যুথিকা বড়ুয়া

( ১ )

হঠাৎ ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে যায় মমতার। তন্দ্রা জড়ানো চোখে ধড়্ফড়্ করে ওঠে। বুক ধুক্ ধুক্ করে উঠেছে। থর থর করে কাঁপছে সারাশরীর। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে হাঁপাচ্ছে। মুহূর্তের জন্য ঠাহর করতে পাচ্ছিল না, স্বপ্ন না বাস্তব। ঘুমের ঘোর কেটে যেতেই চোখ মেলে দ্যাখে চারিদিকে, তখনও আবছা অন্ধকার বাইরে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্যাখে, পৌনে পাঁচটা বাজে। দিগন্তের পূর্ব প্রান্তর জুড়ে ঊষার প্রথম স্নিগ্ধ, নির্মল, কোমল ক্ষীণ আলোর আভায় ক্রমশ একটু একটু করে লাল হয়ে উঠছে। চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ।
পাশ ফিরতেই দ্যাখে, খোকনের ঘরের দরজাটা খোলা। ঘরে আলো জ্বলছে। ওর ঘরের সংলগ্ন বাথ্রুমে ঝর্ণার মতো ঝির ঝির করে পাইপকলের জল পড়ছে শোনা হচ্ছে।-খোকা স্নান করছে বোধহয়। কিন্তু এতো ভোরে! খোকা আজ যাচ্ছে কোথায়!
স্বগতোক্তি করতে করতে বিছানা ছেড়ে নেমে আসে মমতা। বারান্দায় বেরিয়ে দ্রুত গিয়ে ঢোকে খোকনের ঘরে। ঢুকেই নজরে পড়ে, বিছানার পাশে টেবিল ল্যাম্পের আড়ালে কালো রঙের বড় একটি কাপড়ের পোটলা পড়ে আছে। মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল, কোনো জীব-জন্তু জানালা দিয়ে ঢুকে টেবিল ল্যাম্পের পাশে ঘুপচি মেরে বসে আছে।
সবিস্ময়ে কাছে এগিয়ে যায় মমতা। গিয়ে দ্যাখে, কোনো জীব-জন্তুও নয়, কাপড়ের পোটলাও নয়। সেটি মাঝারি আকারের একটি ল্যাদারের ব্যাগ। ব্যাগটি বাইরে থেকে ফুলে উঠেছে। মনে হচ্ছে, ব্যাগটিতে ভর্তি কোনো জিনিস আছে। কিন্তু কি হতে পারে! আশ্চর্য্য, খোকার ঘরে এতবড় ল্যাদারের ব্যাগ এলো কোত্থেকে! আগে তো কোনদিন দ্যাখেনি। বলল মনে মনে।

স্বাভাবিক কারণেই ব্যাগটি খুলে দেখবার বড্ড কৌতূহল হয় মমতার। সম্বরণ করতে পারে না। কিন্তু ব্যাগটি হাতে নিতেই চাপা আর্ত কণ্ঠে গর্জে ওঠে খোকন,-‘মা, তুমি? এঘরে কি করছ? সর্বণাশ, ওটা শীগ্গির রেখে দাও।’
বলতে বলতে বাথরুম থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসে খোকন। ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে মায়ের হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নেয়। এদিক ওদিকে তাকিয়ে নিরাপদ জায়গা টি-টেবিলের নিচে রেখে দেয়।

অপ্রস্তুত মমতা হঠাৎ থতমত খেয়ে গেল। আচমকা খোকনের এধরণের বিহেইব, উত্তেজিত মুখ দর্শণে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে যায়। খোকনের আপাদমস্তক লক্ষ্য করে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে হাঁ করে চেয়ে থাকে। ও’যে কিছু একটা লুকোচ্ছে, সেটা দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত হয়। কিন্তু সহজ সরল মমতা তার পরক্ষণেই ভাবে, কি আর হবে! ইউনিভার্সিটির ছাত্র, বন্ধু-বান্ধবের কোনো ব্যক্তিগত জিনিস হবে হয়তো! কিন্তু মমতা আদৌ জানেনা যে, ঐ ব্যাগটিতে কি আছে! মায়ের অজান্তে খোকন যাচ্ছে কোথায়! আর সেই সর্বণাশা জিনিসটাই বা কি!

মায়ের বিবর্ণ চেহারা লক্ষ্য করে খোকন স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে। গলার স্বর নরম করে বলে, -‘খামাখা ঘুম থেকে উঠে এলে। আজ ইউনিভার্সিটিতে আমাদের খুব জরুরী একটা মিটিং আছে। সবাইকে আর্লি-মর্নিংএ এ্যাটেন্ড্ করতে হবে। যাও যাও, গিয়ে শুয়ে পড়ো যাও। সোয়া পাঁচটা বাজে মাত্র।’

এমন স্বাভাবিক গলায় বলল, যেন কিছু হয়নি। এদিকে মনে মনে ভাবছে, নিশ্চয়ই টের পেয়ে গিয়েছে মা। ওয়াচ্ করছে সব।

নজর এড়ায় না মমতার। লক্ষ্য করল, মুখখানা মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে গেল খোকনের। গভীর তন্ময় হয়ে কি যেন ভাবছে। খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। বিরবির করে কি যেন বলছে।

এমতবস্থায় একজন গর্ভধারিনী মায়ের মন, কিছুতেই স্বস্তি পায় না। মমতা চিন্তায় পড়ে যায়। কারণ অনুসন্ধানে প্রচন্ড উদগ্রীব হয়ে ওঠে। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় খোকনের মুখের দিকে পলকহীন নেত্রে চেয়ে থাকে।

চোখে চোখ পড়তেই অস্ফূট হেসে ফেলল খোকন। বলল,-‘তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো মা! যাও। খামাখা টেনশন নিচ্ছো। এক্ষুণিই রেডি হতে হবে আমায়।’

মায়ের সাথে খোকন কথা বলছে ঠিকই কিন্তু ওর নজর ঐ ব্যাগটির দিকে। কেমন অস্থির অস্থির লাগছে ওকে। মনে হচ্ছে, মাকে ঘর থেকে বিদায় করতে পারলেই ও’ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

খটকা লাগল মমতার। সন্দেহজনক মনে হলো। অসন্তোষ গলায় বলল,-‘খোকা, আমার মাথার দিব্যি দিয়ে বল্তো, এই সাতসকালে তুই কোন্ রাজকার্যে যাচ্ছিস একটু শুনি? তখন থেকে দেখছি, কেমন উদাস, অন্যমনস্কভাব। বলি কিসের এতো চিন্তা তোর? তোদের ইউনিভার্সিটিতে মিটিং আছে বলছিস, কিসের মিটিংটা?’

খানিখটা বিরক্তি প্রকাশ করে খোকন বলল,-‘ওফঃ হো, কি মুশকিল, বলছি গিয়ে শুয়ে পড়তে! যাও তো, যাও। ওসব তুমি বুঝবে না।’

এবার নরম হয়ে পড়ে মমতা। গলার স্বর মোলায়েম করে খোকনের মাথায় হস্ত সন্চালণ করতে করতে বলে,-‘মায়ের কাছে কিছু লুকোস নে বাবা। কোথায় যাচ্ছিস, কি করছিস, মাকে বলবি নে! তুই ছাড়া মায়ের আর কে আছে বল! হ্যাঁ রে, ঐ কালো ব্যাগের মধ্যে কি আছে রে! খুব দামী জিনিস আছে বুঝি!’

খোকন নীরব, নিরুত্তর। পড়ে যায় বিপাকে। মায়ের জেরায় একবার পড়ে গেলে আর রেহাই নেই। জবাবদিহী করতে করতে প্ল্যান-প্রোগ্রাম সব যাবে মাটি হয়ে। এইভেবে মাকে উপেক্ষা করে হঠাৎ আহাল্লাদে গদগদ হয়ে ওঠে খোকন। বাধ্যগত ছেলের মতো মার্জিত হয়ে বলল,-‘এতো ভাবনার কি আছে মা! মারাত্মক কিছু নয়! ওটা আমার এক বন্ধুর। কয়েকদিনের জন্য গচ্ছিত রেখেছিল। কিন্তু তুমি ঘুম থেকে উঠে এলে কেন বলো তো! আমি কি দুধের খোকা!’
হাতের মাশেল ফুলিয়ে বলে,-‘ইউনিভার্সিটির ছাত্র আমি, হাট্টা গোট্টা তরুণ যুবক। সামান্য একটা তুচ্ছ বিষয়কে এতো সিরিয়াসভাবে কেন নিচ্ছো বুঝি না! আমারও তো একটা প্রাইভেসি থাকতে পারে, না কি!’

ভ্রু-যুগল কুঁচকে চেয়ে থাকে মমতা। চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে। ভিতরে ভিতরে ক্রোধে ফুলে উঠছে। কিছু বলবার ব্যাকুলতায় ঠোঁটদু’টো কাঁপছে। ইতিপূর্বে মাকে জড়িয়ে ধরে খোকন। কনভিন্স করার চেষ্টা করে। সহাস্যে বলে,-‘রিল্যাক্স মাদার রিল্যাক্স,ডোন্ট ওরি! আরে চটে যাচ্ছো কেন? ক’মন! আচ্ছা, ঘুম থেকে উঠেই এলে যখন শীগগির এককাপ গরমাগরম চা করে নিয়ে এসো দেখি! শরীরটা একটু ঝর ঝরে হয়ে যাক!’

কথা না বাড়িয়ে মমতা তক্ষুণিই চলে যায় রান্নাঘরে। ইত্যবসরে খোকন দ্রুত জামা-প্যান্ট পড়ে নেয়। মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে রান্নাঘরের দিকে গলা টেনে দ্যাখে। মমতা পিছন ফিরতেই টি -টেবিলের নিচ থেকে ব্যাগটি হাতে নিয়ে নিঃশব্দে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায় খোকন।

তার পরক্ষণেই প্লেটে করে চা, বিস্কুট নিয়ে আসে মমতা। ঘরে ঢুকে দ্যাখে, খোকন ঘরে নেই। বাথরুমে  গলা টেনে দেখলো,   সেখানেও নেই। মায়ের অগোচরে কখন যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল খোকন, টেরই পায়নি। হঠাৎ নজরে পড়ে, টি-টেবিলের নিচে কালো ব্যাগটিও নেই।
মমতা তৎক্ষণাৎ চাপা উত্তেজনায় স্বগতোক্তি করে ওঠে,- ‘আশ্চর্য্য, দানাপানি মুখে না দিয়েই খোকা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল! এতো জরুরী মিটিং! মাকে একবার দর্শণ দিয়ে গেল না! কিন্তু মিটিংএর দোহাই দিয়ে কালো ব্যাগে করে খোকা কি নিয়ে গেল? কোথায় নিয়ে গেল? কাকেই বা দিতে গেল?’

সাধারণতঃ মায়ের মন সবর্দা কু-ই গায়। হাজার প্রশ্নের ভীঁড় জমে ওঠে মমতার। দুঃশ্চিন্তা-দুর্ভাবনায় আষ্টে-পিষ্ঠে ঘিরে ধরে। কিছুতেই স্বস্তি পায় না। অজানা আশক্সক্ষায় বার বার বুক ধুক্ ধুক্ করে উঠছে।
মমতা সহজ সরল, সেকেলে মহিলা। সংস্কারপ্রবণ মন-মানসিকতা। স্বামী বিয়োগের পর একেবারে নরম হয়ে গেছে। কোনো বিষয়ে কখনো গভীরভাবে ভাবতে পারেনা। মস্তিস্ক কাজ করে না। কখনো মাথাও ঘামায় না। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে হারিয়ে ফেলেছে মনের শক্তি, আত্মবিশ্বাস। সামান্য কারণেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফ্যালে। মন-মানসিকতা দুর্বল হয়ে পড়ে। সারাক্ষণ নিজের জগতে বাস করে। গ্রামের বাড়িতে শ্বশুড় কূলের ভিটে-বাড়ি সহ স্বল্প পরিমানে কিছু ধানি জমি ছিল, তাতেই শাক-সব্জি, আনাচপাতির চাষ করে। উৎপন্ন ফসলের অধিকাংশই বাজারে বিক্রি করে। সম্প্রতি হাঁস-মুরগীর পল্ট্রিও খুলেছে। সেখান থেকেও বেশ কিছু আমদানী হয়। সব মিলিয়ে উপার্জন যা হয়, তা দিয়ে মা-ছেলে দুজনের দিব্যি স্বচ্ছলভাবে চলে যায়। টাকা পয়সা নিয়ে কখনো ভাবতে হয়না। একমাত্র খোকনকে নিয়েই যতো চিন্তা-ভাবনা, আশা-ভরসা মমতার। অকাল বৈধব্যে একাকী নিঃসঙ্গতায় শোক-দুঃখ-বেদনা ভুলে প্রাত্যহিক জীবনের পারিপার্শ্বিক কোন্দল-বিবাদ-বিচ্ছেদ-বেদনার কালো ছায়া থেকে সড়ে এসে খোকনকে এতকাল বুকে আগলে রেখে নিজের মনের মতো করে মানুষ করেছিল কি এই জন্যে? এইদিন দেখার জন্যে? মায়ের মনে কষ্ট দিতে বিবেকে এতটুকু বাঁধলো না খোকার?
খোকনের আচরণে ক্ষোভে দুঃখে ফেটে পড়ে মমতা। কোনো কাজে মন লাগছে না। সকালের খাবার পর্যন্তও মুখে উঠছে না। গভীর তন্ময় হয়ে ডুবে যায় ভাবনার অতল সাগরে। ধাওয়া করে অনিশ্চিত মোহনার দিকে। কি অপরিসীম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় অতিবাহিত হতে থাকে মমতার এক একটা মুহূর্ত।

( ২ )

খোকন ছোটবেলা থেকেই বড্ড একরোখা ছেলে। অনমনীয় ওর জেদ। বিরল সেন্টিমেন্টাল। প্রতিটা বিষয়েই ওর বিরোধীতা, আপত্তি, অভিযোগ। প্রখর সংগ্রামী মনোভাব। যেদিন শহরের রাজপথে প্রথম ভাষা আন্দোলনের শুরুতে নবীন সদস্য আবদুল রশীদ বেকায়দায় পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নির্মমভাবে আত্মাহুতি দিয়েছিল তাদেরই বন্দুকের গুলী বিদ্ধ হয়ে। আর সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা সমগ্র জনগণের মনে বৈপ্লবিক চেতনার সাংঘাতিক বিস্ফোরণ ঘটে। সেই বৈপ্লবিক চেতনার বাতাবরণে খোকন আরো গভীরভাবে স্বাধীনতা বিপ্লবের সাথে আষ্টে-পিষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে। বেশ কিছুদিন যাবৎ লোকের কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে,-‘উজ্জ্বল চৌধুরী (ওরফে খোকন) একজন বিপ্লববাদী স্বদেশী।’

তবু কখনও মনের মধ্যে তেমনভাবে সন্দেহের দানা বাঁধেনি মমতার। বরং মনে মনে গর্ববোধ করতো। আত্মগর্ভে মায়ের বুক ভরে উঠতো। ভাবতো, স্বদেশী মানেই তো দেশকে ভালোবাসা, দেশের জনগণকে ভালোবাসা, দেশের সেবা করা, দশের সেবা করা, জনগণের সেবা করা। এটা একটা মহৎ কাজ, মহা পূণ্যের কাজ। কিন্তু খোকা আজ কোণ্ কার্যালয়ে গিয়েছে? কিসের পূর্ণ অর্জন করতে গিয়েছে?

বেলা দশটা বাজে। মমতা তখনও অশান্ত, উদ্বেলিত, মর্মাহত। ক্ষণে ক্ষণে গহীন বেদনানুভূতির তীব্র দংশণ আর ভোরের ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের প্রতিঃচ্ছবি ক্রমাণ্বয়ে ওর স্নায়ূকোষে ঘুরপাক খাচ্ছে। কখনো জীবন্ত হয়ে মনঃশ্চোক্ষে দেখা দিচ্ছে। তন্মধ্যে খোকনের আকস্মিক অভাবনীয় ব্যতিক্রম চাল-চলন, কথাবার্তা, বিবর্তন চেহারা প্রদর্শণে মনের মধ্যে সন্দেহের দানা চাড়া দিয়ে ওঠে। অজানা আশক্সক্ষায় ঘিরে ধরে। সন্দেহ ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকে। প্রচন্ড ভাবিয়ে তোলে। নদীর ঢেউএর মতো মস্তিস্কের কোষে কোষে বার বার একই প্রশ্ন ফিরে এসে আঘাত করতে থাকে,-মায়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে, মাকে ভাবনার সাগরে ডুবে রেখে, সম্পূর্ণ উপবাসে খোকা আজ গেল কোথায়?

সেই সকাল থেকে চা-জল-খাবার নিয়ে বসে আছে মমতা। কিছুতেই মুখে ঢুকছে না। ক্ষিদে, তৃষ্ণাও ভুলে গেছে। কখন থেকে কলিং বেলটা একটানা বাজজিল, এতক্ষণ খেয়ালই ছিলনা। হঠাৎ জানালার ধারে বসে থাকা হুলো বিড়ালটা মিঁয়াউ করে ডাক দিতেই চমকে ওঠে। বেলের আওয়াজ শুনে ভাবল, খোকা ফিরে এলো বোধহয়।

দৌড়ে যায় মমতা। দরজা খুলে দ্যাখে, একটি অচেনা যুবতী মেয়ে উদ্ভান্ত হয়ে দরজার ওপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। কিছু বলবার ব্যাকুলতায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে।

অপ্রত্যাশিত অপরিচিত মেয়েটিকে দেখে ঘাবড়ে গেল মমতা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাঁপাতে হাঁপাতে মেয়েটি বলে ওঠে,-‘মাসিমা, আমি অলকা, উজ্জ্বলের ক্লাসমেট্। কিছুক্ষণ আগে আমাদের পুকুরঘাট থেকে ওকে যেতে দেখলাম মনে হলো। গায়ে চাদর জড়ানো, পায়ে হাওয়াই চপ্পল। রেললাইন ধরে খুব জোরে হেঁটে যাচ্ছিল। ও’ কোথায় গেল আপনি জানেন?’

কম্পিত স্বরে মমতা বলল,-‘তা তো জানি না। বলছিল, ইউনিভার্সিটিতে যাবে। জরুরী মিটিং আছে! কিন্তু যাবার সময়…!’

মমতার কথা শেষ না হতেই আঁতকে ওঠে অলকা,- ‘এ্যাঁ, ইউনিভার্সিটিতে গেছে!’ বলে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ থেমে বলল,- ‘সর্বণাশ, আপনি ঘর থেকে আজ ওকে বের হতে দিলেন কেন?’ বলে ধপাস করে সিঁড়িতেই বসে পড়ে অলকা।

ব্যস, পড়লো মরার উপর খাড়া। চিন্তাধারার গতিবেগ আরো তিনগুণ বেড়ে গেল মমতার। আঁতঙ্কে বুকের ভিতর ধুক্ ধুক্ করে কাঁপতে থাকে। ভয়-ভীতিতে বুক শুকিয়ে যায়। চোখেমুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, মনে বিভীষিকা। হঠাৎ কাঁন্নাজড়িত কণ্ঠে আর্তনাদ করে ওঠে,- ‘কার কি সর্বণাশ হবে মা! কোথায় হবে? কেন হবে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি নে!’

মনে মনে বিব্রোতবোধ করে অলকা। খানিকটা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলল,-‘কেন, খবরে কিছু শোনেন নি? আজ ইউনিভার্সিটির চারপাশে সরকার এক’শ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করেছে। নোটিশ ঠুকে দিয়েছে, ইউনিভার্সিটির ত্রিসীমানায় কোনো মিটিং, মিছিল কিংবা জটলা করা চলবে না। আজ একটা গন্ডোগোল হবার খুউবই সম্ভাবনা আছে!’

শুনে চমকে ওঠে মমতা।-‘এ্যাঁ, বলো কি! তুমি জানো কাদের মিটিং? কিসের মিটিং? এক’শ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করেছে, কিন্তু কেন? গন্ডোগোলই হবে কেন?’

বিস্মিত কণ্ঠে অলকা বলল,-‘সেকি মাসিমা, উজ্জ্বল কিছু বলেনি আপনাকে? আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা করার দাবিতে ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা একজোট হবে, আন্দোলন করবে আপনি জানেন না? ওরা এক’শ চুয়াল্লিশ ধারা লঙ্ঘন করে, হাতে ঝান্ডা নিয়ে শ্লোগান দিতে দিতে এসেম্বেলীর দিকে যাবে। পুলিশ নিশ্চয়ই ওদের উপর হামলা করবে, লাঠিচার্জ করবে, কাঁদানি গ্যাস ছুড়বে। ব্যস, তারপর শুরু হয়ে যাবে ঘোরতরো গন্ডোগোল।’

অলকার কথা শুনেই ধপাস করে দরজার গোড়ায় বসে পড়ে মমতা। অসহায় চোখের চাহনি। কণ্ঠে হতাশার সুর। একটা ঢোক গিলে বলল,-‘হ্যাঁ, শুনেছিলাম! কিন্তু এতোটা বাড়াবাড়ি হবে, তা ভাবিনি। এখন কি হবে বলো তো!’

মমতার মানসিক পরিস্থিতি লক্ষ্য করে শান্তনা দেবার চেষ্টা করে অলকা। বলল,-‘কিছু হবে না মাসিমা। আপনি অযথা ভেঙ্গে পড়ছেন। আমি বলছিলাম, কখন কি হয়, বিপদের কথা তো বলা যায় না! আর তাছাড়া, উজ্জ্বল বিদ্যান, বুদ্ধিমান, চালাক চতুর ছেলে। আর যাই হোক, অন্তত গায়ে আঁচ পড়তে দেবে না। ওনিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি, কাউকে পাঠিয়ে ওর খবর নেওয়া যায় কি না!’

অলকা চলে যেতেই ভারাক্রান্ত মনটা খানিকটা হাল্কা হয় মমতার। চিন্তা-ভাবনাও খানিকটা দূরীভূত হয়। মানসিক অবসন্নতা ঝেড়ে ফেলে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। যথারীতিই নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তারপরেও মনের মধ্যে কেমন যেন একটা খটকা লাগছে। কোথায় যেন খুব হৈ চৈ হচ্ছে, চিৎকার চেঁচামিচি হচ্ছে শোনা যাচ্ছে। মমতা শোনে কান পেতে। কিন্তু শব্দটা তক্ষুণিই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ভাবল, হয়তো ওর মনের ভ্রম।
-‘দূর্গা, দূর্গা! সবই মায়ের ইচ্ছা!’ আপন মনে বির বির করতে করতে ঢুকে পড়ে ঠাকুরঘরে।

( ৩ )

প্রায় ন’টা বাজে। খোকন দূর থেকে লক্ষ্য করে, পূর্ব পরিকল্পিত অনুযায়ী ছাত্র-ছাত্রীরা তখনও এসে পৌঁছায় নি। ইউনিভার্সিটির চারিদিকে পুলিশ পাহাড়া দিচ্ছে। কিন্তু শ্লোগান শোনা যাচ্ছে,- ‘রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই!’

খোকন চেষ্টা করে ইউনিভার্সিটির পিছনের গেট দিয়ে ঢুকতে। কিন্তু উপায় নেই। সেখানেও ঝাঁকে ঝাঁকে পুলিশ দাঁড়িয়ে, হাতে বন্দুক নিয়ে কড়া নজরে পাহাড়া দিচ্ছে। ততক্ষণে ছাত্র-ছাত্রীরা দলবেঁধে মিছিল করতে করতে ইউনিভার্সিটির মেইন গেটের প্রাঙ্গনে চলে এসেছে। পুলিশ তক্ষুণি ওদের উপর হামলা চালায়, লাঠিচার্জ করে। কয়েকজনকে জামার কলার ধরে জবরদস্তী তুলে নেয় গাড়িতে। তখনই শুরু হয়ে যায় হট্টোগোল, ভাগ-দৌড়, বিরূপ বিশৃঙ্খল পরিবেশ। খোকন ছুটে এসে চাদরের ভিতর থেকে এলোপাথারী ছুঁড়তে লাগল বারুদের গোলা। ইতিপূর্বে কয়েকজন ছাত্র ক্যারোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দেয় কয়েকটি পুলিশ ভ্যান। অন্যদিকে উত্তেজিত জনসমুদ্রের ঢেউএ ক্রমাগত ভেসে আসছে, শ্লোগানের তীব্র হুঙ্কার, জনগণের দাবি। তাদের অবরোধ করতে পুলিশ ছুঁড়তে থাকে কাঁদানি গ্যাস। তীরের মতো ছুড়ছে বন্দুকের গুলী। ক্রমাণ্বয়ে চলছে একের পর এক হৃদ-কাঁপানো বোমা-বারুদের বিস্ফোরণ। মুহূর্তেই পরিণত হয়, এক বিভীষিকাময় রক্তাক্ত রণক্ষেত্র। রক্তে ভাসছে গোটা শহর, শহরের রাজপথ। চারিদিকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। আকাশে বাতাসে ভাসছে বারুদের উগ্র গন্ধ। চোখে পথ দেখা যাচ্ছে না। মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে, চিরশায়িত সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ভাইএর মতো আরো কত অগণিত বাংলা মায়ের বীর সন্তান, বীর যোদ্ধা। এমতবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীরা দলভঙ্গ হয়ে যে যার নিজের আত্ম রক্ষার্থে দ্বিগি¦দিক জ্ঞান শূন্য হয়ে অন্ধের মতো ছুটতে শুরু করে।

এমনিতেই মন-মেজাজ সকাল থেকে ভালো ছিলনা মমতার। তন্মধ্যে চতুর্দিক থেকে বজ্রপাতের মতো বোমা বাজীর আওয়াজ কানে এসে লাগছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি গায়ের উপর এসে পড়লো। সেই সঙ্গে মরার কাঁক একটা সেই তখন থেকে জানালার ধারে বসে তীব্র স্বরে কাঁ কাঁ করে ডাকছে। যেন কিছু বলতে চাইছে, কোনো সংবাদ বয়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু মায়ের মন, কু-ই গায়। স্বাভাবিক কারণেই হঠাৎ মনের মধ্যে উদয় হয়, কাঁকটি সত্যিই কোনো দুঃসংবাদ বয়ে আনেনি তো! হে ভগবান, এমন বিপর্যয়ের মুখে খোকা কোথায় আছে, কি অবস্থায় আছে, ভেবে ভেবে কিছুতেই স্বস্তি পায়না মমতা। সারাক্ষণ কত কুচিন্তা, কুভাবনা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। একদন্ডও সুস্থির হয়ে থাকতে পারেনা। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে বারান্দায়। খাঁচার পাখীর মতো বারান্দার এমাথা ওমাথা অনবরত পায়চারি করতে থাকে।

একসময় থেমে যায় বোমা বারুদের বিস্ফোরণ। দাঙ্গা, হাঙ্গামা। কিন্তু রয়ে যায় তার রেশ। ক্লান্তি সূর্য্য অস্তাচলে ঢলে পড়তেই গোটা পৃথিবীটা যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। গুমোট মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ। রক্তে ভাসছে গোটা শহর। অন্যদিকে পুত্র বিয়োগের শোকে, দুঃখে কাতর কত অভাগিনী মায়ের শূন্য বুক অশ্রুবন্যায় ভেসে যাচ্ছে। কিংবা স্বামী হারানোর শোকে বিহ্বলে মুহ্যমান হয়ে পড়ছে কত নব পরিণীতা গৃহবধূ।

মনের অজান্তেই বুকটা হঠাৎ কেমন ছ্যাৎ করে উঠলো মমতার। হৃদস্পন্দন আরো দ্রুত গতীতে চলতে শুরু করে। সবুর সয় না। নেমে আসে আঙ্গিনায়। তাকায় রাস্তার দিকে। ততক্ষণে বিশাল জন-সমুদ্রের ঢেউ ওদের বাড়ির সন্নিকটে এগিয়ে আসে। মমতা চোখ পাকিয়ে দ্যাখে, সাদা কাপড়ে ঢেকে একদল যুবক ছেলে কাকে যেন কাঁধে চেপে উর্দ্ধঃশ্বাসে দ্রুতগতীতে এগিয়ে আসছে। ওদের পিছন পিছন উপছে পড়ছে অগণিত মানুষের ভীঁড়, ঠেলাঠেলি।

ইতিপূর্বে ছুটে আসে অলকা। ছুটে আসে পাড়া-প্রতিবেশী, বাচ্চা-বুড়ো-জোয়ান সবাই। মুহূর্তেই বাড়ির চারিধারে প্রচন্ড ভীঁড় জমে ওঠে। যা ক্ষণপূর্বেও কল্পনা করেনি মমতা। কিন্তু আপনগর্ভে লালিত সন্তান আর মায়ের নারীর চিরন্তন বন্ধন, সে এক অদৃশ্য শক্তি, এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন, নারীর টান। তাকে অবরোধ করে সাধ্য কার! স্বয়ং বিধাতারও নেই! আর সেই অদৃশ্য বন্ধন শক্তির প্রভাবেই মমতাকে বারান্দা থেকে টেনে নিয়ে আসে প্রশ্বস্ত আঙ্গিনায় মাঝে। যার কারণ নিজেও জানতো না মমতা।
হঠাৎ কর্ণগোচর হয়, উজ্জ্বলের নাম ধরে ছেলেরা কি যেন বলছে। নিশ্চয়ই ওর বাড়ি খুঁজজে। তবে কি খোকারই কোনো অঘটন ঘটলো?

ততক্ষণে বুঝতে কিছু আর অবশিষ্ঠ থাকে না মমতার। বিদ্যুতের শখের মতো হৃদয়পটভূমিতে খুব জোরে একটা ধাক্কা লাগলো। র্থ র্থ করে সারাশরীর কাঁপতে থাকে। ভেঙ্গে পড়ে বোবা কাঁন্নায়। অনুভব করে, পায়ের তলা থেকে মাটি যেন ক্রমশ সড়ে যাচ্ছে। জমে হীম হয়ে যাচ্ছে সারাশরীর। স্থীর হয়ে আসছে চোখের দৃষ্টি। একসময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভাবসাম্যহীন হয়ে পড়ে। হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই ওকে জড়িয়ে ধরে অলকা।

ততক্ষণে সাদা চাদরে ঢাকা খোকনের রক্তাক্ত মৃতদেহটাকে শোয়ায়ে রাখা হয় বারান্দায়। যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে উজ্জ্বল। জীবনের সব হিসেব নিকেষ চুকিয়ে দিয়ে এসেছে। কত নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোচ্ছে। কোনো চাহিদাই আর নেই। কারো প্রতিই ওর আক্ষেপ নেই, অভিমান নেই, অভিযোগ নেই। কিন্তু ওর গর্ভধারিনী মা, মাকে কি জবাব দেবে খোকন? কেন মায়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে নীরবে চলে গেল খোকন? এ কথার জবাব মমতা কি পাবে কোনদিন? কেউ কি বোঝাতে পারবে কোনদিন?

কারো মুখে কথা নেই। সবাই বাক্যাহত, বেদনাহত, মর্মাহত। বিমূঢ়-ম্লান মুখে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখে জল। কিছুক্ষণ পর ভীঁড়ের মধ্য থেকে একটি যুবক ছেলে এগিয়ে এসে বলে,-‘কই, উজ্জ্বলের মা কোথায়? ওনাকে ডাকুন!’

কিন্তু কোথায় উজ্জ্বলের মা? তখন ও’ আর ওর মধ্যে নেই। সম্পূর্ণ উদ্মাদ। সমানে আবোল-তাবোল বকছে। কখনো আপনমনে বির বির করছে। কখনো চোখমুখের বিচিত্র অবয়বে নিজের মনের সাথেই সমঝোতা করছে। বহু চেষ্টা করেও মমতাকে ঘরের ভিতরে নেওয়া গেল না। বার বার শুধু বলছে,-‘আমার খোকাকে তোমরা কেউ দেখেছ? ও’ কোথায় গেছে তোমরা জানো? আমার খোকা এখনো বাড়ি ফিরে আসে নি। ওর খাবারগুলি এখনো থালায় ঢাকা আছে। আমি ঢেকে রেখেছি। তোমরা দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও না, চলে যাও না তোমরা। আমি তো আছি এখানে। আমার খোকা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি এই সিঁড়িতেই বসে থাকবো!’

হঠাৎ মমতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে অলকা। কাঁন্নাজড়িত কণ্ঠে বিলাপ করে বলে,-‘আপনার খোকা আর ফিরে আসবে না মাসিমা। উজ্জ্বল আর ফিরে আসবে না। আর কোনদিন আমাদের মাঝে ফিরে আসবে না। ভাষা আন্দোলনে ওর জীবন বলিদান করে গেছে ও’। রাতের অন্ধকার আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আমাদের সবার অন্তরে উজ্জ্বল চিরদিন অমর হয়ে থাকবে। ওকে আমরা কোনদিনও ভুলবো না।’

সমাপ্ত

 

 

যুথিকা বড়ুয়া : কানাডার টরোন্টো প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন