শালী প্রভু-স্বামী পঙ্গু ও বৃদ্ধ , যখন সব প্রতিশ্রুতি এবং স্বপ্নগুলো বুলেট বিদ্ধ করে টুঙীপাড়ায় মাটি চাপা দেয়া হয়েছে এবং বিষ বৃক্ষের বপন চলছে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ,তখনও আমার মা সাবধানে উঁকি দেয়া স্বাধীনতার মত আমার কাছে আসতে ভয় পেত আমার পড়াশুনায় ডিসটার্ব হবে বলে।
অথবা যদি কখনই এসে দাঁড়াতো আমার চেয়ারে পিছনে এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে , বলত “বাবা দুধডা খাইয়া ল গরম গরম ।” আমি দুধটা পান করতাম , মা চলে যেত। মাকে আমি সেই সময় জড়িয়ে ধরে একটু ভালোবাসা জানাতে পারতাম বা মা ও পারতেন কিন্তু আমার মনে পড়েনা , কিচ্ছু মনে পড়েনা ।

আমার স্মৃতি বিশ্বাস ঘাতক , পিচাশের চেয়ে ও পিচাশ,আমার জাতির স্মৃতির আয়না , যা না দেশপ্রেমিক না বিশ্বাসঘাতক কাউকেই মনে রাখেনা। আমি এই জীবনে কত কত প্রানীর দেখা পেয়েছি কিন্তু কোনদিন কোন ভ্যামপায়ারের দেখা পাইনি , পেলে শুধু একবার দেখে নিতাম আমার মুখের আদল কতটুকু তার মুখের আদল থেকে ভিন্ন।

মার পৃথিবী ছিল খুব ছোট : বিক্রমপুর , নারায়নগন্জ আর ঢাকার বারডেম। না আমার মা সমুদ্র দেখেননি, পাহাড় দেখেননি , নীলগিরির কি পাহাড় ,না মেঘ ,না পাখী মা তা কোনদিন জেনে উঠতে পারেননি। আমি পৃথিবী ঘুরে বেড়াই , কত নগর গ্রাম অরন্য নদী পাহাড় সমুদ্র মহাসমুদ্র দেখি, কত মানুষের সাথে কথা বলি , আমার রোগীদের মায়েরা আমাকে কত ভালোবাসে, কৃতজ্ঞতা জানায়,তাদের সন্তানদের সুস্থ করে তোলার জন্য, সুচিকিতসা দেয়ার জন্য , অথচ আমার মা ?
আমার মা এক নীল নৈর্বেক্তিকতা।

মা আমি চলে যাবার পড়েও ৭ বছর জীবিত ছিলেন । তখন আমাদের বাড়ীতে ফোন ছিলনা , আর আমার রাশিয়া থেকে দেশে ফোন করার পয়সা ছিলনা। দেশে আসার পয়সাও ছিলনা। চিঠি লিখতাম , বাবা ভাই বোনেরা উত্তর দিত, মা লিখতে জানতেন না , পড়তে জানতেন না। সুতরাং তার সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিলনা। তিনি ছিলেন জীবিত থেকেও মৃত । এখন না জীবিত , না মৃত শুধু স্মৃতি ও একতাল অনুভূতি ।
মা তার এক সন্তান যখন পাকিস্থানে আটকা পড়ে তখন কেঁদে কেঁদে চোখ ভাসাতেন। তারপর আমি হই তার দ্বিতীয় সন্তান যার পথ চেয়ে কেঁদে কেঁদে কাটিয়ে দেবেন বাকী জীবন।
মাকে আমি শেষ দেখেছি শেষ ৮৮ র আগস্টের ২৯ তারিখে। আমি চলে গেলাম, দেশ ও আমাদের বাড়ী তলিয়ে গেল একবুক বন্যার জলে। আমার মা আমার মাতৃভূমির অবিকল প্রতিবিম্ব।
না আর দেখিনি। ৯০ র ৩১ শে জানুয়ারী একবছর প্যারালাইজড থেকে চলে গেছেন। আমি তখন ছ’বছর ডাক্তারী পড়া শেষ করে ইংল্যান্ডের একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করি ওয়েটার হিসেবে। ছোট গাছ একদিন বড় হয়ে যায়, বড় গাছ হয়ে যায় বৃদ্ধ। জীবন বুদবুদ বার্স্ট হয়ে যায় । গোলাপী রং হয়ে যায় নীল, জীবন বিষের রং মেখে মেখে।

কি হয় এত বই পড়ে , বিদ্যা অর্জন করে যদি তা দূরে সড়িয়ে রাখে মায়ের থেকে? যদি তা মাকে কিছুই না দেয়? কি সেই মানুষের দাম যে জীবনের সিদ্ধান্ত নেবার সময় মায়ের মুখটি মনে রাখতে পারেনা?
কি সেই মানুষ যে সাড়া জীবন পৃথিবীর পথে পথে হাঁটে এবং কোনটা মায়ের মুখ, আর কোনটা মাতৃভূমির মুখ তা মালুম করতে পারেনা?

শাহাব/ মে ৮, ২০১৬

3 মন্তব্য

  1. অপূর্ব ! মাকে নিয়ে অনেক লেখা পরছি,কিন্তু ইটা যেন একেবারে হৃদয় ছুয়ে যায়। আপনার্ লেখায় আমার এ অনুভুতি সৃষ্টি হয়েছে যে মাকে নিয়ে যা বলি তা যেনো অনেক কম হলো। সুন্দর লেখার জন্য ধন্যবাদ।

  2. অসাধারণ একটি লেখা. মায়ের জন্য হৃদয় নিঙরান অনুভূতি এরকম অকপটে প্রকাশ খুব কম লেখাতেই দেখি. আপনাকে সশ্রদ্ধ সালাম.

  3. শুধু বলব্, আপনি ভাগ্যবান, অসম্ভব ভাগ্যবান। এরকম একজন মা পাবার ভাগ্য সব সন্তানের হয় না। তাঁর আত্মা চির শান্তিতে থাকুন। আর আপনার অন্তরেও শান্তির নহর বয়ে যাক। এ কামনা।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন