( এক )

ক্ষীর মিঠাই, পিঠা-পায়েশ খুব প্রিয় বাবলুর। খেয়ে মন ভরেনি। বাটিটাই ছিল বড়। গৌরীরানি দিয়েছিলও নামমাত্র। ঐটুকু খেয়ে তৃপ্তি হয় কারো! পেটের এককোণাও ভরেনি। গৌরীরানি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই বাবলু পা টিপে নৈঃশব্দে ঢুকে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে ক্ষীরের পাতিলাটাই নিয়ে বসেছিল খেতে। কিন্তু বেচারা একটুও মুখে দিতে পারেনি। আঙ্গুলটা মাত্র ডুবিয়েছে, তক্ষুণি জানালার ধারে বসে থাকা হুলো বিড়ালটা মিউ করে ডাক দিতেই বাবলু চমকে ওঠে। আর সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীরের পাতিলাটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে বাসনপত্রের ওপর। বাবলু স্বগতোক্তি করে ওঠে,- “সর্বণাশ, এতগুলি ক্ষীর, পাতিলা শুদ্ধু সব পড়ে গেল মাটিতে! কি হবে এখন!”

ততক্ষণে একটা লেগে তিনটে পড়ে। পড়তে পড়তে বাসনপত্রের টুং টাং শব্দে কানে একেবারে তালা লাগার উপক্রম। ভয়-ভীতিতে বাবলু কাঁপতে শুরু করে। গলা শুকিয়ে আসে। তবু খাওয়ার লোভ সামলাতে পারে না। সারা মুখে, আঙ্গুলের ডগায় যেটুকু ক্ষীর লেগেছিল, সেটুকুই চেটে চেটে খায় আর ভাবে,-মায়ের হাত থেকে আজ আর রক্ষা নেই! কপালে ওর দুঃখ অনিবার্য!

ইতিমধ্যে ছুটে আসে গৌরীরানি। ক্ষীরের গন্ধ্যে ছেয়ে গিয়েছে সারা ঘর। পা ফেলবার জায়গাই নেই। দেখে মনে হচ্ছে, ক্ষীরের পাতিলা থেকে ডুব দিয়ে উঠেছে বাবলু। ঐ বীভৎস চেহারার দর্শণে গৌরীরানি রেগে আগুন। বাবলুর আপাদমস্তক লক্ষ্য করে অনায়াসেই বোধগম্য হয়, ও ক্ষীর চুরি করে খেতেই রান্নাঘরে ঢুকেছিল। হাতের সামনে একটা ঝাঁটা ছিল। চোখমুখ রাঙিয়ে গৌরীরানি ঝাঁটা নিয়ে তেড়ে আসে। গলার স্বর বিকৃতি করে বলে,-“বেয়াদপ, রাক্ষশ কোথাকার! তড় এত্তবড় সাহস!” বলতে বলতে দমাদম পিটাতে শুরু করে। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ওঠে বাবলু। মায়ের পা-দু’টো জড়িয়ে ধরে বলে,-‘মা, মাগো, আমায় মেরো না মা! আর কক্ষনো করবো না! আমায় মেরো না মা!’

পাষাণ হৃদয় গৌরীরানির। সহজে গলার নয়। শাড়ির আঁচলটা কোমড়ে গুঁজে দাঁত-মুখ খিঁঁচিয়ে কর্কশ কণ্ঠে গর্জে ওঠে,-“হইছে হইছে, আমার পা-খান্ ছাড়! তড়ে না বাটি ভইর‌্যা দিছিলাম! খাইয়া প্যাট ভরে নাই তর! বাসনগুলারে ফ্যালাইয়া আমার কাম একখান বাড়াই রাখছস। এত্তো জ্বালাশ ক্যান, ক?”

বাবলুর কানদু’টো খুব জোরে মলে দিয়ে বলে,-“হারামজাদা, তলে তলে তড় এত্ত বুদ্ধি! চুরি বিদ্যাও শিখছ, এ্যাঁ! আবার দেখি রান্নাঘরে, তর ঠ্যাঁং-আমি ভাইঙ্গা দিমু! আউক তর বাপ! এর বিহিত একখান্ করতেই হইব!”

বলে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে হিংস্র বাঘিনীর মতো কটাক্ষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। চোখ দিয়ে যেন আগুনের গরম শলাকা বের হচ্ছে। যেন গিলেই খেয়ে ফেলবে বাবলুকে।

ইতিমধ্যে বাবলুর বাবা শশী ভূষণের গলা শোনা গেল। তিনি হলেন আরেক জগতের মানুষ। প্রচন্ড মাছ ধরার বাতিক। একরকম নেশাও বলা যায়। ছুটির দিনে বাড়িতে দর্শণই পাওয়া যায় না। তন্মধ্যে প্রত্যেক দিন মায়ে-পুতের পাঁচালী শুনতে শুনতে বিরক্তি ধরে গেছে। সাত সকালেই ছিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ছিলেন মাছ ধরতে। পড়ন্ত বিকেলে ফিরে এসে হাঁক ডাক দিয়ে বললেন,-“কোইগো ছোট গিন্নী, কোই গ্যালা! আইশ্যা ধরো শীগ্গির! আজ একখান গঙ্গার ইলিশ আনছি!”

স্বামীর কণ্ঠস্বর শুনে রক্তের চাপ যেন আরো দশডিগ্রী বেড়ে যায় গৌরীরানির। রাগে মুখের পেশীগুলি ফুলে লাল হয়ে ওঠে। সবুর সয় না। ঝাঁটা হাতেই উত্তপ্ত মেজাজে হন্হন্ করে বেরিয়ে আসে বারান্দায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে-“ওগো, শুনছো! তোমার গুনধর পুত্তুর কি করসে দ্যাখো, আমার হাঁড়-মাংস এক্কারে চিবাইয়া খাইতাছে! আমার সহ্য হইতেছে না! অর শীগ্গির একখান্ ব্যবস্থা কর!”

শুনে থ্ হয়ে যায় শশী ভূষণ। বিস্ময়ে হাঁ করে থাকে। গিন্নীর আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে বললেন,-“এ তুমি কি কইলা ছোট গিন্নী! পোলাপাইন মানুষ, জ্ঞান-বুদ্ধিও হয় নাই! দোষ তো করবই। অরে শাসন করো। তুমিই না কইছিলা, অরে দ্যাখবা, মানুষ করবা। হেই ভড়সায় তো তোমারে আনছি। প্যাটের সন্তান হইলে কি আর একথা কইতে পারতা! বুঝি না বাপু, কও কি? অন্তরে কি মায়া-দয়াও নাই তোমার?”

ফোঁস করে ওঠে গৌরীরানি।-“অ, এইবার বুজ্ঝি! হ্যার লাইগ্যাই চাইরটা বছর গত হইল, আমারে আজও একখান সন্তান দিলা না। উল্টা আমারে জব্দ কর। হক্ কথা কই দেইখ্যা জ্বলন ধরছে। বুঝি না কিছু!” বলে স্বামীর হাত থেকে মাছের ব্যাগটা টেনে নিয়ে উগ্র মেজাজে গজগজ করতে করতে ঢুকে পড়ে রান্নাঘরে।

শশী ভূষণ বরাবরই শান্তি প্রিয় মানুষ। কোনপ্রকার ঝামেলা, অশান্তি একদম পছন্দ করেন না। সর্বদা এড়িয়ে চলেন। গায়ে মাখান না। কিন্তু আজ আচমকা ছোট গিন্নীর অপ্রীতিকর বাক্য শ্রবণে হতাশায় মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। ইচ্ছে হচ্ছিল, প্রতিবাদ করবেন। সত্য উদ্ঘাটন করবেন। কিন্তু পরিস্থিতি বেগতিক লক্ষ্য করে গৌরীরানির মুখের দিকে তাকাতেই মুহূর্তে মোমের মতো গলে একদম নরম হয়ে গেলেন। একটি শব্দও আর উচ্চারণ করলেন না। ধপাস করে বসে পড়লেন বারান্দায়।

ইত্যবসরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পিছন দরজা দিয়ে গোয়ালঘরের দিকে চলে গিয়েছিল বাবলু। আড়ি পেতে মা-বাবার কথা শুনছিল। কিন্তু মগজে কিছু না ঢুকলেও বেচারার অনুতাপের শেষ নেই। নিজের উপরেই প্রচন্ড রাগ হয়। ধ্যাৎ, কোন্ কুক্ষণে যে রান্নাঘরে ঢুকতে গিয়েছিল, মরার বিড়ালটাও মিউ করবার আর সময় পায়নি। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনটা উদাস হয়ে যায়। হাজার প্রশ্নের ভীঁড় জমে ওঠে। নিশ্চয়ই মা আমায় ভালোবাসে না। তাই কক্ষনো আদর করে না, চুমু দেয় না। পাড়ার ছোটনকে কত আদর করে, ভালোবাসে ওর মা। ওকি কখনো অন্যায় করেনা? ঘরের জিনিসপত্র অনিষ্ট করেনা? সেদিন মুরগির বাচ্চাগুলিকে ফার্ম থেকে ছেড়ে দিয়ে সেই কি কান্ড। একটাও বাঁচেনি। সবগুলি গেছে কাঁকের পেটে। কই, ওর মা তো ছোটনকে মারধোর করেনি, চেঁচামিচি করেনি।

বাবা বলে,- ‘পৃথিবীতে মায়ের চে’ বড় আর কেউ নেই। মায়ের স্থান কেউ পূরণ করতে পারে না। মাতা-পিতা দেব-দেবীর সমতূল্য।’
তা’হলে আমার মায়ের মন কেন এত নির্দয়, নিষ্ঠুর? কেন আমায় আঘাত করে? এমন কি অপরাধ করেছি। খাবার জিনিস মায়ের অনুমতি ছাড়া খেয়েছি। আমি কি মায়ের ছেলে নই?

ভাবতেই মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল বাবলুর। মনে হচ্ছে, গোটা পৃথিবীটা বন্ বন্ করে ঘুরছে চারদিকে। দু’চোখ বন্ধ করে বাঁশের খুঁটিতে মাথাটা ঠেকান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

ততক্ষণে ক্লান্ত সূর্য্য অস্তাচলে ঢলে পড়ে। পশ্চিমপ্রান্তে নিস্তেজ সূর্য্যরে ক্ষীণ আলোর আভা মুখের উপর পড়তেই শশী ভূষণ নড়ে চড়ে বসেন। বেচারা স্ত্রী-পুত্রের ভবিতব্য রচনা করতে করতে তখন থেকে অন্যমনস্ক হয়েছিলেন।
চোখ যায় রান্নাঘরের দিকে। ধারণা করেছিলেন, বাবলু ঘরের ভিতর লুকিয়ে আছে। কিন্তু কোথায়! সাড়া-শব্দই নেই ওর। শশী ভূষণ ঘাড় ঘুরাতেই পলকমাত্র দৃষ্টিতে নজর পড়ে বাবলু গোয়ালঘরে।
দ্রুত সন্নিকটে এগিয়ে যান। মৃদু স্পর্শ করে বললেন,-“অ বাবলু, ঘুমায় পড়ছস?”
পিতার আলতো  স্পর্শে ঈষৎ নড়ে ওঠে বাবলু। ওর কানে কানে ফিস্ ফিস্ করে শশী ভূষণ বললেন,-“হ্যারে, মায়ে মারছে বুঝি! করছস কি তুই? কইলাম চল আমার লগে। তর হাত-পা এত্ত নোংরা ক্যান? সাদা সাদা ওগুলা কি মাখছস?’
বাবলু নিরুত্তর। পদাঘাতে থপ থপ  শব্দ করে এগিয়ে যায় পুকুরঘাটের দিকে। শশী ভূষণ আর্তকণ্ঠে বললেন,-“কোথায় যাস বাবলু! ইলিশ মাছ আনছি। গরম ভাত দিয়া দুইটা খাবি আয়।”

( দুই)

কিছুদিন যাবৎ ব্যতিক্রম দেখা দেয় বাবলুর। স্কুল থেকে এসে বারান্দার কোণে বিষন্ন মুখে চুপটি করে বসে থাকে। কারো সাথে কথা বলে না। সময় মতো নাওয়া-খাওয়া করে না। খেলতেও যায় না মাঠে। বিকেল হলে ওর সঙ্গী-সাথিরা বাড়ির সামনে এসে ভীঁড় জমায়। কেউ কেউ ফিক করে হেসে ব্যঙ্গ করে বলে,-‘কি রে বাবলু, আজও ধোলাই খেয়েছিস বুঝি!’

বলিহারী মহিলা গৌরীরানি। গ্রাহ্যই করল না। অকারণে মুখখানা বিকৃতি করে হন্ হন্ করে গোয়ালঘরের দিকে এগিয়ে গেল। কোণা চোখে বাবলুকে দেখলো, কিছু বলল না।

অবাক হয়ে যায় বাবলু। বোবার মতো শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। আশা করেছিল, মা কাছে আসবে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করবে।স্নেহভরা কণ্ঠে জিজ্ঞ্যেস করবে,-“হ্যাঁ রে বাবলু, মায়ে মারছিল, খুব ব্যথা পাইছিলি। আহা বাছা আমার। আয় বাবা আয়, আমার বুকে আয়। আর কক্ষনো তরে মারুম না!’
কিন্তু মা তো কিছুই বলল না। তবে কি মা আমায় ভালোবাসে না?

তুব নিস্পাপ নাবালকের মন কিছুতেই বিশ্বাস হয় না যে, মা কখনো নির্দয় নিষ্ঠুর হতে পারে না। মায়ের অবাধ্য হয়েছি বলেই গালিগালাজ করেছে, মারধোর করেছে। রাত পোহালে সব ভুলে যাবে মা। এই ভেবে মায়ের উপর পুঞ্জীভূত সমস্ত মান-অভিমান মুহূর্তে দূরীভূত হয়ে যায়। প্রতিদিনকার মতো মুখ-হাত-পা ধুয়ে পড়তে বসে। আর বাবলুর পড়তে বসা মানে ফুটবল খেলার রিলে করা। দাঁড়ি নেই, কমা নেই, বিরতি নেই। একটানা কানে তালা লাগিয়ে সজোরে পড়তে পড়তে ক্লান্ত দেহের অবসন্নতায় কখন থেকে যে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ ঘড়ির ঘন্টা শুনে চমকে ওঠে। চোখ মেলে দ্যাখে, রাত প্রায় এগারোটা বাজে। বইপত্র সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিছানায়। মা-বাবা কারো সাড়া-শব্দ নেই। ভাবল, নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে।

ধীর পায়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আসে বাবলু। নৈঃশব্দে দরজা খুলে গলা টেনে রান্নাঘরের দিকে চেয়ে দ্যাখে, দরজা বন্ধ, অন্ধকার। কিন্তু মায়ের ঘরের জানালা দিয়ে ঈষৎ আলোর রশ্মি এসে পড়েছে বারান্দায়। এদিকে ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। সেই দূপুর থেকে কিছুই আর খাওয়া হয়নি। মাকে ডাকাডাকি করলে হয়ত এক্ষুণিই চেঁচামিচি শুরু করে দেবে। এই ভেবে বাবলু নিজেই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই থমকে দাঁড়ায়। মনে হলো, ওর সম্বন্ধ্যেই খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মা-বাবা আলোচনা করছে। কিন্তু কেন? ওতো আজ কোনো অন্যায়, অপরাধ করে নি।

হঠাৎ কৌতূহল জেগে ওঠে। গিয়ে উঁকি দেয় জানালায়। শোনে আড়ি পেতে। আর শোনামাত্র বিস্ময়ে থ্ হয়ে যায় বাবলু। যেন আকাশ থেকে পড়ল। কিছুতেই ওর বিশ্বাস হয় না। এসব কি বলছে মা? সত্যিই কি তাই? আমি ওর ছেলে নই? না, না, এ হতে পারে না। এ কেমন করে সম্ভব। নিশ্চয়ই ভুল শুনেছে।

না, ভুল নয়। ঠিকই শুনেছে বাবলু। হাত নেড়ে গৌরীরানি চিৎকার করে বলছে,-“অরে আমি দেখুম ক্যান? হে তো আমার পোলা নয়। আমি তো ওরে প্যাটে ধরি নাই, অরে জনম দেই নাই। হে আমার পোলা হইল ক্যাম্নে? বান্দর একখান্। খালি ল্যাজটাই নাই। অরে কক্ষনো স্বীকার করুম না! হেইটাই আমার শ্যাষ কথা!”

হঠাৎ যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। চমকে ওঠে গৌরীরানি। চোখমুখ রাঙিয়ে শশী ভূষণ তীব্র কণ্ঠে গর্জে উঠেন,-“তোমারে আল্বাত মাইনতে হইব। বাবলুই আমাগো একমাত্র সন্তান। তোমারেই মানুষ করতে হইব।” বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,-“হায়রে অদৃষ্ট, কেম্নে বুঝাই অরে!”

স্বামীর বিবর্ণ মুখায়ব লক্ষ্য করে নরম হয়ে পড়লেও চোখেমুখে অভিযোগের ছাপ প্রকট গৌরীরানির। একজন বিবাহিতা নারী তার প্রাপ্য অধিকার থেকে কেনইবা সে বি ত হবে! এ অন্যায়, অবিচার। আপন সন্তানের জননী হওয়াই জগতে প্রতিটি নারীর একমাত্র কাক্সিক্ষত স্বপ্ন, জীবনের স্বার্থকতা, পরিপূর্ণতা। আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ীত করতেই গৌরীরানি হঠাৎ প্রতিবাদ করে ওঠে,-‘ওগো না, তোমার দু’টি পায়ে পড়ি। আমার পরাণ থাকতে এ আমি কক্ষনো হইতে দিমু না। এ হইতে পারে না। আপন গর্ভে ধারণ কইর‌্যা সন্তানের মা হইতে চাই। দোহাই তোমার, আমারে বি ত কইরো না!”

স্ত্রীর কাতর অভিযোগে বিচলিত হয়ে পড়েন শশী ভূষণ। মনে পড়ে. ভাগ্যবিড়ম্বণার সেই দিনটির কথা। যেদিন দ্বিতীয় স্ত্রী তার প্রথম সন্তান লাভের প্রচেষ্টার ব্যর্থতার কারণে শশী ভূষণ মর্মাহত হয়ে ছিলেন। বিপদ সংকেতের আশক্সক্ষায় সেদিন একেবারে যমে মানুষে টানাটানি। বাঁচবার কোনো আশাই ছিল না। যার বিনিময়ে প্রচন্ড রক্তক্ষয় হয়েছিল গৌরীরানির। যে কথা আজও ওর অজানা। শুধু কি তাই, সেদিন কি অপরিসীম যন্ত্রণা শশী ভূষণকে নীরবে সইতে হয়েছিল। যা ঘূণাক্ষরেও গৌরীরানিকে জানতে দেয়নি। নিজে অসন্তুষ্ট হলেও চোখেমুখে ক্ষোভ, দুঃখ, অনুশোচনার কোনো চিহ্নই তার ছিল না। অদৃষ্টকে মেনে নিয়ে বুকের কষ্টগুলিকে হাসি মুখেই গ্রহণ করেছিলেন, শুধুমাত্র স্ত্রীর মুখ চেয়ে। গৌরীরানি জানে সেকথা?

মানসিক বিভ্রান্তিতে বিষন্নতায় ছেয়ে যায় শশী ভূষণের। চেয়েছিলেন এতবড় সত্য গোপন করে রাখবেন। কিন্তু পারলেন না। উত্তেজনায় ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে দ্রুত আলমিরার ড্রয়ার খুলে মেডিক্যাল্ রিপোর্ট বের করে তীব্র কণ্ঠে গর্জে উঠলেন,-“এই দ্যাখো, কি লিখছে ডাক্তারে। মনে কষ্ট পাইবা, তাই কই নাই। আমার কি ইচ্ছা হয় না? আমারে ভুল বুইঝ না।”

গৌরীরানি সেকেলে মহিলা। কিন্তু সে যে নিজেই অক্ষম, তা বুঝতে একটুও দেরী হলো না। যা স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি। সন্তান ধারণের ক্ষমতা গৌরী রানির নেই। এতবড় দুঃখ সে কোথায় রাখবে। কেমন করে সইবে।

একটা শব্দও আর উচ্চারণ হয় না। রুদ্ধ হয়ে আসে কণ্ঠস্বর। শোকে দুঃখে হতাশায় পাথরের মতো শক্ত হয়ে ধপ্ করে বসে পড়ে বিছানায়।

একেই বলে বরাত। কত আশা ছিল, কত স্বপ্ন ছিল জীবনে। সব নিমেষে ভেসতে গেল গৌরীরানির। অথচ এতকাল স্বামী শশী ভূষণকে ভুল বুঝে কত আঘাত করেছে। মনে কষ্ট দিয়েছে। আজ নিজেকেই অপরাধী বলে মনে হয়। অনুতাপ অনুশোচনায় অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। একসময় শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে গৌরীরানি কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

শশী ভূষণ শান্তনা দিয়ে বললেন,-‘তুমি কান্দ্ ক্যান ছোট গিন্নী? দোষ তো আমারই। যাও, পোলাডা এতক্ষণ ঘুমায় পড়ছে বোধহয়। ডাইক্যা তোলো অরে।”

শূন্যতায় বুকের ভিতরটা এতক্ষণ খাঁ খাঁ করছিল গৌরীরানির। হঠাৎ মোচড় দিয়ে ওঠে। অনুভব করে, মমতাময়ী মায়ের স্নেহ-মমতা আর ভালোবাসার এক মধুর আবেশ। স্পর্শ করে হৃদয়কে। জাগ্রত হয়, অদ্ভুদ এক চেতনা, এক অভিনব অনুভূতি। যে অনুভূতি দিয়ে গৌরীরানি আজ নিজেকেই প্রশ্ন করে,-মা হারা ছোট্ট শিশুকে দীর্ঘ নয় বছর যাবৎ কোলে পিঠে করে বড় করেছে, কথা বলতে শিখিয়েছে, ও’তো সেই মায়েরই সন্তান। আজ কেন সে তার মা হতে পারবে না? সে কেনইবা মায়ের আদর-স্নেহ-ভালোবাসা পাবে না? বাবলুই রায় চৌধূরী পরিবাবের একমাত্র উত্তরাধিকারী। বংশের প্রতীক। বাবলুই গৌরীরানির একমাত্র সন্তান।

এতক্ষণে মনে পড়ে, সন্ধ্যে থেকে বাবলুর কিছুই খাওয়া হয়নি। সোনা আমার, বাছা আমার। পোলাডা আজ অনাহারেই ঘুমায় পড়ছে।

হঠাৎ চাপা আর্তকণ্ঠে ডেকে ওঠে-‘আমার বাবলু, সোনা আমার, বাবা আমার। আয় বাবা উঠ্! ভাত খাবি আয়!’

বলে বারান্দায় বেরিয়েই থমকে দাঁড়ায় গৌরীরানি। দ্যাখে, অভিমানে গাল ফুলিয়ে জানালার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বাবলু। চোখমুখ বিষন্নতায় ছেয়ে আছে।

বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে গৌরীরানির। আর তৎক্ষণাৎ নিঃসন্তান মায়ের শূন্য বুক জুড়ে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে মাতৃত্বে ভরে ওঠে। অনুভব করে, নারীর অস্তিত্ব। চরম সার্থকতা, পরিপূর্ণতা। সব কিছু হারিয়েও আজ সবই ফিরে পেয়েছে। নতুন করে আবিস্কার করে বাবলুকে। যেন কতকাল দ্যাখেনি। আবেগে দুহাত প্রসারিত করে দেয়। মমতা মাখানো হাসি কাঁন্নার সুরে বলে ওঠে,-‘আয় বাবা আয়, আমার বুকে আয়। আর কক্ষনো তরে মারুম না!’

কিন্তু ছুটে পালায় বাবলু। বলে,-‘না, তুমি আমার মা নও। তোমার কোনো কথা আমি শুনবো না।’

ততক্ষণে বাবলুকে ধরে ফেললেন শশী ভূষণ। বললেন-‘ছিঃ বাবা, ও কথা কইতে নাই।”

সাশ্রু নয়নে গৌরীরানি বলে,-‘আয় বাবা, এই অভাগিনী মায়ের শূন্য বুকখানা আজ যে ভরে গেল বাবা। আমার বুকের আয়।”

শশী ভূষণ দেখলেন, মায়ের অবাধ্য হলো না নাবালক ছেলে বাবলু। দৌড়ে এসে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্নেহাস্পদে বাবলুকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে গালে চুম্বনে চুম্বনে মাতৃ স্নেহে ভরিয়ে দেয় বিমাতা গৌরীরানি।

অদূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন শশী ভূষণ। রাতের ঝলমলে আকাশের পানে একপলক চেয়ে ফোঁস করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন.-“জয় ভোলেনাথ। সবই তোমার ইচ্ছা।”

সমাপ্ত

(ছবি:সৌজন্যে The Public post)

যুথিকা বড়ুয়া : কানাডা প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।

 

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন