সালাহউদ্দিন শৈবাল
টরন্টো থেকে:-

সন্ধ্যার পর পরই মফস্বল শহরটা ঝিম মেরে যেতো। ছোটো বাজারটাতে কিছু দোকান-পাট হয়তো খোলা থাকতো। চায়ের দোকান, পানের দোকান। আরো দু-একটা…। বিক্রি-বাট্টা তেমন নেই। দোকানীরা বসে বসে আড্ডা দিতো। হিসাব মেলাতো। দিন শেষে একটু অবসর।
বাজার থেকে বেরিয়ে বাসা-বাড়ীর পথ ধরলেই অন্ধকার। রাস্তা-ঘাটে বাতি নেই। দু-একটা বাসার লাইট দেখা যায়। টিম টিমে। জানালা বা টিনের ফাঁক দিয়ে হয়তো এক ফালি সরু আলো এসে পড়েছে রাস্তায়। হঠাৎ হঠাৎ দু-এক জন টর্চ হাতে পথচারী। আঁধারে ডুবে থাকা নি:সঙ্গ আলোগুলো অন্ধকারকে আরো বাড়িয়ে দিতো।
রাতে বাইরে একা যাওয়ার মতো সাহস আমার কোনো কালেই ছিলোনা। সন্ধ্যার পর ভদ্র ছেলের মতো তাই পড়তে বসতাম। শুধু পড়ার বই না। যা খুশি পড়তাম। আম্মার অনুমতি ছিলো। মলাটে রবি ঠাকুরের ‘ছোটো গল্প’ লেখা বইকে অনেক দিন ‘ছোটোদের’ বই হিসাবে পড়েছি। ছোটো গল্প যে বড়রাও পড়ে তা জানতাম না।
সন্ধ্যা সাতটা পয়ত্রিশ। পড়াশোনা শেষ। এবার রেডিওতে…”সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান….দুর্বার..”!! বশির আহমেদের একটা গান প্রায়ই বাঁজতো- “অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন ছিড়ে যায়।“
গানের কথা ভালো বুঝতাম না। কিন্তু বশির আহমেদ “অনেক সাধের ময়না আমার….” বলে যখন শেষ দিকে টান দিতো তখন বুকটা কেমন খালি খালি লাগতো। মন খারাপ লাগতো। মফস্বলের রাত আরো গভীর হয়ে উঠতো।
খাওয়া-দাওয়া শেষে বিছানায় যেতাম। আম্মা ঘরের বাতি নিভিয়ে দিতেন। গুটিসুটি মেরে কাঁথার মধ্যে। প্রথমে অল্প ভয় দিয়ে শুরু হতো। মনে হতো অন্ধকার ঘরে কেউ আছে! হাঁটছে! টিনের চালে গাছের ডাল বাতাসে শব্দ করতো। মনে হতো কে যেনো মাথার কাছের জানালায় টুক করে টোকা দিলো।
রাত ধীরে আরো নির্জন হয়ে যেতো। ভয় বাড়তে থাকতো। দূরের পাটকল থেকে রাত নয়টার ঘন্টা থেমে থেমে শোনা যেতো। হয়তো গাছের ডালে এসে একটা কুৎ পাখি বসেছে। কু কু করে ডাকছে। কুৎ পাখি গেরস্থের বাড়ীতে অমঙ্গল আনে। বাড়ীতে মানুষ মারা যায়। ভয়ে আমি থর থর করে কাঁপতে থাকতাম। পাশের ঘরে আম্মার নড়াচড়ার শব্দ খুঁজতাম। মনে হতো দৌড়ে আম্মার কাছে চলে যাই।
ঠিক সেই সময় আমার তাবৎ ভয় আর অন্ধকারকে এক ঝটকায় বিদায় করে দিয়ে দূরে রাত সাড়ে নয়টার লোকাল ট্রেনের হুইস্‌ল শোনা যেতো। আব্বা আসছে!
আব্বা সকালে জামালপুর গিয়েছিলেন। রাতের লোকাল ট্রেনে ফিরছেন।
আব্বা এসে হাত-মুখ ধুঁতেন। ভাত খেতেন। ভাতে খেতে খেতে আম্মার সংগে গল্প করতেন। তারপর আস্তে করে আম্মাকে বলতেন..”শৈবাল কি ঘুমায়?”
শৈবাল এক সেকেন্ডে কাঁথা ফেলে এসে হাজির! আব্বা তার কালো ব্যাগ থেকে ব্রাউন কাগজের প্যাকেটটা বের করতেন। হালকা ঘি ঘি গন্ধ। ব্রাউন প্যাকেট জায়গায় জায়গায় ভেজা। ভেতরে ক্রিমরোল! আমার সবচেয়ে প্রিয়!!
আব্বা প্রায় প্রতি দিন জামালপুর যেতেন। প্রতি দিন কিছু না কিছু আনতেন।
এখন আমার ছেলে আমি বাইরে থেকে এলেই দৌড়ে আসে। “আব্বা কিছু আছে?” আমি অবাক হয়ে এই ‘আমি’কে দেখি। পৃথিবীতে একই মানুষ কি বারবার ফিরে আসে? নাকি একটাই জীবন মানুষ বারবার যাপন করে? জানিনা। আমি আমার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। আমার কালো ব্যাকপ্যাকে হাত ঢুকাই।
আমার দশ বছরের ছেলে আগ্রহ নিয়ে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে।

১ মন্তব্য

  1. আপনার এই লেখায় নিজের শৈশবেরই প্রতিচ্ছবি দেখি. অসাধারণ, শৈবাল ভাই.

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন