leningrad1

ফ্লোরিডা থেকে:-

ফুল যদি গন্ধ দেয় , না চাইলেও নাকে এসে লাগে।
চাঁদ যদি হাসে চোখ বুজে থাকা কি যায় ?
যদি বন্ধু ডাকে, সাড়া না দিয়ে পারা যায় ?
আর সে বন্ধু যদি হয় অনিন্দ্য সুন্দর তুলো মেঘের মত ?

পুরোনো দিন গুলোতে পুরোনো দুনিয়ায় ভালো ছাত্র হবার একটা সুবিধা ছিল, কাকেও না চিনলেও ক্ষতি ছিলনা , যার ছিল প্রয়োজন সে আপনা থেকেই নিত চিনে । আর শরতের কনকনে শীতে যখন গাছের পাতা গুলো নানা রংয়ের আবির মেখে সং সেজে করতো ঝির ঝির ,লেনিনগ্রাদে সোনালী শরৎ হাঁটতো আলেক্সান্দার পুশকিনের ধীর পায়ে, নেভা তীরে , সামার গার্ডেনে , আর তলস্তয়
স্ট্রিটের ধুসরতায় । বুকে টন টন করতো কোন এক শূন্যতা , মা ও অন্য কাউকে ছেড়ে চলে যাবার বেদনা বিথুর শূন্যতা ।

সন্ধ্যা নামার পথ ধরে লম্বা লম্বা রনপায় নেমে আসতো অন্ধকার। বড় বড় ইমারত গুলোর ভুতুড়ে ছায়া গুলো ধীরে ধীরে বড় হতে হতে গ্রাস করে নিত দিন । সংক্ষিপ্ত ,সিক্ত লেনিনগ্রাদের কর্দমাক্ত দিন।
তখন সবে একটু একটু করে প্রেমে পড়তে শুরু করেছি সের্গেই ইয়েসিনিনিনের বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের প্রতীক আন্না স্নেগিনার , ডিকশনারী খুঁজে খুঁজে কাঁপা কাঁপা হাতে উন্মুক্ত করতে শুরু করেছি তার অবয়ব, অপেক্ষা করছি সেই ইয়েসিনিনিনীয় গ্রীষ্মের :

“গ্রীষ্মের কি যেন রয়েছে অনিন্দ্যতা
এবং সেই গ্রীষ্মের সাথে আমাদেরও”

সেই সন্ধ্যা গুলোতে একদল মৌমাছি ছুটে এসে ঘিরে ধরতো ‘শাখাবচিক’ ‘শাখাবচিক’ ( রুশ রমণীদের মুখে শাহাব নামের অন্তরঙ্গ সংস্করন) বলে আমাদের দৈতাকার গোল এনাটমী বিল্ডিংটির সামনে । তাদের কেউ চেনা, কেউ চেনার চেনা কিন্তু আমার অচেনা ,কেউ শুধুই এনাটমী কাতর রূপসী। প্রয়োজন বেশী কিছু নয়, যাদের স্পর্শ করলে হাত পুড়বে নির্ঘাত সেই রাজহংসীদের এনাটমীর তালিম দরকার।

রুশ ভাষা সবে রপ্ত করতে শুরু করেছি , সব কথা বুঝিওনা, কিন্তু এনাটমী জানতাম এবং বেশ জানতাম এবং আমাদের শিক্ষক “সান সানোভিচের ” হাতে অপদস্ত দু চারজনকে তালিম দেয়ার এই হল জিওমেট্রিক প্রগ্রেশন।

এনাটমী হলের ডজন খানেক মৃত মানুষের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল ভালো। তাদের ভেতর বাহির ছিল আমার খুবই পরিচিত। তাই সন্ধ্যা পরবর্তী হলুদ আলোতে , ফরমালিনের নাক ঝাঁঝানো নির্জন হল যখন জেগে উঠতো এই পুষ্পযৌবনা নারীদের স্পর্শ ও হাসির খিল্ খিলে , তারা ‘শাখাবচিক’ ‘শাখাবচিক ‘ এই মিষ্টি ডাকের মায়াময়তায় যোগ ব্যায়ামের শবাসনে শব হয়ে পড়ে থাকতো নিশ্চুপ। আর আমি পিনসেটের চিমটায় একের পর এক ওদের শিরা , উপশিরা, নার্ভ , মাসল , টেন্ডন ইত্যাদি টানাটানি করে দেখিয়ে যেতাম সদ্য ফোটা ড্যাফোডিলের মত অনিন্দ্য শিক্ষার্থীদের । আমার ওই মৃত বন্ধুরা হয়তো পছন্দই করতো ওই কোলাহল পূর্ন ওই সন্ধ্যে গুলো , তাই টু শব্দও করতনা, নড়ে চড়ে বাঁধাতোনা কোন অকাল কান্ড।

ওই সব প্রিয় লাশেদের গন্ধ, ফরমালিনের শ্লেষ্মা ত্যক্ত ঝাঁঝ, পারফিউম আর যৌবনের গন্ধে একাকার হয়ে থাকতো যেই হল তালিম পরবর্তী দিনে টেস্টে পাশ করে সেই হলে শাহাবচিক নামের একজন নার্ডের গালে জমা হতো দৃশ্য অদৃশ্য কত ওষ্ঠের স্পর্শ , কত বুকের কোমল আলিঙ্গন উষ্ণ করে দিত তীব্র শীতের সেই শহর ।

তার পরেও শীত কন কন করতো , তারপরে ও শূন্যতা শিস দিয়ে দিয়ে শব্দ করে যেত নেভা থেকে আসা ঠান্ডা হাওয়ায় !

১ মন্তব্য

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন